#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_৫

৯.
” পাঁচ বছর আগে আমার মা মারা গিয়েছে। তারপর ভাই বিয়ে করে। ভাবী কেনো যেনো আমাকে সহ্য করতে পারতো না। একদিন তার একটি নেকলেস চুরের দায়ী করে আমাকে। অথচ ওরকম নেকলেস আমারো ছিলো। আমি সচ্ছল পরিবারের মেয়ে হয়ে নিজের ভাবীর নেকলেস কেনো চুরি করতে যাবো? এমনো হতো আমি আমার জমানো টাকায় ভাবীর জন্য গিফট কিনে দিতাম। সেদিন ভাইয়া আমাকে অবিশ্বাস করলো। বাবা একটা কথাও বলেনি। সেদিন মামা ছিলো আমার পাশে। বাবা ভাইকে অনেক কথা শুনিয়ে আমাকে নিয়ে চলে আসে। বাবা মাসে মাসে আমার জন্য টাকা পাঠায়। আমি সেখানেই পড়াশুনা শুরু করি। মামী আমাকে বকুল আপুর মতোই আদর করতো। বাড়ীর ছোট মেয়ে হয়ে ছিলাম। কলেজে উঠার পর থেকেই একটা লোক আমাকে টিজ করতে থাকে। লোকটা হিন্দু। মামাকে বললে জানতে পারি লোকটার নাম আশু।উনি এলাকার মধ্যে বড় গুন্ডা। দিন দুপুরে খুন করে কেউ কিছুই বলতে পারে না। মামা ভয় পেয়ে যায়। আশু গুন্ডাকে বুঝিয়ে বলে কোন লাভ হয়না। আস্তে আস্তে আমাকে বিরক্ত করার তুঙ্গে চলে আসে। নানা ভাবে আমাকে হাত করতে চায়। এরমধ্যে বকুল আপুর বড় ঘরে বিয়ে ঠিক হয়। মামার অত টাকা নেই যে বরের বাড়ির আবদার মেটাবে। এই সুযোগে মামীকে হাত করে নেয় আশু। আমাকে বিয়ে করার জন্য টাকা দেয়। কত টাকা দেয় আমি জানিনা কিন্তু অনেক টাকা দেয়। মামাকে হুমকি দিয়ে মামী চুপ করিয়ে রাখে। আমাকে ঘরবন্ধ করে রাখে। বাবা ভাইকেও খবর দেয় না। আজ বিয়ের আগ মুহূর্তে বকুল আপু আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে আমি পালিয়ে আসি। এতোক্ষনে বোধ হয় আশু সেখানে ঝড়….
বাকিটুকু আর বলতে পারে না পূরবী। সাদকে দৌড় দিতে দেখে সামনে তাকায়। একটা মেয়ে কোলে একটা বাচ্চা আর ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে আসছে। ব্যাগটা সেখানেই পড়ে যায়। বাচ্চাটাও পড়বে পড়বে অবস্থা হতেই সাদ কোলে তুলে নেয়। রেগে গিয়ে বলে, ” নূরা এতো ইরেসপন্সিবল কিভাবে তুই? ” কিন্তু সেকথা নূরার কানে পৌঁছায় না। পূরবীর সামনে এসে এতোবড় একটা হা করে অবাক হবার ভান ধরে। খুশিতে লাফিয়ে বলে,
” দোস্ত. …এইডা কি? এই মাল কত্তে আমদানী হইলো ?”
পূরবী ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। নূরা এসে পূরবীর হাত ধরে ফেলে পূরবীকে ঘুরিয়ে ঘূরিয়ে দেখতে থাকে। এই মুহুর্তে পূরবীর মনে হচ্ছে তাকে একটা পাগলে ধরেছে। নূরাকে অনেক উত্তেজিত দেখাচ্ছে। চিৎকার করে বলে উঠে, ” দোস্ত.. কি নরম হাত। ” পূরবীর চোয়াল ধরে একবার বামদিক তো আরেকবার ডানদিক করে বলে, ” দোস্ত. …পরী পরী. . । ” পিছিয়ে গিয়ে আরেকবার পূরবীকে স্ক্যান করে লাফিয়ে উঠে,
” দোস্ত… বিয়া কইরা হালছোস? আমারে সাক্ষী দিতেও দিলি না হারামী. .কুত্তার আছারী কনেকার। কি সুন্দর। তুই তলে তলে প্রাইভেটকার চালাইয়া বড়ার পাস কইরা হালছোস আর আমি কিচ্ছু টের পাই নাই। হায় আল্লাহ এতো গাধী আমি। ভাল্লাগছে দোস্ত ভাল্লাগছে। ”
পূরবীর কাছে এসে বলে, ” ওরে মাইয়া। এতো দিন কনে আছিলা? আমারে কেন দেখা দেওনাই। তুমি যব্বে আমারে দেখা দিতা তব্বেই তোমার বাসর হইয়া যাইতো। ননদ হই তোমার ননদ। বুঝছো? কি সুন্দর রে. …..”
