বাসন্তী
পর্ব- ২৭
লেখা-লিমু
—–” আলতো করে পুষ্পের হাতটা স্পর্শ করলো প্রণয়। হঠাৎ স্পর্শে পুষ্প চমকে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় চোখের ইশারায় পুষ্পকে আশ্বস্ত করলো,ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সব ঠিকই থাকবে।পুষ্প চোখে ভয় রেখেই মুখে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করলো। প্রণয়ও সেটা বেশ বুঝতে পারলো,তবে আর কিছু বললোনা। শুধু শক্ত করে পুষ্পর হাতটা চেপে ধরলো,এটা বুঝাতে যে তার প্রণয় তার পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে সবসময়ই। পুষ্প প্রণয়ের হাতের উপর নিজের অন্য হাতটা রাখলো। যেটা দেখে প্রণয় মৃদু হাসলো পুষ্পর দিকে তাকিয়ে। পুষ্পও হাসি বিনিময় করলো। অনেক সময় মুখে কথা না বলেও, অনেক কিছুই বুঝানো যায়। শুধু চোখের দিকে তাকিয়েই পরম নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া যায়। আর প্রণয়ের চোখে পুষ্প সে নির্ভরতা খুঁজে পায় বরাবরই। যদিও ভেতরে ভেতরে ভয় কাজ করছেই।
অবশ্য ভয় কাজ করাটাই স্বাভাবিক।
যখন ওরা সাজেক ছিল তখনি প্রণয় বলেছিল ওর বাবা মা জানুয়ারিতে দেশে আসবে। আর সে কারনেই আজকে ওরা দুজন এয়ারপোর্টে। উনাদের রিসিভ করতে এসেছে। পুষ্প আসতে চাই নি, কিন্তু প্রণয় নাছোরবান্দা। সে ওর বাবা মাকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে। কিন্তু সেটাই পুষ্পর ভয়ের সবচেয়ে বড় কারন। কারন সারপ্রাইজ যে কোনদিক থেকে আসে,সেটাই ভয়। আর উনাদের পরিবারের একটা রেপুটেশন আছে। সেসব ভেবেই পুষ্পর গলা শুকিয়ে আসছে। সবকিছু জেনেও কি উনারা পুষ্পকে সহজভাবে গ্রহণ করবে!”
পুষ্পর বুকের ভেতরটা ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে জোরে জোরে। অনবরত ঘেমে চলেছে এসি রুমে বসেও। চাইলেও ও স্বাভাবিক থাকতে পারছেনা। বারবার বোতল থেকে পানি খেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও কতকাল ধরে পানি পান করেনা,তাই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সময়টা যেন থেমে গেছে,যাচ্ছেই না। মনে হচ্ছে কত দীর্ঘ সময় ধরে ওরা বসে আছে এখানে। অথচ একঘন্টা হয়েছে মাত্র। আর উনাদের ফ্লাইট অবতরণ করার সময়ও এসে গেছে। প্রণয় ঘড়ির দিকে তাকালো,তিনটা পয়তাল্লিশ বাজে। তার মানে ফ্লাইট অবতরণ করে গেছে। প্রণয় উঠে দাঁড়ালো,কিন্তু পুষ্প ঠাঁয় বসে রইলো। একদম পাথরের মূর্তির মতো,কোন নড়াচড়া করছে না। এটা দেখে প্রণয় হাটুঘেরে পুষ্পর সামনে বসে পড়লো। তারপর পুষ্পর হাত ওর মুঠোয় পুরে বললো,
—–” ইউ লাভ মি?”
—-” পুষ্প হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।”
—-” ইউ বিলিভ মি?”
—-” পুষ্প আবারও মাথা নাড়ালো।”
প্রণয় হাসলো পুষ্পর কান্ড দেখে। ছোট বাচ্চাদের মতো কেমন মাথা নাড়াচ্ছে, যেন কথা বললে কেউ বকবে।
—-” তাহলে এতো কিসের ভয় তোমার?”
আমি আছিতো নাকি?
