বাসন্তী
পর্ব- ৩৮
#লেখা-লিমু
-” প্রায় ফুল স্পিডে গাড়ি চালিয়ে মেহেরদের বাসায় গেল প্রণয়। কিন্তু মেহের তখন ক্লিনিকে। অগত্যা আবার গাড়ি ঘোরালো সে। ওর ফুফাতো বোন মেহের। ছোট থেকেই প্রণয়ের প্রতি দুর্বলতা ছিল ওর। প্রণয় সেটা জানে। কিন্তু কখনোই বোনের বাইরে অন্য কোন দৃষ্টিতে দেখেনি সে।
কখনোই কোন ফিলিংস তৈরি হয়নি ওর প্রতি। যদিও সে একদম সুন্দরী এবং সাথে মেধাবী। যাকে বলে বিউটি উইথ ব্রেইন। কিন্তু সেসব কিছুই প্রণয়কে আকৃষ্ট করতে পারেনি ওর প্রতি। প্রণয় যখন বুঝতে পারলো ওর উয়িকনেস,তখনি ওকে সরাসরি সব বলে দিলো।
যদিও তারপরও মেহের আশা ছাড়ে নি। প্রণয়ের থেকে ছয় বছরের ছোট সে। প্রণয়ের মাও জানতো যে,মেহের প্রণয়কে পছন্দ করে। কিন্তু ছেলের মত শুনে, আর জোরাজুরি করেন নি। কারন তার কাছে ছেলের পছন্দ সবার আগে। এতে অবশ্য ননদের সাথে উনার সম্পর্কটা একটু বদলে গেল। কারন তারাও প্রণয়কে তাদের মেয়ের জামাই করতে চেয়েছিলেন।
প্রণয় পুষ্পর বিষয়ে সব মেহের কে বলেছিলো। এমনকি পুষ্পর ঐ একসিডেন্টের পর মেহেরই পুষ্পকে রেগুলার চেকআপ করতো। যেহেতু পুষ্পর মা কোন আইনি ঝামেলাই যেতে চাননি,তাই প্রণয় ওর কাজিনকেই সবটা খুলে বলেছিল। প্রণয় অবশ্য চেয়েছিল পুলিশ কেস করতে। কিন্তু পুষ্পর মা নিষেধ করেন। কারন এদেশে ধর্ষকের বিচার নেই। উল্টো মেয়েটাকে সবার সামনে চিহ্নিত করা হয়। সারাদেশের মানুষ এটা জানে যে, এই মেয়েটা ধর্ষিত হয়েছে। কিন্তু কখনোই এটা জানতে পারেনা, রেপিস্ট কে। সে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
তাই পুষ্পর বিষয়টা আর সামনে আনতে দেয়নি পুষ্পর মা। শুধু পুষ্পর মা নয়,এদেশে অনেকেই এই ধর্ষণ বিষয়টা চেপে যেতেই পছন্দ করে। কারন তারা ভাবে,পুলিশ কেস করলে যতটুকু সম্মান অবশিষ্ট থাকে,সেটাও খোঁয়াবে। আর বিচার পাওয়া,সেটাতো কল্পনা।
তাই একটা মেয়ে নিজের সব সম্মান হারিয়েও,অবশিষ্ট সম্মান নিয়ে সমাজে যেন টিকে থাকতে পারে, সেই চেষ্টা করে। কারন সমাজও সেই মেয়েটাকে, অন্য চোখে দেখে। যেন মেয়েটাই অপরাধী।
এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে মেহেরের ক্লিনিকের সামনে এসে নামলো প্রণয়। কিন্তু মেহের তখন অটিতে। অপারেশনের রোগী আছে,তাই একটু সময় লাগবে। প্রণয়ের যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কারন সে কিছুতেই বুঝতে পারছেনা,পুষ্প কেন মেহেরকে জিজ্ঞেস করতে বললো। মেহের কি জানবে? আর সেটার সাথে পুষ্পর এমন আচরণ করার কি মানে? মাথাটা একদম কাজ করছেনা প্রণয়ের। এতো ভয় কাজ করছে মনে,কিন্তু কেন সেটা জানেনা। এক অজানা ভয় প্রণয়কে গ্রাস করছে। আচ্ছা পুষ্পর কি বিয়ে হয়ে গেছে? সাথের লোকটা কি ওর হাসবেন্ড ছিল?
