প্রিয়ঃ_আপডেট
মোর্শেদা রুবি পর্ব ২

পাপিয়ার বিয়ে এখানেই ঠিক হয়ে গেল।সালেহা বেগমের খুশি যেন আর ধরেনা।বড় আশা করেছিলেন তিনি।বাস্তবে তা ঘটতে দেখে তার মন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠতে লাগলো।
পাপিয়ার শ্বাশুড়ী মাজেদা বেগম বউয়ের গলায় চেইন পড়িয়ে দিলে আনন্দে সালেহার চোখে পানি এসে পড়লো।

মাজেদা বেগমের বড় বোন হলেন সাজেদা হাই।মাজেদা বেগম যে কোন ব্যপারে বড়বোনের সাথে পরামর্শ করে নেন।বলতে গেলে বড় বোন আর বড় বোন জামাই তার অভিভাবক।এছাড়াও বড় বোন সাজেদা হাই এর ছেলে শারদের সাথেই তার ছেলের ব্যবসার লেনদেন।টাকা পয়সা দিয়েও সাজেদা হাই বোনকে প্রচুর সাহায্য করেন।সে কারনেই আজ ছেলের এনগেজমেন্টের দিন সাজেদা হাই কে অনেক বলে কয়ে একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছেন মাজেদা বেগম।

মাজেদা জানেন যে মাত্র কয়েক মাস আগেই সাজেদা আপার ছেলের বৌটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে।তারপর থেকে একমাত্র নাতনী “প্রিয়” আর একমাত্র ছেলে শারদকে নিয়ে বড়আপার পেরেশানীর শেষ নেই।

এদিকে তার নিজের ছেলের আরমানের বিয়ের তারিখ ঠিক হবে আজকে,আপা দুলাভাইকে ছাড়া তো মাজেদা এটা করতেই পারবেন না।কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে ‘প্রিয়’ হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে রেখেছিল।মাজেদা নিজেও কয়েকবার “প্রিয়”কে সামলাতে চেষ্টা করছিলেন কিন্তু পারছিলেন না।বাচ্চাটা ভীষণ জেদী আর একগুঁয়ে হয়ে উঠছে দিন দিন।
পরে অনুষ্ঠানের শেষ দিকে এসে মাজেদা লক্ষ্য করলেন যে,পরিবেশ একদম ঠান্ডা।যেটা প্রিয় এতক্ষণ গরম করে রেখেছিলো।সাজেদা আপাও হাসিমুখে সবার সাথে কথা বলছেন।দেখে মাজেদার খুব ভাল লাগল।বাচ্চাটা হয়ত কোনো খেলার সাথী পেয়েছে।

এমন সময় সাজেদা হাই ছোট বোন মাজেদাকে ইশারায় ডাকলেন।মাজেদা সাথে সাথেই উঠে এলেন-“বলো আপা”!
সাজেদা বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন-“এ্যাই মাজু…তোর নতুন বেয়াইনের বাসায় ভেতরের রুমে একটা সুন্দর মত মেয়ে দেখে এসেছি।মেয়েটা কে রে? একটু খোঁজ নে তো”!
মাজেদা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকালেন-
“দাঁড়াও আপা, খবর বের করছি”!
মাজেদা কথাবার্তার এক ফাঁকে পাপিয়ার মা সালেহা বেগমকে ডেকে এক কোণায় নিয়ে গেলেন-“আপা,একটু কথা আছে”!

