বাদামী সংসার
পর্ব ২৭
মিশু মনি
প্রফুল্ল সারাদিন ধরে অম্লানকে ‘সরি’ বলার অভিপ্রায়ে পেছনে লেগে রইলো আঠার মতো। বারবার অম্লানের দিকে চায়, কিছু একটা বলতে গিয়েও মাথা নামিয়ে ফেলে। লজ্জাজনক ব্যাপার। অম্লান রিহার্সাল রুম থেকে বের হয়ে দ্রুতপদে ভার্সিটির প্রধান ফটকে এসে দাঁড়ালো। একটা রিকশা ডাক দিতে যাবে এমন সময় প্রফুল্ল ছুটে এসে বললো, ‘দাঁড়ান।’
অম্লান প্রফুল্লকে দেখে অবাক হয়। রীতিমতো ছুটে এসে হাঁফাচ্ছে মেয়েটা। অম্লান জানতে চায়, ‘বলুন। কোনো দরকার?’
প্রফুল্ল লাজুকভাবে উত্তর দেয়, ‘না। আসলে আপনার সাথে যেকোনো বিষয়ে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন কোনো লাইন কিংবা.. ‘
অম্লান হাত তুলে ইশারায় থামিয়ে দেয় প্রফুল্লকে। মুখে লেপ্টে থাকা মিষ্টি হাসির ঝিলিক খানিটা প্রফুল্লকে উপহার দেয়। হেসে বললো, ‘উদাহরণ দিতে হবে না। আমার নাম্বারটা রাখুন। যেকোনো প্রয়োজনে দ্বিধা ঝেড়ে কল দিতে পারবেন।’
প্রফুল্ল অবাক হয়ে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মাথা নিচু করে হেসে বললো, ‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া।’
অম্লান প্রফুল্ল’র মোবাইলে নিজের নাম্বার সেভ করে দিয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রফুল্ল মিনিট দুয়েক পরেই ইংরেজির ক্যাপিটাল লেটারে, SORRY লিখে পাঠায় অম্লানের ফোনে।
মেসেজের উত্তর আসে, ‘সরি কেন?’
প্রফুল্ল উত্তরে লিখে দেয়, ‘For my misbehavior.’
– ‘সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করিনি। আমার কাছে মিসবিহ্যাভের সংজ্ঞা অনেক বড়। আপনি তার একটা পয়েন্টও ফুলফিল করেননি।’
প্রফুল্ল মেসেজের উত্তর দেখে হাসে। হালকাবোধ করে সে। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে থাকে দারুণভাবে। নিজেকে চমৎকার ভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারে সে বদ্ধপরিকর। অম্লান সহ মাঠে বসে আলাপ আলোচনা করে, কিভাবে দুজনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে প্রোগ্রামটিকে মনোমুগ্ধকর করে তোলা যায়। কাব্যিক কিছু লাইন লিখে দেয় অম্লান, সাথে কিছু যোগ করে প্রফুল্ল। দুজনের প্রচেষ্টাও এগিয়ে চললো সমানতালে।
বসন্ত বরণ অনুষ্টান শেষ হলো খুব উপভোগ্য বৈচিত্র্যময়তার মধ্য দিয়ে। অম্লান ও প্রফুল্ল উভয়েই নিজেদের সেরাটুকু দিতে চেষ্টা করেছে। শেষবারের মতো নিজের ভার্সিটিতে একটা মনমতো প্রোগ্রাম করতে পেরে আনন্দিত অম্লান।
অনুষ্ঠান শেষে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছিলো। স্টেজের পেছনে দাঁড়িয়ে খোপার ফুল ঠিক করে লাগাচ্ছিলো প্রফুল্ল। বাসন্তী সাজে প্রফুল্লকে আজ মিষ্টি পরীর মতো লাগছিল। শাড়ি পরিহিতা পরী। মুখে দক্ষ মেকআপ আর্টিস্টের নিঁখুত কাজের ছাপ। দ্বিগুণ হয়ে ফুটে উঠেছে তার রূপ-যৌবন। অম্লান অন্যদিকে মুখ ফেরায়। প্রফুল্ল এসে অম্লানকে বললো, ‘কেমন লাগলো প্রোগ্রাম শেষ করতে পেরে?’
