#ভাগ্যবতী
#লাবিবা তানহা এলিজা
#পর্ব-১৭
পূরবী বিছানা থেকে ব্যথায় উঠতে পারে না। মমতা এসে পেইন কিলার খাইয়ে দিয়েছে। সাদ দরজায় দু হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা কিঞ্চিৎ বাকা করে শুধু দেখে যাচ্ছে। পূরবীর ব্যথা কমে এলে সাদ আবার চলে যায় ঘুমাতে। যাওয়ার সময় তার বিখ্যাত বকাটাও দিয়ে যেতে মিস করেনা। সাথে বলে যায় , বজ্জাত মেয়ে হাটতে শিখেনি এখনো এই বয়সে। মা একে কাল থেকে হাত ধরে ধরে হাটা শিখাবে যাতে বার বার এই পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়। ‘ শরীর বড্ড খারাপ লাগছে তার। একটু রেস্ট নিতেই হবে। মমতা পূরবীর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘ এখন কেমন লাগছে?’
‘ ভালো। ব্যথা নেই। ‘
‘ হুম। বকুল ফোন দিয়েছিলো। বকুলের চারদিন পর বিবাহ। তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। ‘
‘ আমি যাবো বড়মা। ‘
‘ অবুঝের মতো কথা বলো কেনো? তুমি কি তোমার আগের লাইফে ফিরে যেতে চাও? তুমি চাইলেই আমি যেতে দিতে পারিনা। তুমি হয়তো জানো না আমি অনেক গুলো এন জিও এর সাথে এড আছি এবং নিজে একটি বৃদ্ধাশ্রম চালাই। আমি তোমার সাথে অন্যায় কিছু হতে দিতে পারি না। ‘
‘ আমি ছদ্মবেশ এ যেতে চেয়েছিলাম বড়মা। ‘
‘ সাদ কি বলে গেলো শুনতে পাওনি? ঠিক ভাবে হাটতেই পারোনা আর তুমি নাকি ধরবে ছদ্মবেশ? ‘
‘ আমি তো দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গিয়েছি। ছদ্দবেশের সাথে হাটার কি সম্পর্ক বড়মা? ‘
‘ সম্পর্ক অবশ্যই আছে। ধরো তোমাকে কেউ চিনে ফেললো। তখন তোমাকে পালানোর জন্য দৌড়াতে হবে আবার হাটতেও হবে। তখন কি করবে? পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙে তাদের হাতে বন্দী হবে তাইতো? ‘
‘ আমার খুব খারাপ লাগবে বড়মা। ‘
‘ হুম। ‘
‘ বড়মা মি. ডাক্তারের বিয়ে দিচ্ছেন না কেন? চলুন আমরা মি. ডাক্তারের বিয়ের আয়োজন করি। বাড়িতে নতুন একজন আসবে যে আপনার সংসার আলোকিত করবে। ‘
‘ অনেক মেয়ে দেখিয়েছি সে এখন বিয়ে করবেনা মানে করবেনা। অস্ট্রেলিয়া যাবে। স্টাডি শেষ করবে দেন বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবে। ‘
‘ বড়মা কখনো দেখেছেন কেউ একজনকে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করার জন্য পছন্দ করে? ‘
‘ আমার ছেলের জন্য অনেকেই পাগল কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দেয়না। ‘
‘ আপনি ভূল জানেন বড়মা। মি. ডাক্তার পাশের যে নীল বিল্ডিং টা আছে সেখানের একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে আছে। মেয়েটার নাম রিভা। তার বড় বোনের নাম নোভা। আমার সাথে কথা হয়েছে। ‘
‘ এটা হতেই পারেনা। সাদ কাউকে পছন্দ করলে আমাকে ঠিকই বলতো। ‘
‘ আপনি বিশ্বাস না করলে ভোরে দেখতে পারেন। বেলকনিতে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন। ‘
‘ তুমি সত্যি বলছো? ‘
‘ একদম। ‘
