#বাম_পাঁজরের_হাড়
#শেষপর্ব

কাউকে প্রতিদিন একটু একটু করে জানা আর ধীরে ধীরে তার প্রেমে পড়া ব্যপারটা এতো চমৎকার তা আমি সাতচল্লিশ বছরে এসে বেশ বুঝতে পারছি। আর বুঝতে পেরেই যেন আরো বেশি করে ব্যাপারটা উপভোগ করছি। আমাদের বিয়ের বারোবছর পূরণ হবে এই তো কিছুদিন পরে। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে ভরা সংসার আমাদের। বিয়ের দু’বছরের মাথায় জমজ ছেলে মেয়ে হলো আমার। বলে যে, আল্লাহ যখন দেন তখন দু’হাত উজাড় করে দেন। আমাকে প্রথমে তুষারের মতো ভালো স্বামী দিলেন তারপর বছর দুয়েক পর একসাথে দু’টো সন্তান আকিব আর তিষা দিলেন। তার বছর পাঁচেক পরে আবার ছোট মেয়ে তোরা এলো ঘর আলো করে। তিন সন্তানের মধ্যে তুষারের জান আঁটকে থাকে। অফিসের সময় বাদে বাকী সময় তার আমার আর সন্তানদের জন্য বরাদ্দ। বাচ্চারা আমাকে ভয় পায় আর বাবার সাথে বন্ধুত্ব করে। তুষার বাসায় ফেরার পর থেকেই তাদের বায়না শুরু হয়। আমি ইন্টারের অংক খাতা কাটতে কাটতে তাদের বাবা সন্তানদের কান্ড দেখি আর মিটিমিটি হাসি। আমি চাই আমার সন্তানেরা আমাকে না তুষারকে বেশি ভালোবাসুক। বাপকে আদর করুক, আহলাদ করুক, বায়না করুক বাবার কাছে। ওদের বাবা ওদের সেসব আবদার পূরণ করুক। তাতে ওদের মধ্যে ভালোবাসা বাড়বে, বন্ডিং আরো জোরালো হবে। আমি ওদের কাছে না হয় রাগী দুষ্ট মা হিসেবে পরিচিত হবো। এতে আমার কোন আফসোস নেই। বরং তুষারকে ওরা ভালোবাসলে আমি খুশি হবো। আমার সবর্দা একটাই চাওয়া থাকে। যে মানুষটা আমাকে জীবনে এতো সুখী করেছে সে যেন সর্বাবস্থায় খুশি থাকে।

