“প্রেমে পড়া বারণ”
পর্ব ৯

—মানে কি ? তুমি ওপরে চলে এসেছো ?
ঐন্দ্রিলা জানতে চাইলো।

—হ্যাঁ! তোমাদের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি । এবার ফোন রাখছি , দরজা খোলো তো।
তন্ময় বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা গুলো বলল।

ঐন্দ্রিলা নীরবে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আজ সব কিছু কেমন হযবরল হয়ে যাচ্ছে !
আসলে প্ল্যানিংএ বড়ো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। একই দিনে তন্ময়ের সাথে দেখা করা আর আদিত্য-এর কনসার্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করাটা চরম বোকামী হয়েছে।

এখন যা হবার হবে !

রমিলা আজ সকাল থেকে জলিলের কোন ফোন না পেয়ে শেষমেষ নিজেই ফোন করলো দুপুরবেলা ।

—কি ব্যাপার, আইজ ফোন করলা না যে ? কি হইছে ?
রমিলা একটু কপট অভিমানের সুরে আহ্লাদ করে জিজ্ঞাসা করলো।

—কিসু হয় নাই সুন্দরী । দেখলাম তুমি আমারে কেমন মিস করো, জান!

জলিল যথারীতি তার রংতামাশা শুরু করলো। ফোন রেখে দেওয়ার পর রমিলা অনেকক্ষণ বসে ওদের সম্পর্কের কথা ভাবল।
বিয়ে না করেও তো ভালোবাসা আর সখ্যতার সম্পর্ক থাকতে পারে। ভাগ্যিস বড় আপা সে দিন ওকে বকা দিয়ে লাইনে এনেছে। সেই জন্য সে বড় আপার কাছে আজীবন ঋণী থাকবে।

কলিং বেল বেজে উঠতেই রূপসা গিয়ে দরজা খুললো ।

—আরে শিং মাছ, আসো আসো ! তুমি তো দেখি লন্ডনে গিয়ে পুরো লাল টুকটুকে ‘পাঙাশ মাছ’ হয়ে ফিরেছো…., হা হা হা !
রূপসা নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে হাসতে হেঁচকি তুলে ফেললো।

—তোমার কি খবর ‘রূপসা চপ্পল? মাছ উপাধি ছাড়াও অন্য কিছু তো ভাবতে পারো ? জেনে রেখো, আমি কারাটে করি , ব্ল্যাক বেল্ট আছে আমার। আর যেহেতু বিলেত থেকে এসেছি , আমাকে 007 , মানে ‘জেমস বন্ড ‘ বলতে পারো !
তন্ময় হাসছে খুব সাবলীল ভাবে।

—ও রে বাবা , শিং মাছ থেকে একদম জেমস বন্ড ?
সিরিয়াসলি ?
স্বপ্ন দেখার একটা লিমিট আছে ফিশ ! আর আমাকে চপ্পল টপ্পল বলে দেখো আরেক বার, আমিও ফেন্সিং জানি !

ওদের এই সব খুনসুটির মধ্যে ঐন্দ্রিলা ঢুকলো ড্রয়িং রুমে ।
কথার মাঝে তন্ময় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ঐন্দ্রিলাকে দেখে।
একজন মানুষ কি করে এত সুন্দর হতে পারে?

—ওয়াও ঐন্দ্রিলা, কেমন আছো ? ইউ লুক এক্সট্রিম্লি প্রীটি ! আমি একদম মুগ্ধ !
তন্ময় মনে হয় একটা ঘোরে চলে গেল।

—এই যে ফিশ, আমার bff এর দিকে নজর দিয়ো না, শি মে হ্যাভ সাম আদার অপসানস্ !
রূপসা রহস্য করে বলে ঐন্দ্রিলার দিকে চেয়ে চোখ টিপ মাড়লো।

ঐন্দ্রিলা রূপসার চোখের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলো কথার মোড় ঘোরাবার জন্য।

—থ্যাংক ইউ। আমি ভালোই আছি তন্ময়।
আচ্ছা, রূপস্ , দ্যাখ তো দাদী কোথায় গেলেন ?

