#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ১৫) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা

বিশ.
সোহান আবিদকে অত্যন্ত ভয় পায়, যদিও ওর ভয়টা এসেছে সমীহ থেকে। যে বছর কয়েক ও এখানে আছে, কখনো রাগত স্বরে ওর সাথে কথা বলেনি আবিদ, তবুও কেন যেন তটস্থ থাকে ও। খুব সাহস নিয়ে আবিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও, উদ্দেশ্য আজকে সারাদিনের জন্য ছুটি নেওয়া। আবিদ তখন সবে সকালের নাস্তা সারছিল। ঘুম থেকে কিছুটা পরে উঠে বলে একাই খেতে হয় আবিদকে। যেটুকু কিঞ্চিৎ পরিমাণ সাহস নিয়ে এসেছিল এখন তাও পুরোপুরি উধাও। কেন যে এরকম হয়, সোহান বুঝতে পারে না!

বরাবরের মতো আবিদই আগে মুখ খুলল, “বলে ফেলো, এতটা ভয় পাবার মতো কিছু হয়েছে কী?”

সোহান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “স্যার, আসলে বলছিলাম আজকে তো আমি মোটামুটি ফ্রী আছি, তাই….”

“তাই?”

“বাইরে একটা ইমারজেন্সি ছিল, তাই যদি…” আবার থেমে গেল, মনে মনে মিথ্যেটা ঝালিয়ে নিচ্ছিল।

“ইমারজেন্সিটা কী?”

“আসলে আমার এক অতি নিকটাত্মীয় হসপিটালে, এখন তখন অবস্থা, স্যার। বাঁচার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ! যদিও খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না তার সাথে, তবুও স্যার রক্তের সম্পর্ক তো। যদি মরে যায়! না গেলে খারাপ দেখায়। তাই যাওয়া দরকার, স্যার।” বড় করে ঢোক গিলে হড়বড় করে মিথ্যে কথাটা বলল সোহান।

“আচ্ছা? তো শায়লা হাসপাতালে? আর হসপিটাল বুঝি পার্কে!” হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বলল আবিদ।
সোহানের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে হেসেই ফেলল, “মিথ্যেটা গুছিয়ে বলা শিখতে হয়। তুমি এখনো তা শেখনি।”

নিজেকে অত্যন্ত চালাক বলে মনে করা বোকাবোকা সোহানকে ও পছন্দ করে। ছেলেটার মনটা ভালো, কোনো প্যাঁচগোচ নেই। শুধু একটু মাথামোটা, এই আরকি!

সোহানের মাথায় ঢুকছে না আবিদ কীভাবে শায়লার কথা জানল! শায়লা ওর গার্লফ্রেন্ড, চার বছরের সম্পর্ক ওদের। নানা সময়ে নানা রকম অজুহাতে ছুটি চেয়ে নিয়ে দেখা করেছে শায়লার সাথে। কখনও সত্যিটা বলতে সাহসে কূলায়নি। এই লোক সেটাও জেনে বসে আছে। চোখ দুটোতে এখনো বিস্ময় লেগে আছে ওর। প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই আবিদ বলল,

“তোমাকে যতটা বোকা ভেবেছি তুমি দেখছি তার থেকেও বেশি বোকা। আমার সাথে কতদিন থেকে আছ?”

“স্যার, প্রায় তিনবছর।”

“তোমার কি মনে হয় যার সাথে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কাটাব, তার সম্পর্কে ভালো মতো খোঁজখবর না নিয়ে অ্যাপয়েন্ট করেছি?”

এবার সোহানের সত্যি সত্যি নিজেকে বোকা মনে হলো, জীবনে প্রথমবার!
উত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাতের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। এমনিতেই নিজের বোকামির জন্য নিজের উপরে বিরক্ত তার উপর স্ক্রিনে ভেসে উঠা অন্বেষার নাম্বার দেখে ওর বিরক্তি যেন সীমা ছাড়াল!

চোখমুখ খিঁচে ফোন ধরল, “বলেন কী প্রয়োজন?”

ওপাশ থেকে অন্বেষা বলল, “আবিদ শাহরিয়ারের সাথে কথা বলব, ফোনটা উনাকে দিন।”

“স্যার ব্যস্ত। কী দরকার আমাকে বলেন!”