সংসারের শুরুর দিনগুলো মনে পড়লে আমার চেহারায় একটা আনন্দের দুত্যি ছড়িয়ে যায় জানি। ছড়ানোর যথেষ্ট কারন আছে বৈকি। বিয়ের প্রথম বছর আমি আর তুষার কেবল ঘুরে বেরিয়েছি নানা জায়গায়। চাকরি জীবনে এর আগে কখনো ছুটি নেইনি বলে ছুটি পেতে খুব একটা সমস্যা হতো না। তিনদিন সরকারি ছুটি দেখলেই আর দু’দিন বাড়িয়ে নিয়ে আমরা বেড়ানোর প্ল্যান করে ফেলতাম।
বাংলাদেশে ঘোরার মতো সব জায়গায় গেছি আমরা। এরপর সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, মালদ্বীপ। ইন্ডিয়া ভ্রমনের পরিকল্পনা করছিলাম সেই সময় টের পেলাম আমি মা হবো। তুষার খবরটা শুনে কতোটা খুশি হয়েছিলো সেটা আমার বোঝার সাধ্য ছিলো না। বুঝেছি পরের আটমাসে। সে আমার কি পরিমাণ যত্ন করেছে সেসব আমি যতই লিখি আপনারা বুঝবেন না। বাচ্চা পেটে থাকলে মায়েদের নানারকম মুডসুইং হয়। আমার পেটে জমজ বাচ্চা থাকার কারণে মুডসুইং হতো খুব বেশি, খাবার নিয়েও খুব কষ্টে ছিলাম। খেতে পারতাম না, বমি হতো। তারউপর কলেজের কাজ ছিলো। আমার কষ্ট দেখে তুষার আমাকে মাতৃত্বকালীন ছুটিটা আগেই নিয়ে নিতে বললো। বাচ্চা হওয়ার পর সে সামলে নেবে এই ভরসা দিলো। ততদিনে আমি তুষারকে বেশ বুঝতে পারি। বিয়ের পর আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো আগলে রেখেছিলো। কোন সমস্যার কথা মুখে বলার আগেই সে সলভ করে ফেলে। কাজেই জানি সে সামলে নেওয়ার কথা বলেছে মানে সত্যি সে সামলে নেবে। আমি বাচ্চা হওয়ার মাস দেড়েক পরই কলেজে জয়েন করলাম। সে অফিস থেকে উইথআউট পেতে তিনমাসের ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের দেখলো। আর সাথে আমার শাশুড়ী মা তো ছিলোই। এই মানুষটাও আমাকে কম ভালোবাসা দেয়নি। নিজের তিন মেয়ের চাইতে আমাকে কম ভালোবাসে না। আমার ননদেরাও আমাকে তাদের আরেকটা বোনই মনেকরে। টুকটাক যা মনোমালিন্য হয় সেসব খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমরা কেউই সেসব মনে রাখিনা। তাছাড়া মনে রাখার জন্য এতো সময়ই বা কোথায় আমার? টিক ঝাল মিষ্টি সংসার হাঁটি হাঁটি পা পা করতে করতে আজ বারো বছর হয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলেমেয়ে দুটো দশ বছরে পা দিলো আর ছোটটা পাঁচে। এখন ওদের নিয়ে আবার বেড়ানো শুরু করেছি আমরা। এইতো ক’দিন আগে মানালি ঘুরে এলাম। এরপর দার্জিলিং যাওয়ার ইচ্ছে আছে।

