#বিবর্ণ_বসন্ত (পর্ব ১) [রি-পোস্ট]
নুসরাত জাহান লিজা
প্রারম্ভিকা
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের তুমুল জনপ্রিয় লেখক আবিদ শাহরিয়ার। পরপর কয়েক বইমেলায় বেস্টসেলারের খেতাব পেয়েছে তার রচিত বই। লেখালেখির জগতে পা রাখে প্রায় আট বছর। এই সময়ের মধ্যেই তার অসংখ্য ভক্ত তৈরি হয়েছে। তবে চল্লিশোর্ধ সুদর্শন এই ভদ্রলোককে নিয়ে কিছু কানাঘুষা শোনা যায়, প্রচলিত রয়েছে নানারকম কথা। এর কারণ হচ্ছে এখনো তিনি ব্যাচেলর। কেউ বলে হয়তো কোনো ছ্যাকা ট্যাকা খেয়েছে, আবার কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলে হয়তো তার কোন সমস্যা আছে, এরকম আরও নানারকম কন্ট্রোভার্সি বাজারে প্রচলিত। সুন্দরী মেয়ে ভক্তের কোনো অভাব নেই তার, কিন্তু কারও সাথে দহরম মহরমের কোন খবরও শোনা যায়নি কখনো। ঠিক কী কারণে তার এই বৈরাগ্য, তা কেউ আদতে জানে না! কিছু খবরের কাগজ মনগড়া কিছু কথা রঙ চড়িয়ে লেখে তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য। যেহেতু আবিদ শাহরিয়ার সকল প্রচার-প্রচারনা সজ্ঞানে এড়িয়ে চলেন, কোথাও কোন সাক্ষাৎকার দেন না, তাই সত্যিটা জানার কোনোরকম উপায় নেই।
তার প্রত্যেক লেখায় গভীর বিষাদের ছায়া থাকে, গল্পের তীব্র বিষাদ পাঠকের হৃদয়কেও স্পর্শ করে। কী সেই গভীর বিষাদ তা সকলের অজানা!
লেখায় বিষণ্ণতার ছাপ থাকলেও নিজের চারপাশে তুলে রেখেছেন রহস্যের দেয়াল। অনেক সাংবাদিক আঠার মত পিছু লেগে ছিল, অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিছু সভা কিংবা সেমিনারে কথা বললেও ব্যাক্তিগত বিষয়ে মুখে কুলূপ আঁটা বরাবরই। তবে জনশ্রুতি আছে একসময় তিনি ফটোগ্রাফি করতেন, কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের কাভারেও জায়গা হয়েছিল সেসবের। কিন্তু সহসা সব ছেড়েছুঁড়ে গায়েব হয়ে যান, তিনবছর পর অজ্ঞাতবাস থেকে আত্মপ্রকাশ করেন লেখালেখিতে। কেন তার এই অজ্ঞাতবাস তা আজও বিশাল প্রশ্নবোধক হয়ে আছে সকলের কাছে! আশ্চর্যজনকভাবে প্রথম থেকেই পাঠকপ্রিয় হয় তার বই, আস্তে আস্তে ছুঁয়েছেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা।
এক.
অন্বেষা গভীর মনোযোগ দিয়ে নিজেরই লেখা একটা আর্টিকেল পড়ছিল ওর ডেস্কে বসে। পাশের ডেস্কে বসতে বসতে বন্ধুসম সহকর্মী আতিক বলল,
“অভিনন্দন, অন্বেষা। এই ফিচারটাও দারুণ হয়েছে।” পত্রিকা থেকে মুখ না তুলেই অন্বেষা উত্তর দিল,
“ধন্যবাদ। তোমারটাও পড়লাম, আবিদ শাহরিয়ারের ইন্টারভিউটা।”
আতিক হেসে বলল, “আর ইন্টারভিউ, এই লোক জীবনে কখনো সেটা দিয়েছে নাকি?”
এবার অন্বেষা মুখ তুলে নড়েচড়ে বসল, গলায় বিস্ময়, “সে কী! পুরোটা মনগড়া?”
“তা নয়তো কী? বড় লেখক বলে মাটিতে পা পড়ে না, আকাশে হাঁটে! তুমি এইটা এখনো জানো না?” গলায় ক্ষোভ।
“শুনেছিলাম এরকম কিছু একটা, কিন্তু আমাদের পত্রিকাতেও যে এরকম হয় এটা জানতাম না! আচ্ছা, এভাবে সবাই তার ইন্টারভিউ না করেই মনগড়া কথাবার্তা ছাপিয়ে দিচ্ছে, উনিতো চাইলে মামলা করতে পারেন, তখন কি করবে?”
“পারেন, কিন্তু সেটা করবেন না, এই কয় বছরে না হলেও তিনশোর উপরে ফিচার হয়েছে উনাকে নিয়ে, ভালোমন্দ মিলিয়ে। উনি ব্যবস্থা নেননি!”
“আশ্চর্য! উনি কি এসব দেখেন না নাকি?”