“আমার আপনার স্যারের সাথে কথা বলা খুবই প্রয়োজন। আপনি ব্যবস্থা করুন।”

এই মেয়ে সবসময় একটা কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলে ওর সাথে। যা ওর খুব বিরক্ত লাগে। মনে মনে বলল, “আমি যেন ওর চাকরি করি। হুহ্! ব্যবস্থা করুন! বললেই হলো নাকি! করতেছি ব্যবস্থা!”
মুখে বলল, “স্যার আজকে সারাদিন ব্যস্ত। দেখা হবে না।” বলেই খট করে কেটে দিল!

আবিদ কৌতুহলী চোখে ওকে জরিপ করে বলল, “কে ফোন করেছিল?”

“স্যার, ওই জার্নালিস্ট মেয়েটা। কী যে মনে করে নিজেকে, আপনার সাথে মিটিং এত সস্তা নাকি! দুদিন ভালো করে কথা বলেছেন কী বলেননি ওমনি মাথায় চড়ে বসেছে!”

“তাই বলে দিলে দেখা হবে না? ওকে আমি বিশ্বাস করেছি। অন্য কেউ হলে আমি ওকে যা বলেছি তা নিউজপেপারের হেডলাইন হয়ে যেত, টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে স্ক্রলে তা ঘুরত। কিন্তু ও ওর কথা রেখেছে। তুমি ওকে আজ বিকেলে আসতে বল। আমি কথা বলব।”

আবারও বিস্মিত হলো সোহান, একদিনে এত বিস্ময় জমা ছিল ওর জন্য! তবুও শেষ চেষ্টা করল, “স্যার, এদের এত লাই দিবেন না। লাই পেয়ে মাথায় চড়ে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া শুরু করবে।”

আবিদ অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে বলল, “তুমি তোমার কথার বুলডোজার বন্ধ করে যা বললাম তাই করো। আর বিদায় হও।”

বিরস মুখে অন্বেষাকে ফোন করে সময় জানিয়ে দিল ও। চলে যাবার জন্য ঘুরতেই আবিদের ডাকে দাঁড়াল,
“মেয়েটাকে বিয়ে করছ না কেন? বেশি দেরি কোরো না। পরে আবার হয়তো পস্তাতে হবে!”

কী এক গভীর বিষাদ ফুটে উঠেছে গলায়! সোহান জানে না কী এত কষ্ট ওর, তবুও সেই বিষাদী সুর ওকে স্পর্শ করল! গভীরভাবে স্পর্শ করল!

একুশ.
সোহান প্রথমবার মুখের উপর ফোন রেখে দেয়ায় রাগে মাথা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছিল অন্বেষার। কিছুক্ষণ মাথা দু’হাতে চেপে বসে ছিল। কিছু কড়া কথা শোনানোর প্রস্তুতি নিয়ে দ্বিতীয়বার কল করতে যাচ্ছিল ও, কিন্তু এরমধ্যেই সোহান আবার ফোন করে ওকে জানাল আবিদ রাজি। অন্বেষা ভালোই বুঝতে পারে আবিদ নিজে থেকেই রাজি হয়েছে, নয়তো ওই মাথামোটা ঘাড়ত্যাড়া ম্যানেজার ব্যাটা যে ওকে নিতান্তই অনিচ্ছায় কল করেছে তা বোধহয় আর না বললেও চলে। সহসা খুশি হয়ে উঠল ওর মন।

আবিদের দেয়া সময় অনুযায়ী যখন বের হলো, তখন আকাশ প্রবল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে সব কষ্ট কান্নায় ঝেড়ে ফেলার। হিম শীতল বাতাস বইছে। আবিদের বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হলো বিপুল বেগে ক্রন্দন। আবিদের বসার ঘরে বসে চোখ বুলাল চারপাশে। আগের বার যখন বসেছিল এখানে তখন সেভাবে খেয়াল করেনি। পুরো ঘর জুড়ে রুচিবোধের ছড়াছড়ি। অন্বেষা যখন ঘরটা পরখ করতে ব্যস্ত তখনই আবিদের আগমন।

হাতের ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাহ্! একেবারে অন টাইম!”

“প্রত্যেকের কাছেই সময়টা অত্যন্ত মূল্যবান। আমার একটু দেরীর জন্য অন্যের সময় কেন নষ্ট করব?”

“হুম, সেটাই। ভেরি ইম্প্রেসিভ! ডায়েরিটা এনেছ?”

অন্বেষা ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে এগিয়ে দিল ওর দিকে। আবিদ সেটা হাতে নিল পরম যত্নে। মনে হলো ওটা ঠিক ডায়েরি নয়, স্বয়ং অতসী!

“পরের গল্পটা কী ছিল বলুন নাহয়!”