‘খুব ভালো। একটা ইন্টারেস্টিং দিন ছিলো আজকে। আপনি চমৎকার পারফর্ম করেছেন।’
‘আর আপনি? আপনি তো আমার চাইতে বেশি ভালো খেলা দেখিয়েছেন। কি উচ্চারণ! উফফ।’
অম্লান হাসলো। প্রফুল্ল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একটা মোটা কাগজ দ্বারা নিজের গায়ে বাতাস করতে করতে বললো, ‘গরম পড়েছে না অনেক? আমি বাসায় যাচ্ছি। আপনি যাবেন না?’
‘হ্যাঁ যাবো। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে গেটের বাইরে। ওদেরকে নিয়ে বসবো।’
প্রফুল্ল বললো, ‘ওহ। আমি ভাবলাম আপনাকে চা কফি কিছু একটা খাওয়াই।’
অম্লান লাজুকভাবে হাসলো। পাশেই টেবিলের ওপর পরে থাকা কাগজের মোটা অংশ হাতে নিয়ে প্রফুল্ল’র দিকে বাতাস করতে করতে বললো, ‘চা কফি কি উপলক্ষে?’
‘এইযে আমাকে বাতাস করছেন তাই। হা হা।’
‘চা খাওয়াবেন বলেই বাতাস করছি। ঘেমে একাকার অবস্থা আপনার।’
‘শাড়িতে গরম বেশি লাগে।’
‘তাই? আমার মা তো সবসময় শাড়ি পরে।’
‘ওনাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এনিওয়ে, আপনি কি চা কফির দাওয়াত নিচ্ছেন না তাহলে?’
‘অবশ্যই নেবো। উপলক্ষটা শুনি?’
প্রফুল্ল অম্লানের হাতের কাগজের পাখাটা নিজের হাতে তুলে নেয়। পাখাটা টেবিলের ওপর রেখে হেঁটে যাওয়া শুরু করে। পিছু নেয় অম্লান। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো, ‘বললেন না?’
প্রফুল্ল উত্তরে বললো, ‘আপনার সাথে আজকেই হয়তো শেষ দেখা কিংবা কথা। এতদিন একসাথে কাজ করছি। একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠছে। আপনি তো গ্রাজুয়েট হয়ে চলে যাবেন। পথেঘাটে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নাইই বলতে গেলে। একটা চা খাওয়ার দাওয়াত দিলে কি অন্যায় হয়ে যাবে আমার?’
অম্লান ঝটপট উত্তর দেয়, ‘আরে না না। কি যে বলেন না। আমি তাহলে আমার বন্ধুদেরকে চলে যেতে বলি। পরে ওদের সাথে যোগ দিবো। আপনি চলুন।’
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে তারা হাঁটতে থাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লম্বা গাছের ছায়ায় দুজনে হাঁটে। কেউ কোনো কথা বলে না। কেবলই নির্জনতা অবলম্বন করে পাশাপাশি হাঁটা। রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির হর্ণ কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়ে যায়। দুজনে অনেকদূর হেঁটে এসে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে থমকে দাঁড়াল। অম্লান জিজ্ঞেস করে, ‘এখানে বসি?’
প্রফুল্ল উত্তরে বললো, ‘শিওর। চলুন না।’
‘কিন্তু চা কফি পাবো তো এখানে?’
‘তাহলে? কফি পাবো নিশ্চয়ই?’
