প্রিয়ঃ_আপডেট পর্যটন ১৬
ষোড়শ পর্বঃ
মোর্শেদা রুবিঃ
১৬. ———————–
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারদকে মেহমানদারীর প্রস্তুতি নিতে হলো।মেহমান আসার কথা শুনে বিশ্রাম মাথায় উঠলো ওর।অবেলাতেই ওকে বেরোতে হলো ভালো মিষ্টান্ন দ্রব্য আনার জন্য।বেরোবার আগে মায়ের রুমে দেখা করতে গেলো সে!কারন অতিথিদের মুলতঃ তিনিই তো ডেকেছেন।
সাজেদা জানতেন শারদ ইরাদের আগমনে নারাজ তবু ছেলেকে বোঝালেন,মেয়ের বাপকে এতো নাক দেখালে চলে না।নিজেদের জানাশোনার মধ্যে যদি একজন দ্বীনদার পাত্র মিলে যায় তাতে ক্ষতি কি।আজকাল মানুষের মধ্যে নানান রকমের ফ্রড বের হয়েছে।ইরা হলো প্রিয়র আপন খালা।ছেলে যদি প্রিয়’র উপযুক্ত হয় তাহলে মেয়ে দিতে আপত্তির কি আছে।এখানে মেয়ের সুখটাই আসল। তাছাড়া প্রিয়’র যথেষ্ট বয়সও হয়েছে।এভাবে সব কিছুতেই খুঁতখুঁত করলে মেয়েকে শেষমেষ তার চেয়ে অযোগ্য কোনো পাত্রের কাছেই গছাতে হতে পারে।
শারদ এসব শুনে মায়ের সাথে কোনো তর্কে গেলো না।উঠে প্রিয়াকে জানিয়ে বাইরে চলে গেলো।
সন্ধ্যের পরপরই প্রিয়’র নানু তার ছোট মেয়ে মেয়ের জামাই আর নাতিসহ চলে এলেন।প্রিয়ার অনুরোধে শারদ আজ একজন প্রকৃত মেয়ের বাবার ভূমিকাই পালন করতে লাগলো।ইরার স্বামীর সাথে হাত মিলিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে বসালো।ইরা শারদকে দেখতে পেয়ে মাথায় আঁচল টেনে সালাম দিলো।শারদ মাথা নেড়ে সালামের উত্তর দিলো।ওর কিছুটা হাসিও পেলো।সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে কত বদলে দেয়।সময়ের চেয়ে কঠিন শাসক আর বোধহয় নেই।
সবার শেষে এলো ত্বাকী।ওকে দেখে শারদ মনে মনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো।ওর মানসপটে এতক্ষণ একটা অপরিপক্ক তরুনের ছবি ভাসছিলো।যাকে তার মেয়ের পাশে কতটা জুঁৎসই লাগবে সে বিষয়ে যথেষ্ট দ্বিধাও কাজ করছিলো।কিন্তু ত্বাকীকে দেখার পর শারদের ভেবে রাখা সমস্ত কল্পনার ফাণুস খড়কুটোর মতো বাতাসে উড়ে গেলো।কমপক্ষে পৌণে ছয় ফিট লম্বা ত্বাকীর পেটানো শরীর আর ঘন চাপ দাড়ীতে তার নিগূঢ় ব্যক্তিত্ব আর সততা যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো।বয়সটা বোধহয় সবার শরীরে সমান ভাবে তার প্রভাব ফেলতে পারেনা।কেবল দেখতেই না,এই ছেলে আচরণেও যথেষ্ট পরিপক্কতা অর্জন করেছে।জড়তাহীন দরাজ কন্ঠের সালাম দিয়ে সে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলো আমি এখানে অনাহুত নই।
শারদ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে ধাতস্থ হয়ে লক্ষ্য করলো ত্বাকী ওর দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
শারদ হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হলো।হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে অজান্তেই ত্বাকীর হাতটা ধরে সামান্য ঝাঁকি দিলো।
ত্বাকীকে হাত ধরে নিজের পাশে বসালো।ত্বাকীর বাবাই টুকটাক প্রসঙ্গ তুলে কথা এগোনোর চেষ্টা করলেন।
