বাসন্তী
পর্ব-১৯
লিমু
____ ” গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের মত খাঁ খাঁ করছে প্রণয়ের ভেতর বাহির দুইটাই। ধিক ধিক করে জ্বলছে হৃদয় নামক বস্তুটা। কি এক ভীষণ ব্যাথায় পুড়ছে,যেটা গত একটামাস ধরে ওকে ভীষণ্নতায় ভুগাচ্ছে। তার মায়াচন্ডী যে চুপ হয়ে গেছে,তার বাসন্তী যে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ঐ মলিন, বিষণ্ণ মুখশ্রী চোখের সামনে ভাসলেই প্রণয়ের বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে। কষ্টরা,যন্ত্রনারা তোলপাড় শুরু করে, ঝড় বয়ে যায় মনে,শূন্যতার ঝড়। যাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন সাজালো,সেই আজ অভিমানে চুপসে আছে। কিন্তুু সে কার সাথে অভিমান করেছে? নিজের সাথে,না সমাজের সাথে?
– ” কোন কথা বলে না ও,কাঁদেও না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে। ও কি পাথর হয়ে গেছে!
– ” প্রণয়ের নিজেকে এতো অসহায় লাগছে। কেন এমন হয় আমাদের সাথে? যখন আমরা একটু সুখের ছোঁয়া পেতে চাই,তখনই কেন কষ্টরা সেখানে আঘাত হানে। জীবন এমন কেন?
– ” হঠাৎ গিটারের তারে হাত লেগে প্রণয়ের আঙুল কেটে গেল,সাথে সাথে রক্ত গড়িয়ে পরা শুরু হলো। কিন্তুু প্রণয়ের সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর এতো কষ্ট কেন হচ্ছে! সবকিছু ওলট পালট করে দিতে মন চাইছে। কেন ওর সাথেই এমনটা হলো,কি দোষ ছিল ওর। কি দোষ ছিল ঐ নিষ্পাপ মেয়েটার,কেন ওর সাথেই এমনটা হলো। ভালো মানুষগুলোই কেন জীবনে কষ্ট পায়। প্রণয় রাগে, ক্ষোভে একটা চিৎকার দিলো আআআআআ………
– ” প্রণয়ের চিৎকার শুনে কলি তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকলো। ঢুকেই ফ্লোরে রক্ত দেখে আঁতকে উঠে কলি। তাড়াতাড়ি ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে প্রণয়ের সামনে গিয়ে বসলো।
তারপর প্রণয়ের আঙুলটা পরিষ্কার করতে নিলে,প্রণয় হাত সরিয়ে নেয়। বললো,
যে কষ্ট হৃদয়ে হচ্ছে,সেটা কি দিয়ে ব্যান্ডেজ করবে ফুলকলি?
– ” কলি কি বলবে বুঝতে পারলনা,ওর চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
কলি দ্রুত চোখের জল মুছে নিয়ে বললো,
আপনি যদি এতোটা ভেঙ্গে পড়েন,তাহলে বু কে কে দেখবে? ওর তো এখন সবচেয়ে বেশি আপনাকে দরকার ভাইয়া। ওকে যে স্বাভাবিক করে তুলতেই হবে। আর সেটা একমাত্র আপনিই পারেন। তাই আপনাকে যে আগে শক্ত হতে হবে। আপনি দুর্বল হলে তো সব শেষ। বু কে যে আর সুস্থ করতে পারবোনা। আমারও যে ওকে এভাবে দেখতে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কতদিন ওর হাতের কানমলা খায় না,ও তো রোজ একবার আমাকে কানমলা দিতোই দিতো।
কলির চোখ দিয়ে আবারও জল পড়তে লাগলো। সেটা দেখে প্রণয় বললো,
– ” এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন?
