বাদামী সংসার
পর্ব ৩২
মিশু মনি
প্রফুল্ল’র ঘুম ভাংলে অনুভূত হলো পাশে শুয়ে কেউ একজন জড়িয়ে রেখেছে ওকে। দেহের উষ্ণতা টের পাচ্ছিলো। পরক্ষণেই প্রফুল্ল’র মনে পড়ে গেলো রাতের সেই বিভীষিকাময় মুহুর্তের কথা। পাঞ্জাবীওয়ালা যুবক ওকে ধরে নিজের রুমে নিয়ে এসেছিলো, শুইয়ে দিয়েছিলো বিছানায়। প্রফুল্লকে বারবার বলছিলো, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। সে মাথায় হাত বুলিয়েও দিয়েছে। মুহুর্তেই গা কাঁপুনি দিলো প্রফুল্ল’র। দ্রুত হাতের বন্ধন সরিয়ে দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো। প্রফুল্ল’র ঝটকায় ঘুম ভেঙে গেলো রোদেলার। চোখ কচলে জানতে চাইলো, ‘কি রে কি হলো তোর?’
সুস্থির হতে সময় লাগলো প্রফুল্ল’র। পাশে রোদেলাকে শুয়ে থাকতে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেয়ে বললো, ‘ওহ তুই। আমি ভাবলাম!’
‘কি? ওই লোকটা?’
‘তুই এখানে কি করে এলি? আর উনি কোথায়? এটা ওনার রুম না?’
রোদেলা আড়মোড়া ভেঙে বললো, ‘হ্যাঁ। মাঝেমাঝে তুই কি যে করিস না। আর ধকল সহ্য করতে হয় আমাকে। ওই আমাকে ডেকে বললো তুই ঘুমিয়ে পড়েছি। আমি এখানে এসে শুয়ে পড়লাম, আর উনি আমাদের রুমে শুয়েছেন।’
প্রফুল্ল গালে হাত দিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়লো, ‘ওহ আচ্ছা।’
‘তুই রাতে এখানে ঘুমাতে গেলি কেন বলবি?’
‘ঘুম পেয়েছিলো খুব।’
‘নিজের দোষেই তুই মরিস বুঝলি। লোকটা যদি ভালো না হয়ে খারাপ লোক হতো, দিতো তোর বারোটা বাজিয়ে। এজন্যই বলি, এত শোকে কাতর না হয়ে একটা বিয়ে করে নে। নিজেও সুখে থাক আর আমাদেরকেও সুখে থাকতে দে।’
প্রফুল্ল হাই তুলতে তুলতে উঠে পড়লো। হাতমুখ ধুয়ে এসে বললো, ‘চল রুমে যাই।’
‘ওই ব্যাটার ঘুম ভাঙেনি বোধয়।’
‘গিয়ে ভাঙাবো। আমার চেঞ্জ না করা অব্দি ভাল্লাগবে না। যাবি তুই?’
প্রফুল্ল’র জোরাজুরিতে ঘুম তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হলো রোদেলা। চলে এলো নিজের কক্ষে। পাঞ্জাবীওয়ালাকে সকাল সকাল ঘুম থেকে ডেকে তুলে আবার বিনয়ের সুরে প্রফুল্ল বললো, ‘সরি মশাই। ভীষণ সরি। সকাল সকাল জাগালাম।’
সে মিষ্টি হেসে বললো, ‘ইটস ওকে। আমি যাচ্ছি।’
‘আপনার কি আরও ঘুমাতে হবে?’
‘কেন?’