এটা ভাবতেই প্রণয়ের বুকটা হু হু করে ঢুকরে কেঁদে উঠলো।
আবার কেন যেন মনে হচ্ছে, হয়তো বিয়ে হয়নি। এটা ভেবে নিজেকে একটু নরমাল রাখার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু অস্থিরতা যেন বেড়েই চলছে। প্রণয় দু’হাত মুখে চেপে মাথা নিচু করে ওয়েটিং রুমে বসেছিল।
হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেলো। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে মেহের দাঁড়িয়ে, ওর চোখেমুখে বিস্ময়। কারন যে প্রণয়ের কথা শুনতেও মেহেরকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়,সে কিনা আজ এতোদিন পর চোখের সামনে বসে। মেহের একটা চিমটি কাটলো নিজের শরীরে। তারপর একদম ঠান্ডা গলায় বললো,
—” সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছিল,অমাবস্যার চাঁদ আমার সামনে সশরীরে উপস্থিত। প্রণয়ের যেন মেহেরের কথায় কোন বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রণয়ও যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে মেহেরকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
—” যা জিজ্ঞেস করবো,সরাসরি উত্তর দিবি। কোন ঘোরপ্যাঁচের কথা আমার পছন্দ নয়। মেহের বোধহয় এবার একটু ঘাবড়ে গেল প্রণয়ের কথার স্বরটা শুনে,আর ওর চোখমুখ দেখে। প্রণয়ের চোখদুটো মনে হয় রাগে জ্বলছে,যেটা মেহেরের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। একঢোক গিলে বললো,”কি বলবে বলো। আর এভাবে কথা বলছো কেন?
-” পুষ্পকে তুই কি বলেছিলি ঐদিন?”
-” মেহের মনে আতঙ্ক নিয়ে বললো,কোনদিন?
-” কথা জেনেও না জানার ভান করিস না। তুই অনেক ইন্টেলিজেন্ট একটা মেয়ে সেটা আমি জানি,তাই বোকা সাজার চেষ্টাও করিস না। এবার মেহেরের হাত পা ঘামতে লাগলো।
কথা আটকে আটকে আসছে ওর। তবুও তোতলিয়ে তোতলিয়ে বললো,
-” আমি আবার কি বলবো?”
-” তুই ঘামছিস কেন? ”
-” কই,ঘামছি না তো। গরম পড়েছে আজকে বেশ।”
-” শীতের মধ্যেও তোর গরম লাগছে তাই না? ”
-” মেহের কি বলবে এবার কিছু ভেবে পাচ্ছে না। ”
-” দেখ,আমি জানি তুই মিথ্যে বলছিস। তাই আর ভণিতা না করে সরাসরি সব বলে দে আমাকে। কি এমন বলেছিস যে,পুষ্প এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো? ”
-” মেহের একদম নিশ্চুপ,মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ”
-” এবার প্রণয় একটা চিৎকার দিল,”স্পিক আপ মেহের।”
মেহের ভয়ে একঢোক গিললো। তারপর প্রনয়কে বললো,
-” ভাই, এটা হাসপাতাল। তাই চিৎকার করো না,আস্তে কথা বলো প্লিজ। ”
-” দেখ,চিৎকার করার কোন শখ আমার নেই। এটা যে হাসপাতাল, এতোটুকু সেন্স আমার আছে। কিন্তু তুই আমাকে চিৎকার করতে বাধ্য করছিস। যা জিজ্ঞেস করছি ক্লিয়ারকাট বলে দে,আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আগে। আর নয়তো আমি ভুলে যাবো যে,তুই আমার বোন হোস,তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে।
-” এবার মেহের আর চুপ থাকতে পারলনা। বুঝতে পারলো কিছু না বললে প্রণয় এখানে প্রলয়ংকারী ঝড় বাঁধিয়ে দিবে।
আমতা আমতা করতে লাগলো মেহের। তখন প্রণয় আরো জোরে একটা ধমক দিলো,সাথে সাথে মেহের কেঁপে উঠলো। আর প্রায় একনিঃশ্বাসে বলে দিল,
