“ প্রেমে পড়া বারণ “
পর্ব ১
রমিলা ঘর মুছতে মুছতে জলিলের কথা ভাবছে।
গতকাল জলিল বলেছে ওকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে। সাকিব খানের নতুন সিনেমা ‘ফেসবুকের প্রেম’।
সিনেমাটা না কি দারুণ হয়েছে !
কিন্তু জলিল তো এখনও আসলো না।
আবার নূতন ড্রাইভারের ডিউটি পরল না কি ?
রমিলা সকাল থেকেই ঠিক করে রেখেছে গেল ঈদে খালাম্মা যেই কমলা রঙের জমিনে ফুল ফুল শাড়ীটা দিয়েছে, সেটা পড়বে। চুলে কাল রাতেই জবাকুসুম সুগন্ধী তেল মেখে রেখেছে।
ঘরটা মোছা হয়ে গেলেই মোটামুটি কাজ আর তেমন নাই রাতের খাবারের আগে। বাড়ীর বড়ো আপাকে বলে রেখেছে সে যেন খালাম্মাকে একটু ম্যানেজ করে।বড়ো আপা তাকে বিশেষ স্নেহ করে।
জলিল ড্রাইভারের সাথে রমিলার পরিচয় বেশি দিনের না।
মাত্র ৫-৬ মাস !
এরই মধ্যে ওদের বেশ ভাব জমে গেছে। পাশের বাড়ীর ড্রাইভার রহিম আলি রমিলার সাথে বেশ ভাব জমানোর চেষ্টা
করেছিল, কিন্তু রমিলার কেন যেন জলিল ছাড়া কাউকে মনে ধরে না।
কি সুন্দর লম্বা চৌড়া দেহের গঠন, মাথা ভর্তি চুল,একদম শাহরুখ খানের মতো !
গায়ের রং একটু ময়লা , তাতে কি হয়েছে । আর ছেলেদের গায়ের রঙে কিছুই আসে যায় না।
এই বাড়ীর বড়ো মেয়ের নাম ঐন্দ্রিলা। সে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ পড়ছে। দেখতে যেমন সুন্দরী সে, তার ব্যবহারও খুবই মিষ্টি।
কাজের ছেলে-মেয়ে, ড্রাইভার, দারোয়ান, দোকানদার, পিয়ন …. সবার সাথে সে আদব তমিজ সহ আপনি করে কথা বলে। কখনও গলা তোলে না।
মেয়েটাকে কেমন দুখী দুখী মনে হয়।একা একা বারান্দায় বসে বসে কানে হেডফোনে গান শোনে আর প্রচুর বই পড়ে।
তার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব নেই। শুধু একটা মেয়ের সাথে খুব ভাব, ওর ছোটবেলার বন্ধু রূপসা।
আর বাড়ীর ছোট মেয়ে ঐশী আগামী বছর ও লেভেল দিবে । অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই তার দিন কাটে।
রমিলা একটু সাজগোজ করেছে আজ।চুলে বেনী করে লাল ফিতা বেঁধেছে, চোখে গাড় করে কাজল দিলো।
মুখে তেমন কোন প্রসাধনী ছাড়াই তাকে খুব মায়াবতী লাগছে।
রমিলার বাবা বলতেন ,
—মেয়ে আমার লাখে এক সুন্দরী । মেয়েকে আমি কখনও কারোর বাড়ীর ঝি গিরি করতে দেবোনা।
রমিলার বাবা রিক্সা চালাতেন আর মা ছুটা বুয়ার কাজ করতেন।বেশ সচ্ছল সংসার ছিল তাদের, বাড্ডায় বস্তিতে টিনের ঘরে থাকতো তারা।
মাঝে মাঝে এক সাথে ছুটির দিনে বাইরে বেড়াতে যেতো, ভালমন্দ খেতো।
আহা ! এখন স্বপ্নের মতো লাগে দিনগুলো !
