বাদামী সংসার
পর্ব ৩৮
মিশু মনি

সন্ধ্যার লালচে আভায় মিশে থাকা পশ্চিমাকাশ দেখে একটা অচেনা রাজ্য বলেই বোধ হয়। যেই রাজ্য ভীষণ অচেনা কিন্তু অনেকদিনের আপন। শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে নিতান্তই সাধারণ একজন স্ত্রী হয়ে নীলাক্ষী অম্লানের সাথে বেরোলো, সংসারের টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে। বাইরে বেরিয়ে আকাশ দেখে বুকে সুখসুখ অনুভূত হয়। মনে হচ্ছে, আজ আকাশটাও তার সুখে সুখী হয়ে রঙিন সাজ সেজেছে।

বাজারের দোকানপাট সংসারের অংশ হতে চায়। তাই তো নিত্যপ্রবৃত্ত কত কী নিয়ে বসে থাকে!

নীলাক্ষী খুঁজে খুঁজে কিনলো একটা জগ, গ্লাস, ফ্রাইপ্যান, নাস্তা খাওয়ার জন্য ছোট ছোট বাটি আর চামচ। অনেকগুলো জিনিসের মধ্য থেকে নিজের মনের মতো একটা জিনিস কেনা, সংসারের জন্য, ভাবতেই কেমন অন্যরকম লাগছিলো নীলাক্ষীর। একটা সাদা রঙের মগ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার সময় অম্লান এসে পাশে দাঁড়ালো। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,
“পছন্দ হয়েছে বুঝি?”
“এই দ্যাখো না মগের গায়ে কী লেখা?”
“কী লেখা?”
“Happy Home”
“বাহ সুন্দর তো! নিয়ে নাও। আমার তো হোম নেই, একটা ঘর মাত্র।”

নীলাক্ষী মুখ ঘুরিয়ে অম্লানের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে, “একটা ঘর হলে কী হবে, ঘরভর্তি সুখ আছে তো আমার। বিশাল সাত তলা বাড়ি জুরে একুশটা ঘর দিয়ে আমি কী করবো? যদি কোনো ঘরে শুয়েও সুখের ঘুম না হয়?”
“তোমার কী এতদিন সুখের ঘুম হয় নি?”
“তোমাকে ছাড়া আমার ঘুম এলে তো সুখের হবে।”
“আমাকে ছাড়া ঘুম হয় না কেন?”

নীলাক্ষীর কানের কাছে ফিসফিস স্বরে অম্লান বললো, “তোমাকে ক্লান্ত করে না দিলে বোধহয় ঘুম আসে না?”
নীলাক্ষী মগ রেখে দুইহাতে অম্লানকে ছোট ছোট মাইর বসাতে থাকে। মাইর খেতে খেতে শব্দ করে হাসছিলো অম্লান। দোকানের দুই কিশোর কর্মচারী দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ওদের খুনসুটি দেখছিলো। এখানে কত রকমের মানুষ আসে, হাসে, গল্প করে, স্বপ্ন দেখে! তারা তো স্বপ্ন দেখানোর জন্যই দোকান সাজিয়ে রেখেছে।

নীলাক্ষী আরও প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে ব্যাগ ধরিয়ে দিলো অম্লানের হাতে। একটা স্বপ্নময়ী কুহুতান বেজে চলেছে হৃদয়ে। পাশেই একটা কাপড়ের দোকান। নিজের মনের মতো বিছানার চাদর, বালিশের কভার ও গোটা চারেক কুশন কিনে নিলো নীলাক্ষী। দুইহাতে জিনিসপত্র নিয়ে শো-রুমে দেখতে গেলো খাট। একটা সুন্দর ছিমছাম খাট দেখে অম্লান ভ্যানগাড়ি ডাকতে চলে যায়। ভ্যানগাড়িতে খাট তুলে জিনিসপত্র সব তার ওপরে চাপিয়ে অন্য একটা ভ্যানগাড়ি নিয়ে পা ঝুলিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় ওরা। নীলাক্ষীর অন্তরে একটা কিছু ফুটছে, খইয়ের মতো। প্রতিটা মুহুর্তকেও মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দপূর্ণ। একটা সাধারণ জীবনযাপনের মাঝে এত সুখ কে জানতো আগে!

