#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ১৩) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা

ডায়েরির পাতা থেকে……..
সবাই আবারও বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে, আর তুই তখন সবার চোখের কাঁটা যেন। পালিয়ে যাওয়ায় তাদের সামাজিক মর্যাদা কতটা ক্ষুন্ন হয়েছে তা আমার কানে সারাক্ষণ ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলত অনবরত। মানুষ তো, কতদিন আর এসব সহ্য হয়? অবশেষে টিকতে না পেরে মত দিয়ে দিলাম শর্তসাপেক্ষে,

“ঠিক আছে, তোমরা যখন চাইছ আমি আরেকবার বিয়ে করি, তবে তাই হোক। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে রেখে কোত্থাও যাব না। যেখানে যাই মেয়েকে নিয়েই যাব, নয়তো নয়। এটাই শেষ কথা।”

গো ধরে বসে রইলাম, কিছুতেই এর অন্যথা করব না। আমার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন, আমি কেন অন্যের ভরসায় ছেড়ে নিজের কথা ভাবব কেবল? পৃথিবীর কোনো মা’ই তা পারবে না।

এরমধ্যে অনেক পাত্র এলো গেল, কেউ ডিভোর্সি আবার কেউ বা বিপত্নীক। কিন্তু বেশিরভাগই অতসীর দ্বায়িত্ব নিতে রাজি হলো না। কেউ কেউ আবার আরেক কাঠি এগিয়ে মোটা অংকের যৌতুক চেয়ে বসল। অথচ ওদের অনেকেরই সন্তান রয়েছে। কঠিন বাস্তবতার ছোবলে আমি তখন ক্লান্ত, ভগ্ন।

এরইমধ্যে একজন লোক এলো, যে বিয়েটা করতে রাজি হলো, তোর দ্বায়িত্ব নিতেও সে রাজি। আমি অত্যন্ত অবাক হলাম, যৌতুকও চায়নি। কথা বলতে চাইলাম তার সাথে। কিন্তু আমার পরিবার ভেবে বসল আমি হয়তো বিয়ে ভাঙ্গার পায়তারা করছি, তাই প্রথমে অসম্মতি জানায়।

আমি বললাম, “যাকে বিয়ে করব, যে আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে রাজি তার সাথে একবার আমি কথা বলবই। চিন্তা নেই, আমি বিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করব না।”

ভাবি বললেন, “দেখে শুনেই তো বিয়ে করেছিলে, কতদিন টিকলো সেটা? এক আধবার দেখে কী আর মানুষ চেনা যায়?” সত্যিই তো, তবু্ও আমি জেদ ধরে বসে রইলাম।

মা বললেন, “দেখ, ছেলে ভালো। তোর মেয়ে থাকা সত্ত্বেও ওকে নিয়েই তোকে বিয়ে করতে রাজি। দাবী দাওয়াও নেই। বুঝায় যায় মনমানসিকতা উঁচু হবে।”

নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। মানুষ নয় যেন কোনো জড়বস্তু! মেয়েরা কি এতটাই ফেলনা? নিজের পায়ে না দাঁড়ানোর পরিণতি হয়তো এটাই! নিজের ভুলের মাশুল হয়তো এভাবেই দিতে হবে! পুড়ে পুড়ে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে!

শেষে ব্যবস্থা হলো, মুখোমুখি হলাম ওর। নিতান্তই গোবেচারা ধরনের লোক মনে হচ্ছিল। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয়। শুনেছি দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছিল, কিন্তু দু’বারই হেরেছে। সামনে আবারও নাকি অংশগ্রহণ করবে! মগজে চেপে বসা প্রশ্নটা করে বসলাম একেবারে প্রথমেই,

“আমাকে বিয়ে করতে চান কেন? এখনো বিয়ে-থা করেননি, চাইলে অনেক ভালো মেয়ে বিয়ে করতে পারতেন! ডিভোর্সি একজনকে কেন বিয়ে করবেন শুধু শুধু?” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

এতটা অকপট চাঁছাছোলা প্রশ্ন আশা করেনি সে, চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল অবাক হয়েছে খুব। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,
“দেখেন, সরাসরি যেহেতু প্রশ্ন করেছেন উত্তরটাও সরাসরি দেই। ঘোরপ্যাঁচ আমারও ভালো লাগে না। আমি কোনোদিন বাবা হতে পারব না। এইজন্যই এখনো বিয়ে করিনি। ব্যাপারটা আমি আর আমার পরিবার ছাড়া কেউ জানে না। আজ আপনাকে বললাম। আপনার কাছে কিছুই লুকাতে চাই না। আপনার অতীত নিয়েও আমার খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। আপনার মেয়েকে আমি ওর বাবার জায়গাটা দিতে চাই। ওকে আমি দেখেছি, খুব মিষ্টি দেখতে। ওর বাবা হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। বাকিটা আপনার বিবেচনা।” অত্যন্ত বিনয়ী আচরণ লোকটার।

