#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|ত্রিশ তম পর্ব |
প্রেম নীড়ে মানুষজনের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা প্রেম নীড়ের বাগানে দৌঁড়াচ্ছে, খেলছে। দারোয়ান কুদ্দুস মোল্লার মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। আজ প্রেম নীড়ে বিয়ে হবে। হরেক ধরনের মানুষ আসবে। কুদ্দুস মোল্লার পকেট ভরবে।
আকাশ, রাইসার আকদ হবে আজ। আকাশের বিশাল পরিবারের বিশাল জন মানুষ এসেছে প্রেম নীড়ে। কুদ্দুস মোল্লা হাতের কড়ির হিসেব করছে এই বাড়িতে আর কয়টা বিয়ে আসবে এবং কীভাবে পকেট ভরবে। কুদ্দুস মোল্লার গণনার মাঝে সাদা প্রাইভেট কার এসে প্রবেশ করে প্রেম নীড়ের গেইটের অভ্যন্তরে।
সাদা সিল্কশাড়িতে একজন রমণী নেমে আসলেন গাড়ি থেকে। চোখে কালো চশমা, হাতে সাদা পুঁটলি আকৃতির কি যেন। দূর থেকে দেখলে বস্তা মনে হবে কিন্তু কাছে এসে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যাবে এটা কোন বস্তা পুঁটলি না বরঞ্চ ছোট হাত ব্যাগ। রমণীর হাঁটা চলার ধরণ দেখে যে কেউ দেখে বলবে, ‘বড়োলোকের বেটি, ভাব ধরে বেশি।’
রমণীটি চোখের চশমা খুলে পুরো বাড়ি নজর ঘুরালেন। এর মধ্যে প্রেম নীড়ের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসে অকাশ। জড়িয়ে ধরে রমণীকে। হাস্যজ্বল মুখে ভেতরে নিয়ে যায় প্রেম নীড়ের।
এবার দেখা যাক প্রেম নীড়ের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি,
আয়েশা আজাদের মুখে হাসির রেখা যেন সরছেই না। প্রেম নীড়ে মেহমান দেখে আনন্দিত তিনি। কথা বলছেন সোফায় বসে থাকা আকাশের দাদীর সাথে। আকাশের দাদী ধানমন্ডি থেকে এসেছেন। পোশাকআসাক দেখে মনে হচ্ছে খুব সৌখিন মানুষ। বয়স ষাটের উপর। ভারী মেকাপে বয়সের ছাপ ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আজাদ সাহেব হা করে সেই কখন থেকে আকাশের দাদীকে দেখে যাচ্ছেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আকাশের দাদী বলে উঠেন,
” আমি লিরা শেখ। আধুনিক যুগের মডার্ন দাদী। আকাশের পছন্দ আমাদের পছন্দ। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। মেয়ে মর্ডান হতে হবে।”
আয়েশা আজাদ হাসছেন। আকাশ আগেই অবগত করেছেন তার দাদীর সম্পর্কে। দাদীর মাথায় সমস্যা আছে। নিজেকে রাণী এলিজাবেথ ভাবেন। শেষ বয়সে সকলকে নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরান সবাইকে।
” আপনি যেমনটি চান তেমন মেয়ে’ই আমাদের। তাই তো আপনার নাতি পছন্দ করেছে আমার মেয়েকে।”
আয়েশা আজাদের উওরে লিরা শেখ প্রশান্তির হাসি হাসলেন।
আজাদ সাহেবের মুখ ছোট হয়ে আসলো লিরা শেখের কথা শুনে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যুবতী কিন্তু কথা বলার আসল চেহারা সামনে এসেছে। কন্ঠস্বর ভাঙা বুঝা যাচ্ছে আশি বছরের বুড়ি। আয়েশা আজাদ স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকান। আজাদ সাহেব বুঝতে পারেন স্ত্রীর চাহনি। মুখে মিথ্যা হাসি এনে উঠে চলে যান উপরে ছেলেদের কাছে।
——-
” উফ রুপ এতো সেফটিপিন লাগাচ্ছো কেন? আমি কি তুমি! যে শাড়ি সামলাতে পারি না!”