‘না ঘুমালে বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতাম। আজকেই তো চলে যাবো।’
যুবক মাথা চুলকে লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, ‘একবার ওয়াশরুমে যেতে হবে।’
হাসলো প্রফুল্ল। যুবক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রফুল্ল শুকনো মুখে বিছানায় এসে বসে। এখানে দুটো দিন খারাপ কাটেনি। মাঝখান থেকে অম্লান ব্যাটা এসে সবকিছু গোলমাল করে দিয়ে গেলো। যাক সেসব, প্রফুল্ল গতরাতের পর সবকিছু ভুলে গেছে। সে পাঞ্জাবীওয়ালাকে কথা দিয়েছে সব ভুলে যাবে। ভুলতে তো হবেই। আচ্ছা, পাঞ্জাবীওয়ালার নাম কি!
প্রফুল্ল দ্রুত গোসল সেরে একটা সোনালী রঙা থ্রিপিস পরে নিলো। হালকা মেক আপ করে ঠোঁটে দিলো লাল টকটকে লিপস্টিক। রোদেলা তখন ঘুমে বিভোর। প্রফুল্ল রোদেলার ঘুমন্ত চিবুকে একটা চুমু এঁকে দিয়ে প্রাণভরে হাসলো। এরপর বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
পাঞ্জাবীওয়ালা যুবকের দরজায় শব্দ করতেই সে দরজা খুলে দিলো। পরনে সাদা তোয়ালে, খালি গা। দেখেই উষ্ণতা অনুভব করলো প্রফুল্ল। দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল বললো, ‘গোসল করছেন নাকি?’
‘হুম। করবো। আপনি বসুন, আমি দ্রুত শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
‘সকালে উঠে আপনিও গোসল করছেন, আমিও করলাম। বিষয়টা কেমন হয়ে গেলো না?’
যুবক হা করে তাকালো প্রফুল্ল’র দিকে। প্রফুল্ল ভ্রু নাচিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো, ‘মাই গড। আপনি দেখি জোকস শুনে হাসেনও না। ভয় পেয়ে গেছেন নাকি?’
‘রীতিমতো আমার চরিত্রে দাগ লাগানোর মতো কথাবার্তা বলছেন আবার বলেন কিনা ভয় পাবো না?’
প্রফুল্ল হাসতে হাসতে বললো, ‘তাই নাকি? চরিত্রে দাগ লাগবে কেন? ভালোবাসায় কি দাগ হয়?’
‘হ্যাঁ হয়।’
‘সেই দাগও কি ভালো নয়?’
‘হৃদয়ে দাগ হলে…’
প্রফুল্ল যুবককে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘ব্যস। আর বলতে হবে না।’
প্রফুল্ল অন্যদিকে ফিরলো। পাশেই টিভি কেবিনেট। কেবিনেটের ওপর রাখা কফির সরঞ্জাম। প্রফুল্ল সেদিকে মনোযোগ দেয়। যুবক প্রফুল্ল’র পেছনে এসে দাঁড়ায়, ‘আমাকে নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ নেই তো?’
‘না। সন্দেহ থাকলে সকাল সকাল এমন হেসে কথা বলতাম নাকি? ওহ ওয়েট, আপনি কিসের সন্দেহের কথা বলছেন বলুন তো?’
যুবক প্রফুল্ল’র চোখের দিকে এমনভাবে তাকালো যে কেঁপে উঠলো প্রফুল্ল। বললো, ‘রাতে আপনি ঘুমানোর পর কোনো সুযোগ নিলাম কিনা এই ভেবে।’
প্রফুল্ল বললো, ‘সুযোগ? বড় কোনো সুযোগ তো নেননি। ছোট সুযোগ নিলেই বা কি। তাতে নিশ্চয় আপনার মনে শান্তি হবে না?’
প্রফুল্ল’র ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা। যুবক কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে প্রফুল্ল’র কোমরের পিছনদিকে হাত রেখে এক ঝটকায় প্রফুল্লকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললো, ‘আমি পুরুষ, কাপুরুষ নই। কাউকে ভালোবাসার আগেও আমি অনুমতি নিয়ে ভালোবাসবো। আর ভালোবাসবো নিশ্চয় বিয়ের পরে।’
প্রফুল্ল অবাক চোখে যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রফুল্ল’র কোমর ছেড়ে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো যুবক। ফুরফুরে মনটা নিমেষেই বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেলো কেমন!