অম্লান আশেপাশে তাকিয়ে একটা টং দোকান দেখতে পেয়ে ঝলমলে গলায় বললো, ‘চলুন না ওখানে চা খাই ‘
‘বাহ! দারুণ ব্যাপার হবে। চলুন।’
টং দোকানীকে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দুজনে একটা বেঞ্চির ওপর এসে বসে। দোকানে ভিড় করে থাকা দুজন ছেলে ওদেরকে দেখে জায়গা ছেড়ে দেয়। চলে যায় তারা। যাওয়ার সময় একজন ফিরে তাকায় প্রফুল্ল’র দিকে। তাকানোটাই স্বাভাবিক বটে। রূপবতী তরুণী। সাজসজ্জায় একেবারে রাণীর মতো নান্দনিকতা। খোপায় গাঁদাফুলের মালা। হাতেও বাঁধা ফুল। মেয়েদের সাজগুলো ভীষণ কোমল প্রকৃতির হয়। অম্লান বড় আপুদেরকেও দেখেছে তারা কত সুন্দর কমনীয় করে সাজে।
চায়ের স্বাদটা দারুণ। অম্লান এক কাপ চা খেয়ে আরও এক কাপ দিতে বলে। দুই কাপ চা খাওয়া হয়ে গেলে প্রফুল্লকে বললো, ‘এক কাপ বেশি খেয়ে ফেললাম।’
‘আমি কিন্তু বলিনি এক কাপের দাওয়াত। যে কয় কাপ ইচ্ছে খেতে পারেন।’
‘না এক কাপই থাক। এই বেশি খাওয়া এক কাপটা আমাদের মাঝখানে ঋণ এর মতো থাকুক। আবার কখনো দেখা হলে আমি শোধ দিয়ে দেবো।’
প্রফুল্ল শব্দ করে হাসতে থাকে। সেই হাসির সাথে একরাশ সুবাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
অম্লানের চেহারায় আগের মতো উদাসীনতা ভাবটুকু আজ নেই। আজ তাকে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছে। চোখের নিচের কালো দাগ থেকে গেলেও চিবুকের মিইয়ে যাওয়া ভাবটা একেবারেই নেই। প্রফুল্ল বললো, ‘আপনার কয়েকদিনে ভালো উন্নতি হয়েছে চেহারার।’
অম্লান বাঁকা চোখে তাকালো, ‘আপনি যেদিন প্রথম দেখেছিলেন তখন রিসেন্টলি ব্রেক আপ হয়েছে আমার ‘
প্রফুল্ল আবারও হেসে ওঠে শব্দ করে। হাসি থামিয়ে বলে, ‘ইস। সরি আপনার কষ্ট দেখে হাসলাম।’
– ‘হাসতেই পারেন। অন্যের কষ্ট দেখে হাসতে মজা আছে।’
– ‘ছি ছি এভাবে ভাব্বেন না।’
– ‘মজা করলাম। বাদ দিন ওসব।’
চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে প্রফুল্ল একটা রিকশা ডাক দেয়। বিদায় নেয় অম্লানের কাছ থেকে। অম্লানও বিদায় দিয়ে তার বন্ধুবর্গের সাথে সাক্ষাতের জন্য দৌড় দেয়।
এতদূর বলার পর থামলো প্রফুল্ল। একটা ঘন নিশ্বাস ফেললো। পাঞ্জাবীওয়ালা গালে হাত দিয়ে শুনছে। সেও একটা নিশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল প্রফুল্ল’র দিকে। প্রফুল্ল’র চুলের খোপা খুলে যাওয়ায় সে দুইহাত দিয়ে খোপা বাঁধে। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
‘এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমরা একে অপরকে ভুলেও গেছি। কবে একসাথে স্টেজে পারফর্ম করছি সেটা মনে রাখার তো প্রয়োজন নাই। ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তো একদিন আচমকা আমাদের দেখা হয়ে গেলো। আমার আবার বাসা থেকে সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করা সম্ভব ছিলো না। তাই ভার্সিটির কাছেই একটা বাসা নেই। সাবলেট। আমরা ছয়জন মেয়ে থাকতাম। একটা ছিমছাম ফ্ল্যাট। তো ওই বাসায় এক বড় আপু ছিলো, ওনার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্কও হয়ে গেছিল। আপু একদিন বলল, চলো প্রফুল্ল বাইরে যাই। তোমার ভাইয়ার সাথে দেখা করবো আর ফুচকা খাবো। আমি গেলাম আপুর সাথে। আমাদের বাসার পাশে একটা ফিল্ড ছিলো। ফিল্ডের চারপাশে সুন্দর গাছ লাগানো আর বসার ব্যবস্থা। ওখানে ফুচকা টুচকার দোকানও বসতো কিন্তু। আমি আর