লোকটার কথায় খারাপই লাগলো, এতটা সরাসরি প্রশ্ন করে হয়তো কষ্টই দিয়ে ফেললাম। আমার জীবনটা তো শেষই হয়ে গেছে, এই পরিবেশ তোর মানসিক বিকাশের উপযোগী নয়।

সাতপাঁচ ভেবে বললাম, “আপনি যদি কথা দেন আমার মেয়ে উপযুক্ত পরিবেশ পাবে, লোকে কথা শোনাবে না, ওর একটা ছিমছাম গুছানো জীবন হবে, তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।” লোকটার চোখে মুখে স্বস্তি ফুটল, কথা দিল আমায়।

দ্বিতীয়বারের মতো আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম। শুরু হলো আমার সমঝোতার সংসার! অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লোকের পাল্টে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি। পালিয়ে বিয়ে করা, স্বামী পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কটাক্ষ হজম করতে হয়েছে প্রতিনিয়ত।
বিয়ের পরে এই নতুন লোকটার জন্য সেই লোকদেরই সহানুভূতির ফোয়ারা!

অসহায় এক মেয়েকে বিয়ে করে সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে এক নিমেষে মহৎপ্রাণ অবতারে আসীন সে! আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অধরা নির্বাচনেরও শিঁকে ছিড়ল ওর ভাগ্যে! বুঝলাম এই তবে আসল উদ্দেশ্য ছিল ওর। মনটা আরেকবার বিষিয়ে গেল। আমি আর তুই শুধুই ঘুঁটি! পাবলিক সেন্টিমেন্টে একটুখানি নাড়া দেবার প্রচেষ্টা! সবই ক্ষমতা পাবার ধান্দা! ছোট্ট একটা ক্ষমতার জন্য যে এতটা ছলনা করতে পারে, এবার তো ওর সামনে আরও বড় ক্ষমতার হাতছানি!

তবুও কিছু বললাম না। কারণ ততদিনে দেখলাম এক নিঃসন্তান লোক আমার সন্তানের সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠেছে! তোকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহের ছায়া দিয়েছে লোকটা। বাস্তবিকই ভালোবাসতো সে তোকে। আজকের আগপর্যন্ত তাই মনে হতো। এতো বছর ধরে ওর দেওয়া কথা রেখেছে লোকটা। কিন্তু ক্ষমতার লোভে সেই স্নেহ ভালোবাসা আড়ালে পড়ে গেছে। আমি তো কবেই বিলীন হয়ে গেছি, শুধু তোকে আঁকড়ে বেঁচে আছি। তোর জীবনটা কী করে শেষ হতে দিই, বল?*


মা’র কথা বলা শেষ হলো, আমি শুয়ে ছিলাম মায়ের পাশে। এবার দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আষ্টেপৃষ্টে। কেউ কোনো কথা বলছি না, অনেক সময় শব্দ ছাড়াও অনুভূতির প্রকাশ হয়। নৈশব্দের ভাষা এত দৃঢ় হয় যা উচ্চারিত শব্দকেও হার মানায়!

বুকের ভেতরে এত গভীর ক্ষত কী করে এত লম্বা সময় ধরে বইতে পারল মা? আর আমি এতটা কাছাকাছি থেকেও বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলাম না তা! আমার না দেখা বাবার জন্য খুব করুণা হতে লাগল, এরকম প্রলয়ঙ্কারী ভালোবাসা যে পায়ে ঠেলতে পারে তার মতো অভাগা আর কেউ নেই। এটুকু আমি জোর গলায় বলতে পারি।

রাত প্রায় শেষ, ফজরের আযান ভেসে আসছে। দু’জনে উঠে নামাজ পড়ে নিলাম। এরপর মা বেরিয়ে গেল আর আমি শুয়ে রইলাম। তুমি কবে বিদায় চাইতে আসবে তার প্রতীক্ষায় রইলাম।

মনে মনে জপে যাচ্ছিলাম, “আবিদ, কখন আসবে তুমি?”

পরের দিন আমি আমাদের রোজকার দেখা করার জায়গায় বসে ছিলাম আনমনে। মাকে নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল প্রতীক্ষিত গলার স্বরে, হৃদয়ে খুশি ছলকে উঠলো।
ঘুরে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলাম তোমায়। তুমি হয়ত অবাক হয়েছিলে খুব। ইচ্ছে করছিল সব খুলে বলি তোমাকে, জাকির কথা, মায়ের কথা আর আমার শঙ্কার কথা!

কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল তুমি তিনদিন পর চলে যাবে কানাডায়। তোমার স্বপ্নের ফটোগ্রাফি করতে। এসব বললে আমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে তুমি যেতে পারবে না। তাই আর বলা হয় না। গলার কাছে এসে আটকে যায় কথারা। জাকি যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয় বাড়িতে তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমরা এক হতে পারব না। যেখানেই যাই ওই বিষাক্ত লোকটা ঠিক নাগাল পেয়ে যাবে। তবু্ও একবার মরিয়া হয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম। তুমি চলে যাবার আগের তিনটা দিন তো তোমাকে পাব, এই ভেবে। এরপর মরি বাঁচি কোনো পরোয়া নেই। কিন্তু তুমি সেটাকে আমার ছেলেমানুষী আবেগ ভেবে নাকচ করে দিলে। দুবছর অপেক্ষা করতে বলে পা বাড়ালে।

আমি স্বার্থপরের মতো আমার অবস্থান তোমাকে জানাতে পারিনি। শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরে যখন পা বাড়ালে ভবিষ্যতের পথে স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরতে, তখন আমার স্বপ্নে শেষ পেরেকটি ঠুকা শেষ তোমার অজান্তেই! মনে হচ্ছিল এই শেষ দেখা, তোমার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না। কোনোদিন তোমার ওই অসম্ভব সুন্দর চেহারা দেখতে পারব না। যার সৌন্দর্য শুধু চেহারায় নয়, সারল্য ভরা একটা মনে। বুকের ভেতরে হাজারটা মৌমাছি কামড়ে ধরেছে যেন! কী যে হাহাকার জমা হলো, সেই হাহাকারই বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল।

তুমি চলে যাবার পরেই বুঝতে পারলাম ভুল করে ফেলেছি, মস্ত বড়ো ভুল! তোমাকে সব বলা উচিত ছিল। বিয়ের প্রস্তাব যেহেতু দিয়েছিলাম ঝোঁকের মাথায়, বাকিটাও বলা উচিত ছিল। আমার বুদ্ধি মনে হয় আসলেই অপরিপক্ব! নয়তো এরকম বোকামি কেউ করে! কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। তুমি আমাকে এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে অবশ্যই মুক্তি দিতে পারতে, সব বিপদে পাশে থাকতে। আমি নিশ্চিত জানি তা।

তোমাকে ফোন করার জন্য ছুটে গেলাম বাড়ির কাছাকাছি এক ফোন বুথে। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না, জাকির সাঙ্গপাঙ্গরা সেখানে আসন গেড়ে বসে আছে। নিরুপায় হয়ে বাড়ির পথ ধরলাম, বাবার ফোনটা যদি পাওয়া যায়। কিন্তু তাও হলো না, উনি দুদিনের জন্য ঢাকায় গেছেন। এদিকে জাকির আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে। মা আর কয়দিন আমাকে আগলে রাখবে।
দুদিন পরে বাবা ফিরেই ঘোষণা দিলেন বিয়ে করতেই হবে আমাকে। কাছে ডেকে বললেন,

“তুই তো সব জেনেই গেছিস। এখন আর লুকাতে চাই না। তোকে আমি নিজের মেয়ের মতোই ভাবি, ভাবি কী, তুই তো আমার মেয়েই। জন্ম দিলেই তো আর বাপ হওয়া যায় না। আমি কোলেপিঠে করে বড় করেছি তোকে আমিই তোর বাপ। তোর ভালোমন্দ আমিই ভাবব নাকি? তোরে হাত পা বেঁধে পানিতে ফেলবো না। জাকির মাশআল্লাহ কোনো কিছুর কমতি নাই। না টাকা পয়সার আর না ক্ষমতার। তুই রানীর হালে থাকবি। বিনিময়ে আমার একটা স্বপ্ন যদি পূরণ হয় ক্ষতি তো নাই। তুই রাজি হয়ে যা, মা!”

উনার লোভে চকচকে চোখজোড়ায় ক্ষমতার নেশা। এখন মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজাতে চাইছে, না ভিজলে অন্য পন্থা। লোভ মানুষকে কতটা নীচে নামিয়ে দেয়, আবাক চোখে তাই দেখছি শুধু।

ভাবলাম পালিয়ে যাবো, কিন্তু কোথায় যাব? আমার যাবার কোনো জায়গা নেই! এতবড় পৃথিবীতে নিজের নিরাপদ একটা আশ্রয়ের কতটা অভাব! মা আমার হয়ে লড়াই করলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।

ভুলের মাশুল দিতেই হয়তো নিতান্ত অপারগ হয়ে বিয়ে করে ফেলতে হলো জাকির মত নরপশুকে। যার শিরা, উপশিরা থেকে শুরু করে প্রতিটি রক্তকণিকায় শুধু বিষ আর বিষ!
…….

(*চিহ্নিত জায়গার উপরের অংশটুকু অতসীর মায়ের কথা, আর ★চিহ্নিত জায়গার পর থেকে অতসীর বয়ান)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here