আয়েশা আজাদ কিছুক্ষণ আগে রাইসাকে শাড়ি পরিয়ে গিয়েছেন। মেয়েটার লাফালাফিতে শাড়ির কুঁচির ভাঁজ আশি ভাগ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই রুপ রাইসাকে ধরে দাঁড় করিয়ে সেফটিপিন লাগিয়ে দিচ্ছে। নয়তো দেখা যাবে লোকজনের সামনে মান সম্মান শেষ করে ফেলেছে রুপ।
” তুমি শাড়ি পরলে না যে রুপ! আমি দেখেছি তুমি শাড়ি পরলে ভাইয়া বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে।”
” ছিহ্ কি নির্লজ্জ রাইসা! আজ থেকে তুমি চোখ বন্ধ করে রাখবে।”
” নাও! আমি চোখ খুললেই দোষ! তোমার সে যে তাকিয়ে থাকে তার বেলায়!”
রাইসার মুখে দুষ্টু হাসি। রুপ লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে রাইসার মাথায় ডাব ভাঙতে। রুপ চোখ রাঙিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে নিজ মুখ ঢেকে রাখে লজ্জায়। এরমধ্যে নাদিফির আগমন ঘটে। রুপের দু হাতে মুখ লুকিয়ে রাখা দেখে ভ্রু কুঁচকায়। গম্ভীর স্বরে বলে,
” কি ব্যাপার! নতুন বঁধূ কাকে দেখে লজ্জা পেলে? আমি তো এখন পর্যন্ত কিছু করিনি।”
নাদিফের আওয়াজ পেয়ে রুপ মুখশ্রী থেকে হাত সরিয়ে নেয়। নাদিফের কাছে এসে বলে,
” আপনি তো কিছু করেননি। আমি তো করতে চেয়েছিলাম, আপনিই তো দেন নি।”
রুপের কথা শুনে নাদিফ খুক খুক কেশে উঠে। এই সুযোগে রুপ পারাপার। নিজের ঘরে চলে যায়।
রুপ চলে যেতেই নাদিফ বিড়বিড় করে বলে,
” তোমার সব চাল-চলন বুঝে ফেলেছি অপরুপ! কিছু সময়ের অপেক্ষা, তোমার নাচ- গান সব উড়ে যাবে।”
রাইসার মাথায় ঘোমটা টেনে নিচে নিয়ে আসা হয়। যথা সময়ে রাইসা আকাশের আকদ সম্পন্ন হয়। পুরোটা সময় লিরা শেখের মুখ চলছিলো কথার জুড়ি। আকাশের মুখে বিজয়ী হাসি। রাইসাকে আকাশ পেয়ে গিয়েছে আর কি প্রয়োজন।
” আমরা আমাদের দুই মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে একই দিনে করাতে চাই।”
আকাশের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। দাদী আছেন উনার অবস্থাও নাজেহাল। আয়েশা আজাদের কথা শুনে আকাশ বলে,
” কোন সমস্যা নেই আন্টি। আপনাদের নির্ধারিত করা দিনেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।”
” আজ থেকে দশদিন পর বিয়ে।”
সকলে মত দিলো আজাদ সাহেবের কথায়। এদিকে নাদিফ মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে মাত্র আর আজ’ই ছুটি নিতে হয়েছে বসের থেকে। ব্যাপারটা কেমন না! নাদিফ আরেকটা কারণে খুবই বিরক্ত আর সেটা হলো বড়ো ভাইয়ার একমাত্র বঁধূ। রুপকে উল্টা পাল্টা বুদ্ধি শেখায় যে। রাতে যে ফাহিমা ভাবির সব কারসাজি ছিলো তা নাদিফ কিছু সময় পর বুঝতে পারে।
সকলে কথায় ব্যস্ত। সকলের অগোচরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুপের পাশে এসে দাঁড়ায় নাদিফ। রোপের কানে ফিসফিস করে বলে,
” আজ তোমার খবর আছে অপরুপ! তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ, বোকা বানিয়েছ, মিথ্যা কথা বলেছ। আজ আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। তোমার ওই বুদ্ধি দেওয়া ভাবি সাহেবাও না। তুমি ভাবতেও পারবে না রুপ আমি এখন খি করবো। ফাহিমা ভাবিকে এখন আমি এমন এক জায়গায় পাঠাবো যেখান থেকে সে ফিরে আসতে পারবে না আমার কার্য হাসিল করার আগ পর্যন্ত।”
এদিকে রুপ নাদিফের কথায় আগের মতো ভয় পেয়ে যায়। নাদিফের কথা শুনে করুণ চোখে নাদিফের মুখের দিকে তাকায়। এতেও নাদিফের মন গলে না।
নাদিফ রুপের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সোফায় বসে থাকা আজাদ সাহেবের পাশে গিয়ে বসে। এরপর বাবার কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। এসব কিছু লক্ষ্য করছেন আয়েশা আজাদ। বাবা-ছেলের উপর কেমন যেন সন্দেহ জাগছে আয়েশা আজাদের মনে। নিশ্চয়ই বাবা-ছেলে মিলে কোন ফন্দি করছে।
ছেলের কথা শুনে আজাদ সাহেবের মুখ একটুখানি হয়ে যায়। ছেলের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে,
” এভাবে আমাকে বাঁশ দিতে তোর মনে একটুও বাঁধে না রে বাপ!”