আপু আগে গেছি। তখন দেখি দুইজন ছেলে আসলো। মাই গড! আমি ভাবছিলাম অম্লান ভাইয়া আপুর বয়ফ্রেন্ড। ওনাকে দেখে হাসি পাচ্ছিলো আমার। আপু কি ভাবে তাই আমি আর আগ বাড়াই কথাও বলি নাই। তো অম্লান ভাইয়াই আমাকে আগে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন? আমি বললাম ভালো। এরপর বুঝলাম ভাইয়ার ফ্রেন্ড রূপক, উনি আপুর বয়ফ্রেন্ড। তারপর একসাথে বসে চারজনে মিলে আড্ডা টাড্ডা দিলাম, ফুচকা খাইলাম। এরপর প্রায়ই আমরা চারজন একসাথে বসে এভাবে আড্ডা দিতাম। রূপক ভাইয়া ওনার আরও তিনজন বন্ধু সহ আসতো। ফাইরুজ, কৌশিক, অম্লান। সবাই মিলে আড্ডা হতো অনেক। মাঝেমাঝে সংসদ ভবনের সামনে গিয়া বসতাম। অম্লানেরা সবাই গান ধরতো। আমার সময়গুলো এত জোস কাটছে কি বলবো। ওরা সবাই আমার সিনিয়র। তারপরও মনে হইতো আমরা ফ্রেন্ড। একটা সার্কেলের মতো। অনেক হৈ হুল্লোড় করি, রেস্টুরেন্টে বসি। প্রতি সপ্তাহে মিনিমাম দুবার আমরা সবাই এভাবে বসতাম। একবার হইলো কি, ওরা ঠিক করলো চাঁদপুর যাবে। ইলিশ মাছ খাইতে। আমি বললাম আমিও যাবো। আপু যাবে না। ওরা এতগুলো ছেলে, আমি একা তাই আমাকে নিবেও না। আমি অম্লান ভাইয়াকে রিকুয়েষ্ট করলাম, প্লিজ আমিও যাবো। আমি কখনো শিপে চড়িনাই। আমাকেও নিয়া চলেন। তখন ওর বন্ধুরা ওরে বললো, প্রফুল্ল গেলে ওর প্যারা তুই নিবি। আমরা ওর ক্যাঁচক্যাঁচানির মধ্যে নাই। আমি তো রেগে আগুন, আমি ক্যাঁচক্যাঁচ করি? তারপর অবশ্য অম্লান ভাইয়া ওদেরকে রাজি করালো। ওরা সবাই মিলে একটা কেবিন নিলো। সেখানে আমি একটা মেয়ে, সবাই একটু ডিস্টার্বড হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি বাইরে ডেকে বসে হাওয়া খাচ্ছি। বিশ্বাস করেন, অম্লান পুরোটা পথ আমাকে সময় দিয়েছে। কতরকমের গল্প করেছি আমরা। তার কোনো হিসাব নাই। গল্প করতে করতে দুজন দুজনের ভালো বন্ধুর মতো হয়ে গেছি। তখন বাকিদের সাথে আমার একটা গ্যাপ তৈরি হয়। এরপর ওখান থেকে ফিরে অম্লানের সাথে আমি আলাদা বসতাম, আলাদা করে আড্ডা দিতাম। ওদের সাথে আড্ডা দেয়া কমাই দিলাম। এভাবেই চলছিলো সব। রঙিন, স্বপ্নের মতো দিনগুলা। কিভাবে যে আমাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেলো! আমি এখনও ভেবে পাই না।’
প্রফুল্ল উদাস চোখে অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভীষণ আবেগপ্রবণ ও সুখী সুখী দেখালো ওকে। যেন সেই দিনগুলোতে এখনও অবস্থান করছে সে। অনেক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রফুল্ল।
পাঞ্জাবীওয়ালা বললো, ‘গল্পটা সুন্দর ছিলো।’
‘হ্যাঁ। অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম জানেন? একসাথে দুজনে। কত মধুর স্মৃতি ছিলো আমাদের। কত খুনসুটি। কত আবেগ। সব এখন স্বপ্নের মতো মনেহয় ‘
পাঞ্জাবীওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, ‘শেষটা হলো কিভাবে?’
ব্যথাতুর চোখ তুলে তাকায় প্রফুল্ল। মৃদু নরম আলোয় তাকে আরও বেশি ব্যথাতুর দেখায়। মুখ বাঁকা করে ব্যথার হাসি হাসে। প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বললো, ‘কপালে ছিলো না। জানেন তো আমি ওর সাথে সম্পর্কে জড়াতে চাইনি একদমই। আমি জানিনা একসাথে এভাবে চলতে চলতে কখন যে জড়িয়ে গেলাম!’
পাঞ্জাবীওয়ালা বললো, ‘আচ্ছা থাক। কষ্ট পাবেন না। চা খাবেন?’
‘না। এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে না। শেষটা শুনবেন না?’
