বাদামী সংসার
পর্ব ৪০
মানুষের যখন ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে, তখন চোখ দুটো বেঈমানী করে। চোখ নিজের ওপর আস্তরণ টেনে দেয়, যাতে সহজে চোখ ফেটে জল না আসে। অবশ্য পুরুষ মানুষরা যখন তখন কাঁদতে পারে না। পুরুষের কান্না অনেকটা কালবৈশাখী ঝড়ের মতো। সারা বছর আসে না, যখন আসে, তখন এমনভাবে আসে যে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়।
নীলাক্ষী সমুদ্র জলে পা ভিজিয়ে হাঁটছে। ওর ফর্সা পা দুটোতে জড়িয়ে আছে ভেজা বালি। শক্তিমান সূর্য তার সমস্তটুকু তেজ হারিয়ে নিষ্প্রাণ রূপে ডুবুডুবু করছে। ধীরেধীরে আড়াল হওয়ার বাহানায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে সূর্য। নীলাক্ষী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সেই অস্তমিত সূর্যের রূপ দেখছে মুগ্ধ হয়ে। হাতের ইশারায় অম্লানকে ডাকলো নীলা।
অম্লান বালির ওপর স্তব্ধ মুখ করে বসে ছিলো। নীলাক্ষী এত সুন্দর আবদারের সুরে ডাকছে যে সেটাকে উপেক্ষা করতেই পারলো না অম্লান। ধীরপায়ে উঠে গেলো সমুদ্রের দিকে। নীলাক্ষী ছুটে এসে অম্লানকে ধরে বললো, ‘যাচ্ছিলে কোথায়?’
‘তোমার কাছে।’
‘আমি কি ওদিকে নাকি? তুমি পাগল?’
এক রাশি জল ঢেউ হয়ে এসে পায়ের ওপর আঁচড়ে পড়লো। ভিজে গেলো শাড়ি। নীলাক্ষী খিলখিল করে হেসে উঠলো। অম্লান বললো, ‘হাসছো কেন? তোমার শাড়ি ভিজে গেছে।’
‘যাক। আমার না ভীষণ আনন্দ হচ্ছে অম্লান, ভীষণ আনন্দ।’
‘তাই!’
‘হ্যাঁ। তোমার মুখ এত শুকনো কেন বলবা?’
‘কই না তো।’
অম্লান জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করলেও হাসিটা যে কৃত্রিম, সেটুকু নীলাক্ষী বোঝে। নীলাক্ষীর মন খারাপ হতে শুরু করেছে। কিন্তু সে-ও দারুণ চতুর। কিছুতেই অম্লানকে বুঝতে দিলো না, তার ভেতরেও একটা চাপা তুষের আগুন ভেতরে ভেতরে পুড়ছে, তাকেও পোড়াচ্ছে।
অম্লান বললো, ‘জলের রাশিগুলো অনেক সুন্দর তাই না?’
‘হ্যাঁ। আমিও অনেক সুন্দর।’
অম্লান নীলাক্ষী কে আলিঙ্গন করে বললো, ‘তুমি তো রূপবতী। আমি যখন একটা আকাশ কিনবো, তখন ওই আকাশে কোনো চাঁদ থাকবে না। সেখানে তোমাকে রাখবো।’
নীলাক্ষী চমকে উঠে বললো, ‘কতদিন পর!’
‘কি?’