ফেরার পথে কাঁচা বাজার থেকে কিনে নিলো টাটকা শাক সবজি ও বোয়াল মাছ। নীলাক্ষীর মনে হচ্ছে এই প্রথম সে সংসারের স্বাদ পেতে যাচ্ছে। বিয়ের পর এতগুলো মাস যেন সংসারের সত্যিকার আনন্দটা উপভোগ করার সুযোগ হয় নি। হাসিহাসি মুখ করে অম্লানের দিকে তাকালে দেখলো বেচারা শুকনো মুখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কী যেন ভাবছে আনমনে।

ঘরে খাট বসিয়ে বিছানা তৈরি করে রান্না বসালো নীলাক্ষী। বাজার থেকে আনা জিনিসপত্র গুলো একে একে বের করে রাখলো। সারাজীবন কেনাকাটা করে নীলাক্ষী এতটা আনন্দ পায়নি, যতটা আজকে সংসারের জন্য এসব ছোট ছোট জিনিস কিনে পেয়েছে। জীবনে সুখী হতে গেলে বোধহয় বেশী কিছু লাগেনা। নীলাক্ষী অম্লানকে বললো, “আমি আগে কখনো মাছ রান্না করিনি। যদি খেতে খারাপ হয়?”
“খারাপ হলে কড়াইসহ বাইরে ছুঁড়ে মারবো।”

নীলাক্ষী ভয় পাওয়া কণ্ঠে বললো, “কিহ!”

নীলাক্ষীর শুকনো মুখের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে অম্লান বললো, “আরে মজা করছিলাম। আমি নিজেও তো এতদিন রান্না করে খেয়েছি। আমি রান্না করলে তুমি মুখেই তুলতে পারবে না। ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে।”

বাজারের জিনিসপত্র রেখে নীলাক্ষী ছুটে এসে অম্লানকে জড়িয়ে ধরে। এই মানুষটা যে তার কী আপন হয়ে উঠেছে, সেটা দূরে না গেলে কখনো বুঝতেই পারতো না। তাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না নীলাক্ষী। একটা নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে সে, সবটাই তো অম্লানের জন্য। অম্লান নীলাক্ষীর ঘাড় চেপে ধরে গভীর আবেশে চুম্বন করে ওকে। চুলের মুঠি ধরে পাগলের মতো আদর করতে থাকে গলা, ঘাড়ে ও কাঁধে। চুলোয় যাক রান্না। প্রেমের চাইতে বড় জগতে আর কী আছে!

সকালে অম্লান অফিসে চলে যাওয়ার পর নীলাক্ষী বাগানে হাঁটতে বের হলো। ছোট্ট সবজির বাগান। একদিকে লাউ গাছ অন্যদিকে শাক। খানিক বাদেই সেই মহিলাটি এসে কেমন রাগী রাগী চোখে নীলাক্ষীর দিকে তাকিয়ে রইলো। নীলাক্ষী সাহস করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এ বাড়ির মালিক?”

মহিলার ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। দ্রুতপদে ঘরে ফিরে এলো নীলাক্ষী। কিছুক্ষণ বাদে অম্লান ফোন করলে নীলাক্ষী কথাটা তুললো। অম্লান চুপ করে থেকে বললো, “তুমি ওই মহিলার সাথে কথা বলতে যেও না। কাহিনি আছে। বাসায় আসলে বলবো।”

নীলাক্ষী ফোন রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। অম্লান তো অফিসে গিয়ে দিব্যি কাজে মগ্ন। সে সারাদিন করবে টা কী? একটা ঘরে কতক্ষণ ই বা বসে থাকবে? বেশ বুঝতে পারলো কয়েকদিন যেতেই দোয়েলের মতো দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইবে তার। তার চাইতে বরং একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। যাতে করে সময়টা কাটানো যায়, পাশাপাশি মাথাটাকেও কাজে লাগানো যাবে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাছাড়া নীলাক্ষী ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমী।

অম্লান দুপুরের খাবার খেতে ফিরেছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখলো নীলা কিছু একটা করছে। অম্লান হাত টেনে ধরে কাছে টেনে নিলো ওকে। এক পা, দুই পা করে এগিয়ে নিয়ে চললো বিছানার দিকে। স্বর্গরাজ্যে পরিভ্রমণ শেষে বালিশে শুয়ে তাকিয়ে রইলো একে অপরের দিকে।

নীলাক্ষী বললো, “অফিসে যাবা না? দেরি হবে তো।”
“তাড়া নেই আজকে। দেরী করে যাবো। এখানে এসে একটা মজা হয়েছে কী জানো? ইচ্ছেমতো সময় কাটানো যায়। বকা দেয়ার কেউ নেই।”
“এসব আমার ভালো লাগে না অম্লান।”
“কোনসব?”
“কেউ দেখুক বা না দেখুক। নিজের কাজটা ঠিকমতো করবে। আমি কাজে ফাঁকি দেয়া পছন্দ করি না।”
“আরে বাবা কাজ ফাঁকি দিলাম কোথায়? কাজ তো ঠিকমতো করছি। অবসর সময়টা বাইরে কাটানো যায় তাই বললাম। এখানে কাজ খুব কম। ঢাকায় তো কাজের প্রেশারে মাথা দিয়ে ধোঁয়া বের হতো। আর এখানে দিনে একটা কাজ পাই তো কখনো তিন/চার দিনে একটা। বাকি সময় শুধু অফিসে বসে হাওয়া খাই।”

নীলাক্ষী অম্লানের হাতের ওপর ভর দিয়ে কাছে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো, “আচ্ছা মহিলার ব্যাপারটা কী বলোতো?”
অম্লান কিছুক্ষণ সময় নিলো মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে। তারপর মৃদুস্বরে বললো, “আর বলো না। তুমি কী ভাবো তাই তোমাকে জানাই নি। আমাকে ভুল বুঝবে না রো?”
“উহু। বলো?”