“কি ব্যাপার বউ, আজ হঠাৎ ব্যালকনিতে বসলে যে? মন খারাপ নাকি?”
অতীতের সুখস্মৃতির জাল ছিন্ন করে আমি বর্তমানে ফিরে আসি। সামনে তুষার দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাসলাম ওকে দেখে-
“মনে আছে বিয়ের পর বিকেলে প্রায়ই এই বারান্দায় বসে চা খেতাম আমরা?”
আমার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে তুষার হাসলো-
“তা আবার মনে নেই? ওই সামনের বাড়িটা তখনও হয়নি বলে এদিক থেকে রাস্তাটা দেখা যেতো। আমরা কেউ আগে অফিস থেকে ফিরলে এখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আরেকজনের অপেক্ষা করতাম।”
“হুমমম। আর তুমি আমাকে দেখলেই চিৎকার করে নাম ধরে ডাকতে।”
আমি লাজে রাঙা হলাম। তুষার আমায় মুখের রংবদল বুঝে মুচকি হাসে-
“আর তুমি চোখ দিয়ে আমায় শাসন করে লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিতে এই এখনকার মতো।”
“যাহ, মোটেই না।”
আমি তুষারকে মৃদু স্বরে ধমক দেই। তুষার ধমকের বদলে পাল্টা হাসি দেয়। আমার গ্রীবা উঁচু করে বলে-
“মোটেই হ্যা। আর তোমার এই শরমিলা চেহারা দেখার জন্যই তোমার নাম ধরে ডাকতাম আমি। খুব ভালো লাগে এই তোমাকে দেখতে।”
আমি চোখ মটকে তাকাতে যেয়ে হেসে দেই। তুষার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে আমায় সেই প্রথম দিনের মতো।
“তিথী।”
তুষারের গাঢ় স্বরের ডাক শুনে থমকে যাই-
“হুম।”
“মাঝে মাঝে মনেহয়, যেটা হয় ভালোর জন্যই হয়। যদি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতাম তাহলে এতোদিনে হয়তো ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করতো কিন্তু তোমার আমার মধ্যকার এই রসায়নটা থাকতোনা। সেসব ভাবলে মনেহয় দেরীতে বিয়ে করে ভালোই করেছি। এই আমার পঞ্চাশে এসেও নব্য তরুনের মতো এতো ভালোবাসা তোমার জন্য এটা আমি খুব এনজয় করি বুঝলে। আর তুমি যে এখনো কথায় কথায় লজ্জা পাও তাড়াতাড়ি বিয়ে হলে এটা কোথায় দেখতে পেতাম বলোতো?”
“আজ হঠাৎ খুব কথা ফুটেছে তোমার মুখে। ঘটনা কি?”
আমি তুষারকে থামাতে চাই।
“বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে এখনও যদি কথা না বলি আর কবে বলবো? আচ্ছা, তুমি আমার কাছ থেকে কি উপহার চাও বলোতো?”
“বারো বছর ধরেই তো দিচ্ছ আর কি চাইবো নতুন করে? সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকবো এটাই চাওয়া।”
“উহু, এমন তো সবসময় করছি। এবার আমি চাই আবার একটা হানিমুন ট্রিপে যেতে। শুধু তুমি আর আমি। বাচ্চারা ওর দাদী ফুপুদের কাছে থাকবে।”
সত্যি বলতে আমারও খুব মন চাইছিলো এরকম করতে। তুষার মুখে শুনে অবাক হলাম না। আমার সব না বলা ইচ্ছের কথা ও বুঝে ফেলে কিভাবে যেন।
“কোথায় যাবে?”
“তুমিই বলো।”
তুষারের ঠোঁটের কোনে হাসির ছটা। আমি জানি ও কোথায় যাবে। মুচকি হেসে বলি-
“সীতাকুণ্ড। আমাদের প্রথম হানিমুন প্লেস।”
“তোমার মনে আছে?”
তুষারের বিস্মিত মুখ দেখে হেসে দিলাম-
“গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের সেই বিকেল কি ভোলা সম্ভব? ফাস্ট টাইম ইউ টাচড মাই লিপস।”
আমি জড়ানো গলায় কথাগুলো বলতেই
তুষার আমার হাত ওর হাতে তুলে নিলো-
“এইজন্যই আমরা মেড ফর ইচ আদার। দু’জন দু’জনকে এতো ভালো বুঝি যে মুখে কিছু বলার দরকার হয় না।”
“হুমম। শুরুতে একটু দ্বিধা থাকলেও এতোদিনে বেশ বুঝতে পারছি আমি তোমার বাম পাঁজরের হাড় থেকেই তৈরী হয়েছি।”
“সে কথা আর বলতে? তুমি তো আমারই অংশ, তাইতো তোমাকে বুঝতে পারি খুব সহজে আর এটাও জানি তুমি কেবলই আমার এই জনমে এবং এর পরে যদি আরো কোন জনম থাকে সেখানেও।”
তুষার তীব্র আবেগ নিয়ে আমায় হাতে চুম্বন করে। আমি চোখ বুজে ওর স্পর্শে ভালোবাসার গভীরতা অনুভবের চেষ্টা করি যদিও জানি সে চেষ্টা বৃথা। আমরা মুখ ফুটে কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি অথচ প্রতিটা কাজে সেটাই বুঝিয়েছি। না বলেও ভালোবাসা দেখানো এটাকেই বলে বুঝি।
“তিথী।”
তুষারের ডাকে তাকাই। ও আমার চোখে চোখ রেখে তৃষিতের মতো উচ্চারণ করে-
“ভালোবাসি তিথী। খুব ভালোবাসি। বাকী জীবনটা এভাবেই হেসে খেলে কাটাতে চাই তোমার সাথে।”
মুখ ফুটে এই প্রথম সরাসরি ভালোবাসা ব্যক্ত করলো সে। আমি প্রথমে অবাক হলাম তারপর মৃদু হাসি দিলাম। আমার মুঠোয় থাকা তার হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরি। নিশ্চিত নির্ভাবনায় চোখ বুজে চেয়ার হেলান দিয়ে বিকেলের সোনালি রোদের স্পর্শ নেই আর বিরবির করে উত্তর দেই-“আমিও”।

সমাপ্ত।
© Farhana_Yesmin

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here