‘কিছু না।’
নীলাক্ষী একটা নিশ্বাস ফেললো। মনেমনে ভাবলো, কতদিন পর অম্লান এত সুন্দর করে আমায় কিছু বলেছে। মানুষটাকে হুট করে কেমন অচেনা অচেনা লাগছে। অম্লান কী আমি আসার কারণে বিরক্ত? নীলাক্ষী উত্তর খুঁজে পায় না।
রক্তিম সূর্য টুপ করে সাগরের ওপারে ডুবে গেলো। পৃথিবীতে প্রকৃতির চাইতে সুন্দর কিচ্ছু হয় না। এমন একটা সন্ধ্যায় দুজনে কতই না মাধুর্যতার সাথে কাটাতে পারতো! অথচ অম্লান কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না। নীলাক্ষী চাপা মন খারাপ নিয়ে ধীরেধীরে তীরে উঠে এলো। অম্লান কিছুই জিজ্ঞেস না করে হাঁটা ধরলো বাসার দিকে। পিছুপিছু তাকে অনুসরণ করছে নীলাক্ষী।
বালির ওপর উঠে আসার পর একটা মেয়ে ঝলমলে গলায় বললো, ‘তোমরা অনেক হ্যাপি।’
নীলাক্ষী হেসে ফেললো মেয়েটির কথায়। তার আনন্দোচ্ছ্বাস দেখেই কী এমন ধারণা মেয়েটির? সত্যিই তো তারা একদিন অনেক বেশী ‘হ্যাপি’ ছিলো। সুখের ঝরনা চুইয়ে আনন্দ ঝড়ে পড়তো তার ঘরে, তার বালিশে। আজকে কী হয়েছে নীলাক্ষী জানে না! কোন কালবৈশাখী ঝড় তার সবকিছু চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে এসেছে নীলাক্ষী পাগলের মতো সেই উত্তর খুঁজে বেড়ায়।
বাসায় ফিরে দেখলো বাবা অনেকবার কল দিয়েছেন। নীলাক্ষী হেসেহেসে ফোনে কথা বললো পরিবারের সাথে। কতদিন হয়ে গেলো বাবাকে দেখা হয় না। একটা মেয়ে মানুষ কত কী বিসর্জন দিয়ে সংসারে আসে সেটা কে ভাবে!
নীলাক্ষী বললো, ‘তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে না?’
‘পড়ে। মাকে মনে পড়ে।’
‘তাহলে এতদূর এসেছো কেন?’
‘আমি এসেছি নাকি? আমাকে এখানে বদলি করলে আমি কী করবো বলো?’
‘তোমাকে এখানে..
কথাটি বলতে গিয়ে চুপ করে যায় নীলাক্ষী। অম্লানকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। যে মানুষটা একটার পর একটা ব্যাপার এভাবে লুকিয়ে যাচ্ছে, তার ভেতরে কী আছে সেটাও নীলাক্ষীর জানা দরকার। যদিও জেনে কতটুকু লাভ হবে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। নীলাক্ষী একটা নিশ্বাস ফেলে। বাইরে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
এক রাশ শীতল হাওয়া অভিলাষী দোলা দিয়ে যায়। চুল উড়তে থাকে ফরফর করে। নীলাক্ষী চুল খোপা বেঁধে রাখলো। শিরশিরে বাতাসকে দুহাত ভরে টেনে নিচ্ছিলো নিজের দিকে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো নীলাক্ষী। ওহে দুঃখ, কেন হঠাৎ এলি আমার জীবনে? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। মানসিক যন্ত্রণায় একটু একটু করে আমাকে খাচ্ছিস কেন তুই? আপন মনেই বলে ওঠে নীলা।
অম্লান অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। নীল বিষাদময়তা ঘিরে ধরেছে ওকে। হঠাৎ আলো জ্বেলে ঘরে প্রবেশ করলো নীলাক্ষী। অম্লানের তাতেও কোনো ভাবান্তর ঘটলো না।
নীলাক্ষী বললো, ‘অন্ধকারে শুয়ে আছো কেন?’
অম্লান নিশ্চুপ।
‘চা দেবো?’
অম্লান নিরুত্তর।
নীলাক্ষী কাছ ঘেঁষে অম্লানের পাশে বসলো, ‘কি হলো? কিছু খাবে?’
অম্লান চমকে উঠে বললো, ‘হ্যাঁ? কিছু বললা?’
