পর্ব ২০

গ্রিনহাউজ রেস্টুরেন্টের সবুজাভ পরিবেশ। আলো ছায়ার খেলায় চারদিক মোহনীয় সৌন্দর্য ধারণ করেছে। ভেতরে ঢুকে দোয়েল মুগ্ধ নয়নে এদিক সেদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখছিলো। একটা টেবিলে দুজন মুখোমুখি বসে পড়ে। ধীরেধীরে আবছা হতে শুরু করেছে দোয়েলের মনে জমে থাকা নিকষ অন্ধকার। নীলা দুইহাত বাড়িয়ে দোয়েলের হাত ধরে বললো, ‘ভাবী তোমাকে না আজকে দারুণ সুন্দর লাগছে।’

দোয়েল মিষ্টি হেসে বললো, ‘থ্যাংক ইউ। তুই সাজগোজ করিস না কেন? সাজলে তোকেও সুন্দর লাগবে।’
– ‘আমাকে কি এমনিতে কম সুন্দর লাগে ভাবী?’
– ‘না না তুই তো ন্যাচারালি অনেক সুন্দর। সাজলে তোকে আরও সুন্দর লাগবে। একদম পরীর মতো।’
– ‘ভাবী, পরীদেরকে সাজতে হয় না। পরীদের রাজ্যে কি মেক আপ আছে? লিপস্টিক আছে? ওরাও আমার মতো ন্যাচারালি সুন্দর বুঝেছো?’

দোয়েল হা হা করে হেসে ফেললো। তার হাসির স্রোতে হৃদয়ের কোণে জমাট বাঁধা রক্তাক্ত অভিমানগুলোও ক্রমশ স্তিমিত হতে শুরু করেছে। দোয়েল ভেতরে ভেতরে কৃতজ্ঞতা বোধ করে নীলাক্ষীর প্রতি। সে খুব আশা করে ছিলো একটা বোনের মতো জা হোক তার। আজ সেই আশা পূর্ণতা ভরে দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাদামী সংসার
লেখা- মিশু মনি

নীলাক্ষী খাবারের মেন্যু এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘নাও অর্ডার করো।’
– ‘তুই কর।’
– ‘আহা, তুমি করো। যা মনচায় তাই অর্ডার করে ফেলো।’
– ‘আচ্ছা, চাইনিজ ফুড অর্ডার করি?’

নীলাক্ষীর চোখে মুগ্ধতার রেশ প্রস্ফুটিত হয়ে দেখা দিলো, ‘আচ্ছা! যা ভালো লাগে।’

দোয়েল ভ্রু কুঞ্চিত করে খাবারের মেন্যুর পাতা ওল্টায়। অনেকদিন বাইরের খাবার খাওয়া হয় না। দেশীয় মোরগ পোলাও কিংবা কাচ্চির চাইতে তার কাছে চাইনিজ কিংবা থাই ফুড বেশি ভালো লাগে। যদিও কখনো কাউকে মুখ ফুটে এ কথা বলা হয় নি। নীলাক্ষীকে দেখে অবশ্য খাঁটি বাঙালি মেয়ে বলেই মনে হয়। সে নিঃসন্দেহে দেশীয় খাবারকেই বেশি প্রাধান্য দেবে। এসব ভাবতে ভাবতে ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার দিতে কতক্ষণ লাগবে?’
– ‘বিশ মিনিট ম্যাম।’
– ‘আচ্ছা। তাহলে আমাদেরকে এখন দুটো ভ্যানিলা ফালুদা দিন। আপনি আগে ফালুদা নিয়ে আসুন, এরপর আমরা বাকি অর্ডার দেবো।’

ওয়েটার অভিবাদন জানিয়ে চলে গেলে দোয়েল নীলাক্ষীকে বললো, ‘শোন না নীলু, আমার খুব ভালো লাগছে। বিয়ের আগে আমি মাঝেমাঝে আপুর সাথে বাইরে যেতাম। আচ্ছা তুই যেদিন করে ফ্রি থাকবি আমরা একটু বাইরে বের হবো। তোর কি সমস্যা হবে?’

