বাসন্তী
পর্ব- ৩৬
#লেখা-লিমু

___” বিকালে ছাদে দাঁড়িয়ে এয়ারফোন দিয়ে গান শুনছিলো কলি। আর আনমনে কি যেন ভাবছিলো। মাথায় কাপড় দেয়া,তাই কানে যে এয়ারফোন গুঁজা সেটা পেছন থেকে বুঝার উপায় নেই। সেই কখন থেকে পুষ্প ডাকছে,কিন্তু কলির কোন সাড়া নেই। সহসা কলির সামনে গিয়ে টান দিয়ে এয়ারফোনটা খুলে ফেলে,সাথে সাথে জোরে গান বেজে উঠে। আর কলি একটু চমকে যায়,সেই সাথে পুষ্পও। কারন কলি যে সেই চিরচেনা সুরের মানুষের গানটাই শুনছে। কেন এমন করছে কলি!”
সেই সুর,যেটা শুনলেই বুকের ভেতরটা অসহনীয় ব্যাথায় পুরে।
মনে হয় এক অদ্ভুত ব্যাথা প্রতিনিয়ত হৃদয়টাকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করছে। অথচ কেউ জানেনা,কেউ দেখেনা,কেউ বুঝেনা সেই ভীষণ ব্যাথা।
মুহুর্তেই পুষ্পর মুখটা মলিন হয়ে যেতে দেখে কলি মনে মনে বলে, এই সুযোগ। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কি প্লান করবো। এখন দেখছি প্লান নিজে আমার কাছে ধরা দিয়েছে।
—” যেটা অতীত হয়ে গেছে,সেটা সামনে আসলে তো মন খারাপ করার কোন মানে হয় না। অতীতকে অতীতেই চাপা দিয়ে আসতে হয়,তুমিই বলো। তাহলে আজও কেন, তার সুরটা শুনলেই তুমি এমন দিশেহারা হয়ে পড়ো?
কেন এমন বিপর্যস্ত হয়ে যায় তোমার মুখখানি?
সবার থেকে লুকাতে পারলেও,আমাকে কি করে ফাঁকি দিবে? তোমার সবকিছু যে আমার জানা। তোমার মনের অলিতেগলিতে কোথায় কি ঘটে,সবতো আমার জানা ছিল।
শুধু একটা বিষয়ই বুঝতে পারলাম না। সেটাও খুব শীঘ্রই খুঁজে বের করবো আমি। এটা বলে একটা লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো কলি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

—” একটা সত্যি কথা বলো তো তুমি?

—” পুষ্প ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

—” তুমি এখনও ভালোবাসোনা ভাইয়াকে? এই প্রশ্ন শুনে মুহুর্তেই পুষ্পর মুখটা মলিন হয়ে গেল। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে,যে কলি এমন কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু তার উত্তর পুষ্পর জানা নেই। আর জানলেও সে উত্তর দেয়ার মতো সাহস আর পুষ্পর নেই। পুষ্পকে চুপ থাকতে দেখে বললো,

—” আমি জানি তুমি এখনো ভাইয়াকে ভালোবাসো,ঠিক আগে যেমনটা বাসতে। তারচেয়ে কম তো অবশ্যই নয়,হয়তো আরো বেশি। জানো তো, দূরত্ব শুধু ভালোবাসা কমায় না,বাড়ায়ও। তুমি এখনও ভাইয়াকে ভুলতে পারোনা,এবং কোনদিনও পারবেও না। আর এজন্যই তুমি অন্য কোথাও বিয়ে করতে চাও না। কারন আরেকজন মানুষকে তুমি ঠকাতে চাইছোনা। কারন তাকে তুমি কোনদিনও ভালোবাসতে পারবেনা। আমিতো জানি,তোমার হৃদয়ে তুমি দ্বিতীয় কাউকে স্থান দিতে পারবেনা। তাহলে কেন এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো? আর যাকে এতো ভালোবাসো,তাকেই বা কি করে এতো কষ্ট দিচ্ছো? ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিলে নাকি সেই কষ্ট নিজেরই বেশি লাগে। তাহলে কেন এমন করছো বু? কি পাচ্ছো এমনটা করে? কিছু তো বলো অন্তত।

—” পুষ্পর চোখে জল টলমল করছে,কিন্তু পুষ্প সেটাকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আটকে রেখেছে। কিছুতেই পরতে দিবেনা, দুর্বল হবে না সে। একদম চোয়াল শক্ত করে, চোখমুখ গম্ভীর করে কলির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

