বাদামী সংসার
পর্ব ২২
মিশু মনি

অম্লান অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর দরজায় প্রবেশের সাথে সাথেই নীলাক্ষীর নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। বেশ কিছুদিন যাবত এমন হচ্ছে। অম্লানের দাদী অবাক হয়ে কান খাড়া করেন। ছেলেটা বাসায় ঢুকেই তার উপস্থিতি জানান দেয়। বউয়ের নাম ধরে এভাবে সবার সামনে ডাকতে আছে? কবে যে জ্ঞান বুদ্ধি হবে তার। দাদী ভাবছেন একবার অম্লানকে ডেকে বিষয়গুলো বোঝাবেন। কিন্তু আজকে বাসায় ঢুকতেই একটা কান্ড ঘটলো। রীতিমতো আশ্চর্যজনক।

অম্লানের বাবা তার ঘরেই ছিলেন। অম্লান দরজায় কলিং বেল চাপলে দোয়েল দরজা খুলে দেয়। বসার ঘর থেকেই নীলু, এই নীলু বলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো অম্লান। বসার ঘর থেকে করিডোর হয়ে তার ঘরে যেতে হয়। করিডোরের বামদিকে বাবা মায়ের ঘর। ডানদিকে অম্লান ও অনিকের ঘর পাশাপাশি। অম্লান নিজের ঘরে যাওয়ার আগে বাবার ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হয়। আজকে যাওয়ার পথে বাবা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘দাঁড়াও।’

অম্লান অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো, ‘হ্যাঁ আব্বু বলো।’
– ‘পড়াশোনা শিখে কি দিনদিন বেহায়া হচ্ছো? স্কুল কলেজে বেহায়াপনা শেখাইছে তাইনা?’
– ‘মানে? কি বলতেছো এগুলা? বুঝলাম না আমি।’

অম্লানের কথা শুনে বাবার কণ্ঠে এবার রাগের ঝংকার ধ্বনি ভেসে আসলো। বাড়ি কেঁপে ওঠার মতো জোরে হুংকার দিলেন তিনি, ‘ফাজলামো করো? ইয়ার্কি পাইছো আমার সাথে? নোংরামির একটা সীমা থাকে। সীমা ছাড়াই যাচ্ছো তুমি।’

অম্লান কথা বলতে পারে না, নিশ্চুপ ভঙ্গীতে বাবার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবার চোখ থেকে ঠিকরে আগুন ঝরে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এতটাই রাগত চেহারা তার।

বললেন, ‘বাসায় ঢুকে সবার আগে বউয়ের কাছে যাচ্ছো। সেটা নিয়ে তো কেউ না করেনি। গেটে ঢুকেই বউয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়ছো। এগুলো নিয়েও কারো মাথাব্যথা নেই। তা, তোমার মাকে কি একেবারে ই ভুলে গেছো? বাসায় ঢুকে আগে মায়ের সাথে একবার কথা বলছো? মায়ের বুকটা সারাদিন খা খা করে। ছেলে মেয়েরা বাইরে গেলে টেনশনে বুঁদ হয়ে থাকে। বাসায় ঢুকে জিজ্ঞেস করছো, আম্মু কেমন আছো? মায়ের সাথে দেখা করে তারপর ঘরে ঢুকতে সমস্যা কই তোমার? ছোট বেলা তো ঠিকই বাড়িতে পা দিলেই মা মা করে চিল্লাইয়া বাড়ি মাথায় তুলতা। এখন যে এসব ভুলে গেছো, মায়ের কষ্ট হয় কিনা একবার ভাবো নাই?’

ওনার কথা শুনে দোয়েল করিডোরে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঘর থেকে দাদী ছুটে এসে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মায়ের কথা অমান্য করে তিনি আবারও বললেন, ‘আমি এখনও বাড়িতে ঢুকলে আগে মাকে ডাকি। মা’র কাছে যাই। মা মরে গেলে তখন আর ডাকার কেউ থাকবে না। বুঝছো? তোমার মা প্রতিদিন রাতে কান্দে। আমাকে বলে, ছেলেটা পর হয়ে গেছে। মায়ের খোঁজ খবর নিবা না? কথা বলবা না তার সাথে?’

অম্লানের মা এসে স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন, ‘কি শুরু করলা? ও মাত্র অফিস থেকে আসছে।’

মা অম্লানের হাত ধরে বললেন, ‘বাবা তুই যা তো। ফ্রেশ হ গিয়ে। আমি খাবার গরম করতেছি। রুমে যা বাবা।’

বাবার রাগ এখনও কমে নি। অম্লানকে রীতিমতো টানতে টানতে মা ওর ঘরের কাছে রেখে এলেন। স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে ওনারও বুকটা ব্যথাতুর হয়ে উঠলো।

অম্লান ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয়। বিষন্ন মনে টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে শার্ট খোলে। বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে নীলাক্ষী উপুড় হয়ে শোয়া। অম্লানের মনের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। নীলাক্ষীর দিকে তাকায় না সে। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। অনেক্ষণ ধরে গোসল করার পর কিছুটা হালকা বোধ হলে বেরিয়ে আসে। নীলাক্ষী এখনও আগের মতো শুয়ে আছে।

অম্লান কাছে এসে বললো, ‘এভাবে শুয়ে আছো যে? আব্বুর কথায় কিছু মনে করো না। আমি সরি।’

নীলাক্ষী এবারও মুখ তুললো না। অম্লান নীলাক্ষীর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘সরি। মন খারাপ করছো?’