‘না।’
অম্লান বেশ বুঝতে পারলো নীলাক্ষীর গলা রাগমিশ্রিত। তবুও দ্বিতীয় প্রশ্ন সে করার আগ্রহ দেখালো না। নীলাক্ষী দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আবারও চলে গেলো বারান্দায়। হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে যাচ্ছে ওর। কেঁদে কেঁদে মনকে শান্ত করার বৃথা প্রচেষ্টা। কিন্তু কাঁদলেই কী মন হালকা হয়? কাঁদলে দুঃখগুলো আরও কঠিন, আরও দগদগে হয়ে বুকের ভেতর চেপে বসে।
রাতে দুজনে একসাথে বসে ভাত খেলো। যেন কিছুই হয়নি দুজনাতে, সবটাই স্বাভাবিক। খেয়েদেয়ে অম্লান বিছানায় শুয়ে একটা বইয়ের পাতা ওল্টায়। নীলাক্ষী ফোনে বাড়ির লোকজনের সাথে চালায় ভিডিও কলিং। রাত বাড়লে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। রোজকার দিনের মতোই শুয়ে পড়া অথচ মাঝে একটা সুক্ষ্ম দেয়াল। যেই দেয়ালকে উপেক্ষা করে মাঝরাতে নীলাক্ষী ঘুমের ঘোরে অম্লানের বুকের ভেতর এসে লুকোয়। অম্লানের মনে হলো বুকের ভেতর এক টুকরো প্রশান্তি। নীলাক্ষী ওর বুকের মাঝে এমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে, কী যে শান্তি শান্তি লাগে!
কেটে গেলো বেশ কয়েকটা দিন। নীলাক্ষী এতদিন ধরে অফিস না করার কারণ জানতে চেয়ে ওপর মহল থেকে ইমেইল এসেছে। পরপর দু’বার। বড় স্যার স্বয়ং খোঁজ নিয়েছেন। চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি নীলাক্ষী। সব ইমেইল, ফোনকল এড়িয়ে যাচ্ছে কেবল। খুব সম্ভবত নীলাক্ষী নিজেও এখনও মনস্থির করতে পারেনি সে আসলেই কী করবে!
অম্লানের আচরণ আজকাল এতটাই রহস্যময় লাগে যে, মাঝেমাঝে মনেহয় তার পাশে একজন অপরিচিত মানুষ শোয়া। নীলাক্ষীর সত্যিই অম্লানকে ভীষণ অচেনা লাগে। অম্লানের মাঝে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে।
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসায় প্রবেশের সময় অম্লান দেখলো দরজার ওপর একটা বড় কাঠের নেমপ্লেট ঝুলছে। তাতে নান্দনিক স্টাইলে লেখা, “বাদামী সংসার।”
অম্লান মুচকি হাসলো। ডিজাইনটা এতটাই কারুকার্য খচিত হয়েছে, মন ভালো হয়ে গেলো মুহুর্তেই। অম্লান দরজায় শব্দ করে ফুরফুরে গলায় ডাকলো, ‘নীলাক্ষী, এই নীলু।’
অনেক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলো নীলাক্ষী। বললো, ‘এত তারাতাড়ি আজ? আমি ঘুমাচ্ছিলাম।’
অম্লান ভেতরে প্রবেশ করেই নীলাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে গভীর আলিঙ্গনের সাথে চুম্বন করে। ঠোঁটে একটা নিবিড় চুম্বনের পর ঝলমলে কণ্ঠে বললো, ‘এই তুমি এটা কোথায় পেয়েছো?’
‘ওহ ওটা! একটা অনলাইন পেজ থেকে অর্ডার করেছিলাম।’
‘সুন্দর হয়েছে।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’
অম্লান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নামটার ওপর আদুরে প্রলেপন মিশিয়ে হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো, ‘বাদামী সংসার। দারুণ নাম দিয়েছো তো নীলু! আমি মুগ্ধ। জিনিসটাও সুন্দর হয়েছে।’
‘ডিজাইন আমি পছন্দ করে দিয়েছিলাম।’
‘কুরিয়ারে কি তুমি গিয়েছিলে?’
‘আরে না। ওরা ফোন করেছিলো। আমি বাসার এড্রেস বললে ওরা বললো একটা ছেলেকে পাঠাচ্ছি। আমাদের অফিস কাছেই।’
‘যাক ভালোই হলো। আমি অভিভূত।’
অম্লান ঘরে প্রবেশ করলো। নীলাক্ষী দরজা আটকিয়ে ঘরে ঢুকতেই নীলাক্ষীকে কাছে টেনে নিলো অম্লান। বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে ওকে। নীলার চুলে হাত বুলিয়ে কপালে আলতো করে চুমুর রেখা এঁকে দিলো। নীলাক্ষী অম্লানের গলায় ঝুলে রইলো কিছুক্ষণ।
অম্লান নীলাক্ষীকে কোলে তুলে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। ওর দিকে উপুড় হয়ে আসতেই নীলাক্ষী বললো, ‘ফ্রেশ হবা না?’
