#ভাগ্যবতী
#লাবিবা_তানহা_এলিজা
#পর্ব_১৪
১৮.
সাদ সিলেট যাওয়ার পর পর দুইবার পূরবী একই ভূল করে বসেছে। কফি নিয়ে সোজা সাদের বেলকনীতে উপস্থিত হয়েছে। সাদকে দেখতে না পাওয়ায় মনে পড়েছে সাদ বাসায় নেই। নিজের বোকামোতে নিজেই বিরক্ত পূরবী। কফিটা সে নিজের হাতে বানিয়েই সাদকে দেয়। তাই হয়তো লজ্জায় পড়তে হয়নি। যদি জমিলাকে গিয়ে বলতো, খালা মি. ডাক্তারের কফিটা দিন। খালা হাসতে হাসতে বলতো, ও মা তুমি কি ভুলে গেছো যে ছোট সাহেব বাসাতে নাই। তখন কি লজ্জাটাই না পেতে হতো। অন্যের দেওয়া লজ্জার থেকে নিজে নিজে পাওয়া লজ্জা ঢের ভালো। কফিটা কি করবে? পায়ের উপর পা তুলে রাণীর মতো বসে চুমুক দেয়। এখন তো কেউ বলবেনা যে বজ্জাত মেয়ে পূরবী তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি আমার ডিভানে বসে আমার কফিটাতেই চুমুক দিচ্ছো। গেট আউট ফ্রম মাই বেডরুম । সাদ নেই পূরবী পুরো রিলাক্সে বসে থাকতে পারে সাদের রুমে। এই রুমটায় এলে কেনো জানি অনেক ভালো লাগে। আর নিজের ঐ ছোট্ট রুমটায় যেতেই ইচ্ছা করে না। ঠিক তখনি নূরার কথাটা মাথায় ঘুরপাক খায়। নেহাত এই বাড়িতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার উপর আবার মালিকের রুমকে নিজের পার্মানেন্ট রুম করে নেওয়া এ তো আকাশ পাতাল সপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। এমন সপ্নের কথা শোনে মানুষ হাসবে পূরবীকে দেখে। সাদের বেলকনিতে আজ পূরবী কফি ছাড়াই এসেছে। যে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো সেই একঘন্টা আরাম করে বসে কাটাবে। বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। কাজ না থাকলে যা হয় আরকি। বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পূরবীর চোখ পড়ে পাশের বাসার জানালার পাশের মেয়েটির দিকে। মেয়েটি অনবরত হাত নেড়ে যাচ্ছে দেখে পূরবীও হাত নাড়ে। এই মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদকে একমনে দেখে যেতো তাদের মধ্যে কেউ নয় । মেয়েটি বেশ সুন্দর। মেয়েটি গলার স্বর বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, নাম কি তোমার?
পূরবী নাম বলে।
মেয়েটি আবার জিজ্ঞাসা করে, ” তুমি এই বাড়ির লোকের কি হও? আগেতো কখনো দেখিনি। ”
পূরবী হালকা হেসে জবাব দেয়, ” এবার থেকে দেখবেন । ”
” তুমি এই বাড়িতে থাকবে? ”
” হা। যতদিন ইচ্ছা ততোদিন। ”
” কেনো? ”
” এটা আমারো বাড়ি তাই। ”
হয়তো ভেতর থেকে মেয়েটির ডাক পড়ে তাই চলে যায়। পূরবী মিটি মিটি হাসে। সে যতোদিন ইচ্ছা ততোদিন থাকতে পারবে এখানে। যে যেখানে থাকে সেটাই তার বাড়ি হয়ে যায়। যারা গাছতলায় থাকে গাছতলাই তাদের বাড়ি যারা ভাড়া থাকে সেটাও তাদের বাড়ি। পূরবী এই বাড়িতে থাকে তাই এটা পূরবীরো বাড়ি। হোক মালিকানা অন্যের তাতে কি! সেখানে আর না বসে থেকে ডাইনিং এ চলে আসে পূরবী। মমতা বসে খবরের কাগজ পড়ছে। পূরবী পাশে গিয়ে বসে। মমতা পূরবীর দিকে তাকায় না। বেশ কিছুক্ষণ পর পড়া শেষ হলে চিন্তিত মূখে পূরবীকে বলে, সাদের একটা খবর পাচ্ছি না। কেমন আছে পাহাড়ের কোন জায়গায় আছে কে জানে?
