বাসন্তী
পর্ব- ৩১
লেখা-লিমু

পুষ্পর সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল চলছে। তাই পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত। তবে পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে,আর একটা পরীক্ষা আছে। তাই রাত জেগে পড়ছিল। কলি ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ মনে হলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ ফিসফিস করছে। শব্দটা কেমন জানি ভুতুড়ে। পুষ্প ভয়ে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। ভাবলো কলিকে ডাক দিবে কিনা। পরে ভাবলো কলিকে ডাক দিয়ে লাভ নেই,ওর যে গাঁধীর ঘুম। পুষ্পর পড়া প্রায় শেষের দিকে, তাই গুটি গুটি পায়ে টুপ করে কম্বলের ভেতর ঢুকে পড়লো। চোখমুখ জোর করে খিঁচে বন্ধ রাখার চেষ্টা করলো,বুক ভয়ে ঢিপঢিপ করছে। হঠাৎ ফিসফিসানি শব্দটা মনে হলো থেমে গেছে। পাখির বাসা থেকে পাখি যেমন কোন বিপদ সংকেত পেলে মুখটা একটু উঁকি দিয়ে দেখে,পুষ্প ও তেমন একটু করে মুখটা বের করে দরজার দিকে তাকালো। দরজার সামনে একটু ছোট্র কাগজের টুকরো। আজকাল ভূতেরাও চিঠি দেয় নাকি!”
পুষ্প একটু সাহস করে উঠে কাগজটা হাতে নিলো। সেখানে লিখা ছিল,
—–” ফোন সাইলেন্ট কেন?”
পুষ্প পড়ার সময় ফোন সাইলেন্ট রাখে,আর রাতেও ফোন ভাইব্রেশন করে রাখে। পুষ্পর বুঝতে অসুবিধা হলো না,এটা শিক্ষিত ভূত। পুষ্পর মাথায় দুষ্টুমি ভর করলো। টেবিলে গিয়ে বসলো। টেবিল লেম্পটা অন করলো। খাতায় লিখলো,
—” ভূতেরাও আজকাল শিক্ষিত হয়ে গেছে? তা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন ভুত বাবু?
এটা লিখে দরজার নিচ দিয়ে ওপাশে পাঠালো পুষ্প।
প্রণয় কপালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সহসা নিচে কাগজের টুকরো দেখতে পেল। সেটা হাতে নিয়ে প্রণয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। পুষ্পর কিছু কিছু কান্ড প্রনয়কে চূড়ান্ত বিস্ময়ে পৌঁছে দেয়। মেয়েটাকে দেখে বুঝার সাধ্য নেই, ভেতরে একটা দুষ্টু পুষ্প লুকিয়ে আছে।
প্রণয় এবার মেসেজ করলো,”দরজাটা আস্তে করে খোল,যেন কলি টের না পাই। পুষ্পর ফোন হাতেই ছিল। আলো জ্বলতেই দেখতে পেল মেসেজ। মেসেজ পড়ে পুষ্পর চোখ কপালে।
তাড়াতাড়ি জবাব দিল,এতোরাতে এখানে কি?
—” প্রণয় লিখলো,বলছি দরজা খোল।
—” পুষ্পর চোখ এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। টেনশনে ওর কপাল ঘামতে শুরু করলো। এতোরাতে কি দরকার হতে পারে? কেউ দেখলে কি ভাববে? যদিও সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, তবুও। এসব প্রশ্ন পুষ্পর মাথায় এলোপাতাড়ি ঘুরতে লাগলো। তখনি প্রণয় আবার মেসেজ দিল,
—” দরজা খোলবে চুপচাপ,নাকি আমি জোরে ডাক দিব?
তখন কেউ জেগে গেলে সেটার জন্য আমি দায়ী নয়। নাউ চয়েজ ইজ ইউরস।
মেসেজ দেখেই পুষ্প প্রায় সাথে সাথেই আস্তে করে দরজা খোললো। খোলেই দেখে প্রণয় দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প একবার প্রণয়ের হাতের দিকে তাকালো,আরেকবার মুখের দিকে। প্রণয় পুষ্পকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেল। পুষ্প তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে দিল। প্রণয় গিয়ে পুষ্পর পড়ার টেবিলের চেয়ারটায় বসলো। গ্লাসটা টেবিলে রাখলো। পুষ্প ওর সামনে আসতেই চোখে ইশারা করলো দুধটুকু খাওয়ার জন্য।
পুষ্প কোমড়ে একহাত দিয়ে প্রণয়ের সামনে দাঁড়ালো রাগী মুড নিয়ে। তারপর বললো,
—” এটার জন্য আপনি এতোরাতে এখানে?
—” হু,তুমি কি ভেবেছিলে?
—” আমি আবার কি ভাববো?
—” সামথিং?
—” হোয়াট?”
—” দেখ,তুমি যেটা ভেবেছিলে সেটার জন্য তো আমার লাইসেন্স লাগবে। কিন্তু আমার পোড়া কপাল, লাইসেন্স নেই। পেতেও আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তাই এখন ঐসব ভেবেও কোন লাভ নেই। খুবই একটা দুঃখী ভাব নিয়ে প্রণয় কথাগুলো বললো।
কথা শেষ করে পুষ্পর দিকে তাকালো,পুষ্পর চেহারা দেখে প্রণয়ের হালুয়া টাইট হয়ে গেল।
পুষ্প ধিম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর কান দিয়ে মনে হয় ধোঁয়া বের হচ্ছে। একটা মানুষ কতটা অসভ্য হলে পরে মাঝরাতে এসে এমন কথা বলতে পারে,তা পুষ্পর ভাবনার বাইরে। পুষ্পর হাত নিশপিশ করছিলো,কিন্তু এখন কিছু করা যাবে না। সুযোগটার ভালো ব্যবহারই করেছেন মিস্টার প্রণয় মেহবুব। আচ্ছা সুযোগ আমারও আসবে। এটা বলে পুষ্প প্রনয়ের সামনে গিয়ে কথা না বলে মেসেজ দিলো,কাজ শেষ হলে এবার ফুটুন এখান থেকে। তারপর গ্লাসের দুধটুকু খেয়ে নিলো। খালি গ্লাসটা প্রণয়ের হাতে ধরিয়ে দিল।