—” আমি কাউকে ভালোবাসিনা। হ্যা ভালোবাসতাম,কিন্তু সেটা শুধুই অতীত এখন। সেটা আগেও বলেছি আমি। তবুও আবার বলে তোকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। আর তারপরও যদি তোর বিশ্বাস না হয়,তবে যা করলে তোর বিশ্বাস হবে, সেটাই করবো।
—” শেষের কথাটা শুনে কলি ঠিক বুঝতে পারলোনা,পুষ্প কি করতে চাইছে। তবে কলির মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে। সেই ভয়টাই না সত্যি হয়ে যায়। পুষ্প ছাদ থেকে চলে গেল। কলি দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো। দিনদিন ওর বু ওর ভাবনার বাইরে চলে যাচ্ছে। আর এখন যে কি করতে চলেছে,সেটা ভেবেই কলির হাত-পা কেমন করছে। এই মেয়ে নিশ্চিত এবার কোন উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিবে। কিন্তু কলি সেটা হতে দিতে পারেনা। তাই পুষ্পকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে। এভাবে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে, আর নিজের মানুষটাকে তীলে তীলে কষ্টে মেরে ফেলছে। কি যে হয়েছিল ঐদিন ওর কে জানে। কেন যে ওকে একা ছেড়েছিলাম সেদিন। যদি সাথে থাকতাম সারাক্ষণ, তাহলে হয়তো আজকে ওর জীবনটা অন্যরকম থাকতো। তবে, কিছুতো হয়েছিল সেদিন। কিন্তু সেটা যে ঠিক কি,তা তো কেউ বুঝতে পারছিনা। এতো মানুষের মধ্যে কি হয়েছিল, কি না হয়েছিল সেটা কি করে বুঝবে। তবে কলির মাথায় যতটুকু ধরছে,তা হলো ওকে কেউ কিছু বলেছে। তবে হঠাৎ বেঁহুশ কেন হয়ে গিয়েছিল,সেটাও তো রহস্য। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে,সব গুলিয়ে যাচ্ছে কলির।
উফফ…আর ভাবতে পারছেনা সে। মাথাটা ভনভন করছে ওর। কিন্তু এতো সহজে হার মানবে না কলি,একটা না একটা বুদ্ধি বের করবেই সে। ফোনে একটা নাম্বার ডায়াল করলো,একজনের সাথে একটু বিষয়টা আলোচনা করা দরকার। কারন তার সাহায্য ছাড়া, একা কিছু করতে পারবেনা।

সকাল হতেই বাড়িতে দুজন মহিলা এসে উপস্থিত। দুজনকে মহিলা বললে ভুল হবে,একজন মেয়ে। আরেকজন মহিলা। তবে এরা কারা,কলি তার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে পুষ্প আর ওর মাকে দেখে মনে হচ্ছে তারা চিনে উনাদের। তাদের সামনে কলি কিছু জিজ্ঞেস ও করতে পারছেনা। পুষ্পকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—” উনারা কেন এসেছেন,আর কেইবা তারা?
—” পুষ্প বললো,সেটা নিজেই দেখতে পাবি।
—” পুষ্পর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলোনা কলি। পুষ্পর যাওয়ার পানে,ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ের মাথায় কি চলছে, সেটা এক আল্লাহ আর সেই জানে। তবে নিশ্চিত উল্টাপাল্টা কিছু ওর মাথায় ঘুরছে। কলির টেনশন বাড়তে লাগলো। পুষ্প ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে উনাদের সামনে গেলো। বিষয়টা ঠিক সুবিধার লাগছে না কলির কাছে। যে ভয়টা সে করছিলো,সেটাই ঘটতে যাচ্ছে না তো। সেটা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সব প্লান ভেস্তে যাবে। টেনশন আর ভয়ে কলি এদিক ওদিক পায়চারি করছে,মাথার চুল ছিড়তে মন চাইছে।
অনেকক্ষণ পর উনারা চলে গেলেন। পুষ্প আর ওর মা কলির রুমে আসলেন। মায়ের মুখে হাসি,পুষ্প স্বাভাবিক। কলি মনে আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” উনারা কেন এসেছিলেন আম্মু?

—” তোর বু কে তাদের ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে। ছেলে তোর বু’র সাথেই চাকরি করে। অনেক ভালো পরিবার। পুষ্প ভালোই থাকবে আল্লাহর রহমতে।
—” কলির কান দিয়ে মনে হয় ধোঁয়া বের হতে লাগলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে পুষ্পর দিকে তাকালো। কিন্তু পুষ্প কেমন নির্লিপ্তভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কারন কলির চোখে চোখ রাখার সাহস তার নেই।
কলি ভেবে পাচ্ছে না,পুষ্প নিজের মনের সাথে জোর খাঁটিয়ে কি করে এমন একটা কাজ করতে চলেছে। কলি চোখেমুখে একরাশ বিরক্তির চিহ্ন এঁকে পুষ্পর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর কিছু না বলেই সামনে থেকে চলে গেল। রাগে মাথাটা ফেটে যেতে চাইছে কলির। পুষ্প যদি বড় বোন না হতো,তাহলে দুই গালে দুইটা ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে দিতো এতোক্ষণে। কি করবে, না করবে কিছু বুঝতে পারছেনা সে। একদম অসহায় লাগছে নিজেকে। কোন একটা উপায়ে তো বিয়েটা আটকাতে হবেই হবে। কিন্তু কি করে,সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। প্রয়োজনের সময় মাথাটাও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

