বাদামী সংসার
পর্ব ৪৮

ব্যস্ত মহাসড়ক। পিপড়ার মতো সারিবদ্ধ হয়ে গাড়িগুলো এগিয়ে চলছে। দমকা হাওয়ায় ধূলো উড়ছে, উড়ছে গাছের শুকনো পাতা। নীলাক্ষী ফুটপাত ধরে হাঁটছে, ওর পিছনে দ্রুতপদে ছুটছে অম্লান। মুখে বলছে, ‘নীলু প্লিজ আমার কথা শোনো। আমার অপরাধের জন্য আমি অনুতপ্ত।’

নীলাক্ষী দাঁড়িয়ে পড়লো। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় ওকে ভীষণ মোহনীয় সুন্দর দেখাচ্ছে। অম্লান কাছে এসে বিনয়ের সাথে বলল, ‘আমি কী তোমার ক্ষমার যোগ্য নই?’
‘তুমি কী চাও?’

অম্লান থতমত খেয়ে চেয়ে রইলো। সম্ভবত এমন প্রশ্ন সে আশা করে নি।

নীলাক্ষী বলল, ‘চাচ্ছো কী বলো না? আমাকে টেকনাফে নিয়ে যেতে? আট দশটা মেয়ের মতো ঘর সংসার সামলাবো, রাত্রিবেলা তোমার সঙ্গে প্রেম করবো আর সকালে অফিসে যাওয়ার সময় তুমি ভুলেই যাবে আমি তোমার স্ত্রী। দুইবেলা ভাত রান্না আর বাচ্চা জন্মদান ছাড়া আর কী কারণে তোমরা বিয়ে করো বলো তো?’

অম্লান বলল, ‘রান্না আর বাচ্চার জন্য সবাই বিয়ে করে না নীলু। অন্তত আমি তো নই। আমি পরিবারের চাপে বিয়ে করেছি।’

‘পরিবারের চাপে সংসার করতে হবে না। তুমি মুক্ত। পাখির মতো থাকো। তোমার ঘরণীর জন্য ভাত কাপড় জোগাড়ের দায়িত্বও তোমাকে নিতে হবে না। সেটা সে নিজেই জোগাড় করতে পারে। আর কিছু বলতে চাও?’

অম্লান একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। নীলাক্ষীকে কীভাবে নিজের অনুভূতিটা বোঝাবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ওর নেই। সম্পর্কটা তো আগের মতো সহজ স্বাভাবিক অবস্থায় আর নেই!

তবুও মৃদু স্বরে বলল, ‘নীলু, আমার কথাগুলো তুমি শুনবে প্লিজ? ভালো করে শোনো?’

‘হুম শুনবো। রাত বাড়ছে। এই রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে নাটক করতে হবে না। বাসায় চলো।’

‘কোন বাসায়?’

‘আমার বাসায়। যেখানে আমার জন্মদাতা বাপ আছে। তোমার বাসাটাকে আমার বাসা বলার মতো সময় আছে এখনও? ওটা তো যেদিন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য সুদূর টেকনাফে ট্রান্সফার নিয়েছিলে, সেদিন তোমার সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেছে।’

অম্লান ফিক করে হেসে বলল, ‘তুমি এই কয়েকদিনে জটিল সব যুক্তি শিখে গেছো। অথচ আমি তোমাকে ভাবতাম অনেক সাদামাটা একটা মেয়ে। এই, তুমি আজকাল টিভি সিরিজ দেখো নাকি?’

নীলাক্ষী কঠিন চোখে তাকালো। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো ওর। অম্লান ভেবেছিল এই হাস্যরসে নীলাক্ষী হয়তো হেসে ফেলবে। কিন্তু ওর চেহারার কাঠিন্য দেখেই বুঝতে পেরেছে এই নীলু আর আগের নীলু নেই!

নীলাক্ষী একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল অম্লান। নীলাক্ষী রসহীন কণ্ঠে বলল,

‘তোমাকে কী কোলে নিয়ে রিকশায় ওঠাতে হবে?’

‘আমাকে কোলে নেয়ার মতো শক্তিও আজকাল হয়েছে নাকি?’