সালেহা মনে মনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন!আবার কি হলো? এরা মত বদলে ফেললো না তো?”
সালেহা বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন -“জ্বী,আপা বলেন!”
-“আপনাদের বাসায় আপনার সাথে আর কে কে থাকেন?”
-“এই তো আমার স্বামী আমার দুই মেয়ে আর কাজের বুয়া “!
-“ওও….তাই?”
-“জ্বী…!কেন আপা?”
-“না….না ঠিকআছে।”
বলে মাজেদা বেগম হেসে সরে গেলেন।
একফাঁকে বড় বোনের কাছে এসে বললেন-“কাকে দেখেছো আপা,আমাদের বউ পাপিয়া আর ওর ছোট বোন আর আছে বেয়াই বেয়াইন।আর ঐ এক কাজের বুয়া।তুমি কি ওর ছোট বোন সামিয়ার কথা বলছো নাকি?”
-“আরে না না,সামিয়াকে তো এখানেই সারাক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।সামিয়া না,ভেতরের রুমে একটা মেয়ে আছে।এদিকটায় সে আসেইনি।আমার ‘প্রিয়’ তো ওই মেয়েটার সাথেই খেলছে।মেয়েটাকে তখনই দেখেছি।আর সে যে কোন কাজের বুয়া না ওকে দেখলেই বোঝা যায়।একেবারে ভদ্র ঘরের মেয়ে।তোর বেয়াইনকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে দেখ তো, কাকে এত ঘটা করে লুকিয়ে রেখেছে?”

মাজেদা এবার বুঝতে পারলেন বিষয়টা।মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করলেন বোনকে।
-“বুঝেছি,দাঁড়াও! অন্যভাবে খোঁজ নিতে হবে!”
বলে সকলের অগোচরে তিনি বুয়াকে ইঙ্গিতে আঙ্গুল নাচিয়ে ডাকলেন।বুয়া সাথে সাথেই এলো-
“জ্বী,খালাম্মা,ডাকছেন?'”
-“আমাদের বাচ্চাটা কার কাছে দিয়েছো বুয়া ?”
-“ও….বাচ্চাডাতো পিরিয়া আপুর কাছে”!
-“প্রিয়া….?ওওও……তাই? তা সে কি হয় তোমার বেগম সাহেবার?”
-“খালাম্মার তো সরাসরি কিছু হয়না,তয় হেয় খালুজানের আপন ছুডো বায়ের মাইয়া লাগে। খালুজানের ছুডো ভাই তো বাইচ্চা নাই,কয়েক বচ্ছর আগে মারা গেছে!ঐ সুম থেইক্কা পিরিয়া আপু খালুজানের কাছেই থাহে”!

যা জানার জানা হয়ে গেছে মাজেদার।বড় বোনকে গিয়ে কানে কানে সমস্ত কথা জানালেন তিনি।সাজেদা হাই মাথা নাড়লেন-“আচ্ছা…ঠিকআছে”!

অনুষ্ঠান শেষে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো।এমন সময় হঠাৎ সাজেদা নিজেই উঠে প্রিয়কে আনতে গেলেন।তার ইচ্ছা,এই বাহানায় মেয়েটার সাথে আরেকবার দেখাও হবে,কথাও বলা যাবে।

দরোজা নক করলেন সাজেদা।কেউ সাড়া দিলোনা।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সাজেদা দরজার গায়ে সামান্য ঠেলা দিলেন।দরোজাটা খোলাই ছিল।সাজেদার হাতের চাপে দরোজাটা একটু খুলে গেলো।তিনি একটু কেশে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে পুরোটা খুলে উঁকি দিলেন! প্রিয়র নাম ধরে ডাকলেন–“প্রিয় সোনা,কোথায় তুমি..?”

ঘরের ভেতরে হালকা আলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।তিনি ভেতরে ঢুকে দেখলেন।অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে,আর প্রিয় ওর বুকের উপর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে”!দুজনেই গভীর ঘুম।

সাজেদা মনে মনে একটা বড়সড় ধাক্কা খেলেন।হঠাৎ আজই যেন তিনি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারলেন,’প্রিয়’র জেদটা আসলে একটা মায়ের অভাব থেকেই হয়েছে। বিগত দুটো ঘন্টা ধরে সে এই ছোট্ট রুমটাতে ঐ মেয়েটার সাথে আছে অথচ কোনো জেদ বা কান্না কাটি নাই।সে তার খেলার সঙ্গী পেয়ে সব ভুলে গেছে।
সাজেদার হঠাৎ চোখে পানি চলে এল।

