#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ৯) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা
ডায়েরির পাতা থেকে—
মায়ের উত্তেজিত গলা শুনলাম, “তুমি নিজের মেয়ের সাথে এটা কোনোভাবেই করতে পারো না! আমি হতে দেব না এটা, কিছুতেই না।”
“কী বললা তুমি? নিজের মেয়ে? ও তোমার মেয়ে, আমার না। এই কথা ভুলে গেছ? এত্ত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলা?”
বাবার মুখে চিৎকার করে বলা এই কথাগুলো শোনার পর আমার পা থমকে গেল, সেইসাথে থমকে গেল আমার পুরো পৃথিবী! এসব কিছুই সত্য নয়, হতে পারে না! মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলাম। কিন্তু পরের কথা শোনার পরে আমি বুঝতে পারি এর সব সত্যি। আমার সারাজীবন ভুল, মস্তবড় এক ভুল!
“এই কথা আজ এতবছর পরে তোমার মনে হলো? লোভে অন্ধ হয়ে গেছ তুমি। ঠিক বেঠিক তোমার চোখে পড়ছে না!”
“খবরদার! একদম লোভী বলবা না! আর তুমি এমনভাবে কথা বলতেছ, মনে হইতেছে ওরে নদীর জলে ভাসায়ে দিতেছি!”
“জাকির মতো একটা জানোয়ারের সাথে বিয়ে দিতে চাইতেছ, এইটা কত ভয়ংকর হবে তুমি ভেবে দেখছ?”
“ওরে বিয়ে দিতে চাইতাছি আমি, বেইচা দিতে চাই নাই যে এরকম বড় বড় কথা বলতেছ তুমি। এতদিন ওরে এত যত্ন করে বড় করছি, একবারে নিজের মেয়ের মতো। এখন ওর উচিত না এর বিনিময়ে আমার জন্য কিছু করা। এতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করমু কী জন্যে?”
রাগে অন্ধ হলে নাকি ভেতরের রূপটা সামনে এসে পরে, এখানেও তাই হয়েছে। চিরাচরিত ধীরস্থির বাচনভঙ্গি থেকে বেরিয়ে হকারদের মতো স্বরে কথা বলছিলেন তখন। জীবনে যাকে সব থেকে বেশি ভরসা করেছি, তার মুখে এত নোংরা কথা কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না। সব তালগোল পাকিয়ে আসতে লাগল, কিছু একটা দলা পাকিয়ে যেন গলায় আটকে রইল! যার কাছ থেকে সারাজীবন আদর্শের বাণী শুনে এসেছি তার মুখে এসব কীভাবে আসে ভেবে পেলাম না! মুখোশ বুঝি এত সময় পরে থাকা যায়, শ্বাস আটকে যায় না!
“ছিঃ! তুমি সত্যিই একটা লোভী, তুমি আমাকে কথা দিছিলা, আমার মেয়েরে আগলে রাখার ওয়াদা করছিলা। আরও বড় ক্ষমতা পাওয়ার আশায় নোংরা কথা বলতেও তোমার মুখে আটকায় নাই। বিনিময় চাইতেছ! ছিঃ! একটা জানোয়ারের সাথে…. ”
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন, “জানোয়ার জানোয়ার করতেছ কেন? টাকা পয়সা ক্ষমতা কোনটার কমতি আছে ওর। পুরুষ মানুষের এরকম একটু আধটু দোষ থাকেই, এইটা এমন বড় কোনো বিষয় না…..”
গা রিরি করতে লাগল, আর কে কী বলল সেটা আমার কানে আসছিল না, এত বড় ধাক্কায় আমি তখন পুরো টালমাটাল অবস্থায়। শ্লথ হয়ে যাওয়া পা দুটোকে অনেক কষ্টে পোষ মানিয়ে আমার রুমে এসে দরজার ছিটকিনি আটকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজেছিলাম। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার। এভাবে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই এখন আর। নিজের মধ্যে ছিলাম না তখন। কিছুতেই নিজেকে ধাতস্থ করতে পারছিলাম না।
কতক্ষণ সময় কেটে গেছে জানি না, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মুখ তুললাম, মা ডাকছিল। চোখ মুছে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে দরজা খুললাম। মায়ের চোখে পানি নেই কিন্তু তার চিহ্ন বিদ্যমান। চোখ অদ্ভুতভাবে ফুলে আছে, কেঁদেছে তা বোঝা যাচ্ছিল। মা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল, আমার হাত ধরে এনে বিছানায় বসালো, নিজেও বসল। এভাবেই দুজন বসে থাকলাম কিছুক্ষণ, কারো মুখে কোনো কথা নেই। আমার অনুভুতিরা বিকল হয়ে গেছে যেন! কতক্ষণ পরে জানি না মা আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও যেন অকূলে কূল পেলাম। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম।
মায়ের থেকে বাবার সাথেই আমার বন্ধুত্ব যেন বেশি গাঢ় ছিল। ওই নোংরা লোকটাকে আর কখনো বাবা বলব না, মনে মনে ঠিক করলাম। হঠাৎ করেই মাথায় এলো ওরা বলছিল আমি মায়ের মেয়ে, বাবা নিশ্চয়ই কেউ একজন আছে, কে সে? কেন সবকিছু এভাবে উল্টেপাল্টে গেছে? ঠিক করলাম মাকে জিজ্ঞেস করব। এখন তো আগল খুলেই গেছে, লুকোচুরি করে তো আর কোনো লাভ নেই। তাছাড়া উত্তর জানার অধিকার অবশ্যই আমার আছে! মাথা তোলে মাকে বললাম,
“মা, আমাকে বলবে সবটা? কেন এমন হলো? তোমার সাথে কী হয়েছিল?”