“তোমার কি মনে হয় উনি চোখে ঠুলী পরে থাকেন? সবকিছু উনার একটা ভড়ং আসলে। এভাবেই তো পাবলিসিটি বেশি হচ্ছে, নিজেকে তুলে ধরলে পাবলিকের আগ্রহ কমে যাবে না!”
অন্বেষা মাথা নাড়িয়ে দ্বিমত পোষণ করল,
“তুমি যাই বল, উনার লেখার গুণেই লোকে বই কেনে, শুধুমাত্র কৌতূহল থেকে নয়। ভদ্রলোক সত্যিকার অর্থেই ভালো লেখেন।”
“তা আর বলতে! তবে যাই বল, এই লোক প্রচন্ড দাম্ভিক, জার্নালিস্টদের মশা মাছি মনে করে মনে হয়!”
আগ্রহী হয়ে অণ্বেষা বলল,
“যাই বলো, আমার কিন্তু এই লোকের ব্যাপারে জানার কৌতূহল বাড়ছে।”
হেসে আতিক উত্তর দিল, “চেষ্টা করে দেখবে নাকি একবার? সুন্দরী জার্নালিস্টকে পাত্তা দিতেও পারে, কে জানে!”
শেষের দিকে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুর।
নিতান্তই ঠাট্টাচ্ছলে বলা কথাটা কেন যেন মাথায় চেপে বসল অন্বেষার। আর একবার কোন কিছুর ভূত মাথায় চাপলে সেটার পরিণতি না আসা পর্যন্ত থামতে জানে না মেয়েটা। কোনো একদিন ওর এক ক্লাসমেট টিপ্পনী কেটে বলেছিল,
“বাপের টাকায় ফুটানি সবাই করতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, আমাদের মত স্ট্রাগল করে তারপর আমাদের ব্যাপারে কথা বলতে এসো।”
সেই কথার বাস্তবায়ন করেছে, জীবন নিয়ে খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা কখনই ছিল না ওর, কিন্তু ওই কথাটা যেন তাঁতিয়ে দিয়েছিল। খুব একটা স্ট্রাগল করতে না হলেও অল্প সময়ে দেশের প্রথম সাড়ির একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ শুরু করে, ওর ফিচারগুলো সত্যিকার অর্থেই ভালো হয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনো বাবার টাকা নেয়নি। খুব বড় কিছু না হলেও নিজের একটা পরিচিতি দাঁড় করিয়েছে এরই মধ্যে। বাবা অনেক বলে কয়েও রাজী করাতে পারেননি। স্পষ্ট বলে দিয়েছিল,
“গিফট হিসেবে কিছু দিতে চাইলে দাও, কিন্তু নিজের প্রয়োজন আমি নিজেই এফোর্ড করব, তুমি কিছু বলতে আসবে না।”
বাবা প্রথমদিকে আফসোস করলেও এখন একজন গর্বিত পিতা তিনি। মেয়ের ছোট ছোট প্রাপ্তি তো তারও প্রাপ্তি।
দুই.
সম্পাদক সাহেব প্রথমে কিছুটা গাইগুই করলেও পরে অনুমতি দিলেন, যদি অসাধ্য সাধন করতে পারে তবে মন্দ কী! এই মেয়ের মধ্যে একটা স্পার্ক আছে, এটা মনে মনে স্বীকার করেন তিনি। না পারলে নাই, চেষ্টা তো করাই যায়।
অনুমতি আদায় করেই কাজে নেমে পরল অন্বেষা, প্রথমেই কল করল আবিদ শাহরিয়ারের নাম্বারে। কল রিসিভ হল না, নাছোড়বান্দার মত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখল। পঞ্চমবার সাড়া পাওয়া গেল,
“কে বলছেন?”
ক্যাটক্যাটে গলায় প্রশ্ন করল কেউ।
“আমি অন্বেষা আহমেদ, দৈনিক খবর প্রতিদিন থেকে। আবিদ শাহরি…”
বাকীটা বলার আগেই শুনলো,
“দেখুন, স্যার কোনো ইন্টারভিউ দেন না, তারপরও কেন বারবার বিরক্ত করেন আপনারা? আর কখনো বিরক্ত করবেন না।”
ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খট করে লাইন কেটে দিল। কিছুটা দমে গেলেও হাল ছাড়ল না ও। সাংবাদিকতায় এসব খুব সাধারণ ব্যাপার হলেও কেন যেন গায়ে লাগল অপমানটা। আরও কয়েকবার চেষ্টা করেও সাড়া পেল না।
সেদিনের মত রণে ভঙ্গ দিলেও পরেরদিন চলে গেল আবিদ শাহরিয়ারের বাসার সামনে। এভাবেও লাভ হল না, ফলাফল শূন্যই রইল। হঠাৎ করে কী একটা ছেলেমানুষী ভূত মাথায় চেপে বসল,
“আবিদ… আবিদ শাহরিয়ার…” বলে চিৎকার করা শুরু করল। এত মাধ্যম ওর ভালো লাগছে না, সরাসরি আবিদের সাথেই কথা বলতে চায় ও। কিন্তু এবারও লাভ হলো না, উল্টো ভেতর থেকে সিকিউরিটি গার্ড এসে ওকে জায়গাটা দ্রুত খালি করতে বলল।
রাগে, অপমানে চোখ-মুখ টকটক করতে লাগল। রোখ চেপে গেল যেন! এত্ত অহংকার, এত্ত দাম্ভিকতা! এই লোকের ইন্টারভিউ তো নিয়েই ছাড়বে অন্বেষা, যেভাবেই হোক, প্রতিজ্ঞা করল নিজের কাছেই। কিছুক্ষণ পরেই পত্রিকা অফিস থেকে জানানো হলো, এসব আপাতত বন্ধ করতে, অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইন্টারভিউ নেবার জন্য। কিন্তু কারও বাড়ির সামনে গিয়ে তার শান্তি নষ্ট করার জন্য নয়! এরপর যেন এরকম না হয়। মোটামুটি একটা ওয়ার্নিং পেল।
“এর মধ্যে কমপ্লেইনও করা হয়ে গেছে! এই লোককে এমনি এমনি ছাড়ব না, কক্ষণো না? কী মনে করে নিজেকে? চাকরি গেলে যাবে, তবুও এর শেষ দেখে তবে থামব আমি!”
