পর্ব ৮

নীলাক্ষী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখছিলো অম্লানকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় কি না। সেই কখন বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে, তারপর থেকে আর ওর গলাটাও শোনা গেলো না। অনেক্ষণ দেখতে না পেয়ে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। একরাতের ব্যবধানে একজনের প্রতি এইরূপ বিচিত্র অনুভূতির আনাগোনা দেখে নীলাক্ষীকে বিস্মিত হতেই হয়। কই, কভু তো কারো জন্য এমনতর লাগেনি কখনো। তাকে দেখার জন্য চোখ দুটো কেমন চাতকের মতো এদিক সেদিক ঘুরছে, একবার দেখতে পেলেই বোধহয় চক্ষের তৃষ্ণা মিটবে। কান দুটো খাড়া হয়ে আছে, সুক্ষ্ম হলেও যদি একবার তার গলাটা শুনতে পাওয়া যায়। দরদীয়া মনের কাজকর্ম বোঝার সাধ্যি নেই ভেবে নীলাক্ষী দোয়েলের সাথে বসে রইলো। এ ঘর, ও ঘর ঘুরে দেখার পর কেবল একটি কথাই মনে হয়েছে, ‘বাড়ির মানুষ গুলো ভীষণ রুচিশীল। প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় ভীষণ যত্নের ছাপ। ঘর সাজানোর জিনিসগুলোতে তাদের রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।’

শাশুড়ী মায়ের সাথে এখনো ভালো করে গল্প করা হয়নি। তবে মাঝেমাঝে তিনি এসে বিভিন্ন খাদ্যবস্তু খেতে দিচ্ছেন। যেমন একবার এলেন তরমুজ নিয়ে, একবার পেপে, একবার হাঁসের ডিম, একবার আমের জুস। এরকম আদর সারা বছর ধরে চললে তো নীলাক্ষী ফুলে ফেঁপে আলুর বস্তা হয়ে যাবে, এই ভেবে ও হেসে নিলো খানিক্ষণ। কিন্তু অম্লান সাহেব কোথায়! তাকে এখনো দেখা যাচ্ছে না যে। দাদীর কথাটা একেবারে মিলে গেলো দেখছি। দূরে গেলে তার প্রতি প্রবলভাবে টান বেড়ে যায়। নীলাক্ষীও অনুভব করছে সেই অমোঘ টান।

বাদামী সংসার
লেখক- মিশু মনি

নীলাক্ষী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে উদগ্রীব চোখে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। এলাকার নাম লালমাটিয়া। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন এলাকা। গাড়ি চললেও এ রাস্তায় কখনো জ্যাম হয়না বললেই চলে। ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটাই অধিক শান্তিপূর্ণ এলাকা। নীলাক্ষীর হাত দুটো রাখা গ্রিলে। আনমনে ভাবছিলো নানান আঁকিবুঁকি। ভাবনা গুলো কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না। এক ভাবনা থেকে দ্রুত অন্য ভাবনায় ঢুকে যায়। হঠাৎ একটা শক্তপোক্ত দেহ পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে নীলাক্ষীর দুটো হাতের ওপর হাত রাখে। কাঁধের ওপর মাথা রেখে বলে, ‘মিস নীলালুর কি মন টন খারাপ?’

নীলাক্ষী কয়েক সেকেন্ডেই বরফের মত জমতে শুরু করেছে। হৃদস্পন্দন গাড়ির গিয়ারের মত এক ঝটকায় দ্রুত উপরে উঠে গেছে। ও মৃদুস্বরে শুধু বললো, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?’
– ‘বাইরে গিয়েছিলাম একটু।’
– ‘ওহ আচ্ছা। নীলালু মানে কি?’
– ‘নীল আলু?’
– ‘কি? আমি কি আলুর মতো?’
– ‘আদর করে ডাকলাম আরকি। তুমি কি কি করলে এতক্ষণ ধরে?’