কথা বেরোতে চাইছিল না গলা দিয়ে, তবুও ভাঙ্গা গলায় প্রশ্ন করলাম। উত্তর না পেয়ে আবার বললাম,
“এখন আর আমাকে অন্ধকারে রেখো না, মা! দোহাই লাগে তোমার। আমি আর এসব নিতে পারছি না! তোমাদের লুকোচুরি খেলা তো সারাজীবনই দেখলাম। আর দেখতে চাই না। আমাকে মেরে ফেললে না কেন?”
মা চোখ বন্ধ করল শক্ত করে, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। চোখ বন্ধ করেই রইল ক্ষণকাল, এরপর খুব অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল, সেই দৃষ্টিটা ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। কেমন অপ্রকৃতস্থ দৃষ্টি!
“তোকে মেরে ফেলব, তোকে বাঁচাতেই তো আমার সারা জীবনের সংগ্রাম, তোকেই মেরে ফেললে আমার আর কি অবলম্বন রইল বল? বল, বল…”
অপ্রকৃতিস্থের মতো আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কথাগুলো বলেছিল, আমি কিছুটা ভয় পেলাম। মাকে সবসময় অন্তরালের মানুষ মনে হয়েছে। চুপচাপ, নিভৃতচারী। চারপাশে একটা কিসের দেয়াল যেন! ব্যাক্তিত্বের তীক্ষ্ণ ছটা ছিল তাতে। খুব কাছের আবার কখনো খুব দূরের মনে হতো। তাই হয়তো বাবা বলে যাকে জেনেছিলাম উনার সাথেই বন্ধুত্ব বেশি ছিল! এভাবে কখনো দেখেনি তাকে।
“তোর সব উত্তর চাইতো? বেশ, তাই হবে। সব বলব আজ। কিচ্ছু লুকাবো না।”
সহসা শুরু করতে পারল না কথা। অনেকক্ষণ নীরবতা, মায়ের বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ তখন ঘরের একমাত্র শব্দ। রাত তখন কত হয়েছে সে খেয়ালও তখন ছিল না। আচমকাই বলা শুরু করল,
“অনেক বছর আগে, একটা গ্রামে একটা মেয়ে ছিল। বাবার রাজকন্যা। মফস্বলের ধনী বাবার চার ছেলের পরে একমাত্র মেয়ে। সবার আদরের, স্নেহ ভালোবাসার কমতি তো ছিলই না বরং এত বেশি ছিল যে মেয়েটা নিজেকে রাজকন্যাই ভাবত। আদুরে ছোট্ট রাজকন্যা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রচন্ড অভিমানী হয়ে উঠতে লাগল। আবেগে টইটম্বুর! আবেগ!”
