#প্রহেলিকা
#পর্ব_৩৬
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

-“আপনার প্ল্যান কী?”

ইনশিতার প্রশ্নটি খুবই অপ্রয়োজনীয় ঠেকল জিহাদের কাছে। সে হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,

-“প্ল্যান? তাও আবার আমার! কী যে বলো না ইনশিতা!”

-“খবরদার ঐ মুখে আমার নামটাও নেবেন না।”

ইনশিতা ঝাঁঝাল গলায় বলল কথাটা। হাসি থামায় জিহাদ। ঘাড়টাকে হালকা কাত করে তাকায় সে। জিহাদের এমন কাজে ইনশিতার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। ছয় সাত মাস আগের জেহেরকে দেখছে যেন সে। ভয়ে ইনশিতা সামনের গ্লাসটির অবশিষ্ট পানি ঢকঢক করে পান করল। জিহাদ ঘাড় কাত করেই হাসল। তার এঁটো পানি খেয়েছে ইনশিতা! এই মুহুর্তে সত্যি জিহাদকে মারাত্মক ভয়ানক লাগছে। ইনশিতার ঘাম ছুটানো ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটা দেখল কতক্ষণ জিহাদ। তারপর বলে উঠল,

-“আমাকে দেখে জেহেরকে মনে পড়ে গেল তাই না?”

ইনশিতা তৎক্ষণাৎ তাকাল জিহাদের দিকে। জিহাদ কী করে জানল?

-“তোমাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে কতটা ভয় পাচ্ছ। বাট চিন্তা নেই। আমি জেহেরের মতো না।”

-“আজেবাজে কথা রাখুন আর বলুন আপনি এমন কেন করেছেন?”

জিহাদ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

-“আমি আবার কী করলাম?”

বিরক্তিতে ইনশিতা মুখ দিয়ে চ কারান্ত শব্দ তুলল।

-“জানেন না কী করেছেন? এই যে জেহেরকে মারা, আমাকে জোর করে তুলে নেওয়া এইসব আপনি কেন করেছেন? বাবাকে কেন মারতে চেয়েছিলেন?”

-“একটু আগে তো শুনলেই জেহেরকে কেন মারতে চেয়েছি। তাহলে এক প্রশ্ন বারবার করছ কেন?”

-“মা জেহেরকে একটু বেশিই নাহয় ভালোবেসেছিল। এই সামান্য কারণেই আপনি জেহেরকে মারতে চেয়েছেন?”

জিহাদ শক্ত গলায় বলল,

-“এটা মোটেও সামান্য কারণ নয় ইনশিতা। তুমি তো মা বাবার সঙ্গ পেয়েছ ছোট থেকেই, তাই তুমি বুঝছ না। আমি তো ছোট থেকেই বাবার আদর পাইনি, মায়ের আদর যতটুকু পেয়েছি পরবর্তীতে সব জেহের ছিনিয়ে নিলো।”

-“এতে জেহেরের কী দোষ? জেহের তো তখন মা’কে দেখতে পারেনি, এখনো না। জেহের অসুস্থ থাকায় মা শুধু ওর প্রতি একটু বেশি অ্যাটেনশন দিয়েছে ব্যস। তো জেহের কী দোষ করল?”

-“ওর দোষ ও কেন জন্ম নিলো পৃথিবীতে! ও আসার পর থেকে সবকিছুই ছিনিয়ে নেয় আমার থেকে। প্রথমে আমার আপন মাকে, তারপর সৎ মা আর তারপর…আমার ভালোবাসার তুমিকে।”

ইনশিতা তাচ্ছিল্য সহকারে বলল,

-“ভালোবাসা! সিরিয়াসলি! আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আপনার কাছে মনে হচ্ছে না এটা পৃথিবীর সেরা জোক? আমাকে যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকতেন তাহলে নোংরামো করতে চেয়েছিলেন কেন?”

-“আমি এটা করতে চাইনি ইনশিতা। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবেসেছি, ইভেন এখনো বাসি।”

-“ওহ প্লিজ! দয়া করে নোংরামোকে ভালোবাসার রূপ দেবেন না।”

জিহাদ অস্থির হয়ে বলল,

-“ইনশিতা, বিশ্বাস করো। তখন আমার মাথায় পাগল ভর করছিল, আ-আমি সত্যি এমনটা করতে চাইনি। নয়নিকার কথায় আমার যে কী হলো, ব্রেইন ওয়াশ হয়ে গিয়েছিল একদম…তোমাকে পাওয়াটা মুখ্য হয়েছিল তখন। যে করেই হোক, রেপ…”

জিহাদকে থামিয়ে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকায় ইনশিতা।

-“এক মিনিট। নয়নিকা মানে? নয়নিকা কেন এমন আইডিয়া দেবে? ও কখনোই এমনটা চাইবে না। সব আপনার প্ল্যান আমি বুঝি।”

-“সত্যি বলছি আমি, জেবাকেও জিজ্ঞেস করে দেখো। নয়নিকাই এসব করতে বলেছিল, আমি প্রথমে সায় দেইনি, ও-ই আমাকে বার বার বলত। পরে ভেবে দেখলাম এমন করলে তোমাকে পাওয়াটা আরো সহজ হবে। তাই এমন করেছিলাম।”

-“তাহলে নয়নিকাকে মারলেন কেন? নয়নিকা যেহেতু আপনার সাহায্য করতে চেয়েছিল তাহলে ওকে কেন এত নৃশংস ভাবে হত্যা করলেন? আর জেবা কোথায়?”