-” আমি পুষ্পকে বলেছিলাম তুমি ওর প্রতি করুণা দেখাচ্ছো,কোন ভালোবাসা নেই তোমার মনে। তুমি তোমার একটা আলাদা ইমেজ তৈরি করার জন্যই,ওকে বিয়ে করতে চাইছো। সম্পূর্ণ ইউজ করছো ওকে,সময়ে ঠিকই ছুড়ে ফেলে দিবে। আর হাই কোয়ালিফাইড সোসাইটির কাউকে বিয়ে করবে,ঠিক আমার মতো স্মার্ট সুন্দরী কোন মেয়েকে। আর নয়তো ওর মতো মেয়েদের সাধারণ ঘরের কোন ছেলেও বিয়ে করবে না,আর সেখানে তুমি তো সেলিব্রিটি বলা চলে। মেহের আর কিছু বলার আগে একটু প্রণয়ের চোখের দিকে তাকালো,সাথে সাথে ভয়ে ওর আত্না শুকিয়ে গেল। প্রণয়ের চোখ দিয়ে মনে হয় আগুন বের হচ্ছে, ওর পুরো মুখ কেমন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মাথার পাশে কপালের শিরা-উপশিরাগুলো অনবরত লাফাচ্ছে। মেহের একরাশ আতঙ্ক নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
-” ঐ মেয়ে তোমার যোগ্য নয়,তার মধ্যে আবার রে…
-” কথাটুকু শেষ করার আগেই মেহের ওর গালে কিছু অনুভব করতে পারলো। গালে হাত ধরে প্রায় কেঁদে দিলো,ভাবতেই পারছেনা প্রণয় ওর গায়ে হাত তুলেছে। আর ঐদিকে প্রণয় রাগে রি রি করছে। মনচাইছে আরো কয়েকটা থাপ্পড় দিতে মেহেরের গালে,কিন্তু হাসপাতাল তাই ছেড়ে দিলো। শুধু বললো,
-” তুই নিজে একটা মেয়ে,আর তারচেয়েও বড় বিষয় তুই একজন ডাক্তার। তোর মনমানসিকতা এতো নীচ হয় কি করে রে? এই তোর শিক্ষা না রে? তোর এমন মেধার উপর থু থু ফেলি আমি। একটা মেয়ে হয়ে কোথায় এমন একটা মেয়ের সাপোর্ট হবি,তা না করে তুই কি করলি?
সত্যি আমার লজ্জা লাগছে যে,তুই আমার আপন ফুফাতো বোন। অন্য কেউ হলে,আরো কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম। তুই কেন এমনটা করলি?
-” মেহেরের সহজ জবাব তোমাকে পাওয়ার জন্য।
-” প্রণয় একরাশ বিস্ময় নিয়ে মেহেরের দিকে তাকালো।
-” সেই স্কুল থেকে তোমাকে ভালোবাসি,কিন্তু এতো সুন্দরী হওয়া স্বত্তেও তুমি কোনদিন ভালো করে তাকিয়েও দেখো নি আমাকে। অথচ ঐ কালো মেয়েটাকে তুমি হঠাৎ দেখেই বিয়ে করে ফেলার ডিশিসান নিয়ে নিলে। হোয়াই আনসার মি? আমি কি ওর থেকে বেটার নয়? তবুও কেন তুমি ওকেই ভালোবাসো,হোয়াই?
—” প্রণয় পুরো বোকা বনে গেল। জাস্ট ওকে পাওয়ার জন্য, মেহের এমন কোন স্টেপ নিতে পারে সেটা প্রণয়ের ভাবনার বাইরে। অথচ মেহের তো এতো হিংসুটে ছিলো না। আসলেই ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়। কাউকে ভালো করে তোলে,আবার কাউকে ঈর্ষাপূর্ণ করে তোলে। আর তখন সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে, যা খুশি তাই করতে পারে। যেমনটা মেহের করেছে। মেহেরকে আর কিছু বলার নেই প্রণয়ের,তাই সেখান থেকে চলে যেতে নিলো। পেছন থেকে মেহের প্রণয়ের হাত চেপে ধরলো,প্রণয় সেটা হ্যাচকা টানে সরিয়ে নিলো। মেহের কেঁদে কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো,কিন্তু প্রণয় চললো পুষ্পকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে। পুষ্পর মুখোমুখি যে হতে হবে ওকে।
আর মেহেরকে মনে মনে বললো,
একতরফা ভালোবাসা সফল হয় না কখনো। তাই সেটা বুঝে আগেই তোর নিজেকে সামলে নেয়া উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজ তোর জীবনেও অন্যরকম হতো,আর আমারটাও। কিন্তু এখনতো সব শেষ করে দিলি।
প্রণয় পুষ্পর সাথে দেখা করবে,কিন্তু কিভাবে?
ওতো পুষ্প কোথায় থাকে,তার কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। এমনকি ফোন নাম্বারও নেই।
কোথায় খুঁজবে প্রণয় তার বাসন্তীকে!”
#চলবে…