নীলাক্ষী খানিক্ষন চুপ করে থাকে। একটা ঢোক গিলে গলা খাকাড়ি দেয়, তারপর মৃদুস্বরে বললো, ‘সবগুলো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখেছি। মা’র সাথে বসে গল্প করেছি, ভাবির সাথে করেছি, আর একটু পরপর এটা সেটা খেয়েছি।’

অম্লান বাচ্চাদের সাথে কথা বলার মত ভীষণ নরম সুরে আদর মিশিয়ে বললো, ‘ওমা তাই! আমার লক্ষী বউটাকে কে খাইয়েছে একটু পরপর?’
– ‘মা।’
– ‘বাব্বাহ। নতুন অতিথি তো তাই।’
– ‘আমি কি নবজাতক শিশু নাকি?’
– ‘একদম না। নববধূ।’

অম্লানের একটা হাত নীলাক্ষীর আঙুলে ইতিমধ্যেই খেলা শুরু করে দিয়েছে। ভীষণ লজ্জা লজ্জা লাগে নীলাক্ষীর। অম্লান ওকে ঘুরিয়ে ওর দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘তোমার জন্য একটা জিনিস আছে।’
– ‘কি জিনিস?’
– ‘আরে আছে কিছু একটা।’
– ‘আপনি আমাকে এত জিনিস দিচ্ছেন অথচ আমি তো আপনাকে কিছুই দিতে পারছি না।’
– ‘তুমি আমাকে কিছু না দিলেও চলবে। আমার বৃদ্ধ বয়সে আমাকে ভালোবেসো, পাশে থেকো। তাহলেই হবে।’

নীলাক্ষী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে চোখ পিটপিট করে। এমন আবদার কে বা কার কাছে করতে পারে! একটা মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করে তার শেষ বয়সে। ছেলেমেয়েরা আলাদা হয়ে যায়, বন্ধুবান্ধব থাকে না, কাজ থাকে না, থাকে শুধু অফুরন্ত সময়। সেই সময়টাকেও কোনো কাজে ব্যয় করার মত আইডিয়া থাকে না। এমন সময় বসে শুধু কারো সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই বয়স্কদের গল্পও কেউ শুনতে চায় না। কেবল একজন জীবনসঙ্গী বেঁচে থাকলে তাকেই শেষ বয়সে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়। এ আবদারটুকু পূরণ করতে নীলাক্ষীর ভীষণ ইচ্ছে করে, কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত একসাথে থাকতে পারাটাই তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

অম্লান ঘরে গিয়ে একটা জুতার বাক্স এনে নীলাক্ষীর সামনে রেখে বলে, ‘এটা তোমার জন্য। দ্যাখো তো পায়ে হয় কি না?’

নীলাক্ষীর চোখের পলক কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো। নির্নিমেষ ভঙ্গিতে অম্লানের মুখের পানে চেয়ে নীলাক্ষীর অন্তরতম প্রদেশে এক পরম সুখের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। জুতার বাক্স খুলে দেখে এক জোড়া দুই ফিতাওয়ালা জুতা!

সুখে আচ্ছন্ন হয়ে নীলাক্ষী বিছানায় বসে থাকে। মুখে কথা ফোটে না তার। ফ্যানের বাতাসে পৃষ্ঠদেশে মেলিয়ে রাখা চুলগুলো দিগ্বিদিক হয়ে উড়তে থাকে। সীমান্তবর্তী পতাকার মতো। নীলাক্ষী স্তব্ধ হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। বাবার কথা মনে পড়ে যায় ওর। অম্লান পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, ‘জুতা পছন্দ হয়নি?’

নীলাক্ষী নিশ্চুপ।

অম্লান আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে তোমার?’

এবারও নীলাক্ষী চুপ। শান্তবিশিষ্ট প্রাণীর ন্যায় ঝিম মেরে বসে থাকে সে। আর ফ্যালফ্যাল করে দু একবার অম্লানের দিকে তাকায়, ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে মেঝের দিকে চায়। অম্লান বললো, ‘একটা চুমু খাই?’