বাবার কথা শুনে নাদিফ মাথা দুই দিকে হেলিয়ে না করে। ছেলের জিদের কাছে বাবা পরাজয় বরণ করে। সকলের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হেসে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে,
” যা অনুমতি দিলাম কিন্তু কথা দে উল্টাপাল্টা কিছু করবি না।’
বাবার অনুমতি পেয়ে নাদির বাবাকে জড়িয়ে ধরে। বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নাবিলকে চোখ টিপে দেয়। এরপর সরাসরি চলে যায় রুপের কাছে।
এদিকে রুপ তখন বাবা ছেলের কান্ড দেখে সন্দেহের চোখে তাকায়। নাদিফ কাছে আসতে দেখে একটু পিছিয়ে যায়। নাদিফ রুপের হাত ধরে টেনে সকলের সামনে থেকে বের হয়ে যায়।
নাদিফ চলে যেতেই নাবিলও ফাহিমার হাত ধরে বাহিরে চলে যায়। ফাহিমা তখন চালতার আচার খাচ্ছিল। একহাতে বাঁটি সহ ফাহিমা নাবিলের তালে তাল মিলিয়ে হাঁটা শুরু করে।
” এটা কি হলো! বাহিরে কি ডা’কা’ত পড়েছে! এরা এভাবে চলে গেলো কেন?”
লিরা শেখের কথা শুনে আজাদ সাহেব মুচকি হাসেন। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলেন,
“প্রেম নীড়ে বসত করে যে জনেরা,
প্রেমালয়ে মত্ত থাকে সর্বদা।
আপনজনের ভালোবাসায় রাঙাবে তোমার মন,
প্রেম নীড়ে পাবে যে সকল আপনজন।
ছিড়তে পারবে না কোন বন্ধন,
হ্যাঁ!
প্রেম নীড়ে পাবে যে শুধু প্রশান্তির ছায়ার মিলনায়তন।”
———
হালকা বাতাস বইছে চারপাশে। মোটরবাইক চলছে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তাতে। বাইক চালাচ্ছে নাদিফ তাঁর পিছনে বসা নববধূ। নাদিফকে না ধরে নিজের হাত শক্ত করে রেখেছে। ধরছে না নাদিফকে, অভিমান করেছে প্রচুর নাদিফের সাথে। এভাবে সকলের সামনে নিয়ে আসতে লজ্জা পাচ্ছে না এই ছেলেটা। অথচ রুপ ভীষণ লজ্জা পেয়েছে।
” আমাকে শক্ত করে ধরে বসো রুপ! নয়তো পড়ে যাবে। তারপর মানুষ বলবে, ‘হাড়ভাঙ্গা অপরুপা গলায় ঝুলেছে অবুঝ ছেলেটার।’
নাদিফের কথা শুনে রুপ নাদিফকে কয়েকটা চিমটি কাটে। আকস্মিক রুপের নরম হাতের শক্ত চিমটি খেয়ে নাদিফ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ব্যস্ত শহরের রাস্তায় মোটরবাইক কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে চলে। রুপ ঘাবরে যায়। ভীত দৃষ্টিতে তাকায় মোটরবাইকের দর্পণে। নাদিফ হাসছে। মুখশ্রী থেকে মুক্তের দানা যেন ঝড়ছে। রুপ ভাবছে, নাদিফের আজ এতো খুশির কারণ কি! রুপ নয়তো! আজ রুপ বিনা দ্বিধায় নাদিফের পাশে বসে আছে এজন্য হয়তো। নাদিফ পাশে আছে মনে হতেই রুপের মুখেও হাসির রেখা ফুটে উঠে। এখন আর কোন মান অভিমান নেই। মান অভিমানের পাল্লা সরিয়ে রুপ নাদিফের পেটে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। মাথা ঠেকায় নাদিফের পিঠে।