শারদ নিজেও ত্বাকীকে কয়েকটা প্রশ্ন করলো।ত্বাকী অকপটে আস্থার সাথে সেসমস্ত কথার উত্তর দিতে লাগলো।এক পর্যায়ে নাস্তা পর্ব শেষে ত্বাকীর বাবা শারদকে অনুরোধ জানালো তার সম্মতি পেলে তিনি তাঁর বড় মেয়ের ব্যপারে কিছু কথা বলতে চান।শারদের মনোভাব এখন আগের তুলনায় অনেক নমনীয়।প্রশ্রয়ের হাসি শারদের ঠোঁটে।
অবশেষে পাত্রীর সাথে সাক্ষাতের কাঙ্খিত অনুমতিটি মিললো।
প্রিয়’র নানু নিজেই প্রিয় কে নিয়ে সাজেদার রুমে নিয়ে এলেন।এখানেই ত্বাকীর ডাক পড়লো!ত্বাকী এসে অনুচ্চস্বরে সালাম জানালে সাজেদা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিলেন।
প্রিয় চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
আজ তার পরনে নেভী ব্লু ফুলহাতা গাউন আর গোলাপী রঙের হিজাব।হালকা মেকআপের জন্য ওর মুখখানি পূর্ণ চাঁদের মতো লাগছিলো।
ত্বাকী পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো।তারপর পুনরায় সালাম দিলে প্রিয় মৃদুস্বরে সালামের জবাব দিলো।
ত্বাকী সামান্য কেশে বললো-“কেমন আছেন?”
-“জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ!”
-“আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না,কেমন আছি?”
প্রিয় মুখ নামালো! গন্ডে লালাভা দেখা দিলো।
ত্বাকী বললো-
-“আমার তেমন কোনো প্রশ্ন নেই!আপনিই বরং আমাকে প্রশ্ন করুন!”
প্রিয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে সপ্রতিভ কন্ঠে বললো-
-“আল্লাহ কোথায় আছেন এ ব্যপারে আপনি কুরআনের কোন আয়াতটিকে রেফার করবেন ?”
ত্বাকী হাসিমুখে প্রশ্নটি শুনে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো-“একজন সাহাবী যখন একজন দাসীকে মুক্ত করতে যাচ্ছিলেন তখন রাসুল সাঃ দাসীটিকে মুক্ত করার পূর্বশর্ত হিসেবে তার ঈমান যাচাইয়ে এই প্রশ্নটিই করেন।বলো তো আল্লাহ কোথায় আছেন?তখন দাসীটি আঙ্গুল তুলে আকাশের দিকে দেখালে রাসুল সাঃ সন্তষ্ট হয়ে দাসীটিকে মুক্ত করার অনুমতি দিলেন।আর এ ব্যপারে আমি সুরা ত্বহা’র ৫নং আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করবো যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে,রহমান আরশে সমাসীন।মেরাজের রাতে নবীজি সাঃ এর উর্ধ্বাকাশ ভ্রমন,সিদরাতুল মুনতাহার পর নবীজির একাকি গমন,প্রতি শেষ রাতে মহান আল্লাহর প্রথম আকাশে আগমন এই সত্যটির দিকেই নির্দেশ করে যে মহান আল্লাহ আরশে আছেন।যারা তার সর্বত্র বিরাজমান এবং নিরাকার হবার ধারনায় বিশ্বাস করেন তারা মুলতঃ বিধর্মীয় কুফুরী মতবাদের অনুসারী।এছাড়া সুরা আরাফের ৫৪নং আয়াতেও ছয়দিনে পৃথিবী সৃষ্টির পর আরশে সমাসীন হবার কথাই স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে।”
প্রিয় এতক্ষণে তার চেপে রাখা নিঃশ্বাসটি ছেড়ে স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করলো।ত্বাকী মৃদু হেসে বললো-“আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
-“জ্বী,নিশ্চয়ই!”
