বাসন্তী
পর্ব- ৩৯
#লেখা-লিমু

-” প্রণয় ক্লিনিক থেকে বের হয়েই দেখে প্রিয়ম সামনে দাঁড়িয়ে। প্রিয়ম কি করে জানলো প্রণয় এখানে আছে?
যাক, সেসব ভাবার সময় এখন প্রণয়ের নেই।
প্রণয় ভেবে পাচ্ছে না,কিভাবে সে পুষ্পর নাগাল পাবে।
শিট!
একবার কেন জিজ্ঞেস করলো না পুষ্প কোথায় থাকে?
এখন এভাবে একজন মানুষকে খুঁজে বের করা কি আদৌ সম্ভব!
রাগে গাড়িতে একটা লাথি মারলো প্রণয়।
প্রিয়ম সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

-” এনিথিং রং ব্রো ?”

-” এভরিথিং ওয়াজ রং,কমপ্লিটলি রং।”

-” প্রিয়ম কিছুই বুঝতে পারলনা। প্রণয় এখানেই বা কেন এসেছে হঠাৎ? সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগছে প্রিয়মের। প্রিয়মকে কি পুষ্পর ব্যাপারটা বলা ঠিক হবে? না বলেও তো আর কোন উপায় নেই। প্রিয়ম বললো,

-” একটা নিউজ আছে ব্রো। ”

-” আমার লাইফে এখন আর কোন নিউজ নেই,সব ব্যাড নিউজ। ”

-” আপুর সামনের মাসের ১২ তারিখ বিয়ে। প্রিয়ম পুষ্পকে আপুই বলতো,যদিও সেম এজ ওদের। প্রিয়মের কথা শুনে প্রণয় একটুও চমকালো না, সেটা দেখে প্রিয়ম আশ্চর্য হলো। ”

-” প্রিয়মকে আরেকটু আশ্চর্য করতে, প্রণয় বললো,

-” তার মানে বিয়ে হয়নি? ”

-” নাহ,হবে। কিন্তু তুমি এভাবে বলছো কেন?”

-” কারন পুষ্পর সাথে আমার আজকে দেখা হয়েছে,কথাও হয়েছে। আর ওর উডবি হাসব্যান্ডকেও দেখেছি। এটা শুনে প্রিয়ম চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর বললো,

-” কি বলছো তুমি? কি কথা হয়েছে,আর তুমি এখানে মেহের আপির কাছে কেন?

-” এতো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় নেই। আমাকে এখন পুষ্পর মুখোমুখি হতে হবে,কিন্তু কিভাবে! ”

-” সেই ব্যবস্থা না হয় আমিই করে দিচ্ছি। ”

-” প্রণয় বললো,তুই করবি মানে? ”

-” বাসায় চলো। তার আগে চট্টগ্রামে যাওয়ার দুটো ট্রেন টিকিট কাটো। আজ রাতেই চট্টগ্রাম যাবো আমরা। ”

-” প্রণয় মৃদুস্বরে বললো,তার মানে আমার বাসন্তী সাগরপাড়ে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে। আমি আসছি মিস আফরা পুষ্প। তুমি আমার হবে কিনা জানিনা,শুধু আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই। এই তোমার বিশ্বাস ছিলো তোমার প্রণয়ের প্রতি। এতবড় ভুল কি করে করলে,এ ভুলের যে ক্ষমা নেই। চূড়ান্ত শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। আমি নিজে তোমাকে সেই শাস্তি দিবো। তৈরি রাখো নিজেকে,আসছি আমি।

প্রিয়ম কি করে কি জানলো,সেসব জানার বা জিজ্ঞেস করার মতো সময় প্রণয়ের নেই। তার এখন একটাই উদ্দেশ্য, আর সেটা হলো তার বাসন্তীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। অবশ্য ভয় নেই,ফাঁসির কাষ্টে ঝুঁলাবে না, খুব বেশিই ভালোবেসেছিল যে। বেসেছিল কেন বলছে,এখনও বাসে। তবে সেটা কেউ টের পাবেনা,পুষ্প নিজেও না।
প্রণয় পুষ্পকে নিজের করতে যাচ্ছে না,শুধু ওর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। তারপর পুষ্প যার ঘরনী হতে চাই,হোক। প্রণয় তার বুক ভরা প্রণয়,বুকেই দাফন করে দিবে।