বাবা আর মায়ের দুজনেরই মোবাইল ছিল, কত ছবি তুলতো তারা এক সাথে।
হঠাৎ করে বলা নাই কোথা থেকে একদিনের জ্বরে বাবা মারা গেলেন। আর সে থেকে মা একদম পাগল পাগল হয়ে গেলেন। ওদের সংসারে ভীষণ অভাব নেমে এলো।
রমিলার তখন দশ বছর বয়স।একদিন ঐন্দ্রিলাদের বাড়ীতে ওর মা নিয়ে এলো। এই বাড়ীতে অনেক দিন ধরে ছুটা বুয়ার কাজ করছেন রমিলার মা। অনেক অনুনয় করবার পর বাড়ীর কত্রী রাজী হলেন রমিলাকে রাখতে।
এতো সুন্দর মেয়ের উপর পাড়ার ছেলে ছোকড়াদের নজর পড়বার ভয়ে মা এই কাজটা করেছিলেন।
রমিলা খুব ঝটপট কাজ শিখে নিয়েছে। গত ৬-৭ বছর ধরে এই বাড়ীতেই আছে। বেশ মানিয়ে নিয়েছে যেন এটা ওর নিজেরই বাসা।
মা কবে দেশে চলে গেছে !
প্রথম প্রথম বছরে এক-দুবার দেখা হতো। আজকাল আর তাও হয় না।
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে, পশ্চিমের আকাশে রক্তিম আলোর বর্ণছটা । ঐন্দ্রিলা মুগ্ধ হয়ে দেখছে আর গুন গুন করে গাইছে,
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শূন্যগগনবিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা
তুমি আমারি, তুমি আমারি…”
এক সময় একে একে সব মসজিদগুলোর ইমারত থেকে মাগরিবের আজান বেজে উঠলো। কোথায় যেন পড়েছিল ঢাকা শহর মসজিদের শহর নামে বিখ্যাত। খুব একটা ভুল লেখেনি ।
ঐন্দ্রিলা মাথায় কাপড় টেনে দিলো।ওদের পরিবারটা একটু রক্ষনশীল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আসছে ছোটবেলা থেকে। নামাজের মাঝেই শুনলো মোবাইলে বারবার রিং হচ্ছে, কিন্তু ঐন্দ্রিলা ফোন তুললো না ।
বেশ কিছুক্ষণ পর নামাজ শেষ করে যখন সে চা হাতে বসলো, মোবাইলে আবারও রিং বেজে উঠেছে।
উফ্ ! কে যে এতোবার ফোন করছে কে জানে ?
ঐন্দ্রিলা ফোনে দেখলো ১৩টা মিস কল, আর সবগুলোই রূপসার।
রূপসা আর ঐন্দ্রিলা বেস্ট ফ্রেন্ড , আজকাল যাকে বলে bff!
এরা দুজন দুই মেরুর, যেন একজন অন্যজনের কম্প্লিমেন্ট।
রূপসা সারাদিন বকবক করে, আর প্রতি মাসেই ওর বয়ফ্রেন্ড পরিবর্তন হয়।প্রত্যেক বার ব্রেক আপ-এর পরে সে আত্মহত্যার বৃথা চেষ্টা করে। সেটাও এরকম নাটকীয়তা, তাই এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।
রূপসার ইমোশনাল টানাপোড়েনের কারণে ওর বাবা মা সব সময় তটস্থ থাকে ওকে নিয়ে। তার অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করে নেন তাঁরা।
রূপসা অসম্ভব ইমপালসিভ মেয়ে। কোন কিছু মাথায় এলে তার তক্ষুণি করা চাই চাই।
যেমন কিছুদিন আগেই ওর ইচ্ছে হলো ড্রোন কিনবে। বাবা-মা না পারতে অনেকগুলো টাকা দিয়ে ড্রোন কিনে দিলেন। রূপসা ঠিক করলো সে ঢাকা শহরের এরিয়াল ভিউ নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি বানাবে। পুরান ঢাকার অলি গলি নিয়ে তার আগ্রহ বেশি।একদিন বুড়িগঙার আশেপাশে ড্রোন আকাশে উড়ছে , হঠাৎ এক বাজ পাখীর সাথে সংঘর্ষে ড্রোন ভেঙে পড়লো আর বাজপাখীও অক্কা পেলো। রূপসার ডকুমেন্টরি বানানোর স্বপ্নও সেদিন অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল।
ঐন্দ্রিলা ফোন ধরতেই চিৎকার করে উঠলো ,
—ফোন ধরছিস না কেন ? তুই কি আমার কল আজকাল স্ক্রিন করছিস ?
