#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ৭) [রি-পোস্ট] নুসরাত জাহান লিজা চৌদ্দ. অন্বেষা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আবিদের দিকে, বুঁদ হয়ে আছে ওর বলা কথায়। আশ্চর্য, অনুভূতিগুলো এত বছর পরেও এতটা জীবন্ত! আবিদ যখন অতসীর সাথে ওর প্রথম দেখা, প্রথম অনুভূতি বিনিময়ের কথা বলছিল তখন ওর চোখেমুখে সেই প্রগাঢ় অভিব্যক্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল! উজ্জ্বল, উদ্ভাসিত সেই অভিব্যক্তি! চোখে চোখে হয়তো সত্যিই মনের কথা বলা যায়! অন্বেষার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল আবিদের উদ্ভাসিত মুখটা ফ্রেমবন্দী করতে, কিন্তু সেটা তো আর হবার নয়! আবার যখন বিচ্ছেদের কথা বলছিল, কী এক আশ্চর্য বিষাদে নিমজ্জিত হয়েছিল সেই মুখ! “যখন ফিরলেন তখন অতসী কোথায় ছিল? বিয়ে হয়ে গিয়েছিল? ” দ্বিধা কাটিয়ে প্রশ্ন করে ও। জবাবে ম্লান হাসল আবিদ, কারো হাসিতেও যে এতটা গভীর বিষাদ খেলা করতে পারে আজকের আগে তা কখনো দেখেনি অন্বেষা! কী গভীর কষ্টের ছায়া সেই মুখাবয়বে! ফ্লাস্কে করে আনা চা কাপে ঢেলে অন্বেষার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে আবিদ বলে উঠল, “শুধু বিয়ে করে ফেললে তো ও সুখে আছে ভেবে ভালোই থাকতাম হয়তো!” কাপটা হাতে নিয়ে, “তবে কি সুইসাইড করেছিল অতসী? এই বয়সী মেয়েরা যে এত আবেগ কেন দেখায় বুঝি…” আলো আঁধারীতেও আবিদের চেহারায় ফুটে উঠা রাগ স্পট অনুভব করল অন্বেষা, ওর রক্তবর্ণ চোখের দিকে চোখ পরতেই নিজেকে সামলে নিয়ে থেমে গেল। এতটা রেগে গেল কেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। “সুইসাইড! এতক্ষণ ওর কথা শুনে এটাই মনে হলো তোমার? আগ বাড়িয়ে ফালতু কথা বলা খুবই বাজে অভ্যাস। বাড়াবাড়ি রকমের বাজে!” রাতের নির্জনতাকে ভেদ করে গমগম করে উঠল ওর রাগে উন্মত্ত গলা। “তবে? আপনিই তো বললেন যখন ফিরলেন আর পাননি ওকে।” জোনাকির মেলায় চোখ রেখে মিনমিনে গলায় বলে অন্বেষা। “কেন, বিয়ে বা সুইসাইড ছাড়া আর কোনো কারণ থাকতে পারে না? এই টিপিক্যাল ভাবনা থেকে আমরা যে কেন বেরোতে পারি না!” কিছুটা নরম স্বর, প্রায় স্বগতোক্তির মত শোনাল ওর কণ্ঠ। উপরে নিচে মাথা নাড়ায় অন্বেষা, মুখে কিছু বলে না। ওর মনে তীব্র কৌতূহল জেগেছে, এতো বোঝাপড়া, প্রতিশ্রুতি আর ভালোবাসা দিয়ে শুরু হওয়া সম্পর্কের ঝড়টা আসলে কী ছিল? কেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে এভাবে? কিন্তু ওর রাগ দেখে আর আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করল না, কিছুটা সময় দিল। জানে নিজেই বলবে আবিদ। নিস্তব্ধতা ভেদ করে মাঝে মাঝে দূরের শেয়ালগুলো এখনো ডেকে যাচ্ছে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কী অদ্ভুত সে নৈশব্দতা! আবিদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈশব্দকে খানখান করে বলল, “ও আর পৃথিবীতে নেই! খুন করা হয়েছিল অতসীকে।” মাত্রই চা মুখে নিয়েছিল, মুখ থেকে তা ছলকে পরে গেল, এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না ও। “মানে? খুন? কীভাবে আর কেন?” উত্তেজনায় একসাথে কয়েকটি প্রশ্ন করল অন্বেষা। আবিদকে দেখে মনে হচ্ছিল ভেঙে পড়া অসহায় নাবিক, তীরের একেবারে প্রান্তে এসে তরী ডুবেছে