সাদ ধমক দিয়ে বলে, ” তোর লাফালাফি কি বন্ধ করবি এবার? ”
” আরে দেখতে দে। তুই একাই দেখবি নাকি আমিও দেখুম ” বলে পূরবির সামনে রাস্তায় বসে পড়ে। দুই গালে দুই হাত দিয়ে ওয়াও ইমুজি বানিয়ে বলে, ” আহা। রুপ ডাইলা গেলো রে… আগে কেন দেখি নাই তোমারে …”
সাদের আর সহ্য হয়না। একেতো বাবু কোলে তাই তুলে ধরে আছাড় দিতে পারতেছে না। দাতে দাত চেপে বলে, ” তুই উঠবি হারামী? তোর বাদর নাচন দেখতে চাইছি আমি? রাস্তার মধ্যে সিনেমা করতেছিস কেন? ”
” আরে কি বলিস? তুই আমি ভাবী ছাড়া রাস্তায় আছে কে সিনেমা দেখবো? বাই দ্যা ওয়ে দোস্ত এইটা কি সেই মেয়েটা যাকে কক্সবাজার দেখেই আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলি তুই লাইক দিছিস?” এবার নূরাকে সিরিয়াস লাগছে। উঠে এসে সাদের সামনে দাঁড়ায়।
” না। ”
” কি বলিস? তাহলে ঐ মেয়েটার কি হবে? ”
” কিছুই হবে না। ”
” তুই একে আজি বিয়ে করলি তো আমাকে কেনো ডাকলিনা? কবে থেকে প্রেম তোদের? আমাকে তো কিছুই জানালি না দোস্ত। কেসটা কি? ”
” চিনিনা। বিয়ে থেকে পালিয়ে আসছে ।একটু আগে সুইসাইড করতে গিয়েছিলো। ভাগ্য ভালো বাচিয়ে নিয়েছি। কেস টা কিছুই না। ”
” আরে কিছুনা কিছুনা করতেই করতেই তো জমে ক্ষীর হয়ে যাচ্ছে। হিরোইন বিয়ে থেকে পালানো। সুইসাইড করতে গেলে হিরো এসে বাচালো তারপর প্রেম হলো বিয়ে হলো। ”
” তোর মাথা আর মুন্ডু। ”
” আরে রাগছিস কেনো? বাই দ্যা ওয়ে নাম কি তোমার?”
” পূরবী। ”
” দিলে বড় কষ্ট পাইলাম তুমি আমার দোস্তর বউ না শুনে। সমস্যা নেই পালিয়ে আসছো তো? আমার দোস্তর সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। আসো আসো। ”
পূরবী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নূরা হাত ধরে বলে, ” আরে পূরবী আসো। ভয় পেও না। মজাও বোঝে না মেয়ে। ”
সাদ বাবুকে নিয়ে এতোক্ষনে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। নূরার এই বাদর নাচ একদম সহ্য হয়না তার। মেয়েটাকে কি করবে? বিশ্বাস করা তো ভূল হচ্ছে না? কনফিউশনে ঢুবে যায় সাদ। পেছনে তাকিয়ে দেখে পূরবী আর নূরা উঠে বসেছে। নূরা বাবুকে কোলে নেয় ছাদকে গাড়ি চালানোর জন্য। পূরবীর মূখে তার অবস্থা জানার পর খুব খারাপ লাগে নূরার। পূরবী কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” আমাকে একটা থাকার জায়গা করে দেন। আমি আর ফিরে যাবো না। কাজ করে খাবো তাও পিছু ফিরবো না।”
নূরা ভেবে পায়না কি করবে। সাদ বলে, ” বাবুকে দেখাশোনা করার জন্য মেয়েটাকে নিয়ে নে নূরা। ”
” অসম্ভব। পায়ে কুড়াল মারবো নাকি? খাল কেটে সতীন ডেকে আনবো? ”
” পূরবীকে ভালোই মনে হচ্ছে আমার। ”
” পূরবী ভালো বিজয় তো আর ভালো নয়। কি করেছে জানিস? সেদিন দেখি ওর খালাতো বোনের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে হেসে হেসে কফি খাচ্ছে। কত বড় লুচুর হাড্ডি ভাবতে পারছিস একবার ? বোনের সাথে ঘুরাফেরা করে। ”
” হুম । বোনের সাথে ঘুরলে সমস্যা হয়ে যায় তোর আর তুই আমার সাথে ঘুরিস অথচ বিজয় কিছুই বলেনা ।”
” কিছু বললি? ”
” না কিছুনা। ”