প্রফুল্ল কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাগানের একটি বেঞ্চিতে বসে রইলো একা একা।
মিনিট দশেক পরে সেখানে যুবকের আগমন। প্রফুল্ল’র কাছে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সুরে বললো, ‘সরি সরি। আপনি কি কষ্ট পেয়েছেন? কিছু না বলে এখানে? মানে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।’
প্রফুল্ল একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘সমস্যা নেই। আমি কষ্ট পাই নি।’
প্রফুল্ল’র পাশে এসে বললো যুবক। তাকে বেশ বিব্রত দেখাচ্ছে। ক্ষমা প্রার্থনা করতে যাবে এমন সময় প্রফুল্ল বললো, ‘আপনি আমাকে অনেক খারাপ ভাবছেন তাই না?’
‘ছি ছি। খারাপ ভাব্বো কেন?’
‘যে মেয়ে বিয়ের আগে প্রেমিকের সাথে শোয় সে কি খারাপ না?’
পাঞ্জাবীওয়ালা প্রফুল্লকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘চুপ। একদম চুপ। এসব আজেবাজে কথা কে শিখিয়েছে বলুন তো? আপনি ভালোবেসে কাউকে আপনার সমস্তটা সমর্পণ করেছেন এটা তো আপনার অন্যায় নয়। কিন্তু সে যে ভালোবাসার মর্যাদা দেয়নি, এটা ভেবেই এসব করা উচিত নয়।’
প্রফুল্ল করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো যুবকের দিকে। বললো, ‘মর্যাদা তো আমিও দেই নি। দুজনেই কি অপরাধী নই?’
‘থাক না এসব। এসব নিয়ে কথা বলার জন্য নিশ্চয় আমি আসিনি? সব কাল রাতেই খতম হয়ে গেছে। আজকের প্রফুল্ল এক নতুন মানুষ।’
প্রফুল্ল একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে রইলো। যুবক বললো, ‘ভীষণ খিদে পেয়েছে। আসুন খেতে যাই।’
প্রফুল্ল নিরুত্তর। যুবক আবারও বললো, ‘রাগ করে থাকবেন? আচ্ছা আমি যদি আপনাকে প্রেম নিবেদন করি তাহলে কি আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?’
প্রফুল্ল চমকে ওঠে। নিস্তব্ধ চোখ দুটি তুলে সে যুবকের দিকে তাকালো। ছেলেটি বললো, ‘আমি গতরাতে আপনার ঘুমন্ত মুখের প্রেমে পড়েছি।’
প্রফুল্ল বিরস গলায় উত্তর দেয়, ‘এই প্রেম তো তাহলে ঘুম ভাংলেই ছুটে পালাবে।’
হাসলো যুবক, ‘না না। প্রতি রাতে এই সুন্দরের প্রেমে পড়তেই তো আজীবন এই প্রেম টিকে রবে।’
প্রফুল্ল মুখ কঠিন করে তাকিয়ে থাকে যুবকের দিকে। যুবকের ঠোঁটের কোণে হাসি। নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বললো, ‘প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। আগে খেয়ে আসি তারপর প্রেম নিয়ে কথা বলা যাবে। চলুন তো।’
নীলাক্ষী অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো। ক্লান্ত শরীরে এক কাপ চা বানিয়ে বসার ঘরে এসে বসলো সে। দোয়েল চলে এলো খানিক পরেই, ‘কিরে নীল পরী, কি করছিস?’
নীলাক্ষী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দোয়েলের দিকে তাকালো। দোয়েল বললো, ‘টিভি ছাড়িস নি কেন? চল একদিন সময় করে তোর বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।’
প্রফুল্ল বললো, ‘হুম। দেখি।’
‘তোর মন খারাপ নীলা?’