কাছে গিয়ে আস্তে করে প্রিয়ার কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন!
-“এই যে মামনি,ওঠো”!
প্রিয়া চমকে চোখ মেলে তাকাল।তারপর বোকার মতো চারপাশ তাকিয়ে প্রিয়কে দেখলো। লজ্জিত হেসে বলল-
-“ওহ্ আন্টি আপনি।”
বলে প্রিয়কে আস্তে করে তুলে সাবধানে সাজেদা হাই এর কোলে দিয়ে দিল।

প্রিয়কে কাঁধে নিয়ে সাজেদা প্রিয়ার থুতনী ধরে নাড়া দিলেন-“কি নাম তোমার,মা?”
-“জ্বী,প্রিয়া”!
-“সুন্দর নাম।আমার নাতনীর নাম প্রিয়।তা প্রিয়া …..তুমি এলেনা যে সামনের রুমে ?”বলে সাজেদা প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।প্রিয়া অস্বস্তি বোধ করলো কি বলবে ভেবে পেলেনা।কেবল একটু মুচকি হাসল।সাজেদা মনে মনে কিছু একটার আন্দাজ করে নিলেন।আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।

এমন সময় পেছন থেকে হন্তদন্ত হয়ে সালেহা বেগম এলেন।ঘরে ঢুকে, প্রিয়ার সাথে সাজেদা হাইকে কথা বলতে দেখে তিনি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন।
-“আরে,বড় আপা আপনি এখানে? সবাই আপনাকে খুঁজছে,চলুন চলুন।”

সাজেদা হাই এবার সালেহা বেগমকে ধরলেন-“আপা,এই মেয়েটা কে, ওর সাথে তো পরিচয় করিয়ে দিলেন না,একেবারে যেন লুকিয়েই রেখেছেন।”সাজেদার কথায় কিছুটা খোঁচার আভাস পেয়ে সালেহা ফাঁকা হাসি হাসলেন!কাঁপা স্বরে বললেন-
-“আরেহ্ না না…ও এমনই। কারো সামনে একদমই যেতে চায়না।বাইরে গেলেও বোরকা নিকাব পড়ে তারপর যায়।তা..ই আমিও ওকে তেমন বিরক্ত করিনা!ও আসলে সবার সামনে সহজ বোধ করেনা…হেঁ…হেঁ….!”
বলে সালেহা ফাঁকা হাসি হাসলেন।

-“যাই হোক,আপা,আমি বলে যাচ্ছি…যেদিন আপনারা সবাই মাজেদার বাসায় যাবেন সেদিন কিন্তু ওকে অবশ্যই অবশ্যই সাথে নিয়ে যাবেন”!
-“জ্বী……চেষ্টা করবো”!
-“চেষ্টা করবো টরবো না আপা।ওকে অবশ্যই নিয়ে যাবেন! এটা আমার বিশেষ অনুরোধ! ”
সাজেদা অনুরোধ করলেন না যেন অনুরোধের সুরে আদেশ করলেন।সালেহার কানে তাই মনে হলো।
সাজেদা সালেহাকে কথাটা বলে প্রিয়ার দিকে ফিরে বললেন-“এই যে,মেয়ে তুমি কিন্তু সেদিন সবার সাথে যাবে।নইলে রাগ করবো।কি….ঠিক আছে?”

রাতে সবাই চলে গেলে সালেহা নিজের ঘরে এসে গা এলিয়ে দিলেন।মহা ধকল গেছে আজ তার উপর দিয়ে।যদিও রান্নাবান্না সহ বেশীর ভাগ কাজই প্রিয়া করেছে।তবুও ঘন্টাখানেক টানা দাঁড়িয়ে থাকায় ওনার পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে।
এর মধ্যে আরেক ঝামেলা এসে তার মনমেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে।
পাপিয়ার খালা শ্বাশুড়ী সাজেদা প্রিয়াকে হঠাৎ নিয়ে যেতে বলে দিল কেন কে জানে!
সালেহা চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলেন,সাজেদার মতলবটা আসলে কি! তিনি যদি প্রিয়ার জন্য বিয়ের কোনো সমন্ধ আনেন তাহলে কি উত্তর দিবেন তিনি।সালেহা চিন্তায় পড়ে গেলেন। প্রিয়া ছাড়া তাঁর সংসার অচল।
এতো কাজ তিনি একা সামলাবেন কি করে।তাছাড়া প্রিয়ার এখন বয়সই বা কত।এখনি ওকে বিয়ে দেবার কি আছে।