‘আবেগ’ শব্দটাতে যেন একটু বেশিই জোড় দিল। মুখে ফুটল অদ্ভুত হাসি। কী যে বিষন্ন সে হাসি! এরপর একে একে বলে চলল এক দুঃখী রাজকন্যার উপাখ্যান। এর একটা শব্দও আমি কখনো ভুলব না।
মায়ের সেই কথাগুলো মা’য়ের জবানিতেই তুলে ধরছি আমি—–
“দেখতে দেখতে কখন বড় হয়ে গেলাম টেরই পেলাম না। মেট্রিক শেষ করে এলাকারই এক মহিলা কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজ শুরু হবার দুই মাসের মাথায় খেয়াল করলাম একটা ছেলে মোড়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার বাড়িতে ফিরতে হলে সেই মোড় হয়েই ফিরতে হতো। একদিন দুইদিন এইভাবে পুরো একসপ্তাহ দেখলাম, বুঝলাম কাকতালীয় নয়, ইচ্ছাকৃত। আমার সাথে আরও দুজন বান্ধবী থাকত, আমি ভাবলাম হয়তো ওদের কারো জন্য। কিন্তু কিছুদিনের ব্যবধানে দুজনেরই বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ওরা আর আসলো না। পড়াশোনা শিঁকেই তুলে সংসার ধর্মে মন দিল। আমি তখন সে পথের একলা পথিক। তখনও সে ছেলেকে দেখলাম কিছুটা দূরত্ব রেখে হাটতে। বেশিদূর অবশ্য আসত না, কিছুটা এসে ফিরে যেত।
একদিন সাহসে ভর করে চোখ তুলে চাইলাম ছেলেটার মুখের দিকে, আমি তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল সে। আমি অবাক চোখে তাকিয়েই রইলাম কয়েক পলক, একটা কথাই যেন তখন মাথায় ঘুরছিল, এত সুন্দর কোনো ছেলে হয়! মনকে সজোড়ে চপেটাঘাত করে দৃষ্টি সংযত করলাম। পরনে মলিন একটা শার্ট, তবুও মনে হচ্ছিল যেন রাজপুত্র। এই ছেলে কিছুতেই আমার প্রেমে পড়তে পারে না। এরকম রূপবান রাজপুত্র কিছুতেই কালো রাজকন্যায় মন হারায় না।
কত সুন্দরী মেয়ে চারপাশে, সেসব ছেড়ে আমার মতো কালো পেত্নীর প্রেমে কেন কেউ পড়বে? মানুষ এত বোকা নিশ্চয়ই নয়। আমিই উল্টো বোকামি করেছি এসব ভেবে যে এই ছেলে আমাকে ভালোবাসে! ভীষণরকম বোকামো। কালো মেয়েদের কখনো প্রেমে পড়তে নেই। এসব ভেবেই দ্রুত পা চালালাম। কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হলো, জীবনে প্রথমবার নিজের গাত্রবর্ণ কালো বলে প্রচন্ড আফসোস হলো। অভিমান জমলো খুব, কার উপরে জানি না। শুধু জানি বুক চিঁড়ে কিছু একটা গলায় আসতে লাগল। কান্নার জল গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখ বেয়ে। এত কান্না কেন পায়, পৃথিবী ভাসানো কান্না!
সেই রাতে আর ঘুম হলো না, এপাশ ওপাশ করে রাত শেষ হলো। পরের দিন আবারও তাকে দেখলাম। সরাসরি তাকানোর সাহস হলো না, আড়চোখেই তাকালাম। দুজনের আড়চোখের দৃষ্টি এক হতো মাঝে মধ্যেই, কী এক অপরিসীম লজ্জায় দুজনেই চোখ ফিরিয়ে নিতাম। এভাবেই চলতে লাগলো সব। ছেলেটা কখনো সামনে আসার সাহস করে উঠতে পারে না, আমিও দ্বিধা আর সংকোচ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি কখনোই।
তিনমাস হয়ে গেছে আমাদের এই ‘চোখাচোখি’ প্রেমের। তবে আমি যে ওর প্রেমে পড়েছিলাম ততদিনে, এটা আমার কাছে স্পষ্ট হলো তখনই, যখন একদিন হটাৎ দেখলাম সে নেই। আমি তখন তাতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে সেদিনের ওর না থাকাটা আমাকে পোড়াতে লাগল ভীষণভাবে! এরপর আমার দিন কাটতে লাগলো প্রতীক্ষায়! একে একে দিন যায়, কিন্তু তার দেখা নেই।
এমনিতেই আমি কালো, কয়েক দিনের ঘুম না হওয়া রাত যেন সেটার ফায়দা তুললো ভীষণভাবে। মায়া জিনিসটা ভারী অদ্ভুত, ভীষণ বিচিত্র! শুধু চোখে চোখেই এত মায়া জন্মাতে পারে সে আমি তখনই প্রথম জেনেছিলাম।
প্রতীক্ষা বাড়ছিল আর বিশ্বাস হারাচ্ছিলাম। আগের কথাটাই আবার মনে হচ্ছিল, কালো মেয়েদের ভালোবাসতে নেই! ভালোবাসার পৃথিবীটাতে শুধুই সৌন্দর্যের একচ্ছত্র অধিকার। আমি কে সেই অধিকারে ভাগ বসানোর! এত স্পর্ধা দেখানো আমাকে একেবারেই সাজে না! কোনোভাবেই না!
…….
ক্রমশ