তোমার বু ঠিক হবে,নিশ্চয়ই হবে। ওকে যে সুস্থ হতেই হবে,ওর উপর কত দায়িত্ব। সে তো দায়িত্ব কাঁধে নিতে ভালোবাসে। আর নয়তো বিশ বছরের এক মেয়ে কি করে এই বয়সেই এতটা ম্যাচিওরিটি নিয়ে চলে।যেখানে ওর মতো মেয়েরা সাজগোজ করে করেই দিন পার করে,সেখানে ও নিজের পরিবারের কথা ভাবে সারাক্ষণ। এমন মেয়ে যে আজকাল দেখা মিলা ভার।
– ‘ আর তার সাথেই কিনা এমন কিছু ঘটলো! কখনো কখনো অদৃষ্টের কাছে আমরা অসহায়, খুব অসহায়।
– ” কলি প্রণয়ের হাতটা আবার ওর হাতে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে ঠান্ডা স্বরে বললো,
– ” যা ঘটে যায়,বা যা ঘটবে তা তো আমরা বদলাতে পারবোনা। তবে আমরা একটু চেষ্টা তো করতেই পারি,ভালো থাকার,ভালো রাখার। আমাদের জীবনে কতকিছুই তো ঘটে,সব যে সুখকর হবে তেমনটা ভাবার অবকাশ নেই। আবার সব দুঃখের হবে,তেমনটাও না। যা হয় তা আমাদের মানতে হবেই,মানতে বাধ্য আমরা। অনেক কষ্ট,অনেক মন্দ থেকেও সুখ খুঁজতে হবে,ভালোলাগা খুঁজতে হবে।
জীবনটা যে অতটাও সহজ না, তাইনা ভাইয়া?”
– ” প্রণয়ের হঠাৎ করে মনে হলো,এই একমাসে এই ষোড়শী মেয়েটা হুট করে বড় হয়ে গেছে। কেমন ভারী ভারী কথাবার্তা বলছে,হুট করেই কতকিছু বুঝতে শিখে গেছে। অথচ কয়দিন আগেও কত দুষ্টুমি করতো,আর এখন কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কেমন উদাসীন হয়ে থাকে,কি যেন ভাবে একা একা। কখনো সবার আড়ালে চোখের জল ফেলে,প্রণয় সেটা দেখেছে।
– ” খুব বেশি আঘাত বা কষ্ট কি সত্যিই মানুষকে বদলে দেয়,বুঝতে শিখায় অনেককিছু। সত্যিই মানুষ বয়সে বড় হয় না, বড় হয় বাস্তবতায়। তাইতো একটা ষোড়শী বালিকার মুখেও এমন ভারী কথা শুনা যাচ্ছে। প্রণয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কলির দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে,হয়তো রাতেও কাঁদে। ওর বু কে কতটা ভালোবাসে, সেটা হয়তো প্রণয় একটু হলেও অনুমান করতে পারছে। পুষ্পকে পাওয়ার জন্য, কলির কাছে কম পরীক্ষা দিতে হয়নি প্রণয়কে। যদিও মেয়েটার বয়স কম,কিন্তুু বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। এ বয়সের মেয়েদের থেকে এতোটা ম্যাচিওরিটি আশা করা যায় না। অবশ্য হয়তো সেটা পুষ্পর ক্রেডিট। বোনকেও হয়তো নিজের মতোই বাস্তববাদী করে গড়ে তুলেছে। দুই বোন একজন আরেকজনের আত্না। যদিও বোন বোনকে ভালোবাসবে সেটাইতো স্বাভাবিক, তাই না।
– ” তবে এদের দু’বোনের বন্ডিংটা প্রণয়ের বেশ লাগতো। আর এখন দুজনকে দেখলেই,শুধু বুকে ব্যাথা হয়। প্রণয়ের খুব ইচ্ছে হতো,ওর যদি একটা ছোটবোন থাকতো। পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতো তাকে। কিন্তুু সব আশা তো আর পূরন হয় না।
কিন্তুু প্রণয় কলিকে নিজের ছোটবোনের মতোই দেখে,স্নেহ করে। কলিও বড় ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করে,ভালোবাসে।
★
– ” পুষ্পর রুমের সামনে দাঁড়াতেই প্রণয়ের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর চোখের নোনাজল দেখে। মেয়েটা এ কদিনে একফোটা চোখের জলও ফেলেনি,আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য। আজ কি হলো ওর!