—-” পুষ্প আবারও মাথা নাড়ালো। প্রণয় বুঝতে পারলো পুষ্পকে এখন আর কিছু বলে লাভ নেই।
তাই শুধু এটাই বললো,
—-” পুষ্প,তোমার প্রণয় তোমারি। সে শুধু তোমার প্রণয়েই মরবে,বাঁচবে। সে শুধু তার বাসন্তীর প্রণয়েই বাঁধা পড়েছে। সে তার মায়াচন্ডীকেই ভালোবেসেছে,তাকেই চাই শুধু জীবনে। শত ঝড় মোকাবেলা করে হলেও,সে তার প্রণয়িনীর হাত ছাড়বে না। জানো তো জীবন একটাই,সত্যিকারের ভালোও একজনকেই বাসা যায়৷ হ্যা হয়তো বাস্তবতা আমাদের অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন করে,তবে সেসব পরীক্ষায় যে আমাদের পাস করতেই হবে। জানো তো, এতে ভালোবাসা আরো শক্ত হয়। ভালোবাসার ভিত মজবুত হয়। দুজন দুজনকে আরো গভীরভাবে জানা যায়, উপলব্ধি করা যায়। ছোট ছোট পরীক্ষায় পাস করার মাধ্যমে জীবনের আরো বড় পরীক্ষা গুলোর জন্য সাহস সঞ্চার করা যায়। আর এতে করে জীবনে যত বড় সংকটই আসুক না কেন, দুজন সেটা সহজেই হাতে হাত রেখে মোকাবিলা করতে পারবে।
পুষ্প বরাবরের মতই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রণয়ের কথা শুনছিলো। কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে সে। মনচায় সে বলতেই থাকুক,আর পুষ্প শুনতেই থাকুক। প্রণয়ের কথার মাঝখানে পুষ্প বলে উঠলো,
—-” কি সুন্দর করে কথা বলো তুমি। সবকিছু কত দারুণভাবে ব্যাখ্যা করো,যে কারো মনোবল বেড়ে যাবে। আচ্ছা তুমিতো সিংগার,তোমার গানের জাদুতে সবাই কাবু হওয়ার কথা৷ কিন্তু আমিতো তোমার কথার জাদুতে ফেসে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
এতো সুন্দর করে সব বলো,যে বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না৷ সাহিত্যের ছাত্রী আমি,তবুও এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারবোনা।
—-” পাম দিতাছো? তাহলে কিন্তু গ্যাস বেলুনের মতো উড়ে যাবো। ”
—” পুষ্প হেসে দিল প্রণয়ের কথাটা বলার ধরন দেখে। প্রণয়ও সেই হাসিতে যোগ দিল। তারপর বললো,ওকে ম্যাম এবারতো অন্তত নরমাল মুডে ফিরে আসুন। এতো চাপ নেয়ার কিছু নেই। যা হবে, সময়ে দেখা যাবে। দয়া করে চলুন এখন,
আমার বাসন্তীরানী।
পুষ্প হেসেই উঠে দাঁড়ালো। সে মানুষটাই এমন,পুষ্প বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারেনা।
পুষ্প শাড়ি পরেছে আজ। শাড়িটা অবশ্য প্রণয়ের পছন্দেই কেনা। ব্লু আর রেড এর কম্বিনেশনের। পুষ্পর দীঘল কেশ খোলা,পুরো পিঠময় ছড়িয়ে রয়েছে। গলায় জাস্ট একটা লকেট,ঐটা সাজেকে প্রণয় গিফট করেছিল। দুইহাত ভর্তি লাল,নীল চুড়ি। আর কানে লাল বড় পাথরের দুল। এগুলো কলি পরিয়ে দিয়েছে জোর করে। শাড়ির সাথে নাকি বড় কানের দুল ছাড়া মানায় না। পুষ্প এতো বড় দুল কখনো পরেনা। কিন্তু কলির জেদের কাছে ওকে হার মানতে হলো আজকে। ব্যাস এতটুকুই, আর কোন সাজ নেই। কিন্তু পুষ্প যখন এভাবে প্রণয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো,প্রণয় বারবার চোখ কচলাচ্ছিল। এমন ভাব, যেন ওর চোখের পাওয়ারে কোন সমস্যা হচ্ছে। প্রণয়ের এমন অবস্থা দেখে পুষ্প আরো অসস্থিবোধ করতে লাগলো। বারবার শাড়ি ঠিক করতে লাগলো। যদিও শরীর দেখা যাচ্ছে না একদম,কারন ফুলহাতা কলারসহ ব্লাউজ পরেছে। ব্লাউজটা পুরোটা লাল। আর শাড়িটা কুচির অংশটুকু লাল,আর আঁচলটা নীল। আর শাড়িটার পাশে পুরোটা জুরে সোনালি পাড়।