নীলাক্ষী কোমল গলায় উত্তর দেয়, ‘আরে না। কি সমস্যা হবে? তোমার যেদিন বাইরে বের হতে ইচ্ছে করবে, আমাকে বলবে। আমি সময় করে তোমাকে নিয়ে আসবো।’

ঝলমলে গলায় দোয়েল বললো, ‘তুই অনেক ভালো রে।’
নীলাক্ষী দোয়েলের চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললো, ‘তুমিও অনেক ভালো ভাবী। ওর মুখে শুনেছি। তুমি বোনের মতো ওকে দেখাশোনা করতে। তোমার প্রতি আমরা দুজনেই কৃতজ্ঞ।’

দোয়েল অনেক্ষণ চুপ করে থাকে। হঠাৎ বলে ওঠে, ‘জানিস আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করতে চেয়েছিলাম। তোর ভাইয়া রাজি হয়নি। আমাদের বিয়ের পরপর কিন্তু এতটা দূরত্ব ছিলো না। ইদানীং দূরত্ব বেশি বেড়েছে।’

নীলাক্ষী মন দিয়ে ভাবীর কথা শোনে। ভাবী প্রাণ খুলে কথা বলছে। ভেতরে জমে থাকা ধূলো গুলোকে ঝেড়ে ফেলার মতো। কথার ফাঁকে নীলাক্ষী একবার মোবাইল বের করে অম্লানকে এসএমএস পাঠালো, ‘কতদূর?’

অম্লানের রিপ্লাই এলো না। নীলাক্ষী ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। শ্রাবণের ধারার মতো বিশুদ্ধ একটা মেয়ে দোয়েল। বড় বোনের মতো যাকে শ্রদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায়। ভাবীর সাথে সম্পর্কটা আরো গভীর করে ফেলার সুযোগটাকে মোটেও হাতছাড়া করতে চাইলো না নীলাক্ষী। দোয়েলকে বললো, ‘ভাবী, তুমি দীর্ঘমেয়াদি ফ্যামিলি প্লানিং করেছো?’

দোয়েলের শ্বেতকায় বদনখানি মুহুর্তেই লজ্জার লাল আভায় ঢেকে গেলো। মেঝের দিকে তাকিয়ে এক পলক লাজুক হাসি দিয়ে বললো, ‘হুম। দুইমাস হলো বাদ দিয়েছি।’

মিষ্টি করে হাসি ফেরত দিলো নীলাক্ষী। কপালে পড়লো দুষ্টুমি ভরা সুক্ষ্ম ভাঁজ। খানিক ঝুঁকে এসে বললো, ‘ব্যাপার কি ভাবী? হুমমম?’

দোয়েল লাজুক হাসিতে মাথা নুইয়ে ফেলে। টেবিলের ওপর রাখা ডান হাতের ওপর লুটিয়ে পড়ে মুচকি মুচকি হাসে সে। নীলাক্ষী ফিসফিস করে বললো, ‘কিছু চাচ্ছো নাকি?’
– ‘হ্যাঁ রে। তিন বছর তো হলো। একটা বাচ্চা না হলে বাড়িটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে না?’
– ‘বাড়ি শূন্য শূন্য লাগবে কেন? এত লোক বাড়িতে। বলো তোমার কোল শূন্য লাগছে।’

দোয়েলের চেহারায় এক ধরণের নিষ্পাপ আভা ফুটে উঠলো। যেই আভায় মিশে আছে ‘মা ‘মা ‘ ধরনের সৌন্দর্য। একটা মেয়ে বোধহয় মা হওয়াতেই জীবনের সব স্বার্থকতা খুঁজে পায়। নীলাক্ষীর ভালো লাগছিলো দোয়েলের এই বিশুদ্ধ মুখখানা দেখতে। ঠিক এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালো অম্লান ও তার বড় ভাই অনিক।

অনিকের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়েই বড়সড় ভিড়মি খেয়ে যায় দোয়েল। বুকটা ধক করে ওঠে। মুখের হাসি মিলিয়ে যায় মুহুর্তেই। ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা চাপা অভিমানেরা দলবেঁধে বেরিয়ে আসার বায়না সাজায়। মাথা নিচু করে ফেলে। অনিক এসেছে, এটা তার কাছে স্বপ্নাতীত ব্যাপার।

অনিক দোয়েলের পাশে বসে। তবে অপ্রস্তুত বোধ করে সে। এখানে আসার আগে অম্লান পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছে যেন এসেই ভাবীকে একবার জড়িয়ে ধরে। হাত ধরে মিষ্টি করে সরি বলতেও শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সংকোচে কিচ্ছুটি করার জো নেই অনিকের। সে ফাঁদে ধরা পড়া পাখির মতো করুণ চোখে শুধু এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরে বললো, ‘কি অবস্থা নীলাক্ষী? সব ভালো?’