– ” পুষ্প জানালার পাশে বসে আছে, দু’ চোখ বেয়ে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে। এতোদিনের জমানো সব কষ্ট,যন্ত্রণা সব উগড়ে দিচ্ছে মনে হচ্ছে আজ।
– ” কাঁদুক সে। কাঁদুক আমার বাসন্তী। ওর জীবনে আমি আর কোন কান্নার কারন আসতে দিবো না। এটাই ওর জীবনের শেষ কান্নার কারন। ও স্বাভাবিক হয়ে উঠলেই,ওর কান্নারও ইতি টানাবো। আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ওকে প্রতিনিয়ত এভাবে মূর্তির ন্যায় দেখে দেখে।
– ” ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে কষ্ট
পেতে দেখার চেয়ে কষ্ট বোধহয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। আর সে কষ্ট এমন কষ্ট,যেখানে শান্তনা দেয়ার মতো সাহসটুকুও নেই আমার।
আমার বাসন্তীকে আমার ভালোবাসায় মোড়ানোর আগেই,দুঃখ এসে ওকে আঁকড়ে ধরলো। এমন দুঃখ, যেখানে ভালোবাসাও অসহায়।
– ” কিন্তুু আমিও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লাম,শত কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলিয়ে আমার বাসন্তীকে আমার হৃদকুঠিরে বন্ধী করবোই। আর তারজন্য আমার যা করতে হয়,যত কাঠখড় পোড়াতে হয় পোড়াবো। তবুও সে আমার বাসন্তী,কার সাধ্য তাকে অপবিত্র বলার।
যে বলবে,তার মন অপবিত্র।
– ” প্রণয় পুষ্পর সামনে যায় না। আড়াল থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে প্রণয় তার মায়াচন্ডীকে। কিন্তুু তার মায়াচন্ডী যে শান্ত হয়ে গেছে,একদম শান্ত। কোন কথা বলেনা,এতোই অভিমানী সে।
– ” প্রণয়কে দেখলেই পুষ্প কেমন যেন রিয়েক্ট করে,হয়তো লুকাতে চায় নিজেকে প্রণয়ের থেকে। কিন্তুু সে তো জানেনা,এই হৃদয়াসনে যাকে একবার বসিয়েছে,তাকে সরানোর কথা ভাবা যা প্রণয়ের সাধ্য নেই। প্রণয় চাইলেও পারবেনা। যার জন্য হৃদকম্পিত হয়,তাকে ভুলা যে ভাবনার অতীত।
– ” আর এটা প্রণয়ের কাছে এমন কিছু নয়,যে ঐ কুৎসিত মানুষের কুৎসিত কাজের জন্য সে তার পুষ্পকে ভুলে যাবে। পুষ্প মানে ফুল,আর ফুল সবসময়ই পবিত্র।
– ” ঠিক প্রণয়ের পুষ্পও পবিত্র,কার সাধ্য ওকে অপবিত্র বলে। বরং তারা অপবিত্র,যারা পুষ্পর মতো মেয়েদের ছুঁয়ে নিজেকে বীরপুরুষ ভাবে। আসলে তো ওরা নিকৃষ্ট কীট সমাজের,কাপুরুষ কোথাকার। লজ্জা তো ওদের পাওয়া উচিত,পুষ্পর মতো মেয়েদের নয়।
লজ্জা নারীর ভূষণ,তার মানে এই নয় সে পাপ না করেও সে লজ্জা পাবে,গৃহবন্দি করে রাখবে নিজেকে। যে কাপুরুষ এমন ঘৃণ্য কাজ করে,সে লজ্জা পাবে। সে হীনমন্যতায় ভুগবে,সে নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখবে। পুষ্পর মতো মেয়েরা কেন লজ্জা পায়,ভয় পায়। কেন নিজেকে সমাজ থেকে গুটিয়ে নিতে চায়,আড়ালে রাখতে চাই। সময় এসেছে চিন্তাধারা বদলানোর। ঐসব কুলাঙ্গারদের সমাজ থেকে নির্বাসিত করা উচিত,যাদের মন মস্তিষ্ক দুটোই পঁচা। দুটোই পঁচা নর্দমার চেয়েও জগণ্য।
★