অবশেষে দুজনে ঠিক করে একটা হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দিবে পূরবীকে। পূরবী গা এলিয়ে দেয় সীটে। নূরা বলে, ” তুমিতো কিছু খাওনি। ক্ষুধা লাগেনি তোমার? ” পূরবী অসহায় চোখে তাকায়।
” কি খেতে দেই তোমাকে বলোতো? আইডিয়া। বাবু তো ঘুমিয়ে পরেছে। সকালের আগে উঠবেনা। ফ্লাক্সে গরম দুধ আছে। গরুর দুধ। দুধ খাও শক্তি হবে। আর আমি সব সময় কাঠবাদাম আমার ব্যাগেই রাখি। অভ্যাস। কাঠবাদাম খাও। ব্যাগে দেখো আছে। ”
পূরবী ব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করে দূধ খায় ।

ঢাকা এসে একটা হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেয় পূরবীকে। পূরবীকে রেখে নূরা, সাদ চলে আসে। এখান থেকে নূরাকে উবারে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরবে সাদ। নূরা কে নিয়ে মেট্রন দু তালায় নিয়ে যায়। নূরা ধীরে ধীরে দুতলায় আসে। মেট্রন বলে, ” এইযে দেখছো দুইশো চার নাম্বার রুম। এই রুমেই তুমি থাকবে। ” দরজায় নক করতেই একটা মেয়ে দরজা খুলে দেয়। মেট্রন ভিতরে ঢুকে।পূরবীও পিছু পিছু ঢুকে। মাঝারী সাইজ একটা রুমে চারটা সিঙ্গেল খাট। তিনটা খাটে বেডশীট বিছানো। রুমে তিনজন মেয়েও আছে। সবাই সর্ট গেঞ্জি আর ঢোলা প্লাজু পরে আছে।একজন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে স্মোকিং করছে। একজন বলে, ” আন্টি এইটা কে? ”
” তোমাদের নতুন রুমমেট। এখানেই থাকবে। সব নিয়ম শিখিয়ে দাও। আমি যাই।”
মেট্রন বেরিয়ে যেতেই তিনজন ই পূরবীর সামনে এসে দাঁড়ায়। সিগারেটের ধোয়া পূরবীর সহ্য হয়না জন্যে নাক মূখ চেপে ধরে রাখে। মেয়েটি হেসে জিজ্ঞাসা করে, ” কিরে সিগারেট খাস না? নো প্রবলেম শিখে যাবি। ” বাকি দুজন হেসে উঠে। একজন বলে, ” কিগো নতুন রুমমেট? বিয়ে থেকে পালিয়ে আসছো?” বলেই হাসতে থাকে। আরেকজন কাছে এসে বলে ,” এইগুলো কি সোনা? দেখি দেখি ? হাতের একটা আংটি খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে দিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বলে,বাহ। দেখ কি সুন্দর লাগছে। এটা বরং আমিই নিয়ে নিলাম বুঝলে? এই তোরা কিছু নিবি? ”
একজন গলার হারে হাত দেয়।
পূরবী বুঝতে পারে একে একে তার সব চলে যাবে। এখানে থাকা তার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না। পূরবী মেয়েটার আঙুল থেকে আংটি টান দিয়ে খুলে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসে। মেট্রন কে গিয়ে বলে, ” আমি এই হোস্টেলে থাকবোনা। এডভান্সের দু হাজার টাকা ফিরিয়ে দেন। ”
” থাকবেনা মানে? ফিরিয়ে দিন বললেই কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? ”
“আমি আপনার বেডে বসে অব্দি দেখি নি। আমার টাকা ফিরিয়ে দিন। ” টাকা মহিলার হাতেই ছিলো। কড়কড়া দুটো নোট পকেট থেকে বের করতে সাদ এখানে ভর্তি করিয়ে গেছে পূরবীকে। পূরবী খামচি দিয়ে টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে আসে। বুড়ো মেট্রন পেছন থেকে চিল্লাচিল্লি করতে থাকে কিন্তু পূরবীর নাগাল পায়না।

চলবে,

গত পর্বের কমেন্টে পুরো দিল খুশ হয়ে গেছে আমার। এতো ভালো লেগেছে বলে বোঝাতে পারবো না। এইভাবে রেসপন্স করতে থাকলে আরো ভালো চিন্তা ভাবনা করে লেখার উৎসাহ পাই। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here