নীলাক্ষী ড্যাবড্যাব করা চোখে অম্লানের দিকে তাকায়। ভাইয়া দোয়েলের সাথে কথা না বলে তাকে কেন মিছেমিছি প্রশ্ন করছে! নীলাক্ষী বললো, ‘হ্যাঁ ভাইয়া ভালো। আমি খাবারের অর্ডারটা দিয়ে আসি। এই তুমি যাবে?’

প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে সবেমাত্র আরাম করে বসেছিলো অম্লান। নীলাক্ষীর প্রশ্নে মুখ তোলে সে, ‘হ্যাঁ যাই।’

নীলাক্ষী ও অম্লান উঠে যায় চেয়ার ছেড়ে। মূলত অনিক ও দোয়েলকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়াটাই মূখ্য উদ্দেশ্য। দুজনে খাবারের অর্ডার না দিয়ে সোজা রেস্টুরেন্টের বারান্দায় চলে আসে। বাইরে আসতেই দখিনা পবন এক ঝাপটা শীতলতা মাখিয়ে দিয়ে যায় উভয়কেই।

অম্লান বললো, ‘সারাদিন দেখি নাই।’
‘কি?’
‘জানো না?’
‘না তো। কি দেখো নাই? মোবাইল?’
‘নাহ। আমার যক্ষের ধন।’
‘সেটা তো তোমার ড্রয়ারে। সিন্ধুকে তালাবদ্ধ করে রাখা।’
‘সেটার কথা বলিনাই মিস। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নীল আলুর কথা বলেছি।’
‘দেখো আলু কখনো নীল রঙের হয় না।’
‘হয় হয়। ব্যক্তিগত আলু নীল রঙের হয়।’
‘ব্যক্তিগত আলু?’

অম্লান নীলাক্ষীর পাশে এসে দাঁড়ায়। পকেট থেকে একটা বেলী ফুলের মালা বের করে পরিয়ে দেয় নীলাক্ষীর খোপায়। চুলে হাত রেখে অবাক হয়ে অম্লানের দিকে তাকায় নীলাক্ষী, ‘কি সুন্দর ঘ্রাণ! থ্যাংক ইউ।’
অম্লান হাত বাড়িয়ে বললো, ‘এবার আমার গিফট টা দেন।’
– ‘কিসের গিফট?’
– ‘বিয়ের দেড় মাস পূর্তি হলো না? সেই গিফট। দিয়ে দেন তারাতাড়ি।’

নীলাক্ষী এবারও হা করে। তবে বিস্ময়ে নয়, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। তার মুখে কথা ফোটে না। কেবল অগ্নিশিখার ন্যায় চোখ দুটি তুলে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে অম্লানের দিকে।

দোয়েল জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। তার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। মনে শঙ্কার তরী তীরে এসে ঠেকেছে, এখনো কূল খুঁজে পায়নি। ব্যকুল হয়ে তরী ভিড়াবার আপন জায়গাটি খুঁজে চলেছে সে।

অনিক স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘রেস্টুরেন্টে আসবা আমাকে বলো নাই যে?’
নির্বিকার দোয়েল। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে অনিক গলা খাকাড়ি দেয়। দোয়েলের কানের কাছে এগিয়ে এসে বলে, ‘রাগ করছো? সরি। আমি ব্যস্ত ছিলাম বুঝছো। এজন্য সারাদিন কল দিতে পারিনাই। আসলে সত্যি কথা বলতে আমি না আজকের দিনটা ভুলে গেছিলাম। সত্যিটাই স্বীকার করলাম। এখনো রাগ করে থাকবা? একটা গিফট দিবো। রাগ ভাঙো, হাসি দাও। না হাসলে গিফট দিবো না।’

দোয়েল আচমকা হেসে ফেলে। গিফট পাবার আশায় নয়, অনিকের কথার ধরণ শুনে। লোকটা এত সোজাসাপটা কথা বলে যে হাসি পেয়ে যায়। রোমান্টিক হলো না আজও! দোয়েল মুচকি হেসে বললো, ‘রাগ করে আছি। কথা বলবো না।’
– ‘আচ্ছা না বলো নাই। হাসি তো দিছো। তাইলে তো পাওনা দিতেই হয়। এই নাও গিফট।’