প্রণয় মেসেজ দেখে ছোট বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে কান্নার ভাব ধরলো। সেটা দেখে পুষ্প চোখ গরম করে তাকালো।
তা দেখে প্রণয় বাধ্য ছেলের মতো উঠে চলে যেতে নিলো। এতে অবশ্য পুষ্প বেশ অবাকই হলো। তাই প্রণয় যেন আবার দাঁড়িয়ে না পড়ে,সেজন্য দরজা পর্যন্ত পুষ্প পিছু পিছু গেল। কিন্তু ঐ পর্যন্ত যাওয়াটাই পুষ্পর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।
প্রণয় দরজা খোলে বের হওয়ার পরিবর্তে, হুট করেই পুষ্পকে পাঁজাকোলে তুলে নিল। পুষ্প চিৎকার করতে যেয়ে নিজেই নিজের মুখ দু’হাতে চেপে ধরলো। যেটা দেখে প্রণয় একটা দুষ্টু হাসি দিল। আর সেই হাসি দেখে ক্ষোভে পুষ্পর গা জ্বালা করছিলো। কোন কথাও বলতে পারছেনা। তাই রাগে চোখ বন্ধ করে রাখলো। তবে বেশ বুঝতে পারছে, প্রণয় ওকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। যখন প্রণয় থামলো,পুষ্প চোখ খুলতে যাবে কিন্তু তার আগেই প্রণয় ওর দু’চোখের পাতায় ঠোঁট ছোঁয়ালো। পুষ্প একদম শিউড়ে উঠলো। লজ্জায় এখন আর চোখ খুলতেই পারছেনা। এই ছেলেটা এমন অসভ্য কেন!”
প্রণয় পুষ্পকে দোলনায় নিয়ে গিয়ে বসালো। পুষ্প তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সেটা দেখে প্রণয় বললো,
—” চোখ খোল,আর নয়তো এখনি আমার তোমাকে বিয়ে করে ফেলতে মন চাইছে। কারন লাইসেন্স ছাড়া কিছু করে ফেললে, পরে আমি দায়ী থাকবোনা। এটা বলার সাথে সাথেই পুষ্প চোখ খুলে ফেললো,এবং ইয়া বড় রসগোল্লার মতো করলো চোখ দুটো। প্রণয় বললো,

—” এমন রসগোল্লার মতো করেছো কেন চোখ?