ফিক করে হেসে ফেলে নীলাক্ষী। অম্লানকে জড়িয়ে ধরে লাজুক ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। অম্লানের মনে হয় গতরাতের সেই মিষ্টি হাসিটার সাথে এই হাসির খানিক মিল পাওয়া গেছে। মাঝেমাঝে ওকে লজ্জায় রাঙিয়ে দিলে এরকম একটা হাসি ফেরত পাওয়ার আশা করা যেতেই পারে৷ অম্লান নীলাক্ষীর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। কেন যেন মনেহয়, শহরের সব ভালোলাগা গুলো এখন এই ঘরের জানালায় এসে ভিড় করছে। ভালোলাগার আলোয় আলোকিত হয়ে বসে আছে দুটো পাখি। মেয়ে পাখিটির নাম নীলাক্ষী আর পুরুষ পাখিটির নাম অম্লান।

সাউন্ডবক্সে গান ছেড়ে দিয়ে একদল নাচানাচির পসরা সাজিয়েছে। তাদের আনন্দ আর হৈ চৈ এ ঘরকেও মাতিয়ে তুলেছে যেন। দিনদুপুরে প্রেমের আদরে মাখামাখি হয়ে পাখিদুটো এখন বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের রং দেখছে। জানালা দিয়ে রোদের ঝিলিক এসে পড়েছে ঘরে।

নীলাক্ষী সহজ গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনার সারপ্রাইজ পেতে কেমন লাগে?’
– ‘সারপ্রাইজ তো সারপ্রাইজড করার জন্যই। আমার লুঙি খুলে নাচতে ইচ্ছে করে।’
– ‘ছি, কি বলছেন এসব?’
– ‘ছি বলছো কেন? ভেতরে আন্ডারওয়ার থাকবে। আর না থাকলেও সমস্যা কি, তুমিই তো।’
– ‘আপনি এমন ক্যান!’

অম্লান হো হো করে হাসে। কাছের মানুষকে লজ্জায় ফেলে দেয়ার মত দুষ্টুমি মার্কা আনন্দ বোধহয় আর একটিও নেই। কিন্তু নীলাক্ষী মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকে। এরপর অনেক্ষণ অম্লানের দিকে তাকাতেও ওর লজ্জা করবে। অম্লান বললো, ‘তোমার সারপ্রাইজ পেতে কেমন লাগে বলো? উত্তরটা শিখে নেই। এরপর থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে ওই উত্তরটা বলবো।’

নীলাক্ষী হেসে বললো, ‘আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করে খুব মজা পান?’
– ‘খুউউউব। অনেক্ষণ পায়খানা চেপে রাখার পর পেট খুলে হাগলেও এত শান্তি পাই না।’

নীলাক্ষী দুই ঠোঁট কুঁকড়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বিছানায় উঠে বসে। ওর ইচ্ছে করে অম্লানকে ধরে একটু মাইর টাইর দিতে। জোরে নয়, আস্তে। আদরমাখা মাইর। কিন্তু না দিয়ে চোখমুখ শক্ত করে ও বসে থাকে বিছানার উপর। অম্লান জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হলো? বললা না তো কেমন লাগে?’

নীলাক্ষী বললো, ‘আমাকে কেউ কখনো সারপ্রাইজ দেয় নাই। কেউ কখনো গিফট ও দেয় নাই। তাই এর আনন্দ জানি না। আপনি একটু আগে যে জুতাটা আনলেন এইটা কি সারপ্রাইজ ছিলো?’
– ‘না। এটা ভালোবাসা ছিলো। সারপ্রাইজ যখন দেবো, তখন দেইখো কেমন লাগে।’
– ‘ভালোবাসা কি সারপ্রাইজ নয়?’
– ‘না। ভালোবাসা হইতেছে দুইটা হরমোনের কাজ কারবার আরকি। সারপ্রাইজ অন্য জিনিস।’
– ‘আপনি কি জানেন আপনি মারাত্মক লেভেলের ফাজিল?’
– ‘ফিফটি পারসেন্ট জানতাম। মানে আমি ফাজিল সেইটা জানতাম কিন্তু মারাত্মক লেভেলের কিনা সেইটা জানতাম না।’

নীলাক্ষী হেসে বললো, ‘আপনি দুনিয়ার সবথেকে ফাজিল লোক।’
– ‘এইটা মিথ্যা কথা। দুনিয়ায় আমার চেয়েও ফাজিল লোক আছে।’
– ‘আপনার সাথে আমি পারবো না। ইস্তফা দেন।’
– ‘পারবা না ই তো। পুরুষ লোকের এনার্জি আর মেয়েলোকের এনার্জি আলাদা জিনিস।’

