প্রেমাতাল
পর্ব ৩৩
মৌরি মরিয়ম
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠতেই মুগ্ধর ভাবনায় লাগাম পড়লো। উঠে গিয়ে দরজা খুলল, মা এসেছে। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো,
-“তিতির কোথায়?”
-“আমার ঘরে।”
মা সোজা মুগ্ধর ঘরে চলে গেল। মুগ্ধ দরজা লাগিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা বলল,
-“একি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার!”
মা বিছানায় তিতিরের পাশে বসেছে। মুগ্ধ চেয়ার টেনে বসে বলল,
-“তুমি জানলে কিভাবে যে ও এসেছে?”
-“পিউ ফোন করেছিল।”
-“ও।”
মা আবার বলল,
-“মেয়েটার চোখদুটো গর্তে ঢুকে গেছে। চেহারার মাধুর্যটাই চলে গেছে। ডাকাত ফ্যামিলি একটা।”
-“বাদ দাও না মা।”
-“কেন বাদ দিব? ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির জন্যই আজ আমার সংসারে কোন শান্তি নেই, সুখ নেই, আনন্দ নেই। যতটুকু ছিল তাও শেষ করে দিয়েছে। এতদিনে তোর বউ এসে নাতি নাতনীতে ঘর ভরে যাওয়ার কথা ছিল। ওর জন্য বিয়ে করলি না। ৪ বছর অপেক্ষা করলি ওর স্টাডির জন্য। লাভ কি হলো? উলটো অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হলো। এখনও বিয়ে করছিস না। বয়স চলে যাচ্ছে। তুই শুধু শুধুই ওর জন্য অপেক্ষা করছিস। দুনিয়া উলটে গেলেও ওর ফ্যামিলি কোনদিনও মানবে না। আর ও পারবেও না ওর ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে।”
-“মা এখন কি এসব কথা বলার সময়?”
-“অবশ্যই। ইভেন এখনই পারফেক্ট সময়। দেখ ওর অবস্থা, এসব দেখেও যে ফ্যামিলি ইগো নিয়ে বসে থাকতে পারে তারা বিবেকহীন। তাই ওর আশা এবার চিরদিনের জন্য ছেড়ে দে। তুই বুদ্ধিমান ছেলে, জানি এর বেশি কিছু আর তোকে বলতে হবেনা।”
মুগ্ধ চুপ, মা এবার প্রসঙ্গ পালটালো,
-“ওকে নাকি ঘুমের ওষুধ দিয়েছে?”
-“ঘুমের ইঞ্জেকশান।”
-“তাহলে? বাসায় যাবে কি করে? দেখ তুই ওকে বাসায় এনেছিস এটা নিয়ে না ওর ভাই আবার ঝামেলা করে।”
-“না মা। ডাক্তার বলে দিয়েছে জাস্ট ৩/৪ ঘন্টা ঘুমাবে। তারপরও না উঠলে ডেকে উঠিয়ে দিয়ে আসব।”
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“এর চেয়ে অনেক ভাল হত ইকরা কে যদি বিয়ে করতি। এসব আমার আর ভাল লাগেনা।”
-“মা ইকরাকে আমি পছন্দ করিনা।”
-“যাকে পছন্দ করো তার কাছে তো তোমার ভালবাসার দাম নেই। তাই যে তোমাকে পছন্দ করে তাকেই তোমার বিয়ে করা উচিৎ। ইকরার মত লক্ষী মেয়ে কতটা চায় তোকে! ও তোর বউ হলে সারাজীবন তোর পায়ের কাছে পড়ে থাকতো।”
-“বউ কি পায়ের কাছে পড়ে থাকার মত জিনিস মা?”
মা মেজাজ খারাপ করে তাকিয়ে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“তিতিরের কাছে আমার ভালবাসার দাম নেই এটাও তুমি ভুল বলেছ মা।”
-“হ্যা দাম আছে কিন্তু ওর কাছে ওর ওই ডাকাত ফ্যামিলির ভালবাসার দাম তার চেয়েও বেশি।”
-“সেটাই কি স্বাভাবিক না?”
-“না স্বাভাবিক না, আমি যে ফ্যামিলি ছেড়ে তোর বাপের সাথে চলে এসেছিলাম, তার মানে কি এই যে আমি আমার ফ্যামিলিকে ভালবাসতাম না?”