-“অনেকেই তর্ক করেন নবীজি নুরের তৈরী।এ ব্যপারে আপনার বক্তব্য কি?”
প্রিয় মুচকি হেসে বললো-“অবশ্যই তিনি নুরের তৈরী নন,তিনি মাটির তৈরী আদম সন্তান।আর এটা মহান আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন সুরা কাহাফের শেষ আয়াতের প্রথম লাইনে।সেখানে বলা হয়েছে,”আমি নিঃসন্দেহে তোমাদেরই মতো একজন মানুষ…!”
ত্বাকী বললো-“এখানে আরেকটা শক্ত রেফারেন্স হলো,আল্লাহ যখন আদম আঃ কে সৃষ্টি করেন তখন নুরের তৈরী সকল ফেরেস্তাদেরকে নির্দেশ করেছিলেন যে,তোমরা আদমকে সিজদা করো।তখন সকল ফিরিস্তা আদমকে সিজদা করলেও আগুনের তৈরী বলে ইবলিশ সিজদা করতে অস্বীকার করেছিলো কারন সে অহংকার করলো সে আগুনের হয়ে আদমকে কেন সিজদা করবে!তখন সে আল্লাহর আদেশ অমান্য করায় চির অভিশপ্ত হয়ে রইলো।তাই নুরের তৈরী ফেরেস্তারা মাটির তৈরী আদমকে সিজদা করে মাটির তৈরী মানুষকেই শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে নিয়েছে।আর নবীজিও একজন বাসার তার মানে তিনি একজন ‘মানুষ’!নবীজিকে নুরের তৈরী বললে তার মর্যাদাকে খাটো করে দেখা হয়।”
প্রিয় মাথা নেড়ে বললো-“জ্বী,আপনি ঠিক বলেছেন।আমলের চেয়ে আক্বীদা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।তাই আমাদের প্রত্যেকের আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া উচিত।নইলে আমাদের ঈমান সঠিক পথে থাকবেনা!আফসোস হলো,আমরা অনেকেই ভ্রান্ত আক্বীদাকে আঁকড়ে ঘরে আমলের পাহাড় খাড়া করছি!”
দুজনের কথোপকথনে প্রিয়’র নানু আর সাজেদা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন।এবার নানু বলে উঠলেন।
-“তোমাদের কথা তো তোমরা বললে,এবার সংসারের কথাবার্তা শুনি।শোনো নানুমনি,আমার এই ভাইটি কিন্তু রসিক আবার পেটুকও।তাই তোমাকে রান্নাবান্না জানতে হবে।নইলে আমার ভাইটিকে যে না খেয়ে থাকতে হবে!”
সাজেদা হেসে বললেন-“নাহ্,আমার নাতনী ভালো রান্নাও জানে।আপনার নাতিকে না খেয়ে শুকাতে দেবেনা।বলে দুই বৃদ্ধা নিজেদের মধ্যে হেসে উঠলেন।কথার ফাঁকে প্রিয় অজান্তেই ত্বাকীর দিকে তাকিয়ে নার্ভাস হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।
ত্বাকী অপাঙ্গে ওর দিকেই একভাবে তাকিয়ে আছে।আশ্চর্য্য, দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোকের সামনেও এতোটুকু লজ্জা সংকোচ নেই।কেবলার মতো তাকিয়ে থাকার মানে কি!