পূরবী শান্তনা দিয়ে বলে, ” বড়মা আপনি চিন্তা করবেন না। মি. ডাক্তার তো বলেই গিয়েছে যে নেট থাকবে না। ”
” হুম। রুকুর কি অবস্থা? জ্বর কমেছে? ”
” আমি এখনো যায়নি ফুপির কাছে। ”
” মেয়েটা যে কি করে.. কতবার বলি গাড়ি নিয়ে বের হও। একটা কথাও শোনে না। বৃষ্টিতে ভিজে কোপকাত হয়ে এসেছে। এখন বিছানায় জ্বরে শুয়ে আছে। অফিস থেকে কতদিনের ছুটি দিবে বলো? ”
” ঠিক হয়ে যাবে বড়মা। আমি ঠিকমতো ঔষধ দিচ্ছি। মাথায় পানিও দিচ্ছি। ”
” হুম। ”
মমতা পূরবীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। উঠে গিয়ে রুকুর কাছে আসে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর অনেকটা কমে গেছে। শেষ রাতের দিকে গা পোড়ানো জ্বর ছিলো। রুকুকে নিয়ে অনেক চিন্তা হয় মমতার। যুবতী মেয়ে এভাবে কতদিন একা থাকবে? তার একজন জীবন সঙ্গী প্রয়োজন। মানুষ যেখানে একের পর এক লাইফে জীবনসঙ্গী চেঞ্জ করতে পারে সেখানে রুকু কেনো একজনের স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকবে? গার্ডিয়ান হয়ে সেই বা এটা কিভাবে হতে দিতে পারে? দু একটা বেবি থাকতো অথবা ওল্ড এজ হতো তাহলে কিছু বলার থাকতো না। সে যেভাবে লাঈফ লিড করতে চাইতো সেভাবেই করতে দিতো। কিন্তু যেতো যুবতী একটা মেয়ে। মাত্র দুই আড়াই বছরের সংসারের স্মৃতি নিয়ে পুরোটা জীবন কেনো শেষ করে দিবে? এটাতো হতে পারে না। প্রত্যেক মোনজাতে রুকুর জীবনে এমন কাউকে চায় যে রুকুকে সবটা দিয়ে ভালো রাখবে। আল্লাহ কি তা কবুল করবে না? বুকটা ধড়ফড় করে উঠে মমতার। একাকিত্ব জীবন অভিশাপ ব্যতীত কিছুই না। মেয়েদের স্বামী ছাড়া জীবন চলে কিন্তু সন্তান ছাড়া নয়। মমতা স্বামী ব্যতীত বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে কিন্ত সন্তান ব্যতীত নয়। রুকু কি তার কিছুই পাবে না? রুকুর ভালোর জন্য যদি কঠোর হতে হয় তাহলে সে হবে। যখন কারো ভালো থাকার উপর অন্যদের ভালো থাকা নির্ভর করে তখন যদি সে ভালো নাও থাকতে চায় তবে অন্যদের কঠোর হতেই হয়। এদিকে রুকুর জ্বর অন্যদিকে সাদের জন্য টেনশন হচ্ছে। আজ পূরবীকে নিয়ে আশ্রমেও যেতে চেয়েছিলো। আশ্রমে নাকি কি সমস্যা হয়েছে ম্যানেজার ফোন দিয়ে বললো। কয়েকদিন থেকে যাওয়া হয়নি তাতেই সমস্যা বাধিয়ে ফেলেছে। বৃদ্ধাশ্রম টি তিল তিল করে গড়ে তুলেছে মমতা। যারা বৃদ্ধ বয়সে একটু সেবা পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে তাদের নিয়েই এই আশ্রম। এটি শুধু মমতার পরিশ্রমের ফলই নয় বরং মমতার আরেকটি পরিবার । তাদের কোন বিষয়ক সমস্যা হওয়া মানে মমতার নিজের সমস্যা। একবার আশ্রমে যেতেই হবে।
আস্তে আস্তে রুকু চোখ খুলে। মমতাকে দেখে একটা শুকনো হাসি দেয়। সেই শুকনো হাসি মমতার মন গলাতে পারে না। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা টেনশনে আছে। রুকু আস্তে আস্তে উঠে বসে। মমতা পিঠের পেছনে বালিশ ঠেকিয়ে দেয়। রুকু বালিশের উপর ঘাড় ছেড়ে দেয়। চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেই মমতাকে ডাকে,
” ভাবী…. ”
” বলো। ”
” রাগ করেছো আমার উপর? রাগ করো না। আমি ইচ্ছা করেই ভিজেছি। বারিধারায় ভিজতে ভালো লাগে। ”
” তা নয় বুঝলাম। তোমার উচিত ছিলো গাড়ি নিয়ে বের হবার। আমি একদিন ও দেখিনা তোমাকে গাড়ি নিয়ে বের হতে। বাড়িতে দুইটা গাড়ি পড়ে থাকার সত্বেও তুমি কেনো রিকশায়, ট্যাক্সিতে যাতায়াত করো? ”
রুকু ঘাড় ঘুরিয়ে মমতার দিকে তাকায়।
” গাড়িতে ফাকা ফাঁকা লাগে ভাবি। ড্রাইভিং সীটে ড্রাইভার কে সহ্য হয়না আমার। আমার পাশে ড্রাইভার এর সীটটা শুধু একজনের ই।আমার স্বামীর জায়গা ওটা।”