—” পুষ্প কোন কথা বলতে পারলনা,রাগে ফুঁসছে।

—” আরে তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছিলে,এটা না বললে তো চোখ খুলতেই না। তাই একটু ট্রিকস ব্যবহার করলাম আর কি। আর না হলে আমি এমনিতে একদম ভদ্র ছেলে।
পুষ্প মনে মনে বললো,কেমন ভদ্র ছেলে তার নমুনা তো দেখতেই পারছি। ঠিক তখনি প্রণয় বলে উঠলো,

—” অবশ্য হবু বউয়ের সাথে একটু-আধটু অসভ্যতামি করাই যায়,এতে বিশেষ কোন ভুল হয়ে যাবে না। এটা মনীষীরা বলেছেন। একথা শুনে পুষ্প বললো,

—” তা মনীষীর নামটা কি জানতে পারি?”

—” আরে নাম মনে থাকে নাকি। ঐসব তোমাদের সাহিত্যের স্টুডেন্টদের মনে থাকার কথা।
—” সেটা আমিও জানি। তবে এমন কোন কথা, কোন মনীষী বলেছে বলে আমার মনে হয় না।
—” আরে, তুমি কি সব মনীষীর কথা মুখস্থ করে ফেলেছো নাকি? হতেই পারে,এটা তুমি শোন নি।
—” পুষ্প বুঝতে পারলো,এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। জীবনেও কথায় হারবেনা।
—” তখন প্রণয়ই বললো,এখানে এসেও কি পড়াশুনার আলাপ করছো বলো তো? এমনিতেই পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে তোমার পাত্তাই পাওয়া যায় না। কি এতো পড়ো বলো তো? বাংলা এতো পড়ার কি আছে,এমনিই লিখা যায়।
—” তাই না?”
—” হু, তাই।
—” আচ্ছা আমি একটা প্রশ্ন করি উত্তর দেন তাহলে।
—” হুম করো। এসব কোন ব্যাপার নাকি,আমি সেকেন্ডে বলে দিব।
—” ওকে,গুড। বলুন, চর্যাপদের একমাত্র মহিলা কবির নাম কি? অনিলা দেবী কার ছদ্মনাম? অমিত,লাবণ্য কোন উপন্যাসের চরিত্র?

পুষ্প আরো প্রশ্ন করতে চাইছিল,কিন্তু প্রণয় তার আগেই হুট করেই পুষ্পকে আবার কোলে তুলে নিলো। পুষ্প প্রণয়ের চোখের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো,একই সাথে মনে বিস্ময় নিয়ে। করছেটা কি এ ছেলে!”
যখন মন চাইছে কোলে নিচ্ছে , আমি কি তার বিয়ে করা বউ?
কি করতে চাইছে, সেটাইত বুঝতে পারছিনা। হুট করে এতো রাতে ছাদে নিয়ে আসলো।আবার এখন কিছু না বলেই নিয়ে চলে যাচ্ছে। এসবের কোন মানে হয়।
সিঁড়ি দিয়ে নামছে প্রণয়। পুষ্প ফিসফিস করে বললো,

—” কি সমস্যা আপনার? কোলাতঙ্ক রোগ আছে নাকি?

—” প্রণয় এতোক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়েছিল,কিন্তু পুষ্পর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বললো,

—” জলাতঙ্ক রোগ শুনেছিলাম, কোলাতঙ্ক আবার কি?