” পৃথিবীর সর্বোচ্চ শান্তি যেন পেয়েছি অপরুপ! এমন একটি দিনের আশায় ছিলাম, যেদিন তুমি ভালোবেসে আমার পাশাপাশি থাকবে। না বলেও বুঝিয়ে দিবে যে কতো ভালোবাসো তুমি আমায়।”
নাদিফের কথায় রুপ মুচকি হাসে। নাদিফকে আরো একটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে,
” যানবাহন চলাচলের সময় কথা বলতে নেই, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। গাড়ি চালান অসভ্য ঠোঁট কাঁ’টা বদ লোক।”
গাড়ি থেমেছে শহরের নামকরা রেস্টুরেন্টের সামনে। নাদিফ মোটরবাইক পার্কিংয়ে রেখে রুপের হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করে।
সুন্দর কারুকার্য করা রেস্টুরেন্ট। অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো একপাশে। এখানে মানুষজনেরা ছবি তুলে। একটি দোলনাও রয়েছ। রুপ রেস্টুরেন্টের চারপাশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। দোলনা দেখে আনমনে সেখানে বসে। পা দিয়ে আস্তে আস্তে দোল খেতে থাকে। রুপের মুখশ্রীতে আনন্দের হাসি। নাদিফ অপলক দৃষ্টিতে রুপের হাসি দেখছে।
সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা। রুপ অস্থির নয়নে নাদিফকে খুঁজে চলছে। নাদিফ এক ঘন্টা হয়েছে লাপাত্তা। রুপকে রেস্টুরেন্টে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। রুপ ভয় পাচ্ছে। নিজের জন্য না নাদিফের জন্য। কোন ক্ষতি হয় নি তো! রেস্টুরেন্টের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুপ। চেষ্টা করছে নাদিফকে খোঁজার। কিন্তু রুপের অধৈর্য আঁখি জোড়া ব্যর্থ। নাদিফের কোন চিন্হ নেই।
কিছুক্ষণ পর পায়ের কাছ থেকে জামায় টান লাগায় নিচে ফিরে তাকায় রুপ। ছোট একজন বাচ্চা দাঁড়িয়ে রুপের জামা টানছে। মেয়েটা শ্যামাবতী ডাগর চোখের চাহনি দেখে যে কেউ আদর করতে চাইবে। রুপ আশেপাশে ভালোকরে দৃষ্টিপাত করে নিলো। বাচ্চার খোঁজ কেউ করছে কি না! কাউকে দেখতে না পেয়ে রুপ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে টেবিলের উপর বসালো এবং নিজে চেয়ার টেনে বসলো। এরপর বাচ্চাটাকে প্রশ্ন করল,
” কি নাম তোমার?”
” আমার নাম সেথু। তার নাম তো অপরুফ, থাই না!”
রুপ বুঝতে পারে মেয়েটা ‘ত’ কে ‘থ’ উচ্চারণ করে। মেয়েটার নাম সেতু। রুপ মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
” হ্যাঁ, তুমি কীভাবে জানলে? তোমার আম্মু, আব্বু আসে নি?”