ছোটখাট আরো কিছু আলাপের পর সাজেদা প্রিয় কে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলেন।ত্বাকী মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে প্রিয় ভেতরে চলে গেলো কিন্তু যাবার সময় ত্বাকীর মনটিও বিনা অনুমতিতে নিজের সাথে করে নিয়ে গেলো।একমাত্র মনটি হারিয়ে ত্বাকী এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগলো।
চলে আসার আগে দিয়ে ইরা আচমকা নিজের গলার চেইন খুলে প্রিয়র গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো-“আমার বৌমাকে আমি নিজের করে নিলাম।এবার তোমরা কবে আমার মেয়েকে আমার করে দিচ্ছো বলো!” প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলো ইরা।প্রিয়া হাসিমুখ ধরে রেখেই কিছুটা দ্বিধা নিয়ে শারদের দিকে তাকালো।
শারদ কিছুটা গম্ভীর সুরে বললো-“প্রিয় আমার প্রথম সন্তান বলেই নয়, ও আমার বাকি মেয়েদের চেয়ে আলাদা।আমার যে কোনো সিদ্ধান্ত সে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নেবে জানি কিন্তু পিতা হিসেবে আমার কর্তব্য হলো তার কাছ থেকে পরিস্কার অনুমতি নেয়া।তাই এ ব্যপারে যা কথা বলার তা প্রিয়’র সাথে কথা বলার পরেই আমি বলতে চাই!”
তাৎক্ষণিকভাবে সবাই চুপ করে গেলেও ত্বাকী পরিস্কার কন্ঠে বলে উঠলো-“আপনার কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত আঙ্কেল।ওনার পূর্ণ সম্মতি ছাড়া আমি নিজেও স্বচ্ছন্দ বোধ করবো না।ইসলামে বিয়েতে পাত্রীর অনুমতিটা গুরুত্বের সাথে দেখে।পাত্রীর অনুমতি বা সম্মতি নেই অথচ কন্যার পিতার ইচ্ছায় বিয়ে হয়েছে এমন বিয়ে আল্লাহর রাসুল ভেঙ্গে দিয়েছেন।”
এরপরে পরিবেশটা হালকা হয়ে উঠলো।টুকটাক আলাপের পরে ইরার পরিবার বিদায় নিলে শারদ না খেয়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়লে প্রিয়া বাধা দিয়ে বলে উঠলো-“একবারে খেয়ে নিলে ভালো হতো না!”
শারদ চিন্তিত মুখে চুপচাপ শুয়ে রইলো।
প্রিয়া তা দেখে স্বামীর পাশে বসলো-“কি হয়েছে? কি নিয়ে এতো চিন্তা করছেন?”
শারদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“প্রিয় যদি সম্মত হয় তো ওর বিয়ে হয়ত এখানেই হবে।কিন্তু এরা তো আমার মেয়েটাকে নিয়ে দুরে চলে যাবে!চাইলেই যখন তখন মেয়েটাকে দেখতে পারবো না।আমার মা মরা মেয়েটা…..”বলেই শারদ হঠাৎ থেমে প্রিয়ার দিকে তাকাল।
প্রিয়া মুখ নামিয়ে বসে আছে।শারদ প্রিয়ার হাত ধরে বললো-“স্যরি,তুমি মনে কষ্ট নিও না।কথাটা আমি ওভাবে বলিনি।প্রিয়কে তুমি মায়ের স্নেহ যত্নে যেভাবে গড়ে তুলেছো তা নীরাও পারতো কিনা জানিনা।তবে লালন-পালনের মধ্য দিয়েই যে সন্তানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তৈরী হয় তা প্রিয়কে দেখলে বুঝি।তোমার জায়গায় অন্য কেউ ওর মা হলে প্রিয় আজ আর দশটা সাধারন মেয়ের মতো হাটে বাজারে চরে বেড়াত।তোমাকে বা প্রিয়কে কাছ থেকে না দেখলে জানতাম না মেয়েরা এমনও হয়।আসলে পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রাণীকে স্রষ্টা আপনাপন বৈশিষ্ট্য দিয়েই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।একমাত্র নারী জাতি ছাড়া জগতের আর একটি সৃষ্টিও অপরের বৈশিষ্ট্য নিজ অস্তিত্বে ধারন করেনা বা করতে চায়না।কিছু নারীই কেন যেন পুরুষের সমকক্ষ হওয়াকে বেশ মর্যাদার মনে করে।অথচ ক্ষেত্র বিশেষে নারীই শ্রেষ্ঠ কারন তার গর্ভেই সমস্ত পুরুষজাতির জন্ম।সে যে একজন গর্ভধারিনী এটা ভুলে গেলে চলবে কিভাবে!”