নীলাক্ষী মাথা তুললো। তার চিবুক কান্নার আবরণে সিক্ত। ঝাঁঝমিশ্রিত গলায় বললো, ‘তোমার নিজেকে ছোট ছোট লাগছে না? লজ্জা হচ্ছে না অম্লান? আমাকে সরি না বলে মাকে গিয়ে সরি বলো। বাবা যা বলছে ঠিকই বলছে। তুমি ইদানীং বেশি বেশি করছো। আমিও যে কি নির্লজ্জ। লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাইতে পারবো না।’

অম্লান মাথা নিচু করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না। বুকের ভেতর প্রমত্ত দাবানল হঠাৎ করেই তীব্র বেগে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। একটা শার্ট গায়ে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

কাউকে কিছু না বলেই বাইরে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটা শুরু করে অম্লান। মাঝে মাঝে বোধহয় মানুষ শিশুসুলভ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। তখন উলটা পালটা কাজ করা শুরু করে। নিজের কাজের জন্য তার লজ্জিত হওয়া উচিৎ।

অম্লান রূপকের নাম্বারে কল দিয়ে দেখা করতে বলে। ছেলেরা মন খারাপের সময় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ চায়। কোনো কথা না বলে চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকলেও মনটা হালকা বোধ হয় তখন। রূপক চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। দুই বন্ধু একটা পিলারের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলো। অম্লান একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, ‘তোর যে পেইন্টিংটা করতে দিয়েছিলি ওটার কাজ শেষ?’
– ‘নাহ। এখনও শেষ হয় নাই। তোর এতদিন পর বসার সময় হইলো ক্যাম্নে সেইটা বল? ইদানীং তো খুপড়ির মুরগী হয়ে গেছিস।’

অম্লান বললো, ‘দোস্ত বাজে বকিস না। জানিস তো দুজনেই সারাদিন অফিস করে আসি। বাসায় সন্ধ্যার মুহুর্তটা একে অপরকে না দিলে ক্যাম্নে হয় বল? রাতে তো বেঘোরে ঘুমাই।’
– ‘ঘুমাস? হেহ। দুইটা তিনটা পর্যন্ত পিরিতি না করলে ঘুম আসে? ব্যাডা আমারে শেখাস?’
– ‘বিয়া করলে বুঝবি। বাইরে থাকলে বউ রাগ করে।’
– ‘হ কইছে। মানুষের আর বউ নাই। নিজে বউ ছাড়া থাকতে পারো না সেইটা বলো না ক্যান?’
– ‘ধুর থাম তো। এমনিতে মন মেজাজ খারাপ।’
– ‘কেন?’

অম্লান উত্তর না দিয়ে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। সিগারেটের ধোঁয়ায় মনের দুঃখ অব্যাহতি দেয়ার চেষ্টা। রূপক বললো, ‘কি হইছে বলবি তো?’
– ‘আরে বাদ দে। বসে থাক চুপচাপ।’
– ‘প্রফুল্ল’র খবর জানিস? ইদানীং তো প্রচুর আনন্দে আছে দেখি।’

অম্লান মুখ ফেরায় রূপকের দিকে। রূপকের আপাদমস্তক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আনন্দে আছে?’

– ‘হুম। সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড দেয়। দেখি। রেগুলার জিমে যায়। জিমে ছবি তুলে আপলোড দেয়। এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। গতকাল দেখলাম সাজেকে গিয়েছিলো। ট্রাভেল বার্ডস না কি যেন একটা গ্রুপের সাথে। মেঘপুঞ্জিতে ছবি তুলে আপলোড দিয়েছে।’

অম্লান একটা হাত উঁচিয়ে ইশারায় থামতে বলে রূপক কে। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে বলে, ‘ভালো থাকলেই ভালো। তবে শুনে অবাক হয়েছি। লাস্ট দুই বছরে ওর যে উন্নতি হয়নাই, আমার বিয়ের পর সেটা হয়ে গেলো। কিভাবে!’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অম্লান আবারও বললো, ‘যাইহোক, ওর কথা আর বলিস না। আমি ভালো আছি। তাই প্রফুল্লও ভালো থাকতে শিখে গেছে। হয়তো বিয়েও করে ফেলবে। আমি তো চাই সেও তার জীবনটা সুন্দরভাবে কাটাক।’