—” এই যে যখন তখন কোলে তুলে নিচ্ছেন, এটা কোলাতঙ্ক রোগ। এটা শুনে প্রণয় জোরে হাসার ভান করলো,হাসলো ঠিকই, তবে শব্দ হলো না। সেটা দেখে পুষ্প অন্যদিকে মুখ ঘোরালো। প্রণয় এবার মুচকি হাসলো পুষ্পর ঈষৎ মুখ বাঁকানোতে।
রুমের সামনে এসে পুষ্প কোল থেকে নামার চেষ্টা করলো,কিন্তু পারলনা। পুষ্পকে না নামিয়ে ইশারায় দরজাটা খোলার কথা বললো। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে পুষ্প দরজাটা আস্তে করে খুললো। পুষ্পকে একদম বিছানায় নিয়ে গিয়ে কোল থেকে নামালো। পুষ্প যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রণয় চলে যেতেই দু’চোখ বুজে পুষ্প একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। কয়েক মিনিট পর চোখ খুলে দেখে প্রণয় আবার ওর সামনে দাঁড়িয়ে। পকেটে দুইহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে,ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা হাসি বিদ্যমান। প্রণয়ের চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ সরিয়ে নিলো পুষ্প।
প্রণয় পুষ্পর সামনে হাটুঘেরে বসলো। তারপর মুখটা দুঃখী ভাব করে বললো,
ভেবেছিলাম একটু যত্ন নেয়ার ছলে রোমান্স করবো,কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার নেই। সেখানে গিয়েও পড়ার আলাপ শুরু। তাই নিয়ে আসলাম। এখন যত পড়ার পড়ো। বিয়ের পর আমি যা পড়াবো,তাই পড়তে হবে।
আমার সিলেবাসটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো? অবশ্য না বুঝলেও সমস্যা নেই। তেমন কঠিন কোন সিলেবাস না। প্রিপারেশান না নিলেও শুধু এটেন্ড করলেই পাস করে যাবে। আমি আবার এতো কড়া পরীক্ষক না। সহজেই পাস মার্ক দিয়ে দিবো। এটা বলেই প্রণয় চোখ টিপলো।
আর পুষ্প হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো,একটা পঁচিশ বাজে। পুষ্পর দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রণয়ও ঘড়ির দিকে তাকালো। সময় দেখে একহাতে কান ধরে সরি বললো। পুষ্পকে গুড নাইট বলে চলে গেল। পুষ্প দরজা লক করার জন্য উঠে আসলো। যখন দরজা লাগাতে যাবে,দরজার ওপাশ থেকে আকস্মাৎ প্রণয় বলে উঠলো,
——-” আই লাভ ইউ বউ। এটা বলেই চলে গেল। আর পুষ্প দরজা বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে ঠাঁয় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলে গেল, বউ!” পুষ্পর হৃদয়ে ছোট্র একটা খুশির লহর বয়ে গেল, চোখ থেকে একটা ভালোবাসার অশ্রু ঝরে পড়লো। এতো ভালোবাসা কি পাবার যোগ্য সে! এটা ভেবেই দু’চোখ ভারী হয়ে উঠলো। কি যেন এক অজানা ভয় পুষ্পকে তাড়া করে ফিরে। যেন আচমকায় সব কিছু বালুর ঝড়ের মতো শেষ হয়ে যাবে। পুষ্প যে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে,সেটা কি স্বপ্নই থেকে যাবে। ওর ভালোবাসা কি অধরাই থেকে যাবে!”