প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“আপনি ঠিকই বলেছেন।না,আমি কিছু মনে করিনি।প্রিয় আমার গর্ভজাত না হলেও ও আমার স্বামীর ঔরসজাত সন্তান।ওকে দুরের ভাবার কোনো যুক্তিই নেই।আমি চেয়েছি প্রিয়’র মধ্যে সকল নারীসত্ত্বা স্বমহিমায় উজ্জল থাকুক।তাই সেভাবেই ওকে তৈরী করেছি।জ্ঞানে বুদ্ধিতে যোগ্যতায় আমার প্রিয় কোনো পুরুষের চেয়ে কম নয় কিন্তু এটার প্রমান দেবার জন্য মাঠে নেমে ঘোমটা খুলতে হবে কেন!এক শ্রেনীর পুরুষরা নারীকে স্বাধীনতার আপ্তবাক্য শুনিয়ে কৌশলে ঘরের বাইরে নিয়ে নিয়ে এসেছে আর তাতে নারীর অবমাননা ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো উপকার হয়নি।”
-“হমম,আল্লাহর লাখ শোকর যে আমার প্রিয়কে তুমি অন্ধকার জগতে পা বাড়াতে দাওনি।ওকে দ্বীনের আলোয় উদ্ভাসিত করেছো।আমি সবসময় এজন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।”
প্রিয়া প্রসঙ্গান্তরে বললো-“ওদের কে তো জবাব দিতে হবে।প্রিয়র সাথে কথা বলেছেন?”
-“নাহ্,বলবো।প্রিয় কি করছে?”
-“ঘরেই তো আছে।চলুন,আমি সাথে যাচ্ছি।”
–“নাহ্,কাল কথা বলবো।আজ থাক্।”
পরদিন বিকেলের দিকে প্রিয়’র ঘরের দরজায় এসে নক করলো প্রিয়া।
তারপর উঁকি দিয়ে বললো-“আম্মু তোমার বাবা একটু তোমার সাথে কথা বলতে আসতে চাচ্ছেন।”
প্রিয় শুয়েছিলো।উঠে বসে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বললো-“এসো আম্মু!”
প্রিয়া ‘তোমরা কথা বলো’ বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
শারদ হাসিমুখে সালাম দিয়ে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলো-“আমার আম্মুটা আজ কেমন আছে?”
-“আলহামদুলিল্লাহ আব্বু!”
-“নাস্তা খেয়েছো মা?”
-“জ্বী,আপনি খেয়েছেন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহ খাইয়েছেন!”
বলেই শারদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“আচ্ছা,এই যে কথাটা বললাম ‘ আল্লাহ খাইয়েছেন’ এটার ব্যখ্যা কি।আমার ঘরভর্তি খাবার,আমি সবদিক দিয়ে ফিট একজন মানুষ।খাবার তো আমি ইচ্ছে হলেই খেতে পারি।তাহলে আমরা কথাটা এভাবে বলি কেন?”
প্রিয় বুঝলো বাবা ওর ইন্টারভিউ নিচ্ছেন।সে বাবার কাঁধে মাথা রেখে বললো,সেদিন তুমি শখ করে ইলিশ মাছ কিনে এনেছিলে মনে পড়ে?”
-“হমম,খুব মনে আছে!”
-“আম্মুকে বললে ভাপা ইলিশ করতে।আম্মু কত যত্ন করে কলাপাতায় মুড়িয়ে তোমার পছন্দের ভাপা ইলিশ করলো কিন্তু তুমিই খেতে পারলেনা অথচ আমরা সবাই মজা করে খেলাম!”