ঐন্দ্রিলা বিরক্ত হয়ে বললো ,
—জানিস না, এখন মাগরিবের ওয়াক্ত। নামাজ পড়ছিলাম।
—ধুর ! কেন যে এতো কষ্ট করে নামাজ পরিস ? একা একা স্বর্গে গিয়ে কি করবি বল? সেখানে তোর বন্ধুবান্ধব লাগবে না ?
ঐন্দ্রিলা উত্তরে বললো,
—ফোন করেছিস কেন এখন বল।
—তোর শিং মাছের কথা মনে আছে ?
রূপসার কণ্ঠে রাজ্যের উত্তেজনা !
—মানে, কোন শিং মাছ?
ঐন্দ্রিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
—আরে, তুই কয়টা শিং মাছ চিনিস বল তো? তোর মনে নেই, ওই যে তোকে খুব পছন্দ করতো, তারপর ক্লাস এইটে লন্ডনে চলে গেল ? সে এতোদিন পর দেশে বেড়াতে এসেছে।
আর তোকে না কি হারিকেন দিয়ে খুঁজছে !
—তো আমি কি করতে পারি ? ক্যানডেল লাইট ডিনার এরেন্জ করবো ?
ঐন্দ্রিলা বিরক্তির সাথে বললো।
‘শিং মাছ’ ওরফে তন্ময়, ছেলেটার কথা ঐন্দ্রিলার মনে পড়ে গেল এতদিন পর।
সেই ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়তো তারা। হঠাৎ করেই ক্লাস সেভেনের দিকে সে ঐন্দ্রিলার প্রেমে পড়ে গেল।
প্রতি শুক্রবার এক ডজন লাল গোলাপ পাঠাতো , সাথে চকলেট। কিন্তু ঐন্দ্রিলা কখনও রেসপন্ড করেনি।
রূপসা তন্ময়কে দুই চোখে দেখতে পারতো না, কারণ তন্ময় রূপসাকে “ রূপসা চপ্পল “ নামে ডাকতো ! আর রূপসা ওকে ডাকতো “ শিং মাছ” বলে , কারন সে ছিল একটু শ্যামলা বর্ণের, একহারা গঠন অনেক লম্বা প্রায় ছয় ফিট ।
এদিকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর, রমিলা মোবাইলে জলিলকে মেসেজ পাঠালো জানবার জন্য সে কোথায় ? মেসেজ করবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জলিল সশরীরে এসে উপস্থিত।
সে এসেই রমিলার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে রইল !
— মাইয়াডা কি সুন্দর রে !
জলিল মনে মনে ভাবলো।
একটুপর দুজনে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো।
তারা আজ যমুনা ফিউচার পার্ক নামক বিশাল শপিং সেন্টারে এসেছে। সেখানে প্রথমে আইসক্রীম খেলো।
জলিল রমিলাকে নিয়ে একসাথে নানা ভঙ্গিতে অনেকগুলো সেলফি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে আপলোড দিয়ে দিলো।
তারপর তারা সিনেমা হলের দিকে গেল। বিশাল সিনেমা হল দেখে রমিলা মুগ্ধ! ঠান্ডা এসিতে বসে কোকোকলায় চুমুক দিতে দিতে সিনেমা দেখছে তারা।
সিনেমার শুরুতে সাকিব খান মোটর সাইকেলে নায়িকাকে নিয়ে গান গাচ্ছে ,
“ তুই আমার ফেসবুকের নাম্বার ওয়ান বান্ধবী,
তোরে ছাড়া কে খুলবে এই হৃদয়ের চাবি।
উ উ উ আ আ…..”
রমিলার মনে হলো, আহা জলিল যেন ওকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছে আর গানে গানে ভালবাসায় দুলছে তারা দুজন।হঠাৎ মনে হলো তার ডান উরুর দিকে কে যেন স্পর্শ করলো । সম্বিত ফিরে পেয়ে রমিলা দেখলো জলিলের এক হাত ওর গালে আর অন্য হাত ওর ডান উরুতে।
—জান, কাছে আইসো !
জলিল খুব নীচু স্বরে রমিলার কানের কাছে এসে বললো ।
রমিলার ভীষণ ভয় হচ্ছে, আবার একটু একটু ভালও লাগছে।
(চলবে)
-বিপাশা বাশার