এবছরের প্লে-ব্যাক সিংগার হিসেবে প্রণয় নমিনেশন পেয়েছে।
অনেকটা উত্তেজনা কাজ করছে,একেই সাথে নার্ভাসনেস।
প্রথমবার ফিল্মে রেকর্ডিং করলো,সেটাই নমিনেশন পেয়েছে। পুরস্কার পাবে কি পাবে না,তা জানেনা। তবে নমিনেশন পাওয়াটাই কম কিসে?
সবাই ভীষণ খুশি।
এই প্রোগ্রামে প্রণয় পুষ্পকে সারপ্রাইজ দিতে যাচ্ছে। ওর সাথে পুষ্পও যাবে অনুষ্ঠানে। পুষ্প অবশ্য যেতে চাইছিলো না। কিন্তু প্রণয়ের মায়ের কথায় যেতে মানলো। উনার কথা ফেলতে পারে না পুষ্প। নিজের মায়ের মতো আরেকজন মা যে পেয়েছে।
পুষ্পকে পার্লার থেকে সাজিয়ে আনলো পাপড়ি নিজে গিয়ে। একটা এ্যাশ আর ব্লু কম্বিনেশনের গাউন পরেছে পুষ্প। চুল কার্ল করে একপাশে রাখা। তেমন গাঢ় মেকআপ পুষ্পর পছন্দ না,তাই হালকা মেকআপই করেছে।
প্রোগ্রামে প্রণয়ের হাত ধরেই পুষ্প প্রবেশ করলো। সেখানে সব বড় বড় সিংগার,অভিনেতা,ডিরেক্টর সব উপস্থিত। ওরা প্রবেশ করতেই বেশ কিছু ক্যামেরার ফ্লাশ জলে উঠলো পর পর। অনেকে অনেক কথা বলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। কারন পুষ্প একদম সাদামাটা একটা মেয়ে। তাই প্রণয়ের মতো এরকম ইয়াং, হ্যান্ডসাম সিংগারের পাশে পুষ্পকে অনেকের চোখে বেমানান লাগছিলো। পুষ্প এসব দেখে মুড অফ করে রেখেছিল,কিন্তু প্রণয় চোখের ইশারায় পুষ্পকে স্বাভাবিক থাকতে বললো। এসবে পুষ্পকে অভ্যস্ত হতে হবে। কারন মানুষ কত কথাই বলবে,সব কথা পাত্তা দিলে চলবে না।
পুষ্পকে একপাশে দাঁড় করিয়ে প্রণয় ওয়াশরুমে গেল। ঠিক তখনি বাঁধলো বিপত্তি। একটা লোক পুষ্পকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। যেটা দেখে পুষ্পর অসহ্য লাগছিলো। হঠাৎ লোকটা একটা বাজে মন্তব্য করে বসলো। পুষ্প অন্যদিকে যেতে নিলেই প্রণয়ের সাথে ধাক্কা খায়। পুষ্পর চোখে জল দেখে প্রণয় সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। তারপর কাছে গিয়ে বললো,
—” হোয়াটস ইউর প্রবলেম?”
—” লোকটা কেমন জানি কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসলো,যেটা দেখে প্রণয়ের মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু এখানে কিছু করা যাবে না। তাই মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তখনি লোকটা বলতে লাগলো,
—” ঐ মেডামকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু মনে পড়ছেনা। আই থিংক…ফেসবুকে উনার ছবি দেখেছি। তবে নরমাল কোন ছবি না,প্রায় নুড-ই বলা চলে। ছবিটার ক্যাপশন ছিলো মে বি আরো একটা রেপ…
প্রণয় লোকটাকে কথাটা শেষ করার সুযোগ দিলো না,তার আগেই হাত তুলতে নিলো। কিন্তু লোকটা প্রণয়ের মুখের অবস্থা দেখে আগে আগেই কেটে পড়েছে। পুষ্প পাশেই একটা চেয়ারে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। প্রণয় তাড়াতাড়ি পুষ্পর সামনে এসে বসলো। পুষ্পর হাত ধরতেই পুষ্প এবার জোরে কেঁদে দিল। প্রণয় তাড়াতাড়ি পুষ্পকে একটা রুমের ভেতর নিয়ে গেল। এখানে এতো মানুষ দেখলে সমস্যা।
রুমে গিয়ে পুষ্প কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—” কতজনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি? কতজনের গায়ে হাত তুলবেন? আমি এজন্যই এখানে আসতে চাইনি। এটা বলে পুষ্প আবার কান্নায় ভেংগে পড়লো।
পুষ্পর কান্না দেখলে প্রণয়ের দিশেহারা লাগে। পুষ্পর চোখের জল মুছে দিল। তারপর একদম ঠান্ডা গলায় বললো,
আজকের পর আর কেউ কোন কথা বলার সুযোগ পাবেনা। আজকের পর থেকে তোমার পরিচয় হবে একটাই,তুমি পুষ্প। প্রণয়ের ফুল।
পুষ্প প্রণয়ের কথার মানে কিছুই বুঝতে পারলনা। আজকের পর কি হবে?”