নীলাক্ষী দুই ভ্রু’য়ের মাঝখানে ভাঁজ ফেলে ঠোঁট মুখ বাঁকা করে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ওর যে কি করে ফেলতে ইচ্ছে করে নিজেও বুঝতে পারছে না। অবশেষে ক্ষান্ত হয়ে বলে, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি।’
– ‘হা হা। যাইও না। আসো এবার ভালো কথা বলবো। আসো না, আমার লক্ষী বউ।’

নীলাক্ষী মুচকি হেসে অম্লানের পাশে শুয়ে পড়ে। অম্লান একহাতে নীলাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো। তোমাকে কেউ কখনো গিফট দেয়নি তাইনা?’
– ‘না। তবে হাইস্কুলে আমার একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ওর নাম অবনী। ও আমাকে গিফট দিতো। ওর দেয়া চারটা গিফট আমি যত্ন করে রেখেছি।’
– ‘এরপর আর কেউ দেয়নি?’
– ‘না।’
– ‘অবনীও দেয়নি?’
– ‘অবনী তো ক্লাস নাইনে উঠে স্কুল চেঞ্জ করেছে। তারপর শুনেছি ওরা ইন্ডিয়ায় না কোথায় যেন চলে গেছে। আর আমাদের কক্ষনো যোগাযোগ হয়নি।’

অম্লান করুণ সুরে বললো, ‘আহা রে। একটা মাত্র গিফট দেয়ার মানুষ ছিলো, তাও চলে গেলো। দুঃখজনক।’

নীলাক্ষী বললো, ‘গিফটের জন্য নয়। আসলে ওর মত বান্ধবী আমি আর একটাও পাইনি। ও আমার কলিজার টুকরো ছিলো। কত্ত ভালোবাসতাম। কিন্তু কেন যে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো! আসলে বন্ধুত্ব কখনো হারায় না, হারিয়ে যায় যোগাযোগ।’

অম্লান বললো, ‘হুম। মন খারাপ কোরো না। এখন তো আমি আছি, তোমাকে সারপ্রাইজের স্বাদ দেবো। এত এত সারপ্রাইজ দেবো যে ভাবলেও সারপ্রাইজড হয়ে যাবা।’
– ‘সত্যিই!’
– ‘হুম।’
– ‘জানেন আজকে ভাবী কি বলছে?’
– ‘কি?’

নীলাক্ষী উপুর হয়ে শুয়ে অম্লানের দিকে ফেরে। অনেক আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘আজকে ভাবী বলেছে সে সবসময় চাইতো তার একটা বোনের মত জা হোক। দুজনে মিলে একসাথে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে থাকবে। রান্নাবাটি খেলার মত একটা সুন্দর সংসার সাজাবে। আমিও না ওরকম একটা সংসারের স্বপ্ন খুব দেখি। ভাবীকে আমার এত্ত ভালো লেগেছে!’

অম্লান বললো, ‘ভাবী আমার বোনের মতই। আপুর বিয়ে হয়ে গেছে সেই ছোটবেলায়। ভাবীকেই জ্বালিয়েছি। মাঝেমাঝে রাত দুইটায় বাসায় এসে ভাবীকে ডেকে বলতাম একটা ডিম ভেজে দাও। ভাবী ঘুমঘুম চোখে আমার জন্য ডিম ভেজে নিয়ে আসতো।’

ভাবীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা আরো ছেয়ে যায় নীলাক্ষীর। মনেমনে সংকল্প করে, কখনো ভাবীকে ও স্বেচ্ছায় কষ্ট দেবে না। আজীবন বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করবে। ভাবীর কাজে হোক, প্রয়োজনে হোক, সবসময় পাশে থেকে মানুষটার আপন হয়ে উঠতে চেষ্টা করবে। জীবনে যদি সম্পর্কগুলোকে মিষ্টি মধুর রাখা না যায় তাহলে আর কেমন মানুষ হলাম!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here