অম্লান বললো, “একদিন রাতে আমি শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছি। ঘুম আসছিলো না। তো হঠাৎ আমার দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। অনেক ক্ষীণ আওয়াজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে? তখন মহিলা হালকা গলায় বললো, আমি। ওটা শোনার পর জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলবেন? উনি বললো, দরজাটা খোলেন। একটা দরকার আছে। এরপর দরজা খুলে দেখি মহিলা বিশ্রীভাবে শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা স্তন বের করে রেখে আমার দিকে ক্যামন ক্যামন চোখ করে..”

নীলাক্ষী অম্লানকে থামিয়ে দিয়ে রাগী স্বরে বললো, “ওকে একটা থাপ্পড় দাও নাই তুমি? আমি থাকলে খুন করে ফেলতাম।”
“মেয়ে মানুষ, কিছু বলাও তো যায় না। আমি মাথা নিচু করে রেখেছিলাম। উনি বললো, আপনার রুমে কী মসুর ডাল আছে? আমি তো অবাক। এত রাতে মসুর ডাল দিয়ে কী হবে? ওর চোখেমুখের অভিব্যক্তি দেখেই মনে হচ্ছিলো কী চাচ্ছে সে। আমি বলেছি, নেই। কখনো আমার সামনে নোংরাভাবে আসবেন না। আর রাত্রিবেলা তো একদমই নয়। ওর মুখের ওপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছি।”

নীলাক্ষীর চোখ ঠিকরে যেন বহ্নিশিখা বেরিয়ে আসছে। ইচ্ছে করলে ওই মহিলার চুলের মুঠি ধরে আছাড় মারতে। অম্লান বললো, “আমি ভয়ে ভয়ে আছি কোনদিন আবার আমার নামে কুৎসা রটায়। এরমধ্যেই তুমি চলে এসে আমাকে উদ্ধার করলে। থ্যাংক ইউ নীলু।”
“তুমি বাসাটা ছেড়ে দাও নাই কেন?”
“মাস তো শেষের দিকে। এখন তো বাসা হুট করে ছাড়তে পারিনা। আমি বাসা খুঁজছি।”
“খুঁজছি টুজছি বললে হবে না। কালকেই আমি এই বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠবো।”
“কালকেই? বাসা খুঁজে পেতে হবে তো। তাছাড়া এখন তো তুমি আছো। আর কোনো সমস্যা নেই।”

নীলাক্ষী রাগী স্বরে বললো, “সমস্যা আছে। ওই বেয়াদব মহিলাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হবে। আমি কাল বাসা দেখবো আর কালই উঠবো। আর কিছু জানিনা ব্যস।”
“কিন্তু কাল আমার অফিস আছে।”
“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। আমি এই বাসায় আর একটা দিনও থাকতে চাই না। আমি কাল একা একা বাসা দেখে কালকেই একটা ঠিক করে ফেলবো এবং উঠবো। মনে থাকে যেন।”

অম্লান নিরুপায় স্বরে বললো, “তুমি তো কিছু চেনো না। ঠিক আছে দেখো। পছন্দ হলে আমাকে কল দিও আমি চলে আসবো।”
“অম্লান..”
“হু..”
“তুমি আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও, আর কোনোদিনও তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্পর্শ করবে না। হাজার সুযোগ আসলেও না। কথা দাও?”

অম্লান চোখ তুলে তাকালো নীলাক্ষীর দিকে। হঠাৎ বুকের বামপাশে কেমন করে ওঠে ওর। নীলাক্ষী করুণ চোখে চেয়ে আছে। কিছু বলার আগেই জড়িয়ে ধরে ভেজা স্বরে বললো, “আমি সারাজীবন কাউকে অবিশ্বাস করিনি অম্লান। আমি অনেক সাধাসিধা একটা মানুষ। তোমাকে আজীবন ধরে বিশ্বাস করতে চাই।”

অম্লানের চোখ অপলক দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাক্ষীর চুলে হাত রেখে মৃদু স্বরে বললো, “আমি তোমার বিশ্বাসের যোগ্য মানুষ নই নীলু। আমাকে বিশ্বাস করো না। আমি হয়তো এর মর্যাদা রাখতে পারবো না ”

কেঁপে উঠলো নীলাক্ষী। মুখ তুলে প্রশ্নময় চোখে অম্লানের দিকে তাকালো। একটা বিষাদের ছেয়ে এসে ভর করলো নীলাক্ষীর সুন্দর মুখাখানাতে। মুহুর্তেই কালো মেঘে আনাগোনা প্রবল হয়ে উঠলো চারপাশে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here