আবিদ ডায়েরিটা কোলের উপর রাখল, এরপর ডুব দিল বহুবছর আগের এক ধূসর অতীতে, যখন বিবর্ণতায় ছেয়েছিল ওর রঙিন বসন্ত!


কানাডা যাবার পর প্রথম ছয় মাস কেটে যায় নিজেকে সেখানে মানিয়ে নিতে নিতেই। অতসীকে পরপর দুটো চিঠি লিখলেও কোনো উত্তর আসেনি। আবিদ ভেবেছিল অভিমান! ছেলেমানুষি আবদারে সাড়া দেয়নি বলে হয়তো অভিমান করেছে। অতসীর বাবার নাম্বারে কয়েকবার কল করেও সাড়া পায়নি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না৷ না ছিল স্মার্টফোন আর না ছিল এত এত সোশ্যাল মিডিয়া। এমনকি হাতে হাতে ফোনও ছিল না সবার। হরহামেশা যোগাযোগ তাই সম্ভব ছিল না। তাই সন্দেহেরও উদ্রেক হয়নি। ভেবেছিল ও ভালোই আছে ওর নিজের জগতে, কিছুটা অভিমান নিয়ে!

আবিদের চোখে তখন স্বপ্নের রোদ্দুর। ভালো ইনকাম, পরিবারকে ভালো রাখতে পারছে, আর কোনো একজনের সাথে নিজের জীবন জড়ানোর স্বপ্ন মজ্জায় মজ্জায়! সাথে শখের ফটোগ্রাফি তো আছেই। স্বপ্নে ভর করে অসাধারণ কাটছিল সময়।

এক বছরের মাথায় কানাডার অন্যতম সেরা ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিনে অফার পেলে খুলে যায় ভাগ্যের দুয়ার। কিন্তু ওদিকে অপরজনের ভাগ্যে তখন বেলা শেষের ডাক তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি ও!

ছুটে চলা জীবনে অবসর তখন সোনার হরিণ প্রায়। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলা জীবনে অতসীর জন্য মন কেমন করলেও খুব একটা পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল অতসী তো থাকবেই প্রতীক্ষায়। কিন্তু দেড় বছরেও যখন কোন উত্তর পেল না, তখন কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায় ও। হাতের কাজ শেষ করতে করতে চলে যায় আরও তিন মাস। এরপর বাকিটা গুছিয়ে ছুটি পেতে পেতে আরো সময় গড়ায়।

টিকিট কেটে শেষ পর্যন্ত যখন দেশের বিমানে সওয়ার হলো ততদিনে আরও দুইমাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রায় দুবছর পরে হৃদয়ে সহস্র সুতোর বুননে আঁকা স্বপ্নের টানে ওর এই ঘরে ফেরা। এক বসন্তে পাড়ি জমিয়েছিল সুদূরে, অন্য আরেক বসন্তে ফেরা একই সুতোর টানে! অদৃশ্য আর বড্ড মায়াময় সেই সুতো!

বাড়িতে ফিরে বাবা, মা আর একমাত্র ছোটভাইয়ের সাথে দু’দিন কাটিয়ে ছুটল কোনো এক অভিমানীর প্রতীক্ষার প্রহর ঘোচাতে। প্রথমেই গেল নিজেদের প্রিয় জায়গাটায় যেখানে দেখা হতো ওদের রোজ বিকেলে।

কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিল, ঢিপঢিপ করছিল বুক। কিছুক্ষণ বসে মুক্ত বাতাসে শ্বাস ফেলে পা বাড়ালো অতসীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় এক পাগলের সামনে পড়ে গেল, উসকোখুসকো চুল আর চোখে কেমন যেন বিভ্রান্ত দৃষ্টি, ভালো করে খেয়াল করতেই ধ্বক করে উঠলো বুক! অতসীর বাবা!

কিন্তু গ্রামের পরাক্রমশালী চেয়ারম্যানের এরকম পরিণতি খুব একটা স্বাভাবিক নয় নিশ্চয়ই। উত্তর পাবে না জেনেও কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“অতসী…… ”

এটুকু বলতেই উনি বললেন, “অতসীরে দেখছ তুমি? আমি ওরে খুঁজে পাইতেছি না। আমি জেনেশুনে ওরে কবর দিছি এই দুই হাতে।”

শেষের কথাগুলো হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, বলা শেষ হতেই অস্বাভাবিক কান্নায় ভেঙে পড়ল! আবিদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না, শুধু অতসীর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল, কেঁপে উঠল ভেতরটা! অতসীর বাড়ির পথে যত এগুচ্ছে বুকে ব্যথাও ক্রমশ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে!
………
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here