‘হবো। আগে তোমাকে ভালোবাসি।’
‘আমাকে বুঝি ভালোবাসো না সবসময়?’
‘সবসময়ই বাসি। এখন..’
নীলাক্ষী অম্লানের মুখে আঙুল রেখে বললো, ‘উহু, আমি বলি। সবসময় বাসি আর এখন টাটকা তাই তো?’
নীলাক্ষী খিলখিল করে হেসে উঠলে অম্লান বেশ কয়েকটা চিমটি কেটে নীলাক্ষীকে শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করে। একসময় একে অপরকে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। অম্লানের আজ মন অনেকটা হালকা বোধ হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে কোন ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো সেটা ভেবেও অবাক হচ্ছে অম্লান।
নীলাক্ষী নাস্তা বানাতে চলে গেলো। গরম গরম ফুলকো লুচি সাথে হাঁসের মাংস ভুনা। হাঁসের মাংস দুপুরেই ভুনা করে রেখেছিলো নীলাক্ষী। মনমাতানো সুঘ্রাণে পুরো ঘর মঁ মঁ করছে। অম্লান দক্ষিণের জানালাটা খুলে দেয়। শীতল হাওয়া প্রবেশ করে ঘরের ভেতর।
খাবার খেতে খেতে অম্লান বললো, ‘অমৃত বুঝলে অমৃত! এত টেস্টি খাবার কতদিন খাই না!’
‘আমি কী সবসময় খারাপ রান্না করি?’
‘না মানে একটু তো করো-ই।’
‘কী বললা?’
নীলাক্ষীর অগ্নিদৃষ্টি দেখে পিছিয়ে যায় অম্লান, ‘ওরে বাবা রে!’
শব্দ করে হেসে ওঠে নীলাক্ষী। দুজনে একসাথে বসে বেশ আয়েশ করে খানা খাচ্ছিলো। অম্লান দু’বার নীলাক্ষীকে খাইয়েও দিলো।
হঠাৎ অম্লান বললো, ‘আমাদের সংসারটা সত্যিই বাদামী সংসার তাইনা? সূর্যাস্তের পর পশ্চিমাকাশের রংটার মতো। কিন্তু ওটা তো রক্তিম। তুমি কমলা সংসার দিতে পারতা। লাল সংসার দিলে বেশী ভালো হতো। হা হা হা।’
অম্লান শব্দ করে হাসলো। নীলাক্ষী বললো, ‘আমি তো সেই অর্থে বাদামী সংসার বলি নি।’
‘তাহলে?’
নীলাক্ষী খেতে খেতে সহজ গলায় বললো, ‘বাদামের মতো সংসার। একটা বাদামকে বাইরে থেকে দেখলে মনেহয় একটাই বাদাম। অথচ ভেতরে দুটো বাদাম সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ কারও সাথে কখনো জোড়া লাগে না। যে সংসারে দুজন মানুষ একসাথে থাকে, বাইরে থেকে দেখলে মনেহয় অনেক সুখী, ভেতরে তারাও সবসময় সুখী হওয়ার ভান ধরে কিন্তু প্রকৃত অর্থে দুজনেই সবসময় আলাদা।’
মুহুর্তেই থমকে গেলো অম্লান। মুখের সামনে আনা খাবার প্লেটে ফেরত চলে গেলো। নিষ্প্রাণ চোখে নীলাক্ষীর চোখের দিকে তাকালো সে।
নীলাক্ষী মাথা নিচু করে লুচি মুখে পুরে দিলো। সহজ গলায় বললো, ‘বিয়ের এত মাস পরেও তো আমাকে ভালোবাসতে পারো নি। সবসময় চেষ্টা করছো মানিয়ে নেয়ার। আমিও মানিয়ে নিয়েই আছি। যেন আমরা কত সুখী! নিজেদেরকে আমরাও বোঝাই আমরা সুখী। অথচ…’
গম্ভীর এক নিশ্বাস ফেললো নীলাক্ষী। অম্লান শ্বাস বন্ধ করে নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঊনত্রিশ বছরের জীবনে এরচাইতে কঠিন কথা কোনোদিনও শোনে নি!
চলবে..