হঠাৎ করেই কেন জানি প্রণয়ের মনটা খুব ছটফট করতে লাগলো। যদিও সবসময়ই তার বাসন্তীর জন্য হৃদয় পুরে,কিন্তু আজ কেন যেন বেশিই পুরছে। আজ তিনটি বছর ধরে প্রণয় তার বাসন্তীকে একপলকের জন্যও দেখতে পায় নি। পুষ্পর বান্ধবী তন্নীর বাসায় গিয়েছিল প্রথমে,কিন্তু তারা বলে যে পুষ্পর কোন খবর জানেনা। যদিও প্রণয় বুঝতে পেরেছিল যে, ওরা মিথ্যা বলছে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে না চাইলে,তাকে তো আর জোর করা যায় না। আর প্রণয় এটাও ভালো করে জানে,পুষ্পই নিষেধ করেছে ঠিকানা বলতে। তাই আর খোঁজার চেষ্টা করেনি সে।
তবুও এই তিনটা বছরের প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহুর্ত সে অপেক্ষা করে গেছে তার বাসন্তীর ফিরে আসার। মনে হতো,এই বুঝি ফিরে এলো। এসে একগাল হেসে সরি বলে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু সেটা যে শুধুই প্রণয়ের অবচেতন মনের নিছক কল্পনা।
কত নির্দয় হয়ে গেছে সে। কত অবলীলায় ভুলে আছে তাকে। সত্যি ভুলে গেছে সে?
এটা আমি বিশ্বাস করতে পারিনা কেন?
আমার কেন মনে হয় সব ভুলে আমার বাসন্তী আমার জীবনের রঙ ফিরিয়ে দিতে, ঠিকই ফিরে আসবে।
সত্যি আসবে কি সে?
নাকি আমাকে সারাজীবনের জন্য কাঁদিয়ে চলে যাবে দূর থেকে বহুদূরে।

আমিতো জানিই না সে কোথায় আছে,কেমন আছে। সে কি আমার কথা একবারও মনে করে না?
কোথায় আছো তুমি পুষ্প?
প্লিজ ফিরে এসো, আমাকে কিছু বলার সুযোগ তো দাও। কোন ভুল হয়ে থাকলে,সেটা শোধরানোর একটা সুযোগ তো দিবে।
তুমিতো আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলেনা।
এভাবে কেউ কাউকে ছেড়ে যায়,এতোটা কষ্ট দেয়।
কি করে পারলে তুমি!”

হঠাৎ করে ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে বসলো প্রণয়। সাথে শুকনা কাশি। প্রিয়ম জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল,প্রণয় যেতেই চাইছিলোনা। প্রিয়ম হালকা চেকআপ করিয়ে নিলো,কাশিতে কোন প্রবলেম ছিলো কিনা। রিপোর্ট দিতে একটু সময় লাগবে। তাই অপেক্ষার করছিলো বসে। প্রণয়ের বিরক্ত লাগছিলো,তাই একটু বাইরে বেরিয়ে গেল। হাসপাতালের সাথেই শপিং মল।

হঠাৎ প্রণয়ের চোখজোড়া আটকে গেল একটা মুখশ্রীর উপর।
সেই চিরচেনা মুখ,সেই মনভোলানো রূপ। সময়টা থমকে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। প্রণয় তার বাসন্তীকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মেটাক। অন্তরের তৃষ্ণা মেটাক। যেন হাজার বছরের তৃষ্ণায় ভুগছিল অন্তরচক্ষু।
সেই তৃষ্ণা মেটাতে প্রাণভরে দেখছিলো তার বাসন্তীকে।

ঠোঁটের কোণে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার রেখা বিস্তৃত হতে গিয়েও সংকীর্ণ হয়ে গেল। মুহুর্তেই ভালোলাগাটা বিষাদে পরিণত হলো। কালো মেঘে ছেয়ে গেল মনজমিন।
পুষ্প অন্য একজন পুরুষের সাথে একই রিকশায়, হেসে কথা বলছে।
প্রণয়ের ভেতর-বাহির দু’জায়গাতে একটা শান্ত ঝড় বয়ে গেল,তবে সে ঝড় তার ভেতরটা তছনছ করে দিয়ে গেল।
এতোদিন মনে একটা আশা ছিল,কিন্তু আজ! ”
সব শেষ,সব!
একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here