আচ্ছা,সাজেদা কি বিয়েশাদীর কথা বলবেন নাকি?নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করলেন সালেহা।তারপর আপনমনেই বললেন-এ জাতীয় কিছু বললে তাকে এমন কিছু বলতে হবে যেন তিনি প্রিয়ার ব্যপারে নিরাশ হয়ে যান, আবার মাইন্ডও না করেন।হাজার হোক সাজেদা তার বড় মেয়ের হবু খালা শ্বাশুড়ী।

সালেহা পাপিয়ার হবু শ্বাশুড়ীকেও দেখেছেন বড় বোনকে হুজুর হুজুর করে কথা বলতে।তাই সেরকম কিছু বললে খুব সাবধানে কথা বলতে হবে,মুখের উপর মানা করা যাবেনা।’
তাহলে কি বলা যায় তাকে! ভাবতে লাগলেন সালেহা বেগম।

ওদিকে প্রিয়া বুয়াকে নিয়ে পুরো ঘরদোর ঝেড়ে পরিস্কার করে ফেলেছে।সালেহা বেগম এসে প্রিয়াকে অর্ডার দিলেন-“রান্নাঘরে খাবার দাবার কি আছে দেখে সব বোল বাটিতে ঢেলে ফ্রিজে ঢুকা।বুয়াকে দে তুই নিজেও খেয়ে নে,যা”!
প্রিয়া মাথা নেড়ে চলে গেল,বুয়াও ওর পেছন পেছন যেতে নিলে সালেহা ওকে ডাকলেন-“এই হনুফা,শোন্,এদিকে আয়।”
-“জ্বী,খালাম্মা?”
-“মেহমান প্রিয়ার ঘরে গেলো কি করে!প্রিয়া বের হয়েছিলো?”
-“না খালা,আমিই হেগো বাবুডারে নিয়া হাটতে হাটতে পিরিয়া আপুর ঘরের কাছে গেসি!যে জ্বালানি জ্বালাতাসিল মাইয়াডা! দুইন্নার ঠ্যাডা!”
,-“হয়েছে,চুপ কর।”ধমক দিলেন সালেহা!
“একটা বাচ্চাও রাখতে পারিস না ঠিকমতো! ঐ টাও প্রিয়ার কাছে দিয়ে দেয়া লাগে,যা সর এখান থেকে”!
-“আমি কি করুম বাচ্চা না মানলে “!বলে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল হনুফা।সালেহা কিছু বললেন না।বেশী কিছু বললেই আজকাল সে কাজ ছেড়ে দেবার হুমকি দেয়।এই হয়েছে এক জ্বালা।এমনিতেই আজকাল কাজের ভালো লোক পাওয়া মুশকিল!

রাতে শুতে গিয়েও ভাবনা পিছু ছাড়ছেনা সালেহার।বিয়ের কথা বললে কি বলবেন?একসময় বিরক্তবোধ করলেন সালেহা।দুর…যত্তসব, পছন্দ করেছিলি আমার সামিয়াকেই পছন্দ করতি।মেয়েটা আজ পার্লার থেকে এতো সুন্দর করে সেজে এসেছে অথচ ওকে সাজেদার চোখে পড়লোনা।চোখে পড়লো কিনা……ভাবতে ভাবতে হঠাৎই সালেহার মাথায় বুদ্ধিটা এলো!

সালেহা মুচকি হেসে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন-“হ্যাঁ,বিয়ের কথা বললে সালেহা সোজা বলে দেবেন,ওর বিয়ে একজায়গায় ঠিক হয়ে আছে।পাত্র বিদেশে থাকে,এলেই বিয়ে হবে”!

চলবে…..!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here