মমতা চিন্তায় পড়ে যায়। তার আড়ালে সাদ… কিভাবে সম্ভব? যখন বিয়ের কথা বলা হয়েছে তখন ই বলে দেওয়া উচিত ছিলো সাদের। কিন্ত সাদ তো এমন ছেলে না যে এতোবড় কথাটা আড়াল করে রাখবে। পূরবীর রুম ছেড়ে উঠে যায় মমতা। পূরবী কাথা টেনে মুচকি হাসতে হাসতে ঘুমের পথে পাড়ি জমায়।
সাদের খবর পেয়ে নূরা এসেছে। এসেই দেখে পূরবী সোফায় বসে বসে চা পান করছে। মিষ্টি একটা সুগন্ধ ভেসে আসছে। পূরবী ফ্রিজ খুলতেই চা পাতার পলিগুলো দেখতে পায়। জমিলাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে এই চা পাতার চা নাকি সাদের খুব ফেভারিট। সে সিলেটে গেলেই কয়েক পলি চা পাতা নিয়ে আসে। পূরবী আর লোভ সামলাতে পারে না। জলদি চুলোয় চা বসিয়ে দেয়। জমিলার হাতে এক কাপ সাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সোফায় বসে আরাম করে সে চা খাচ্ছে। নূরা জিজ্ঞাসা করে,
‘ হুয়াটস আপ বিউটি? দেখি দেখি.. ঢাকার হাওয়া পেয়ে তো দেখি আরো সুন্দর হয়ে গেছো। ‘
পূরবী উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে , ‘ আপু কেমন আছো? অনেক দিন পর। ‘
‘হুম। তা শুনলাম তোমার নাকি কোমড় ভেঙেছিলো? ‘
‘ ঠিক হয়ে গেছে। ‘
‘ তো হুটহাট কোমড় কেনো ভাঙে?হুম? তাও আবার সাদের রুমে।’
নূরাকে কিছু বলা যাবে না। যাই হোক ওটা এক্সিডেন্ট ছিলো। নূরা শূনলে একে আবার দুইসিডেন্ট বানাতে উঠে পড়ে লাগবে । পূরবী আবার কথা ঘুরায়।
‘ বাবুকে নিয়ে আসলেনা কেনো আপু? ‘
‘ লুক মি। সোজা হসপিটাল থেকে এসেছি। সাদের সাথে একটু দেখা করেই চলে যাবো। ‘
‘ আরেকবার আসলে বাবুকে নিয়ে আসবে আপু ।’
‘ আচ্ছা। ‘
নূরা সাদের সাথে দেখা করে চলে যায়। সাদ নিজে গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসে। বাসায় ফেরার সময় ডাইনিং এ দেখা হয়। পূরবী কোন কথা বলে না। নিচ দিক হয়ে খাবার শেষ করে উঠে যায় সাদ ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে। পরদিন সকাল থেকেই মমতা খেয়াল রাখে সাদের উপর। পূরবীর কাজটা আজ নিজে করে। কফির মগ টা বেলকনিতে নিয়ে আসে। মাকে হটাৎ কফি আনতে দেখে হকচকিয়ে যায় সাদ।মনে মনে প্রশ্ন জাগে, ‘ বজ্জাত মেয়েটা কেনো এলোনা? এখনো ঘুমুচ্ছে নাকি? নাকি শরীর খারাপ? এদিকে বেলকনিতে এসেই মমতা নজর ফেলে রিভার উপর। সাদের এক্সপ্রেশন দেখে যা বুঝার বুঝে যায়। পর পর দুদিন দেখে সিউর হয় যে তার ছেলে আর রিভার মাঝে কিছু একটা ঘটছে। পূরবী যা বলেছিলো তাই সত্যি হয়। পূরবীকে খবরটা দিতেই খুশিতে বাকবাকুম হয়ে প্রস্তাব করে বসে, ‘ বড়মা আমি তাহলে রিভা আপুকে খবরটা জানিয়ে দিচ্ছি। তার বাবা মাকে প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলে দিচ্ছি। ‘ মমতা মুচকি হেসে বলে, ‘তো তুমিই ঘটকের কাজটা করবে। ‘ হজ্জের সমান সওয়াব পাওয়া গেলে ঘটকালিটাতো করতেই হয়। ভবিষ্যতে আরো করবো। ‘
‘ রিভা মেয়েটাকে আগেও কয়েকবার দেখেছি। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। তবে আমার ছেলের জন্য আমি তার থেকে আরো বেশী সুন্দরী মেয়ে এক্সপেক্ট করেছিলাম। কিন্তু সাদের যেহেতু পছন্দ সেহেতু আর না করার কিছু নেই। ‘