” দেখো রুকু আমরা তোমার উপর জোর করলেও কিছু চাপিয়ে দিই নি। তোমার কথাই বহাল রেখেছি। তাই বলে এটা নয় যে তুমি এভাবে পিছুটান নিয়ে জীবন পার করে দিবে। তোমার থেকে আমাদের ও কিছু এক্সেপটেশন আছে। এ বাড়িতে যখন এলাম তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা ছিলে তুমি। ননদ হলেও নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছি তোমাকে। মায়ের ভালোবাসা দিয়ে কষ্ট করে আগলে রেখেছি। তিনজন বাচ্চা একসাথে বড় করা একা মানুষের পক্ষে কতোটা কষ্টের তা একমাত্র আমিই জানি। যাকে এতোটা যত্ম নিয়ে কষ্ট করে তিল তিল করে মানুষ করেছি তার জীবনটা এভাবে রংহীন হয়ে থাকবে আমি কিছুতেই সেটা মা হয়ে মেনে নিতে পারবো না। তোমার ব্যপারে অবশ্যই আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে । ”
” কি করতে চাইছো তুমি? ”
” তোমার পাশের সীট যেনো আর ফাঁকা না থাকে সেই ব্যবস্থা। ”
” ভাবী তুমি প্লিজ বড়ো আপুর মতো হয়ো না। তুমি তো আমাকে বুঝো। আমি পারবোনা এটা। আমার জীবনে বারিধারার জায়গা কাউকে দিতে পারবোনা আমি। ”
” মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। বারি তোমার প্রাক্তন রুকু। প্রাক্তন কে বর্তমানে টেনে এনো না। যা চলে যায় তা আর ফিরে আসেনা। অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরে এসো। চারপাশে তাকিয়ে দেখো একবার। পৃথিবী কতোটা পাল্টে গেছে। তোমার সামনে তোমার বর্তমান ভবিষ্যত দুটোই পড়ে আছে। বাঁচতে হলে আঁকড়ে ধরো রুকু।
” যদি বারি ফিরে আসে? ”
” বারি আর কখনো ফিরবেনা তোমার লাইফে। তার আশা করা বোকামো ছাড়া আর কিছুই না। সি ইজ ডেড। ”
” আমি বিশ্বাস করিনা। বারি মরতে পারে না। তোমরা মিথ্যা বলেছো আমাকে। আমাকে তার লাশটাও দেখাতে পারোনি। তার কবর অব্দিও যেতে দাওনি। বড়াপু আমাকে আটকে রেখেছে কারন আমি তো চিনে যাবো যে ও বারিধারা কিনা তাইনা? অন্য একজনের সাথে তোমরা বারিধারাকে মিলিয়ে ফেলেছো। ”
” আমি নিজে তার লাশ দেখেছি রুকু। ”
” আমি দেখিনি। যা আমি দেখিনি তা আমি বিশ্বাস করিনা। ”
” তোমাকে বাচানোর জন্য তোমাকে আটকে রেখা হয়েছিলো রুকু। বারিধারার কাছে যেতে দিলে তোমাকেও যে বাচানো যেতো না। আমরা যে তোমাকে হারাতে পারবোনা রুকু। ”
” এখন যে বেচে আছি সেটা তোমাকে কে বললো? দেহের মৃত্যু সবাই দেখে আত্মার মৃত্যু কেউ দেখে না। ”
” আমি দেখি রুকু। নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনো। নতুন করে আবার জীবন শুরু করো। প্রাক্তন কে ভূলে যাও। ”
” তুমি পেরেছো প্রাক্তন কে ভুলতে? ”
থেমে যায় মমতা। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। চোয়াল শক্ত করে বলে,
” পেরেছি। নতুন করে তোমার ভাইকে ভালোবেসেছি। এক সমুদ্র ভালোবাসার সাগরে সুখের সংসার বেধেছি। মৃত্যু অব্দি তাকে ভালোবেসে যাবো। আমাকে দেখে শেখো রুকু। ছোট্ট এই জীবনে কারো জন্য নিজেকে থামিয়ে দিও না। সময় ফুরিয়ে গেলো আফসোস ছাড়া আর কিছুই পাবে না। সময়ের স্রোতে গা ভাসাও। যা তোমাকে ধরা দিতে চায় তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাও। বেঁচে থাকার নতুন অধ্যায় খুঁজে পাবে। তুমি তো অবুঝ নও ।”
রুকু ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। মমতার গলা জড়িয়ে বলে, আমি পারছিনা ভাবী। আমি কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছিনা। স্মৃতির কোটরে বার বার সে উকি দিতে আসে। আমাকে কিছুতেই ভূলতে দেয়না। আমি ওকে ভূলতে চাই ভাবী। আমি হাপিয়ে গেছি। হাপিয়ে গেছি।
মমতা রুকুকে আটকায় না। কাঁদুক। যতপারে কাঁদুক। যতো কাঁদবে ততো নিজেকে হালকা লাগবে।
চলবে,