একটু পর প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। তাই প্রণয় দ্রুত পুষ্পর চোখের জল মুছে দিল টিস্যু দিয়ে। ওর চোখের কাজল মুছে ঠিক করে দিলো। তারপর পুষ্পকে হাতে ইশারায় দেখালো স্মাইল করার জন্য। পুষ্প জোর করে হাসার চেষ্টা করলো একটু। প্রণয় পুষ্পর কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল। পুষ্প চোখ বুজে রইলো। এতো কেন ভালোবাসে, কেন!”

যখন এ্যাংকার মাইকে প্রণয়ের নামটা উচ্চারণ করলো,প্রণয় খুশির তোপে পাশে বসা পুষ্পকে জড়িয়ে ধরলো। অনুষ্ঠান টা যে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, সেটা প্রণয়ের মাথায়ই ছিলো না। ঐদিকে বাসায় প্রণয়ের মা তার ছেলের এমন কান্ডে হো হো করে হাসি শুরু করলেন। বাসায় সবাই একসাথে বসে দেখছিলো। প্রিয়ম বলে উঠলো,

—” ব্রো টা আমার বিশ্বপ্রেমিক হয়ে গেল। পাবলিক প্লেসে অপেন রোমান্স! ”

পাশ থেকে কলি বলে উঠলো,

আরে এটা অপেন রোমান্সের কি হলো?
হাগ করতেই পারে,টেক ইট নরমাল।

প্রিয়ম কেমন বাঁকা চোখে তাকালো কলির দিকে। সেটা দেখে কলি অন্যদিকে মুখ ঘোরালো।

টিভিতে প্রণয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে সবাই সেদিকে মনোযোগ দিলো।

—” প্রণয় মাইকে বলতে লাগলো,

এটা আমার ফিল্মে প্রথম গান,আর সেটাতেই পুরস্কার পাবো সেটা কল্পনাতীত। তবু যারা মনোনয়ন করেছেন,আর দর্শক যারা পছন্দ করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
সবাই প্রথম পুরস্কারটা বাবা, মা কেই ডেডিকেট করে। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেই সাথে আরো একজন বিশেষ মানুষকে আমি এই পুরস্কারটা ডেডিকেট করতে চাই। সে এখানেই উপস্থিত আছে। আই উড লাইক টু কল অন স্টেজ মিস আফরা পুষ্প,প্লিজ কাম অন দ্যা স্টেজ।

পুষ্প কি করবে বুঝতে পারছেনা,ওর হাত পা কাঁপছে। কাঁপাকাঁপি করেই স্টেজে উঠলো। সাংবাদিকদের ক্যামেরা তখন ওদের দিকে। পুষ্প স্টেজে উঠার পর, প্রণয় বলতে লাগলো;
—” পুষ্প….
—” আই লাভ ইউ। একটা বিশেষ কারো জন্য আমাদের বুকের বা-পাশটা সবসময় ধুক ধুক করে। জানান দেয়,কেউ একজন সেই ধুক ধুকের কারন। সযতনে সেই ধুক ধুক এতোদিন পুষে রেখেছি,সেই বিশেষ মানুষটার জন্য। সেই মানুষটা আর কেউ নয়,আমার সামনে দাঁড়ানো সে।
পুষ্প…..
—” তুমি কি আমার সেই হৃদয় ধুকপুকের চিরস্থায়ী কারন হবে?
—–” উইল ইউ বি মাইন ফরএভার?
—” পুষ্প বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রণয় এমন কিছু করবে,এটা ওর ভাবনার বাইরে। এভাবে লাইভ প্রোগ্রামে প্রপোজ,টিভিতে নিশ্চয়ই বাসার সবাই দেখছে। লজ্জায় পুষ্পর মাথা কাটা যাচ্ছে, এমন বেহায়া কেন এই ছেলে!”
সবার সামনে আমাকে লজ্জায় ফেলতে উনার খুবই মজা লাগে। পুষ্প যখন এসব সাত-পাঁচ ভাবছিলো,তখন শুনতে পেলো কিছু মানুষ বলছে,
—” সে ইয়েস,সে ইয়েস।
—” পুষ্পর এতোক্ষণে ঘোর কাটলো। দেখলো প্রণয় তখন হাটুঘরে ওর সামনে বসে আছে। একহাতে সাদা গোলাপ সামনে ধরে রেখেছে,আর এক হাত পিছনে। পুষ্প ফুলগুলো হাতে নিয়ে বললো,
—” ইয়েস,আই ওয়ান্ট টু বি ইউর ফরএভার। আমি তোমার হৃদয় কাঁপাকাঁপির চিরস্থায়ী কারন হতে চাই।