‘ আমিও কথা বলে বুঝলাম রিভা আপু মি. ডাক্তার কে অনেক ভালোবাসে। মি. ডাক্তার সারপ্রাইজড হয়ে যাবে একদম। ‘
পূরবী নোভার সাথে দেখা করে ।নোভা এতো খুশি হয় যে পূরবীকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানায়। তাদের বাবা মা নানু বাড়িতে গিয়েছে। সেখান থেকে আসলেই দু বোন সহ বাবা মাকে নিয়ে উপস্থিত হবে জানায়।
সাদ বাড়ি ফিরে নয়টা দশটার দিকে। অনেক সময় হসপিটালে চাপ থাকায় আরো লেট হয়। ঢাকাতেই দুটো হসপিটালে বসে এখন। ব্যস্ততায় ঢুবে থাকে প্রতিমুহূর্তে। বাড়ি ফিরে লিভিং রুমে আসতেই পূরবীর রুমটার দিকে নজর পড়ে। মেয়েটাকে দুদিন হলো দেখে না। শরীর খারাপ নাকি? একবার গিয়ে দেখে আসলে সমস্যা কি? যেই ভাবা সেই কাজ। পূরবী জানালার গ্ৰিল ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ছে। পেছন থেকে মুখটা দেখা যাচ্ছেনা। তবুও বোঝা যাচ্ছে বাইরের আলোয় তাকে ভীষণ মায়াবী লাগছে। গুটি গুটি পায়ে পূরবীর পেছনে এসে দাঁড়ায় সাদ। উড়ো চুলগুলো উড়ে একদম সাদের চোখে মুখে ছুয়ে দিচ্ছে। সাদ পকেটে দু হাত ভরে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় । পূরবী বিন্দুমাত্র টের পায় না তার পেছনে যে একটা জলজান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।অনেক সময় পর বাইরের রাত্রি বিলাস শেষ করে পিছু ঘুরতেই সাদের সাথে ধাক্কা লাগে পূরবীর। পূরবী ভয় চিৎকার দিতে যাবে তখনি সাদকে দেখে দুহাত মুখে চেপে আওয়াজ বন্ধ করে। সাদ চোখ বন্ধ রেখেই ধীর গলায় বলে
‘ কখনো জানালা খুলে ঘুমুবেনা ।’
‘ কেনো? ‘
‘ জানালার পাশে রাতে অনেক কিছুই আসতে পারে তোমার উপর নজর ফেলতে। ‘
‘ ভুত? ‘
‘ ভূত বলতে কিছু নেই। তবে জ্বীন জাতি আছে। কুমারী মেয়েদের প্রতি তাদের একটু নজর থাকতেই পারে। ‘
‘ আপনি এসব বিশ্বাস করেন? ‘
‘ সত্য সবসময় বিশ্বাস্য।’
‘ হুম। আপনি হসপিটাল থেকে ফিরলেন তাইনা? আমাকে ডাকলেই তো হতো। কিছু বলবেন? ‘
‘ উহু। দেখতে এসেছি তুমি ঠিক আছো কিনা। ‘
‘ তাহলে চোখ বন্ধ করে আছেন কেনো? ‘
‘ কোন কোন সময় চোখ বন্ধ রাখাটাই ভালো। ‘
‘ কেনো? আমার অসস্তি হচ্ছে। চোখ খুলুন। ‘
‘ আসছি। ‘
সাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পূরবী ডেকে বলে,
‘ কিছু বললেন না তো মি. ডাক্তার। ‘
ছাদ দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। পেছনে না ঘুরেই বলে, ‘তুমি অসুস্থ ভেবেছিলাম না দেখতে পেয়ে তাই দেখতে এসেছিলাম। আর… না কিছু না। ‘
‘ আমার মন খারাপ মি. ডাক্তার। অনেক মন খারাপ । আমার আপুর বিয়ে কিন্তু সেখানে আমি নেই। আপু ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছিলো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ‘ পূরবীর চোখ থেকে টুপ টুপ করে দু ফোঁটা জল পড়ে। সাদ তাচ্ছিল্য হেসে বলে, ‘ তোমার ভাগ্যটাই খাবার পূরবী। এতে কারো হাত নেই। তবে আমি তোমাকে জলে ফেলে দিবো না। মানুষ হয়ে যদি মানুষকে সাহায্য না করতে পারলাম তাহলে কেমন মানুষ হলাম? যাই হোক তুমি কি পড়াশোনা করতে চাও?’