– ” ভোরবেলা পুষ্পকে নিয়ে কলি বাসার পাশের পার্কটাতে হাঁটতে বের হলো। পুষ্প বের হতে চায় না, অনেক জোর করে কলি বের করে নিয়ে গেছে। প্রণয় ওদের সাথে যায়নি,তবে আশেপাশেই ছিলো। কলি একটা বসার জায়গায় পুষ্পকে নিয়ে বসলো। তার ঠিক বিপরীত পাশেই একটা কাপল বসে ছিল। দুজনের মুখই অনেক গম্ভীর দেখাচ্ছে। মেয়েটা একনাগাড়ে কাঁদছে। কোন সমস্যা হয়েছে হয়তো,তাই এতো সকালে দুজন দেখা করতে এসেছে।
হঠাৎ ছেলেটা মেয়েটার সামনে হাটুঘেরে বসে পড়লো,মেয়েটা হয়তো সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলনা।
– ” কলি বিষয়টা দেখছিলো মনোযোগ দিয়ে হঠাৎ পুষ্পর কান্নার আওয়াজে ওর ঘোর কাটলো। পুষ্প কান্না করছে ঐদিকে তাকিয়ে। কলির বুঝতে অসুবিধা হলো না একটুও,পুষ্প কেন কান্না করছে।
পুষ্প ইদানিং শুধু কান্না করে,কিন্তুু কোন কথা বলে না। খাওয়া-দাওয়ার কোন ঠিক নেই। একবার খেলে আরেকবার খায় না। চেহারা একদম বিবর্ণ হয়ে গেছে,মুখটা শুকিয়ে গেছে একদম। ঐ মায়াবী চোখ কেঁদে কেঁদে মলিন হয়ে গেছে।
এক ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে জীবনটা মুহুর্তেই। জীবন কত বিচিত্র না!
জীবনে খুব বেশি কিছু তো চায়নি পুষ্প,অল্পতেই খুশি থাকার মেয়ে। ওর সাথেই কেন এমন হলো।
– ” প্রণয় আড়াল থেকে লুকিয়ে পুষ্পকে দেখছিলো। কিন্তুু আবার ওর কান্না দেখে নিজেকে দমিয়ে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিলো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সবটা দুঃখ নিজে নিয়ে নিতে। কিন্তুু সেখানেও যে সে অসহায়!
– ” রাগে একটা গাছের মধ্যে একটা ঘুষি দিল প্রণয়। চোখের সামনে ওর বাসন্তী এভাবে কাঁদছে আর ও কিছুই করতে পারছেনা। প্রণয়ের নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। এ কোন কঠিন পরীক্ষায় পড়লো সে। যদি সামনেই না যেতে পারে,তবে কিভাবে ওকে স্বাভাবিক করবে। কিন্তুু পুষ্পতো কথায় বলছেনা,এত্ত অভিমান কেন মেয়েটার। এতদিনে আমাকে কি একটুও বুঝতে পারে নি। সে আমার জীবনে রং ছড়ালো,আমার ভুবনটা রাঙালো। অথচ আজকে তার ভুবন বিবর্ণ,রঙহীন। যে আমার মনে রং ছুঁয়ালো,তার জীবনে রংয়ের ছটা আবার এনে দিবো আমি,এটাই আমার একমাত্র আশা এখন।
– ” আমার বাসন্তীকে আমি আমার ভালোবাসার রংয়ে রাঙাবোই। যেখানে থাকবেনা কোন বিবর্ণতা, থাকবেনা কোন কষ্টের স্মৃতি।
– ” হঠাৎ প্রণয়ের ফোনটা বেজে উঠলো,কলি ফোন করছে, কিন্তুু কেন?
সামনে তাকিয়ে দেখে ওরা যেখানে বসে ছিল সেখানে নেই,কোথায় গেল তাহলে। এসব ভেবে ভেবে প্রণয় তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কলি বললো,” ভাইয়া বু হঠাৎ কোন কিছু দেখে জোড়ে চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছে। আপনি দ্রুত পার্কের পূর্বদিকে চলে আসুন,আমার অনেক ভয় করছে।
– ” প্রণয়ের মাথা শূণ্য হয়ে গেল, পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলো। এতটুকু পথ,তবু ও যেন ফুরুতে চায়ছেনা। বুকটা আবার চিনচিন ব্যাথা করছে, ব্যাথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
এ ব্যাথা ভয়ের,হারানোর ভয়ের। তার বাসন্তীকে হারানোর ভয়ের।
#চলবে…….