মুখ টিপে হেসে রিকশায় উঠে বসলো অম্লান। বেশ জোড়ে বাতাস বইতে শুরু করেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। নীলাক্ষী রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘মামা জোরে টানুন।’
‘উনি তোমার মামা হয়?’ অম্লান জিজ্ঞেস করলো।

নীলাক্ষী দাঁতমুখ শক্ত করে বসে রইল। অম্লান বলল, ‘আপনি আমার মামা শ্বশুর? এতদিন পরিচয় হলে আমাকে আর কষ্ট করে লোকাল বাসে এখানে সেখানে যাতায়াত করতে হয়? আমি তো মামা শ্বশুরের রিকশাতেই যেতে পারতাম।’

রিকশাওয়ালা হাসতে হাসতে বলল, ‘মামা, আমি এই শহরের সবারই মামা হই।’
‘আপনার বাবার তাহলে অনেক নাতি। সৌভাগ্যবান পুরুষ।’
‘আমিও সৌভাগ্যবান। আমার অনেক ভাগ্নে ভাগ্নী।’
‘তাও ঠিক। আমি আরও ভাবলাম আমার স্ত্রী’র স্পেশাল মামা হন কী না। আপনার ভাগ্নীকে একটু বোঝান না মামা। খুব ঝামেলা করতেছে।’

রিকশাওয়ালা কিছু বলল না। অনেক যাত্রীই তার রিকশায় উঠে ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলে, সে ভ্রুক্ষেপ করে না। সবার কথাই কানে আসে, শুনেও না শোনার ভান করে থাকতে হয় তাকে। সে কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না।

অম্লান বলল, ‘নীলু, সিনেমার নায়িকাদের মতো তুমি আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দেবে না তো?’
‘কী মনে করে?’
‘এইযে বেশী কথা বলছি সেজন্য।’
‘আমি কাউকে কোথাও ফেলে যাই না।’
‘ও আচ্ছা। সে জন্যই আমাকে না জানিয়ে পালিয়ে চলে এসেছো?’
‘পালিয়ে আসিনি। আমি তোমার কাছ থেকে নাটকীয়ভাবে বিদায় নিতে চাই নি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, বিদায় দেবার সময় তোমার মুখের দিকে তাকালে আমার রাগে তোমাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করতো।’
‘খুন! ওরে বাবারে। তুমি তাহলে থ্রিলার সিনেমা দেখা শুরু করেছো?’

নীলাক্ষী উত্তর দিলো না। বাতাসের তীব্রতা বেড়েছে। ধুলো উড়ছে এখন। এই ধূলোঝড়ে রিকশা চালানো কষ্টকর। নীলাক্ষী বলল, ‘মামা আপনি রিকশা দাঁড় করান। এভাবে যাওয়া সম্ভব না।’

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো রিকশা। নীলাক্ষী রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার পাশের এক কফি শপের দিকে এগোলো। অম্লান বলল, ‘তোমার থ্রিলার মুভিতে বুঝি নায়িকারা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দেয়?’
‘তোমার মতো কাপুরুষ মিথ্যাবাদী প্রেমিক থাকলে দেয়।’
অম্লান থমকে দাঁড়াল। এই প্রথম নীলাক্ষীর একটা বাক্য ওকে বাঁণ মেরেছে। অম্লানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো নীলাক্ষী। ওর কঠিন চোখ অম্লানের ভেতর ঝড় তুলে দিতে বাধ্য।

কফিশপের ভেতর মাত্র কয়েকটা চেয়ার টেবিল। লোকজন কেউ নেই। টেবিলের ওপর সুন্দর আলো জ্বলছে। একটা টেবিলে গিয়ে বসলো নীলাক্ষী। অম্লান ওর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেও মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে কিছু ভাবতে লাগল। নীলাক্ষী নিজের জন্য একটা ক্যাপাচিনো কফি অর্ডার করে অম্লানকে বলল, ‘কী দেবো?’
‘চা।’
‘মালাই? মাসালা?’
‘আদা লেবু দিয়ে রং চা।’
‘তোমার কফি পছন্দ।’

অম্লান চুপ করে রইল। চাইলেও এই মুহুর্তে স্বাভাবিক হতে পারছে না অম্লান। নীলাক্ষী বলল, ‘বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কখন থামবে কে জানে।’

কফি চলে আসার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত চুপ করে রইল দুজনে। অম্লান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, ‘পরিস্থিতি মানুষকে অনেক বদলে দেয় তাইনা?’
‘সেটা আমারই তোমাকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল, নয় কি?’
‘তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন আমাদের কখনো পরিচয়ই ছিল না।’
‘আমি এমনভাবে কথা বলছি যেন আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘আসলেই কি গেছে নীলু?’
‘সেটা কী আমার চাইতে তোমার ভালো জানার কথা নয় অম্লান? আমি তোমার পরিবর্তন মেনে নিতে পারছিলাম না। সবকিছু ফেলে ছুটে চলে গেছি তোমার কাছে। যে আমি কোনোদিনও বাড়ি থেকে অফিস আর রেস্টুরেন্ট ছাড়া এই শহরের বাইরে কখনো একা যাইনি। সেই আমি কতটা দুঃসাহস পেলে একা একা বাসে উঠে টেকনাফ যেতে পারি? কেন গিয়েছি?’