যার! নয়তো রাজ্য থেকে বিতাড়িত রাজা। কী ভয়ঙ্কর অসহায় আর নিঃস্ব যে লাগছিল দেখতে! অন্বেষার বুকের ভেতরে টনটনে এক অনুভূতি হল, মায়া হল। কী গভীর আর প্রগাঢ় সে মায়া! প্রায় অচেনা এক মানুষের জন্য এত মায়া কোথা থেকে এলো জানে না ও! অথচ আজও ক্ষণেক আগেও আবিদকে দাম্ভিক আর নাক উঁচু মনে হয়েছিল। অথচ ভেতরে ভেতরে কী ভয়ংকর অসহায় এই লোক, তা কে ভেবেছিল কোনোদিন, কোনো কালে! “ওসব আজ থাক, অন্য আরেকদিন বলব, এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।” এতটা শীতল ছিল সেই স্বর যে এড়াতে পারল না অন্বেষা। তাছাড়া এইমুহূর্তে লোকটাকে বিরক্ত না করাই উচিৎ। একটা স্মরণীয় রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্য শেষবারের মতো অবলোকন করে পা বাড়াল ঘরের দিকে। ওর সঙ্গী হলো নতুন এক বুক চিনচিনে অনুভূতি! আদতে দাম্ভিক, অহংকারী এক মানুষের খোলসে পুরোপুরি ভেঙে পড়া, নিঃস্ব একজন! তার জন্য মায়া আর সহানুভূতি অনুভব করলে সেটা দোষের কিছু নয় নিশ্চয়ই! চা মুখে দিতেই সেটা অত্যন্ত বিস্বাদ লাগল আবিদের, অথচ এই চা ওর ভালো লাগে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবিদ হারিয়ে গেলো ওর একান্ত নিজস্ব জগতে, যেখানে কোনো রঙ নেই, সবকিছু বড্ড ধূসর, বড্ড বিবর্ণ! পনেরো. পরেরদিন সকালে ঢাকায় ফিরল ওরা, সেদিন ইন্টারভিউ দিল না আবিদ, তবে প্রতিশ্রুতি দিল যেকোনো দিন সুবিধাজনক সময়ে তা দেবে। সবাইকে বলা থাকবে যেন ওকে না আটকায়। যাক ‘নো এন্ট্রি’ সাইন তো পাওয়া গেল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল অন্বেষা। ফিরে এসে যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের জগতে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিনের মতো আবিদের চোখ গেল টেবিলে রাখা ডায়েরির দিকে। এর ভেতরে লেখা প্রতিটি শব্দ ওর অন্তঃস্থ, তবু্ও একবার হলেও হাত বুলায় প্রতিটি পাতায়। এর প্রায় প্রতিটি পাতায় হয়তো ছোঁয়া লেগে আছে পেয়েও নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলা অপার্থিব রমনীর! জীবনটা এখন বড্ড বেশিই দীর্ঘ মনে হয় ওর। অপরাধবোধের বোঝা বইতে বইতে ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। হয়তো সরাসরি ওর কোনো দোষ নেই, কিন্তু সেদিন যদি পিছুডাক না এড়িয়ে অতসীর কথায় রাজি হয়ে যেত, হয়তো এড়ানো যেতো বিপর্যয়। ঠিক তিনদিন পরে এলো অন্বেষা। ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিলো তখন চোখ গেল আবিদের দিকে। ভারিক্কি চালে হেঁটে এসে বসল মুখোমুখি, হাতে ডায়েরির মতই কিছু একটা। প্রতিটা পদক্ষেপে যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে আভিজাত্য। “কেমন আছ, অন্বেষা?” “ভালো, আপনি?” “বেঁচে আছি, আমার কাছে এখন বেঁচে থাকাটাই ভালো থাকা!” তীব্র বিষাদ ভেসে এলো অন্বেষার কানে। “আপনার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই? আর আপনার পরিবারের লোকজন কোথায়? তাদেরকেও কখনো দেখা যায়নি কোথাও।” আবিদ মৃদু হেসে বলল, “সেসব পরের কথা, আগে মাঝের ঘটনা জানা দরকার তোমার। আবারও তোমাকে সাবধান করছি, আমি কিন্তু বিশ্বাস করেছি তোমাকে।” শেষের কথাগুলো বলল দৃঢ়তার সাথে, চেহারার কাঠিন্য এনে। অন্বেষাও কিছুটা কঠিন গলায় বলল, “বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি কখনও করিনি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এই কথাগুলো পাবলিশ হবে না।” কিছুটা আহত হয়েছে ও, এই লোকটা এখনো ওকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি আর ও কিনা আবেগে হাবুডুবু খাচ্ছে! অন্বেষা কিছুটা কষ্ট পেয়েছে, তা বুঝতে পারল আবিদ। কথা না বাড়িয়ে এতদিন যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা ডায়েরিটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। “বিশ্বাস করেছি বলেই এটা তোমাকে দিচ্ছি। এটা অত্যন্ত সাবধানে রাখবে, অন্যকারো হাতে যেন না পড়ে তা খেয়াল রাখবে।” সাবধান করল আবিদ। “ভয় নেই, এটা এখন আমার দ্বায়িত্ব। আর আমি আমানত রক্ষা করতে জানি।” অভয় দিল অন্বেষা। বিমর্ষচিত্তে অণ্বেষাকে বিদায় জানায় আবিদ। ডায়েরি হাতে নিয়ে তীব্র কৌতূহল বোধ করলো ও, দ্রুত বাসায় ফিরেই নিজের রুমে দরজা আটকে সেটা নিয়ে বসল। কিছুটা পুরোনো হয়ে গেছে, পাতা উল্টে দেখল সেগুলো হালকা মলিন হয়েছে এত বছরে। ডায়েরির একেবারে প্রথমেই কোটেশন আকারে লেখা, “আবিদ, ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না। এটা শুধুমাত্র তোমার জন্য লিখছি। আমি জানি তুমি কখনো না কখনো ফিরবেই, তাই আমার না বলা কথাগুলো তোমাকে বলে যেতে চাই। ইচ্ছে ছিল কোনো এক পৃথিবী ভাসানো জোছনায় তোমার হাত ধরে নিজের স্বপ্নের কথাগুলো বলব। কিন্তু এখন তা আর হবার নয়। নিজের গভীর বিষাদের কথাগুলোই না হয় জানাই। কতটা বলতে পারব জানি না, সময় হয়তো ফুরিয়ে আসছে। যাবার আগে নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে এটা তোমার হাতে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে যাব! পড়বে কিন্তু সবটুকু! এটাই আমার শেষ অনুরোধ।” এটুকু পড়ে ওর আগ্রহ তীব্রতর হলো, অন্বেষা দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টালো। আর ডুবে গেলো তাতে। ডায়েরির পাতা থেকে– শুনেছিলাম আমার ‘অতসী’ নামের অর্থ ‘সোনালী রঙের ফুল’। নামটি রেখেছিল আমার বাবা, যাকে আমি কখনো দেখিনি! অবাক হবে হয়তো, যাকে বাবা বলে জানি সে কে তা ভেবে? আমিও ভীষণ অবাক হয়েছিলাম, যখন সব সত্যি সামনে এসে আমার এতদিনের সাজানো পৃথিবীটাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে! কতটা ভেঙে পড়েছিলাম সেটা নাই বা বললাম। বাকিটা নাহয় সামনে বলব, যখন প্রসঙ্গ আসবে। লেখালেখির হাত ভালো না বলে গুছিয়ে লিখতে পারছি না। হয়তো বিরক্তি চলে আসবে, বিরক্ত হলেও পড়বে, প্লিজ! তো যা বলছিলাম, আমি নিজেকে ফুলই মনে করতাম। যার গায়ে থাকতো স্বর্ণালি আভা। কিন্তু তা কবেই বিলীন হয়ে গেছে, সোনালী ফুল বিষে বিষে নীল হয়ে গেছে। ‘নীল আহত ফুল’ হয়তো এখন আমার সাথে বড্ড মানানসই আর ভারসাম্যপূর্ণ হবে! সদা হাস্যোজ্বল এই আমি কখন যে হাসতে ভুলে গেছি তাও জানি না। এই কয়েক দিনে আমি বাস্তবতাকে এতটা উপলব্ধি করেছি যে ভীষণ রকম ভীতিকর তা আমার জন্য। বাস্তব সবসময় কঠিন আর রূঢ় হয় বলে শুনেছিলাম, কিন্তু তাই বলে এতটা সর্বগ্রাসী তা জানা ছিল না! যে আমাকে তুমি চিনতে, বাস্তবতার ছোবলে সে কবেই বিলীন হয়ে গেছে, বাকি আছে শুধু খোলসটা। সেটাও বড্ড নিভু নিভু, কোনোরকমভাবে জ্বলছে সলতেটা। এক চিলতে বাতাসেই যা নিভে যাবে চিরতরে! ………… ক্রমশ