প্রণয় তখন পিছনের হাত সামনে আনলো,পুষ্প দেখতে পেলো রিং বাক্স। পুষ্প চোখ বড় বড় করে প্রণয়ের দিকে তাকালো। প্রণয় বরাবরের মতোই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বাক্স থেকে রিং বের করে পুষ্পকে আংগুল সামনে ধরার জন্য ইশারা করলো। পুষ্প বাধ্য মেয়ের মতোই সেটা করলো। প্রণয় রিং পরিয়ে একরাশ খুশি নিয়ে পুষ্পর চোখের দিকে তাকালো। চারদিকে তখন ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলছে,হাততালি বাজছে।
হয়তো আগামীকাল পেপারের ফন্ট লাইনে ছাপা হবে,
সিংগার প্রণয় মেহবুব লাইভ প্রোগ্রামে এসে কি করলেন!”
তাতে অবশ্য প্রণয়ের কিছু আসে যায় না।

গাড়িতে বসে প্রণয় পুষ্পকে বলতে লাগলো,
—” একটা দুঃখের কথা বলবো?”
—” কি?”
—” আজকের পর থেকে না আমার ফিমেল ফ্যান ফলোয়ার ডাউন হয়ে যাবে একদম। প্রণয় একটা দুঃখের ভাব করলো এটা বলে।
—” পুষ্প একদম তেড়ে গেল প্রণয়ের দিকে,কিল ঘুসি দেয়ার চেষ্টা করলো। প্রণয় তখন নিজেকে বাঁচাতে ব্যাস্ত।
পুষ্প একনাগাড়ে বলতে লাগলো,
—” ফিমেল ফ্যান ফলোয়ারের জন্য গান করেন আপনি,তাই না। পেটে পেটে এসব চলে,আর আমি কি নদীর জলে ভেসে এসেছি নাকি? বেশি করলে সব ফিমেল ফ্যানদের ব্লক করে দিবো।
—” তাহলে আমার গান কে শুনবে?
—” গাইতে হবে না গান,বিজনেস দেখাশোনা করবেন। তাও ফিমেল ফ্যান ফলোয়ার নিয়ে মাতামাতি চলবে না, হুম।
—” আরে, এতো হট হচ্ছো কেন?
—” কিহ?”
—” মানে ফ্যান ফ্যানের জায়গায়, পার্সোনাল লাইফে তারা আসবে নাকি। পার্সোনাল লাইফ,আর প্রফেশনাল লাইফ আমি পৃথক রাখতে জানি। সেটা নিয়ে আপনাকে এতো চাপ নিতে হবে না ম্যাম। এটা বলে পুষ্পর গাল টেনে দিল।
—“পুষ্প হুহ বলে অন্যদিকে মুখ বাঁকালো। পুষ্পর ভাব দেখে প্রণয় জোরে হো হো করে হেসে দিল। যেটা দেখে পুষ্পর গা জ্বালা করতে লাগলো। আর মনে মনে ওর ফিমেল ফ্যান ফলোয়ারের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলো।

#চলবে…

তাড়াহুড়ায় লিখেছি,ভুলত্রুটি মার্জনীয়😑

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here