‘না ভাবী। টায়ার্ড লাগছে।’
‘আচ্ছা তুই রেস্ট কর। আমি কিছু বানিয়ে দেবো? খাবি?’
‘না ভাবী। তুমি অস্থির হয়ো না।’
দোয়েল টিভি চালাতে ভয় পাচ্ছে। থাক না, এখন টিভি দেখার দরকার নেই। নীলাক্ষী ক্লান্ত হয়ে ফিরেছে, ওকে বিরক্ত না করাই ভালো। ও আরাম করুক।
দোয়েল উঠে চলে এলো নিজের ঘরে। রাত বাড়ছে। সারাদিনে অনিক একটা বারও কল দেয় নি। মাঝেমাঝে বুকের ভেতর হাহাকার করে। অবশ্য বাড়ির বউদেরকে অতকিছু ভেবে কষ্ট পাওয়ার সময়ও নেই। এইতো এখনই আবার রাতের জন্য রান্না বসাতে হবে!
দোয়েল কিছুক্ষণ বালিশে মাথা রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। ভীষণ আনমনা লাগছে। ক্ষণিক পরে বুঝতে পারে, চোখের পাতা ভিজে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখ মুছে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে দোয়েল। মানুষের জীবনে কতরকম নতুনত্ব থাকে, অথচ তার জীবনে সবসময় একঘেয়েমি। তবুও সে নিজেকে সুখী রাখতে চায়, কখনো পারে, আর কখনো অভিনয় করে দেখাতে হয়, আমি অনেক ভালো আছি।
সকালবেলা নীলাক্ষী অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। অম্লান পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ সন্ধ্যায় বাইরে খাই চলো?’
‘দুদিন আগেই তো রিসোর্ট থেকে ঘুরে এলাম।’
‘মনে হচ্ছে অনেকদিন যাই না কোথাও।’
‘তোমার যে কত কিছু মনে হবে!’
অম্লান মনেমনে ভাবছে, আমার ভেতর সারাক্ষণ একধরনের অশান্তি কাজ করছে। তোমাকে বলতে চেয়েও পারি না। তুমি কি শুনবে আমার কথা?
নীলাক্ষী বললো, ‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’
‘আমার সুন্দরী বউকে দেখছি। বলো না আজকে অফিসের পর বাইরে খাবে?’
‘না। আজকে অফিসের পর আমার একটা জরুরি মিটিং আছে। আমরা আরেকদিন বাইরে খাবো।’
এমন সময় দরজার পর্দার আড়াল থেকে দোয়েল বললো, ‘নীলাক্ষী আসবো?’
‘হ্যাঁ ভাবী আসো।’
দোয়েল ভেতরে প্রবেশ করে। চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। যেন একটা প্রস্ফুটিত ফুল। কি যে মায়াবী লাগছে তাকে! খুশিতে ঝলমল করতে করতে বললো, ‘জানিস নীলা, একটা সুখবর আছে।’
‘কি গো?’
দোয়েল লাজুক স্বরে বললো, ‘আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসছে।’
দোয়েলকে আনন্দে জাপটে ধরে নীলাক্ষী। ছুটে আসে অম্লানও, ‘সত্যি ভাবী! হুররেএএ। আমি চাচ্চু হবো।’
দোয়েল যেন লজ্জায় মরে যায়। অম্লান দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। বাসার সামনেই ফুলকলি’র মিষ্টির দোকান। এক কেজি মিষ্টি নিয়ে ছুটে এলো ভেতরে। সবাই মিলে মিষ্টি মুখ করে নীলাক্ষীকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো অম্লান।
নীলাক্ষী মনেমনে ভাবছে, ‘আজকে সন্ধ্যায় সৌখিনের সাথে দেখা করতে হবে। অম্লানকে কোনোভাবেই সৌখিনের কথা বলা যাবে না।’
চলবে..