-“তা বলিনি মা, সবার তো আর সেই সাহস টা থাকে না।”
-“শোন মুগ্ধ, বিয়ে করে ফেললে সব ফ্যামিলিই একসময় মেনে নেয়। আমাদের ফ্যামিলি কি মানেনি? তুই হওয়ার পর মেনেছে কিন্তু মেনেছিল ঠিকই। তিতির যদি চলে আসতো তোকে বিয়ে করতো ওর ফ্যামিলিও এক সময় মেনে নিতো।”
-“মা তোমাদের সময়ে পালিয়ে বিয়ে করার একটা ট্রেন্ড ছিল। যা এখন নেই।”
কতক্ষণ রক্তচক্ষু নিয়ে মা তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল,
-“যা ইচ্ছে কর, এত মানুষ মরে আমি মরি না কেন কে জানে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিতিরের দিকে তাকালো মুগ্ধ। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে না মুগ্ধর। হচ্ছে না তিতিরের উপরেও। দুজনই হয়তো তাদের যার যার যায়গা থেকে ঠিক। শুধু মুগ্ধই ভাঙা সেতুর রেলিং ধরে ঝুলে আছে।
সেদিন তান্না খুব স্বাভাবিকভাবে মুগ্ধর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল হ্যান্ডশেক করার জন্য। তিতিরের বাবা বলেছিল,
-“এই আমার ছেলে।”
মুগ্ধ হ্যান্ডশেক করলো। তান্না বলল,
-“বাবা পরিচয় করাতে হবে না, উনি আমাকে ভালভাবেই চেনেন।”
তিতির বলে উঠলো,
-“তোমরা একে অপরকে চেনো?”
তান্না বলল,
-“হ্যা, চিনি। খুব ভালভাবেই চিনি। তো ভাইয়া, আপনি আমার বোন কে বিয়ে করতে চান? সত্যি আমি অবাক! কেন আপনার সেই গার্লফ্রেন্ডের খবর কি?”
সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওদের দুজনকে। মুগ্ধ এতটা ভয় আগে কোনদিন, কোনো সিচুয়েশনে, কাউকে পায়নি যতটা ভয় পাচ্ছে আজ তান্না কে। খুব অসহায় লাগছে। কোনরকমে বলল,
-“তখনও তিতিরই আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল।”
তান্না বলল,
-“রিয়েলি? গল্পটা বেশ।”
তিতিরের বাবা এতক্ষণে কথা বলল,
-“ব্যাপারটা কি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তান্না তুই ওকে কিভাবে চিনিস?”
-“বাবা উনিই মেহবুব। মিথুনদের বাসার দোতলায় থাকতো। বুঝতে পেরেছো কার কথা বলছি?”
বাবা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধর সত্যিই সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। বাবা মুগ্ধর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তিতির আংটিটা ফেরত দিয়ে দাও।”
তিতির অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে! মুগ্ধর মা বলল,
-“কেন ভাই? কি হয়েছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওদের পরিচিত হওয়ার সাথে তিতিরের আংটি খুলে ফেলার কি সম্পর্ক রয়েছে?”
তিতিরের বাবা বলল,
-“এ বিয়ে সম্ভব নয়। আমি কোনো গুন্ডা ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা।”
তিতির কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে! কিন্তু এটা বুঝতে পারছে সমস্যা বিরাট কিছু কারন মুগ্ধ প্রচন্ড নার্ভাস। মুগ্ধকে খুব কঠিন সময়েও নার্ভাস হতে দেখেনি তিতির। তাই ভয়ে তিতির আর কোনো কথা বলতে পারছিল না। কিন্তু যা দেখছে তাতে বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসতে লাগলো। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পড়ছে, মুখে আঁচল চেপে ধরে আছে তিতির। মুগ্ধর মা বলল,
-“গুন্ডা মানে? আমার ছেলেকে গুন্ডা কেন বলছেন? ও কি করেছে?”
-“আন্টি সেসব কথা বাচ্চাকাচ্চা আর মুরুব্বিদের সামনে আমি মুখে আনতে পারবো না। তাই ভাল হয় আপনি মেহবুব ভাইয়ার কাছ থেকেই এসব জেনে নিয়েন। উনি সত্যি ঘটনাটাই বলুক আর রঙচঙ মিশিয়েই বলুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
তিতিরের বাবা হাতজোড় করে বলল,
-“মাফ করবেন, এ বিয়ে সম্ভব না। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
একথা শুনে মুগ্ধর কি যে হলো সাথে সাথে তিতিরের বাবার সামনে দুই হাটু মুড়ে বসে পা ধরে বলল,
-“অাঙ্কেল, একথা বলবেন না প্লিজ। আমি যা করেছিলাম ভুল করেছিলাম। আজ আপনার পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করুন।”
তিতিরের বাবা আর একটি কথাও না বলে চলে গেল নিজের ঘরে। পেছন পেছন তিতিরের মাও গেল। বাবার পাশেই তান্না দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তান্নার পা ধরে বলল,
-“তান্না তুমি আমার ছোটই হবে তবু যে হাতে তোমাকে মেরেছিলাম সে হাতেই আজ তোমার পা ধরে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ ক্ষমা করো, তিতিরকে আমার থেকে আলাদা করোনা।”
এই দৃশ্য দেখে পিউয়ের চোখে পানি এসে গেল। স্নিগ্ধ্বও তাকিয়ে ছিল অবাক হয়ে। এটা কি ওদেরই বড়ভাই? যে কোনদিন কারো সামনে মাথা নিচু করেনি সে আজ একজনের পর একজনের পা ধরে মাফ চেয়ে যাচ্ছে!