” আমাকে নিচে নামাও। থোমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাবো।”
রুপ তাই করলো। মিষ্টি সেতুকে পেয়ে নাদিফের কথা যেন ভুলে গেলো। সেতুকে নামিয়ে দিতেই সেতু রুপের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যাচ্ছে। এক তলা উপরে উঠতেই রুপের চোখ ছানাবড়া। নাদিফ পাঞ্জাবী পরিহিত। রুপের সাথে আসার সময়ের কাপড় গায়ে নেই। রুপের গায়ে আগে থেকেই সুতি শাড়ি পরিধান করে ছিলো। জলপাই রঙের শাড়ির সাথে মিলিয়ে নাদিফও একই রঙের পাঞ্জাবী পরেছে। নাদিফ রুপের কাছে এসে গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বলে,
” একরাশ গোলাপের শুভেচ্ছা অপরুপ! অভিনন্দন অপরুপ নতুন জীবনের জন্য। ধন্যবাদ আমার জীবনকে পরিপূর্ণ করার জন্য, ভালোবেসে আগলে রাখার জন্য।”
রুপ অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। রেস্টুরেন্টের উপরের পাশটা ভি আই পি দের জন্য। পুরোটা সাজিয়েছে নাদিফ। রুপ গোলাপের তোড়া হাতে নেয়। মুখে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে প্রত্যুওরে বলে,
” আপনার ভালোবাসা প্রকাশে আমি আপ্লুত। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না আমি জীবনে কি পেয়েছি। শুধু এতটুকুই বলবো, সারাজীবন পাশে আছি।”
উপস্থিত সকলের করতালির আওয়াজ শোনা যায় রুপের কথা শেষ হতে। অনেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছে রুপ নাদিফকে। রুপ সকলের সামনে নাদিফকে জড়িয়ে ধরে। মুখ লুকায় নাদিফের বক্ষঃস্থলে।
” চলে এসেছি বাপজান!”
আজাদ সাহেবের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই রুপ ছিটকে সরে যায় নাদিফের বক্ষঃস্থল থেকে। নাদিফও কম চমকায় নি বাবার কথা শুনে। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রেম নীড়ের সকলে এসেছে। মুখে আনন্দের হাসি।
” ছোট ভাইয়া, একা একা প্রেম করতে চাও! দরজা জানালা দেখে শুনে নাও! কখন না যেন কে চলে আসে! কাবাব মে হাড্ডি হতে অপেক্ষায় থাকে।”
ফাহিমা ছিলো সবার পিছনে। রুপ নাদিফকে একসাথে দেখে আনন্দিত হয়ে বলে উঠে। আজাদ সাহেব কাশতে শুরু করলেন প্রতিবারের মতো। আয়েশা আজাদ স্বামীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর করুণ চোখে বড়ো ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন যেন বলছেন,
” বাপ! তোর বউয়ের এমন সময়’ই কি বো’মা ফাটাতে হবে?”
নাবিল মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে সরি বলে। ফাহিমার গালে আস্তে করে চুমু এঁকে দেয় যেন এই শকে চুপ থাকে। বেচারি ফাহিমা এবার দ্বিগুন স্বরে চিৎকার করে উঠলো। সকলের সামনে স্বামীর সম্মান আকাশে তুলে,
” এটা কোন সময় হলো আদর করার! সবাই কি ভাববে?”
নাবিলের মাথায় হাত। ফাহিমাকে টেনে নিচে নিয়ে আসে সেখান থেকে। ফাহিমার কাহিনী দেখে সকলে হেসে উঠে। উপস্থিত আছে এখানে নাদিফের বন্ধু, রেস্টুরেন্টের কিছু দম্পতি যারা এখানে এসেছিলেন। সেতু তাদের মধ্যে এক দম্পতির বাচ্চা।
রুপ বাবা-মায়ের ন্যায় শ্বশুর শাশুড়িকে পেয়ে অনেক খুশি হয়। নাদিফ মাথা চুলকে যাচ্ছে এভাবে যে বাবার সামনে ধরা পড়বে এজন্যে।
” তোমরা এখানে?”