অনিক একটা ব্যাগ এগিয়ে দেয় দোয়েলের দিকে। দোয়েল বিস্মিত চোখে একবার ব্যাগটার দিকে তাকায়, আরেকবার অনিকের দিকে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বাঁকা হাসির আভাস। চোখ ভরা আবেগী কৌতুহল। দোয়েলের মনের কূলহারা তরী তার আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। জমে থাকা হাজারও লাল নীল অভিমানগুলি নক্ষত্র হয়ে উবে গেছে আকাশে। ঝকঝকে পরিষ্কার মন নিয়ে দোয়েল গিফটের প্যাকেট খোলে।

এবার দারুণ চমকাবার পালা। একটা স্বর্ণের চেইন ঝলমল করে উঠলো দোয়েলের সামনে। মুহুর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো দোয়েল। তার স্বামী কখনো একসাথে দুই হাজার টাকাও তার পেছনে খরচ করেছে বলে কদাচিৎ মনে পড়ে। আজ স্বর্ণের গয়না! কম করে হলেও পনেরো হাজারের বেশি তো হবে ই। দোয়েল স্থির চোখে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘পছন্দ হইছে? না হইলে আমার দোষ নাই। অম্লান পছন্দ করে দিছে।’

দোয়েল একটা নিশ্বাস ফেলে। অম্লান নিশ্চয় বুদ্ধি করে জোরপূর্বক এটা কিনতে বাধ্য করেছে। নয়তো অনিকের ঘটে এই সুবুদ্ধি কখনো আসতো না। তবে যাই হোক, এত বছর কোনোকিছু না পাওয়ার অভাবটা হয়তো একটা উপহার দিয়েই পূর্ণ করে দিলো। দোয়েল অনিকের দিকে বিস্মিত আবেগ মাখা চোখে তাকিয়ে থাকে, তার মুখে কথা আসে না।

খাবারের অর্ডার দিয়ে চেয়ারে এসে বসে অম্লান ও নীলাক্ষী। দোয়েলের হাতে থাকা লাল রঙা ছোট্ট বক্সখানা দেখে বিস্ফারিত চোখে নীলাক্ষী জানতে চায়, ‘এখানে কি ভাবী? ভাইয়া দিলো বুঝি?’

অনিক অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সে ঠিক অভ্যস্ত নয়। দোয়েল হাসিমুখে বক্সটা এগিয়ে দেয়। ভেতরে জ্বলজ্বল করা স্বর্ণের চেইন হাতে নিয়ে মুগ্ধ চোখে নীলাক্ষী অম্লানের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ আগে অম্লান বলেছিলো ভাবীর জন্য সে একটা গিফট কিনে ভাইয়াকে দিয়েছে। ভাইয়ার হাতে কোনো টাকা ছিলো না। নীলাক্ষী যেন সেটা দেখে রাগ না করে। নীলাক্ষীর রাগ হলো না, কিন্তু ভীষণ অবাক হয়েছে সে। ভাবীর জন্য এত দামী গিফট, অথচ ভাবী কখনো জানতেও পারবে না এটা অম্লানের দেয়া। তবুও মেয়েটা খুশি হোক। আর এটা দেখেও যদি অনিক ভাইয়া কিছু শিখতে পারে তাতেই স্বার্থকতা। নীলাক্ষী ঝলমলে গলায় বললো, ‘ভাবী, ভাইয়া নাকি রোমান্টিক নয়? এত চমৎকার গিফট কিনেছে তোমার জন্য। এক্ষুনি গলায় দাও। দারুণ মানাবে তোমাকে।’

নীলাক্ষী ডানহাতে চেইনটা এগিয়ে দেয় দোয়েলের দিকে। অনুভব করে চেয়ারে রাখা তার বামহাত টা অম্লান শক্ত করে চেপে ধরেছে। হাত ধরারও কিছু অর্থ থাকে। এই হাত ধরার মানে, তুমি মন খারাপ কোরো না। আমি তো তোমারই। একদিন তোমাকেও অনেক দামী কিছু গিফট দেবো।

নীলাক্ষীর মন খারাপ হয় নি। বরং ভালো লাগে, স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে সে। সম্পর্কগুলো এভাবেই ভালো থাকুক সবার।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here