রোখ চেপে গেছে মাথায়, ওর মা যখন বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় ওর বয়স তখন সবে পাঁচ, বাবা ওর কথা মাথায় রেখে বিয়ে করেননি আর। অফুরন্ত আদর পেলেও শাসন কখনো পায়নি ও। যত দিন গড়িয়েছে, তত রূপান্তরিত হয়েছে একরোখা আর জেদীতে। খামখেয়ালী আর একগুঁয়েমি ওর মাথায় সহজে চাপে না, কিন্তু একবার সেটা চাপলে শেষ তো ওকে দেখতেই হয়!
গাড়িতে বসে ওর এক বন্ধুকে ফোন করল, যার একটা ডিটেক্টিভ এজেন্সি আছে, নিজের পরিচয় দেয় ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ বলে।
“দোস্ত, তোর এজেন্সির কী অবস্থারে এখন?”
আনন্দ’র হতাশ গলা শোনা গেল,
“আর এজেন্সি, সারাদিন বসে থাকি, একটা ক্লায়েন্ট পাই না। এই দেশে এসব ডিটেকটিভদের কেউ পাত্তা টাত্তা দেয় না, বুঝলি?”
উৎসাহী হয়ে ও বলল, “তাইলে তো তোর কোন কাজ কর্ম নাই, তুই আমার কেইসটা নে তাহলে?”
“তোর আবার কিসের কেস?”
“একজনকে ফলো করবি, কোথায় কোথায় যায়, কী কী করে সব টাইম টু টাইম আমাকে জানাতে হবে?”
পেশাদারী সুরে বলল অণ্বেষা।
“কার? দোস্ত তুই কি আবার প্রেমে টেমে পরছিস নাকি? প্রেম করার আগে বাজিয়ে দেখতে চাস?”
“তোর মাথা, এই স্থুল বুদ্ধি নিয়ে তুই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হইতে গেছিস ক্যান আমার মাথায় ঢুকতেছে না। এইজন্যই তো ক্লায়েন্ট পাস না!”
আনন্দ বলল, “ঠিকঠাক পেমেন্ট করিস, আমি করে দেব। কারে ফলো করতে হবে তার নাম ঠিকানা, ছবি আরও যদি কোন ডিটেইল থাকে দে?”
“নাম- আবিদ শাহরিয়ার, পেশা লেখক, এড্রেস আমি তোরে টেক্সট করতেছি। পেমেন্ট নিয়ে চিন্তা করিস না, পেয়ে যাবি।”
আনন্দ যে হকচকিয়ে গেছে এটা ওর গলা শুনেই আন্দাজ করা যায়,
“কী বলিস, তুই উনার পেছনে পড়ছিস ক্যান? আর উনি যদি টের পায় তো তোর সাথে সাথে আমারও জেলে যাওয়া লাগব!”
“তুই ডিটেকটিভ কেন সাজছিস এইটাই বুঝতেছি না আমি, এইটুকু ইঁদুরের কলিজা নিয়ে তুই এই প্রফেশনে আসলি কেন? রিস্কতো থাকবেই তুই সাবধানে থাকবি, তারে দেখায়ে দেখায়ে তো আর ফলো করবি না, গাধা?”
“আরে, এইটা আমার প্রফেশন নাকি, বেকার পরিচয় দিতে আর ভাল্লাগে না। তাই এই ভং ধরছি! প্রেস্টিজ থাকে না বেকার বললে। এইটা একটা কাভার বলতে পারিস।”
“এইরকম আইডিয়া তোর মোটা মাথা থেকেই বের হওয়া সম্ভব! আমার কাজটা ঠিকঠাক মতো করিস, ক্লায়েন্ট আমি নিজে জোগাড় করে দিব।”
রাজী হয়ে ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আনন্দ, ও শতভাগ নিশ্চিত এই প্রচন্ড একরোখা মেয়েটির খেয়ালীপনার খেসারত দিতে হবে ওকেও। নিজেও ডুববে সাথে ওকেও ডুবিয়ে ছাড়বে!
……….