তান্না সরে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে বলল,
-“নিচে দারোয়ানকে বললে গেট খুলে দেবে।”
তখনও মুগ্ধ ফ্লোরে বসা। ওর মা ওকে তুলে বলল,
-“চল।”
মুগ্ধ নির্বিকার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। মুগ্ধ,পিউ,স্নিগ
্ধকে নিয়ে ওদের মা তিতিরদের বাসা থেকে বেড়িয়ে এল। বের হওয়ার আগে একবার মুগ্ধ তিতিরের দিকে তাকালো। তিতির ওর ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আর কোনদিন মুগ্ধ তিতিরের চোখের জল মুছে দিতে পারবে না। ওর আজকের এই যত্ন করে পড়া লাল শাড়ি, চোখের কাজল সব মিথ্যে হয়ে গেল।
মুগ্ধ খুব ভেঙে পড়েছিল। পিউ, স্নিগ্ধ, মা সবার মনেই কৌতূহল ছিল আসলে কি এমন হয়েছিল তান্না আর মুগ্ধর মধ্যে? মা জিজ্ঞেস করতেই মুগ্ধ পুরো ঘটনাটা বলল। মা বলল,
-“ওদের আশা তাহলে ছেড়ে দে। তিতিরকে বল একদম খালি হাতে চলে আসতে।”
ওদিকে ওরা চলে যাওয়ার পর তান্না গিয়ে বাবার ঘরে ঢুকলো। তিতির ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। তান্নাকে বাবার ঘরে যেতে দেখে তিতিরও গেল। আসল ঘটনাটা কি সেটা ওর জানতেই হবে। ঘরের দরজায় পা রাখার আগেই তিতির শুনতে পেল তান্না বাবা-মাকে বলছে,
-“তিতির হয়তো কান্নাকাটি করবে তোমরা আবার গলে যেওনা।”
-“তান্না এসব কিছুই আমাকে বলতে হবে না। আমার খুব ভালভাবেই মনে আছে তুই এক সপ্তাহ হসপিটালে ছিলি। কয়েক মাস লেগেছিল সুস্থ্য হতে।
-“ওই ছেলে যদি ভাল হতো আমাকে মারার জন্য ওদের বিয়ে আটকে থাকতো না বাবা। ও একটা ক্যারেক্টারলেস। ব্যাচেলর ফ্ল্যাটে মেয়ে নিয়ে আসতো ভাড়া করে। চিন্তা করো একবার। আর আমাকে মারার সময় কি বাজে বাজে গালি যে দিচ্ছিল বাবা তার একটাও যদি তিতির শোনে ও ঘৃনায় মরে যাবে। আমার নাকি কোন জন্মের পরিচয় নেই, মাকে নিয়ে কতটা বাজে কথা বলেছিল বাবা আমি কিছুই ভুলিনি! তার সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে তো কিছুতেই মানব না বাবা।”
তিতির বিস্ময়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরে ছিল তান্নার কথা শুনে। মুগ্ধ ভাড়া করে মেয়ে নিয়ে আসতো! অসম্ভব.. তিতির চেনে মুগ্ধকে। মুগ্ধ কখনোই ওরকম না। কিন্তু মার আর গালাগাল! সেটা তো তিতির নিজেই চোখেই দেখেছে কতবার! তবু সবটা জানতে হবে। বাবা-ভাইকে পরে ফেস করবে। আগে পুরোটা মুগ্ধর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। তিতির নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর ফোন করলো মুগ্ধকে। ওপাশ থেকে ভেসে এল,
“আপনার ডায়ালকৃত নামারটি এখন বন্ধ আছে। দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।”
তিতির অবাক হলো, মুগ্ধর মোবাইল তো কখনো বন্ধ থাকেনা। আজ তবে বন্ধ কেন? চোখে পানি যেন আজ আটছেই না। উপচে উপচে পড়ছে।
To be continued…