-“কি করবো,খাওয়ার শুরুতেই বেকায়দায় একটা কাঁটা গলায় বিঁধলো,যেটা কখনো হয়না।যন্ত্রনার চোটে মাছটা খাবার রুচিই চলে গেলো!”
-“ঠিক এমনিভাবেই বিভিন্ন কারনে,কখনো দাঁত ব্যথা,পেটে বা মাথায় ব্যথা,অরুচি,অসুস্থতা ছাড়াও এমন হাজারটা কারন তৈরী হতে পারে যা আমাদেরকে তৃপ্তির সাথে আহার করতে দেয়না।তাই যখন আমরা কোনো কিছু নির্বিঘ্নে খেতে পারি তখন প্রশংসাটাতো আল্লাহরই প্রাপ্য হয়।সেদিন শুনলাম,ইমরান আঙ্কেল সাদা ভাত আর ডাল খাচ্ছেন অথচ সেদিন বিয়ে উপলক্ষে কয়েক লক্ষ টাকার মুখরোচক খাবারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি অথচ আলসারের সমস্যার কারনে তিনি তা ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না।আমাদেরকে তো মহান আল্লাহই খাওয়ান।”
শারদ হেসে মেয়ের কপালে চুমু খেলেন-“আমার মা’টাকে আল্লাহ অনেক হিকমা দিয়েছেন!”
-“আলহামদুলিল্লাহ!”মৃদুস্বরে বললো প্রিয়।
-“আম্মু,আমি গতকালকের অতিথিদের ব্যপারে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
-“জ্বী,বলুন আব্বু!”
-“তোমার খালামনি সম্পর্কে মোটামুটি সব কথাই তো জানো।এখানে আত্মীয়তা করার ব্যপারে আমি তোমার পরামর্শ চাচ্ছি!”
প্রিয় মুখ নিচু করে বললো-“আপনার সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত আব্বু!”
-“তাহলে মানা করে দিলে তোমার আপত্তি নেই,কি বলো?”শারদ গম্ভীর সুরে বললো।
প্রিয় চট করে বাবার মুখের দিকে তাকাতেই শারদ হা হা করে হেসে বললো-“আমি ভাবছি,ওদেরকে সামনের সপ্তাহে আসতে বলবো কি বলো আম্মু।
প্রিয় আনন্দ চাপতে মুখ নামালো।
ইরাদের বাড়ীতে শারদের ফোন যেতেই ওরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো।অবশেষে পরের সপ্তাহেই আকদের সিদ্ধান্ত স্থির হলো!
আজ প্রিয়’র আকদ অনুষ্ঠান।
পুরো বাড়ীকে ছোট ছোট লাল নীল হলুদ বাতিতে সজ্জিত করা হয়েছে।প্রিয়া ব্যস্ত হাতে মেয়েদের তৈরী করছেন।সবাই আসতে এখনো দেরী আছে।তাই প্রিয়’র নানু কনের যাবতীয় সাজ পোশাক নিয়ে বিকেলেই হাজির হয়ে গেছেন।সাজেদার রুমে গল্প করছেন তিনি।
সন্ধ্যের পরপরই নামাজ পড়ে প্রিয়কে তৈরী করার জন্য পার্লার থেকে একটা মেয়েকে আনা হলো।সে প্রিয়’কে সাজিয়ে দেবে।
প্রিয় কাচুমাচু মুখে বললো,”আমাকে খুব হালকা সাজাবেন।সাজগোজ আমার একদম পছন্দ না!আর আমি খোঁপাও বাঁধবোনা!”