অম্লান নীলাক্ষীর মুখের দিকে তাকাতে পারে না। ওর গা শিরশির করে উঠছে।
নীলাক্ষী বলল, ‘আমি নিজেদের ঘরের একটা সমস্যাকে রাস্তাঘাট, রিকশা বা কফিশপে নিয়ে আসতে চাই না। ওটা আমাদের বেড আর বেডরুম পর্যন্তই থাকুক। এখন আমরা চাইলে অন্য বিষয়ে কথা বলতে পারি?’

অম্লান অবাক হয়ে নীলাক্ষীর দিকে তাকালো, ‘আমরা ঘরে অশান্তিতে থাকবো আর বাইরে সেটা নিয়ে কথা বলবো না?’
‘না। কারণ অশান্তিটা ঘরেই তৈরি হয়েছে।’
‘আর বাইরে আমরা শান্তিতে আছি?’
‘হ্যাঁ আছি তো। চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তাঘাট ফাঁকা, ঝুম বর্ষণের সাথে মাতাল হাওয়া। কত রোমান্টিক পরিবেশ। কফিশপে কফির কড়া সুঘ্রাণ, আশেপাশে কেউ নেই। পুরো কফিশপ জুরে শুধুই আমরা দুইজন। আর কি চাও?’

অম্লান বিস্মিত চোখে নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটাকে তার হঠাৎ করেই খুব অদ্ভুত লাগছে। ওর কথার ধরনে ঠিক বোঝার উপায় নেই ও সন্ধি চাচ্ছে নাকি বিচ্ছেদ!

নীলাক্ষী বলল, ‘আমরা ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে কথা বলতে পারি। তোমার কোন খেলা পছন্দ?’
‘আমরা এখানে খেলা নিয়ে কথা বলবো?’
‘তাহলে কী নিয়ে কথা বলবো? তুমি সেক্সের ব্যাপারে খুব দক্ষ সেটা নিয়ে? নাকি প্রেমের অভিনয়ে তোমার চাইতে সেরা কেউ নয়, বাংলা নাটকের জন্য তোমার থেকে স্ক্রিপ্ট নেয়া উচিৎ, সেটা নিয়ে?’

অম্লান চায়ের কাপ শক্ত করে ধরে বলল, ‘চুপ করো। এটা কফিশপ।’
‘ওহ আচ্ছা। কফিশপে ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তর্ক করা যায় আর ক্রিকেট ফুটবল নিয়ে কথা বলা যায় না?’
‘ নীলাক্ষী, তুমি কী জানো খুব অদ্ভুত আচরণ করছো তুমি?’
‘জানি না তো। আমার আচরণ তোমার কাছে অদ্ভুত লাগবে, আমার কাছে নয়। তুমি গত দু তিন মাস আমার সাথে যে অদ্ভুত আচরণ করেছো সেসবের দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটাই কী স্বাভাবিক নয়?’
‘আচ্ছা থামো। আমরা বাসায় গিয়ে এসব নিয়ে কথা বলবো ‘
‘এই তো, ভালো ছেলে। বলো, তোমার ক্রিকেট পছন্দ নাকি ফুটবল?’
‘ফুটবল।’
‘ওহ, আমার ক্রিকেট। বৃষ্টি কমে এসেছে, আর আমার কফিও। তাহলে যাওয়া যাক।’

অম্লান উঠে দাঁড়ালো৷ নীলাক্ষীর সাথে সম্পর্কটা আবারও গড়ে উঠবে নাকি এটা একেবারেই ভেঙে পড়ে যাবে, সেটা ভেবে আতংকিত বোধ করছে অম্লান। নীলাক্ষী কফির বিল পরিশোধ করে বাইরে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে নিলো। ওকে অনুসরণ করলো অম্লান। অস্বস্তিতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here