ছেলের কথায় আজাদ সাহেব ভাব নিয়ে বলে,
” ছেলে যেখানে, বাবা সেখানে! সে কি জানা নেই! তোমার পিছু পিছু চলে আসলাম। এখানে না আসলে তো ছেলের মতিগতি কিছুই দেখতাম না। ছেলে যে আমার মতো হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারতাম না।”
বাবার কথা শুনে নাদিফ হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আয়েশা আজাদের বাবা ছেলের অসীম ভালোবাসা দেখে চোখে পানি এসে যায়। মুখে হাসির রেখা এনে বিড়বিড় করে বলে,
” আল্লাহর নিকট হাজারো শুকরিয়া। এভাবেই যেন আমার পরিবার সমসময় হাসি খুশি থাকে।”
———-
সময় এখন রাত বারোটা। অনেকদিন পর পরিবারের সাথে বাহিরে সময় কাঁটিয়েছে নাদিফ। নাদিফ বর্তমানে অবস্থান করছে প্রেম নীড়ে চিলেকোঠার ঘরে। অপেক্ষা করছে রুপের। বাহির থেকে আসার পর রুপ ঘরে প্রবেশ করার আগে নাদিফ খুব শক্ত করে বলে দেয় যেন এক ঘন্টা পর ছাদে চলে আসে। নাদিফ রুপের জন্য অপেক্ষা করবে। রুপও মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। ফ্রেস হয়ে নাদিফ চলে আসে ছাদে।
কিছু সময় অতিবাহিত হয়। রুপ আসে সময় নিয়ে। নাদিফ তখন চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে ছিলো। রুপ নিশ্চুপ পায়ে নাদিফের পাশে এসে দাঁড়ায়। আস্তে করে নাদিফের মাথার কেশব টেনে দেয়।
” মাথাটা অনেক যন্ত্রণা করছিল অপরুপ! শান্তি পাচ্ছি এখন, ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে যাই তোমার নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে।”
রুপ ভেবেছিলো নাদিফ ভয় পাবে। ভাববে অন্য কেউ এসেছে বুঝি। উল্টা পাল্টা কয়েকটা বকুনও দিবে। কিন্তু তা হলো না। নাদিফ বুঝে গেলো রুপের হাতের স্পর্শ। রুপ মুচকি হেসে আরো ভালোভাবে কেশব টেনে দেয়।
” আপনি বুঝলেন কীভাবে আমি এসেছি!”
” বুঝে গিয়েছি।”
নাদিফের কন্ঠস্বর গম্ভীর। রুপ ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। নাদিফের মাথা থেকে হাত সরিয়ে সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
” কি হয়েছে আপনার? মাথা কি অনেক ব্যাথা করছে?”
রুপের কথা শেষ হতে না দিয়েই নাদিফ নিজের হাত বক্ষঃস্থলের বাম পাশে হাত রেখে বলে,
” এখানে ব্যথা করছে অপরুপ! তোমার কাছে কি কোন ঔষুধী আছে অপরুপ, ব্যথা সারানোর?”
” এখানে ব্যথা করছে মানে! অনেক ব্যথা করছে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে? নিচে চলুন বাবাকে ডাকি, না না এত রাতে বাবাকে ডাকা যাবে না। ভাইয়াকে ডাকবো।”
রুপ চলে যেতে নিলেই নাদিফ রুপের হাত টেনে ধরে। হ্যাঁচকা টেনে রুপকে নিজের কোলে এনে বসায়। ললাটের উপর এসে থাকা অবাধ্য কেশবগুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে বলে,
” এখানে ব্যথা কেন হচ্ছে বুঝনা তুমি! ঠিক আছে তোমার বুঝতে হবে না। তুমি চলে যাও, গতকাল যেভাবে মিথ্যা বলে চলে গিয়েছিলে ঠিক সেভাবে। তোমার তো আবার আমার কাছে আসতে ইচ্ছে করে না।”
রুপ নাদিফের কথা শুনে বুঝতে পারে যে,স্বামী অভিমান করেছে। কিন্তু রুপ কীভাবে অভিমান ভাঙ্গাবে? গভীরভাবে চিন্তা করছে রুপ। অবশেষে রুপ লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এগিয়ে যায় নাদিফের কাছে। নাদিফ খুব গভীরভাবে রুপের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। রুপের এগিয়ে আসা দেখে নাদিফ ভ্রু কুঁচকায়। কিন্তু পরমুহুর্তে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কেননা রুপ নাদিফের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়েছে। যেন নাদিফের রাখ ভেঙে যায়। হলোও তাই! নাদিফের রাগ শেষ। রুপকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“এটা কি করলে অপরুপ! আমি তো এবার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাবো! তোমার আজ রক্ষে নেই পাখি!”
দশদিন পর……
চলবে…….!