‘হ্যাঁ শুনবো। বলুন।’
‘শেষটা কালকে বলবো।’
‘ওকে। তবে আপনার গল্পের শুরুটা আমাকে ইমোশনাল করে দিয়েছে। শুনেই মনে হচ্ছে এই সম্পর্কটা সবসময় ভালো থাকুক। সুখে থাকুক ‘
প্রফুল্ল বললো, ‘হুম। আমরা অনেক ঈর্ষণীয় একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম। অনেকেই হিংসা করতো আমাদের জুটিকে। আচ্ছা, বাদ দিন। রাত বেড়ে গেছে। আমি রুমে যাই, আপনিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আবার কথা হবে। সকালে ঘুম ভাংলে কল দিয়েন।’
পাঞ্জাবীওয়ালা বিদায় জানায় প্রফুল্লকে। ওকে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। বিদায়ের সময় বলে, ‘কষ্ট দিলাম?’
প্রফুল্ল শুকনো হেসে উত্তর দিলো, ‘আরে না না। কষ্টের কিছু নেই। অতীত তো হারিয়ে গেছে। আপনি না বলেছেন ওটাকে আবারও ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবো?’
– ‘সেই কামনাই করি। গুড নাইট।’
প্রফুল্ল রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। পাশে ওর বান্ধবী আধোঘুমে ডুবন্ত। প্রফুল্ল’র ঘুম আসে না। একেকটা স্মৃতি দগদগে হয়ে মনের ভেতর ঘা হয়ে বসে আছে। পীড়া দিচ্ছে ভীষণ।
প্রফুল্ল চোখ বন্ধ করে। প্রেমের শুরুটা কবে হয়েছিলো কে জানে। তবে যেদিন একে অপরকে প্রথম ভালোবাসার কথা জানায়, সেই দিনটা হয়তো আজীবনেও ভুলতে পারবে না প্রফুল্ল। হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সে। অম্লান তার জন্য কি ভীষণ দুশ্চিন্তা করেছিলো এটা এখনও চোখের সামনে ভাসে। বাবা মা বাসায় চলে গিয়েছিলো। কেবিনে ছিলো একটা বান্ধবী। অম্লান পাশে বসে কথা বলার সময় সেও রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রফুল্ল’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত চোখে অম্লান তাকিয়ে থাকে।
প্রফুল্ল’র জ্বরের ঠোঁট, চড়চড়ে হয়ে আছে। অসুস্থতার ছাপ মুখে, চুল এলোমেলো। মায়াভরা চোখে অম্লানের দিকে তাকিয়ে প্রফুল্ল জিজ্ঞেস করল, ‘এতক্ষণ ধরে হা করে তাকিয়ে আছো কি জন্য?’
অম্লান বললো, ‘তোমাকে নজর দিচ্ছি। নজর দিলে নাকি অসুখ গুলো আরেকজনের গায়ে চলে যায়?’
শুকনো মুখে হা হা করে হেসে উঠেছিলো প্রফুল্ল। হাসি থামিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় বসে রইলো। অম্লান হঠাৎ বললো, ‘তোমাকে একটা চুমু খাই?’
ধক করে উঠলো প্রফুল্ল’র বুক। অম্লানের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে ওর সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছিলো। সেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অম্লান বললো, ‘এই গোলাপের পাপড়ি দুটো দেখতে দেখতে আমার আর সহ্য হয়না।’
প্রফুল্ল শক্ত করে অম্লানের হাত চেপে ধরে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গা শিউরে ওঠে তার। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চায়, ‘কেন? আমি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড?’
অম্লান বললো, ‘না। জানো না তুমি আমার কি?’
প্রফুল্ল ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘ভালোবাসো আমায়?’
অম্লান শক্তভাবে প্রফুল্ল’র হাত চেপে ধরে মাথা নিচু করে রেখেছিলো অনেক্ষণ। তারপর প্রফুল্ল’র হাতে একটা চুমু দিয়ে জোরগলায় বলেছিলো, ‘প্রচন্ড ভালোবাসি প্রফুল্ল। এইযে রাত জেগে টেনশনে কাতর হচ্ছি, তাও কি বোঝো না?’
প্রফুল্ল শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে এনে অম্লানের কোমল ওষ্ঠের ওপর স্পর্শ করে। নিবিড়ভাবে চুম্বন করে অম্লান। সেই স্পর্শ এখনো আপন অধিকারে চারপাশ ঘিরে রেখে প্রফুল্লকে বলে, ‘অম্লান তোমার, তোমার।’
চলবে..