—দাদীর মোবাইলে একটা ফোন এসেছিল, উনি বারান্দায় গিয়ে কথা বলছেন।

একটু পরেই একটা বিশাল তুফান আসবে যখন দাদী তন্ময়কে দেখবে। ঐন্দ্রিলা আর ভাবতে চায় না এসব।

তন্ময়, রূপসা আর ঐন্দ্রিলা …. তিনজনে বসে বসে স্কুলের পুরোনো দিনের গল্প করছে আর অহেতুক হাসি আনন্দে গড়িয়ে পড়ছে একেকজন ।
স্কুল জীবনের বন্ধুত্বের সাথে আসলে কোন কিছুর তুলনা চলে না । সেই নিষ্পাপ, অনাবিল আনন্দের সময়টুকু মানুষের জীবনে আর কখনও ফিরে আসে না।

—তোর ‘বগা’ কে মনে আছে ? সেই যে একবার মোজাম্মেল স্যার কি পিটুনি দিলেন ক্লাসে চুইয়িং গাম খাওয়ার জন্য !
রূপসা হাসতে হাসতে আর কথা বলতে পারছে না ।

এমনি সময় দাদী ঘরে ঢুকলেন ।
ঐন্দ্রিলা দাদীর সাথে তন্ময়ের পরিচয় করিয়ে দিলো ।

—ওহ তুমি ঐন্দ্রিলার ক্লাসমেট ?
লন্ডনে কি পড়ালেখা করছো?
তোমার বাবা কি করেন ?
তোমাদের দেশের বাড়ী কোথায় ?
তোমরা কত ভাই বোন ?
তুমি কি বড় ছেলে ? ….

ঐন্দ্রিলা যা ভেবেছিল, দাদী আজ লাখো প্রশ্নবানে তন্ময়কে জর্জরিত করবেন। বেচারা তন্ময় … নিতান্তই ভদ্র গোবেচারা ছেলে।
কি সুন্দর সুবোধ বালকের মতো “ জী জী বলছে “ আর দাদীর সব প্রশ্নের উত্তর একে একে দিয়ে যাচ্ছে।
এসব কথার মাঝে দাদী হঠাৎ বলে উঠলেন ,

—আচ্ছা ঐন্দ্রিলা, ঐ সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্টে কারা উঠেছে রে ?
কিছু জানিস ?

—কেন দাদী? তাদের চিনি না। মনে হয় দেশের বাইরে থাকে।

—দেখলাম একটা লম্বা চওড়া ছেলে একটু পরপর তোদের এই বাসার দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটার চোখগুলো বিড়ালের মত কটা । ছেলেটার মতি গতি আমার ভালো ঠেকেনি। খবরদার তুই কিংবা ঐশী আর ঐ বারান্দায় যাস নে।

—কি যে বলো না দাদী !

—কে জানে, এরা কে বা কারা, কোথা থেকে এসেছে ? কেন যে এতো এক্সস্ক্লুসিভ আবাসিক এলাকায় সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্ট বানাতে পারমিশন দিল !
দাদীকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো।

দাদীর কথার মাঝেই রূপসা বারান্দার দিকে দৌড়ে গেলে। কিন্তু কাউকে দেখলো না সার্ভিস এ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায়।
একদম ফাঁকা।

ঐন্দ্রিলার হার্টবিট বেড়ে গেছে, গলাও শুকিয়ে আসছে !
এখন কি হবে ?
দাদী মনে হচ্ছে জলিলকে ডেকে সব খবর বের করে ফেলবেন আজ। বাবা মা যদি জানতে পারে, ভীষণ রাগ করবেন।
পুরো কেলেংকারী অবস্থা হয়ে যাবে !
ঐন্দ্রিলা মনে মনে ১০ বার আয়াতুল কুরশি পড়ল আর বলছে ,

—আল্লাহ ! তুমি রহম করো আজ।

ঐন্দ্রিলার দোয়া আল্লাহ্তা’লা শুনলেন । দাদী একটু পরেই তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন। ওনার নাকি কোন বন্ধুর বাসায় দাওয়াত আছে আজ রাতে। যেমন ঝড়ের মতো এসেছিলেন, তেমনি ঝড়ের মতোই চলে গেলেন ।

ঐন্দ্রিলা ঘড়ি দেখলো।
ছ’টা বাজে।
আদিত্য-এর কনসার্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ।
এখন তন্ময়কে কি বলবে সে, ভাবছে।
আর একেবারে সেই মুহূর্তে তন্ময় হঠাৎ ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

—ঐন্দ্রিলা ! তুমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আমি সারা জীবন শুধু তোমাকেই ভালবেসেছি।

‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই ।’

—উইল ইউ গ্রো ওল্ড উইথ মি ?
তন্ময় একটা হীরের আংটি পকেট থেকে বের করে ঐন্দ্রিলার বাম হাতের অনামিকাতে পরিয়ে দিলো।
ঐন্দ্রিলা কিছু বলতে পারছে না, বার বার চেষ্টা করেও সে চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না।

রূপসা বারান্দা থেকে ঘুরে এসে এই আনন্দঘন মুহূর্তটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলো।

—কনগ্রেচুলেশনস্ গাইজ।

রূপসা অতি উত্তেজনায় চিৎকার করে গান গেয়ে উঠলো ….

“কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ–
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।”

—ঐন্দ্রিলা , কাঁদছো কেন ? কিছু তো বলো ? একদম চুপ হয়ে গেলে যে ?
তন্ময় অনুনয়ের সুরে বললো।

—আমার মনে হয় ঐন্দ্রি এখনও শকে আছে । তন্ময়, ওকে একটু সময় দাও। সব কিছু ধাতস্থ হতে ওর সময় লাগবে । আজ আর কিছু জিজ্ঞাসা করো না। লেটস্ গিভ হার সাম টাইম।
রূপসা তন্ময়কে অভয় দিলো।

তন্ময় কিছুটা মন খারাপ নিয়ে চলে এলো।
ঐন্দ্রিলা কেন এতো কাঁদছে ?
কেন কিছু বলছে না ?
ওর কি ভাল লাগে নি তন্ময়ের প্রপোজল ?
সে কি তন্ময়কে ভালবাসে না ?

তন্ময় তার দাদীমার হীরের আংটি টা অনেক বছর আগে থেকেই চেয়ে রেখেছিল তার হবু বধুর জন্য।
এই আংটির একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। তন্ময়ের দাদাভাই আর দাদীমা যখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী করতে আমেরিকার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন, তখন দাদাভাই দাদীমাকে ছাত্রজীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে সেখানকার বিখ্যাত অলংকারের দোকান, টিফেনী’স থেকে সেই আংটি কিনে দেন। এরপর দাদাভাই আরও কত কিছু কিনে দিয়েছিলেন দাদীমাকে, কিন্তু সেই আংটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। তিনি সেই হীরের আংটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন তন্ময়ের জন্যে।
এবার লন্ডন থেকে এসে তন্ময় দাদীমাকে ঐন্দ্রিলার কথা সব খুলে বলেছিল। তিনি অত্যন্ত আনন্দের সাথে হীরের আংটি টি তন্ময় কে দিয়ে দিয়েছেন আজ ভোর বেলা ।
দাদীমা বলেছিলেন,

—আমার হীরের টুকরো নাতি আর তার বউ-এর জন্য এই হীরের আংটি আমি যক্ষের ধনের মতো এতদিন পাহারা দিয়ে রেখেছি। এখন বাবা, তুমি তোমার নিজের জিনিস নিজের কাছে রাখো। আমি নিশ্চিত এই আংটি আমার হবু নাত বউএর অনেক পছন্দ হবে।

—ঐন্দ্রি , ঐন্দ্রি …. আর কাঁদিস নে প্লিজ ! তুই এতো কাঁদছিস কেন আমাকে সত্যি করে বলবি ?

—জানি না।

—তন্ময় এতো ভালো একটা ছেলে আর এতো রোমান্টিক ! তোকে সে আজীবন তীব্র ভাবে ভালবাসবে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
রূপসা ঐন্দ্রিলাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঐন্দ্রিলার কান্না থামছেই না।

—আচ্ছা , তুই কি এখনও আদিত্য-এর ব্যাপারে কনফিউজড
আছিস ? সত্যি করে বল ।
এইবার রূপসা একটু দৃঢ় ভাবে জানতে চাইলো।

ঐন্দ্রিলা আস্তে করে মাথা নাড়ল ।

—ও এম জি ( OMG) ! তুই কি সিরিয়াস ?
রূপসা অসম্ভব বিরক্ত হলেও ঐন্দ্রিলাকে বুঝতে দিলো না।

—তাহলে চল, দেরী না করে চল !

—কোথায় যাবো?

—কোথায় আর ? বিলাই চোখ আমেরিকান পাগলা বেহালাবাদকের কনসার্টে ! যা এখনই উঠে পড়। অলরেডী অনেক দেরী হয়ে গেছে । কনসার্ট শুরু হওয়ার কথা রাত ৮টায়।
এখন বাজে সাড়ে সাতটা। রাস্তায় যে জ্যাম থাকে এই সময়ে ! তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নে।

ঐন্দ্রিলার এই দোনমন আচরণ রূপসার একেবারেই ভালো লাগছে না। কিন্তু মানুষের মন কেন যেন সব সময় অচেনা অজানা নিষিদ্ধ মোহের পেছনে ছোটে।

(চলবে)

–বিপাশা বাশার

#বিপাশা_বাশার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here