‘ হুম। আমি আমার পেপারস সাথে নিয়ে আসছি। প্রত্যয়ন পত্রটি তুললেই আবার ভর্তি হতে পারবো। ট্রান্সফার করানো যাবে কিনা । রেজিস্ট্রেশন অলরেডি হয়ে গেছে। ‘
‘ ইয়ার লস হয়ে গেলো তাহলে। ‘
‘ হলে হোক। কিছু করার নেই তো। ‘
‘ খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে পড়াশোনার ব্যপারে ।ভেরী গুড। কোন গ্রুপ? ‘
‘ সাইন্স। ‘
‘ কি হতে চাও? ‘
‘ ডাক্তার। ‘
‘ বেশ। তো এস এস সি রেজাল্ট কি তোমার? ‘
‘ গোল্ডেন। ‘মুচকি হাসে সাদ।
‘ মাকে বলো তোমার পেপারস আনার ব্যবস্থা করতে। আমি তোমাকে কোন কলেজে দেখি এডমিট করানো যায় কিনা।আসি। ‘
সাদ চলে যায়। পূরবীর খুশিতে চোখে জল চলে আসে। ডিনারে বসেও নাক টেনে টেনে খাবার খায় পূরবী।জমিলা আর পূরবী পূরবীর কান্না দেখে অস্থির হয়ে যায়। বার বার জিজ্ঞাসা করে পূরবী কাঁদছে কেনো? কিন্তু পূরবী কোন উত্তর দেয় না। সে মনের আনন্দে চোখের জল ফেলে আর খেতে থাকে। এমন অবস্থা দেখে সবাই অবাক হয়ে খাওয়া বাদ দিয়ে পূরবীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদ মুচকি মুচকি হাসে। পূরবীর মুড অন করতেই স্টাডির কথা বলেছিলো সাদ। এবার দেখা যাচ্ছে সত্যি সত্যি মেয়েটাকে এডমিট করাতে হবে নয়তো ভীষন কষ্ট পাবে। মমতার ফোন দিয়ে কয়েকবার কথা হয় বকুলের সাথে। দু বোনের মধ্যে হিংসে থাকলেও রক্তের টান ঠিকই প্রকাশ পায় সময় এলে। দুজনেই ফোনে কান্নাকাটি করে। পূরবী কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ আমার দুঃখের সময় তুমি ছিলে আপু। আর আমিতো তোমার সুখের সময় ও থাকতে পারলামনা। ‘ বকুল পূরবীকে শান্তনা দেয়। বিয়ের পর পূরবীর সাথে গিয়ে দেখা করে আসবে বলে। তাতেও কাজ হয়না। বিয়ের আগের দিন রাতে পূরবী না খেয়েই থাকে। সকালেও ডাইনিং এ যায় না। জমিলা খাবারটা পূরবীর রুমেই দিয়ে যায়। খাবার যেমন ছিলো তেমনি প্লেটেই রয়ে যায়। মমতা খবর শুনে পূরবীর কাছে এসে কাধে হাত রাখতেই পূরবী হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়।
চলবে,