অম্লান একটা নিশ্বাস ফেললো। রূপক বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে অম্লানের দিকে এগিয়ে দেয়। একটা একটা করে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে খেতে শুরু করে। দুই বন্ধু পা ঝুলিয়ে বসে বাদাম খেতে খেতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে। কথা বলতে বলতে পেরিয়ে যায় একটা বিরক্তিকর সন্ধ্যা।

রাতে বাসায় ফিরে অম্লান কারো ঘরেই গেলো না। বেসিনে হাত ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো। টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা। প্লেটে তুলে নেয়ার আগেই মা এসে খাবার তুলে দিলেন। নিঃশব্দে খাবার খাচ্ছিলো অম্লান। মা বললেন, ‘জিবানিয়ার নাকি বিয়ে ঠিক হইছে। ছেলের বাসা কুষ্টিয়া।’

মা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে সবকিছু সহজ করার চেষ্টা করলেন যেন কিছুই হয় নি। অম্লান কোনো উত্তর না দিয়ে খাবার খাচ্ছে। মা বললেন, ‘তারাহুরো করছিস কেন? ধীরেধীরে খা।’

তারপর ডাকতে লাগলেন, ‘ছোট বৌ মা। তুমিও আসো, ভাত খাও।’

মা বললেন, ‘নীলাক্ষীও খায় নি কিছু। তখন ডাকলাম, আসলো না। মেয়েটার মনেহয় মন খারাপ। কি যে করি। বয়স হইছে, এমন সময় এমন সব সমস্যা হচ্ছে।’

অম্লান মায়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো, ‘সরি আম্মু। মাফ করে দাও।’

ছেলের মুখে এ কথা শুনে মায়ের বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। চোখে পানি চলে আসতে চাইছে। তিনি অম্লানের ওপর কখনোই রাগ করেন নি, ছেলে মেয়েদের ওপর রাগ করা যায় না। হয়তো খানিকটা অভিমান জমে ছিলো, এখন তাও একেবারে সাফ হয়ে গেলো। তিনি অম্লানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ধুর। পাগল ছেলে আমার। মন খারাপ করিস না। একটু ঝোল দেই?’

নীলাক্ষী হাত ধুয়ে এসে চেয়ার টেনে বসলো। মুখটা বিষন্ন। শুকনো মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। অম্লান একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নীলাক্ষী নিঃশব্দে প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে আরম্ভ করে।

শাশুড়ী মা বললেন, ‘মা রে। রাগ করিও না। তোমার শ্বশুরের মাথা গরম। উনি ভাবেন ই না ছেলে বড় হইছে। এখনও মনে করে বুঝি বাচ্চা আছে।’

অনেক কিছু বলে নীলাক্ষীর সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। খাওয়া শেষ করে অম্লান স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘আম্মু বাসায় দুধ আছে?’
– ‘হ্যাঁ আছে তো।’
– ‘কলা আনবো কালকে। দুধ চিনি, কলা দিয়ে ভাত মেখে খেতে ইচ্ছে করছে।’
– ‘কলা ও আছে। তুই একটু বস। আমি এখনই দুধ গরম করে দেই।’

নীলাক্ষী খাবার খাচ্ছে। অম্লান হেসে বললো, ‘বিড়ালের মতো কুটকুট করে খাচ্ছো কেন? আরেকটু ভাত নাও। মাছ নিয়ে বেশি করে খাও।’

নীলাক্ষী উত্তর দেয় না। অম্লান বসে রইল। মা ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করে পানিতে রাখলেন। অম্লান বসে বসে গল্প করতে লাগলো মায়ের সাথে। হঠাৎ করেই নিজের আচরণের জন্য অনুতাপ হতে লাগলো তার। আজ মায়ের সাথে এত সুন্দর করে গল্প করতে বসে মনে হচ্ছে, মা হয়তো সবসময় এমনটাই আশা করেন ছেলেমেয়ে দের কাছ থেকে। বাচ্চারা তাদেরকে সময় দিক, গল্প করুক আগের মতো। মায়ের আদর, স্নেহ, ছোটাছুটি করে এটা ওটা এনে দেয়া, সবকিছু আগের মতোই আছে। অথচ সন্তানরা কেমন যেন বদলে যায়। বড় হয়ে গেলে আগের মতো মায়ের সাথে মেশে না। কিন্তু মা আজ থেকে দশ বছর আগের সেই মা- ই আছেন। অম্লান মাকে বললো, ‘তুমি মাখিয়ে দাও।’

মায়ের হাতের দুধ মাখা ভাত খেয়ে অম্লান ঘরের দিকে গেলো। দীর্ঘদিন পর মায়েরও কোল যেন পূর্ণ হলো আজ। বুকটা ভরে গেলো প্রশান্তিতে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here