প্রিয়’র এসব কথা শুনে পার্লারের মেয়েটি হতাশ চোখে প্রিয়ার দিকে তাকালো।প্রিয়া নিজের মেয়েকে বিলক্ষণ চেনেন তাই মাথা নেড়ে পার্লারের মেয়েটিকে আশ্বস্ত করে প্রিয়’র কাছে গেলেন।
-“দেখো আম্মু,আমি জানি সাজগোজ তোমার পছন্দ না।আর আমিও তোমাকে কখনো সাজতে উৎসাহ দেইনি কারন এতোদিন এটা তোমার দরকার ছিলো না।কিন্তু আজ তোমার সাজ তোমার স্বামীর মনে আনন্দের খোরাক যোগাবে।স্বামীর চোখে দৃষ্টিনন্দন হয়ে উপস্থিত হওয়া প্রত্যেক নারীর অবশ্য কর্তব্য।ইসলাম এ ব্যপারে স্বামী-স্ত্রী উভয়কে পরস্পরের কাছে সুশোভিত হয়ে উপস্থিত হবার পরামর্শ দিয়েছে।আর আজ তো তোমার বিয়ে।তোমার স্বামী কি চাইবেন না তার নববধূটি সুন্দর সুসজ্জিত হয়ে তার সামনে উপস্থিত হোক?
তোমার ভালো না লাগলেও তার ভালো লাগাকে সম্মান জানিয়ে তোমাকে আজ সুন্দর করে সাজতে হবে মা।এই আমাকে দেখো,আমি কখনো অগোছালো এলোচুলে থাকিনা কারন তোমার বাবা আমাকে ওভাবে দেখতে পছন্দ করেন না।আমার বেশীর ভাগ থ্রিপীস নীল নয়তো লেমন ইয়েলো কালারের, কেন জানো? কারন এই দুটো রং তোমার বাবার খুব পছন্দ।তোমার বাবা বেণী পছন্দ করেন না বলে আমাকে সবসময় খোঁপা করে থাকতে হয়।আবার গোল গলার পাঞ্জাবী আমার পছন্দ না বলে তোমার বাবা ঐ গলার পাঞ্জাবী পড়া ছেড়েই দিয়েছে।সে আমার পছন্দের পোশাক পড়ে।আবার বাসায় সবসময় আমার পছন্দের পারফিউমটাই ব্যবহার করে।আমরা আজকে এর উল্টোটা করছি বলে সমাজে কত বিপত্তি দেখো,স্ত্রী সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে সকালে অফিসে যায় কার সামনে?অফিসের বস আর কলিগদের সামনে আর ক্লান্ত শ্রান্ত মলিন মুখে বাসায় ফিরে মুখ কালো করে দাঁড়ায় কার সামনে? নিজের স্বামীর সামনে।যার হক ছিলো মেয়েটির সকালকার সৌন্দর্য্যটা দেখার।অথচ সে দেখছে কাকে?এলোমেলো বেশের এক নিষ্প্রান নারীকে।তাইতো আজকের স্ত্রীদের কাছে অফিসের পরিপাটি পুরুষ আর পুরুষদের কাছে অফিসের সুসজ্জিতা নারীরা বেশী আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।ফলাফল পরকীয়া,ডিভোর্স,সন্তানদের দুর্গতি!”
প্রিয় মুদুস্বরে “স্যরি” বলে পার্লারের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন-“আমাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিন যেন…..!”
প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলো প্রিয়।
প্রিয়া হেসে বেরিয়ে গেলো।
অপরূপ সুন্দরীশ্রেষ্ঠার সাজে টুকটুকে বউ হয়ে সেই কখন থেকে বসে আছে প্রিয়।অথচ বরপক্ষের কারো দেখা নেই।রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চললো।শারদ মনের অস্থিরতা চেপে অধীর আগ্রহে গেটের কাছে পায়চারী করছিলো।
এমন সময় ফোন বেজে উঠল শারদের।নাম্বারটা এক পলক দেখে রিসিভ করেই মুখটা বিকৃত হয়ে গেলো ওর।ফোন কানে ধরে রেখে সেখানেই জমে গেলেন তিনি!
শারদকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে একজন অতিথি ছুটে এলেন-“কি হয়েছে,ওনারা কোথায় এখন?”
শারদ কাঁপা স্বরে জবাব দিলো-
–“হাসপাতালে!”
চলবে……