যেখানে বিশ্বাস নেই,সেখানে আর যাই হোক ভালোবাসা থাকতে পারে না। ভালোবাসার অস্তিত্বের সাথে, বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জানালার গ্রিল ধরে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে,, আছে পুষ্প। হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টি ঝরছে। আকাশেরও কি মন খারাপ আজ পুষ্পর মতো!”
আকাশ কাঁদছে,পুষ্পও কাঁদছে। দুই কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একটু বৃষ্টির ফোটা ছোঁয়ার চেষ্টা করলো। হালকা বাতাস বইছে,আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কেমন একটা গুমোট আবহাওয়া। কেমন একটা নিস্তব্ধতা প্রকৃতি জুরে। কিসের যেন শূন্যতা,ব্যাথা। আকাশ কিছুটা কালো মেঘে ঢাকা,কিছুটা ধূসর। বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোটাগুলো জানালার কাঁচ বেয়ে বেয়ে পড়ছে।
পুরো প্রকৃতি যেন পুষ্পর মনের খবর জেনে,এমন ব্যাথাতুর সাজে সেজেছে। প্রকৃতি আর মানুষের মনের সাথে কি কোন যোগসূত্র আছে? কি জানি থাকতেও পারে।
মানুষের মন তার ধরণ বদলায়,আর প্রকৃতি তার রূপ বদলায়।
বৃষ্টির জলের সাথে সাথে পুষ্পর চোখের জলও অনবরত গড়িয়ে পড়ছে।
রাত বাড়ছে,আর বাড়ছে বিষণ্নতা। দুটো হৃদয় ঢুকরে কাঁদছে,পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রনায়।
ট্রেনে বসে বাইরের টুপটাপ বৃষ্টি পরা দেখছে প্রণয়। এই সময় বৃষ্টি,সত্যি খুব অবাক করার মতো। মানুষের মনের খবরই বুঝা দায়,আর সেখানে প্রকৃতির অবস্থা এ আর এমন কি।

দুজনই জানালায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। একজন ট্রেনের,আরেকজন নিজ রুমে। শত ক্রোশ দূরে থেকেও, তবুও কি অদ্ভুত সাদৃশ্য দুজনের মধ্যে। দুজনের হৃদয়ই একজন আরেকজনের নাম জপছে,অথচ মুখে কাঠিন্য। জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন?”

যাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি,তার কাছ থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়।
যার সাথে এক হওয়ার, এক ছাদের নিচে থাকার স্বপ্ন সাজায়,তার থেকেই নিজেকে আড়াল করে রাখতে হয়,কেন?
ভালোবাসি,তবুও মুখে বলা যায় না।
কেউ কি বুঝে এই যন্ত্রণা?
জানি,কেউ বুঝেনা। সবাই ভাবে আমি স্বার্থপর। সত্যি কি তাই?
আসলেই,হয়তো স্বার্থপরই আমি।
তা না হলে কি করে এভাবে আছি এতোটা দিন ধরে?
হ্যা, আমি স্বার্থপর।
শুনছেন,মিস্টার প্রণয় মেহবুব…..

-” আপনার পুষ্প স্বার্থপর,খুব খুব খুব স্বার্থপর।
কিন্তু আপনি কি জানেন,এই স্বার্থপর মেয়েটা আপনাকে নিজের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলো। হৃদয়ের প্রতিটি কাঁপন আপনার জন্যই ছিলো,আছে এবং থাকবে। শুধু আপনি সেটা কোনদিনও জানবেন না।
আপনি জানবেন,চিনবেন একজন স্বার্থপর পুষ্পকে। যে আপনার সাথে এক হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে,সারাজীবনের জন্য দূরে চলে গেলাম। তবুও আপনি ভালো থাকবেন। আমি আসলেই অলীক স্বপ্ন বুনে ফেলেছিলাম হয়তো। তাই স্বপ্নের চূড়ায় যাওয়ার আগেই,ছিটকে সরে গেলাম।
হয়তো অল্প কিছুদিন আপনার ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য
ছিলো আমার,সারাজীবন এতো ভালোবাসা পাওয়ার মতো ভাগ্যবতী হয়তো নয়।
সেটা হয়তো অন্য কেউ।
ফজরের আযান কানে ভেসে এলো পুষ্পর। সারারাত এভাবে জানালার পাশে বসেই কাঁটিয়ে দিলো। দু’চোখ শুকিয়ে গেছে,চোখের জলও বোধহয় ফুরিয়ে গেছে ঝরতে ঝরতে। তিনটা বছরের প্রতিটা রাত,পুষ্পর চোখের জলের নীরব সাক্ষী।

শুধু দিনের আলোতে পুষ্প হাসিখুশি পুষ্প হয়ে থাকে সবার সামনে। মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়। নিজের এতো সুন্দর ভালো থাকার অভিনয় দেখে।
অবশ্য আমরা সবাই প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় করি।
সব ব্যাথা যে প্রকাশ করার নয়।
বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে গেল নামাযের ওজু করার জন্য। যতই মনে কষ্ট থাকুক,নামায পড়লে একটা প্রশান্তি বিরাজ করে।
নামায শেষে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো পুষ্প। আকাশটা এখনো পরিষ্কার হয় নি। আবছা আলো চারদিকে বিদ্যমান। হঠাৎ কেমন যেন একটা ছায়ামূর্তি দেখলো বলে মনে হলো পুষ্পর। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলো নেই। ভাবলো হয়তো মনের ভ্রম।
বৃষ্টি নেই এখন। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে।
পুষ্প আবছা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-” এই নতুন দিনের মিষ্টি ভোরের সাথে,আপনার জীবনটাও রঙিন হয়ে উঠুক। আর আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিয়েন মিস্টার মেহবুব। এটা বলে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে রইলো পুষ্প। নিঃশব্দে বাঁধ না মানা চোখের অশ্রু গড়িয়ে পরছে।

-” ক্ষমা চাইলেই কি সবসময় ক্ষমা পাওয়া যায়,মিস আফরা পুষ্প?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here