প্রণয়ের রিএকশান দেখে কলি আর প্রিয়ম দুজনি মুখ লুকিয়ে হাসছিল। প্রিয়ম এয়ারপোর্টে আসেনি,ওর কোন বন্ধুর বার্থডে আজকে। তাই সবাই মিলে কোথায় জানি ঘুরতে যাবে। আর প্রণয়কে কানেকানে বললো,তোমাদের দুজনের মধ্যে আমি কাবাব মে হাড্ডি কেন হতে যাবো বলো? এটা বলেই চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে ওর গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
আসার আগে পুষ্প কলির সাথে কি কথা বলছিলো দাঁড়িয়ে। তখন প্রণয় টুপ করে পাশ থেকে পুষ্পর একটা সাইড ছবি তুললো। ছবিটা এমন, পুষ্প ওর ডান হাত দিয়ে চোখের সামনে আসা চুলগুলো সরাচ্ছিল। প্রণয় জুম করে শুধু হাত থেকে উপরের অংশটুকুর ছবি উঠালো। তাই হাতের চুড়ি,কানের দুলের একটু অংশ আর মুখের একপাশ উঠেছে ছবিটাতে। আর পুষ্পর মুখে মুচকি হাসি ব্যাস,একদম মনমতো একটা ছবি। ছবিটা তুলে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ছবিটায়।
চোখ খোলার পরপরই দেখে পুষ্প আর কলি দুজনি ওর সামনে দাঁড়িয়ে। কলি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে,আর একহাত কোমড়ে। প্রণয় দ্রুত ফোনটা সরিয়ে নিল মুখের সামনে থেকে। আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, ওরা কিছু দেখে ফেলে নি তো!”
না দেখলে কলি এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
প্রণয় স্বাভাবিকভাবে পুষ্পকে বললো,” চলো যাওয়া যাক। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
পুষ্প গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। প্রণয় গাড়ির দরজা লাগিয়ে অপরপাশে নিজে উঠার জন্য যাচ্ছিল। ঠিক তখনি কলি পথ আঁটকে দাঁড়ালো। প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,কিছু বলবে?”
—-” হুম।
—-” বলো তাহলো।
—-” ঐ ফোনটা আপনারি,আর ফোনের ভেতর যে ছিল সেও আপনার। তাই এভাবে চুরি করে ছবি উঠিয়ে, পাবলিক প্লেসে এমন আকাম-কুকাম করার কোন মানেই হয় না। নিজের জিনিস,নিজেকেই সেইফ রাখতে জানতে হয়। আজকে আমি দেখলাম,আরেকদিন অন্য কেউ দেখতে পারে। তাই এলার্ট করে দিলাম। এটা বলে কলি চলে গেল।
আর প্রণয় বোকার মতো দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,যাহ এটাতে আকামের কি হলো! মানুষতো আজকাল পাবলিক প্লেসে অপেন আরো কতকিছু করে ফেলে,এটাতো সামান্য ফোনের ছবিতে।
আর ভাবতে লাগলো,ফুলকলির কি এক্সট্রা চোখ আছে আরো,কি করে দেখলো!”
বিমান থেকে নেমে যাত্রীরা তাদের লাগেজ নিয়ে আসছিল এক এক করে। হঠাৎ একটা কাপলকে দেখে প্রণয় হাত নাড়িয়ে ডাক দিল। একজন মধ্যবয়স্ক নারী সেলোয়ার-কামিজ পরা। আর তার পাশে একজন সাদা স্যুট-বুট পরা পুরুষ। পুষ্প বেশ বুঝতে পারলো এরাই প্রণয়ের বাবা মা। তবে তাদের দেখে তো বেশ হাসিখুশি মানুষই মনে হচ্ছে। দুজন কি বলে বলে যেন হাসছে। উনাদের দেখে পুষ্পর নার্ভাসনেস একটু কমলো।
প্রণয় গিয়ে তাদের হাগ করলো। পুষ্প প্রণয়ের পিছন পিছন গেল।
পুষ্প উনাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে নিলে প্রণয়ের বাবা কিছু না বললেও প্রণয়ের মা পা সরিয়ে নেয়,সালাম করতে দেয় নি। যেটা মুহুর্তেই পুষ্পর চোখে জল এনে দিল। তবে কিছুই বললোনা,শুধু প্রণয়ের চোখের দিকে তাকালো। কারন পুষ্পর একমাত্র নির্ভরতার জায়গা সে চোখ,সে চোখের মালিক।
#চলবে…..