-“ও একজন বিশ্বাসঘাতক তাই। জেবার খবর জানি না।”

-“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি নিজেই নয়নিকাকে ফুসলিয়েছেন। নাহলে নয়নিকা কখনোই আমার ক্ষতি করতে চাইতো না। কী বলে ফুসলিয়েছেন ও’কে? বলুন, কী এমন বলেছিলেন যে নয়নিকা তার বেস্টফ্রেন্ডের এত বড় ক্ষতি করতে চাইল?”

জিহাদ চোখ বন্ধ করে বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

-“তোমাকেও পুরো ঘটনা বলতে হয় তাহলে।”

-“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন। শুনতেই তো এসেছি।”

জিহাদ সরাসরি ইনশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

-“তোমাকে দু’বছর ধরে ভালোবাসি। যখন থেকে ভালোবাসি তখন থেকেই তোমাকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে চাইতাম।”

ইনশিতা থামিয়ে দিয়ে বললল,

-“লাইফ পার্টনার না বলে বেড পার্টনারই বলতে পারতেন।”

-“ইনশিতা প্লিজ, আমার ভালোবাসাকে খারাপভাবে দেখবে না।”

-“খারাপ কাজ করলে খারাপভাবে দেখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”

জিহাদ ঐ প্রসঙ্গে কথা বাড়াল না।

-“তোমাকে যখন জেহের বিয়ে করতে চায় তখন আমার রাগ হয় খুব। তোমার বাবাকে জেহেরের নামে উল্টাপাল্টা বলি, যাতে তোমাকে বিয়ে না দেয়। তবে তোমার বাবা পরে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। তাতেই আমার রাগ হয়। এই জন্য সুযোগ খুঁজছিলাম তোমার বাবাকে শাস্তি দেওয়ার। কেউ যদি আমার পছন্দের বাহিরে কাজ করে তাকে আমি ছাড় দেই না কখনোই। তাই যেদিন নয়নিকাকে মা‌রি সেদিন তোমার বাবাকেও মারতে বাসায় যাই। তবে পুরোপুরি মারতে পারিনি আশেপাশের মানুষ এসে যাওয়ায়। ঐদিন আমি জেহেরের সাথে মিলিয়েই ড্রেস আর লেন্স পরেছিলাম যার কারণে তোমার মা আমাকে জেহের ভেবে নেয়।”

-“জঘন্য আপনি!”

জিহাদ বাঁকা হাসে তাতে।

-“তোমাকে না পেয়ে যখন আমি পাগল হয়ে যাই তখন নয়নিকা এসে হাত মেলায় আমাদের সাথে। জেবা আগে থেকেই আমার সাথে ছিল। রাফিদকে জেবা ভালোবাসে। রাফিদকে মারাটা জেবা সহ্য করতে পারেনি, তাই সেও রেগে ছিল জেহেরের উপর। জেহেরকে কোনোভাবে কষ্ট দিতে পারলে সেও খুশি। নয়নিকা আমাদের হেল্প করতে চায় তোমাকে পেতে। আমরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। নয়নিকা যে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড সেটা জানি। তাই ওর প্রতি তেমন বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও বলেছে ও নাকি তোমার ক্ষতি চায়। তোমাকে দেখতে পারত না নয়নিকা।”

-“কেন?”

-“তোমার মনে আছে জেহের তোমাকে পাওয়ার জন্য কলেজে গিয়েছিল একবার। আর তখন নয়নিকাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল?”

-“হ্যাঁ।”

-“সেইদিন রাতেই আমি নয়নিকাকে পৌঁছে দেই। নয়নিকার অবস্থা কিন্তু তখন ভালো ছিল না। হাত কাটা আর এমনিতেও সে ভয়ে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। নয়নিকাকে আমি তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই চলে যাই। নয়নিকা বাড়ির সামনেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আর আশেপাশের মানুষ ব্যাপারটাকে খারাপভাবে নিয়েছে। ভেবেছে ওকে রেপ করে ফেলে রেখে গেছে। সমাজকে চিনো তো? তিল কে তাল বানিয়ে দিতে ন্যানো সেকেন্ডও সময় লাগে না। নয়নিকা কিছু না করেও তার বদনাম তুলে ফেলল আশেপাশের লোকেরা। আর সেই থেকেই নয়নিকার রাগ তোমার প্রতি। তার নামে এত বড় কলঙ্কের দাগের জন্য সে তোমাকে দায়ী করে। ভাবে তোমার জন্যই তো জেহের ও’কে তুলে নিয়েছিল। তোমার জন্যই তার এই অবস্থা। সে জন্যই তোমার কোনোরকম ক্ষতি করতে পারলেই তার শান্তি। জেহেরের কাছে যে তুমি ভালো থাকবে নয়নিকা তা সহ্য করতে পারতো না। হিংসা করতো সে। আমার ইচ্ছে হয়েছিল নয়নিকাকে তখনই পুঁতে ফেলি। তোমার ক্ষতি করতে চায় এমন মানুষকে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে আমার সময় লাগতো না। কিন্তু তখন আমি শুধু তোমাকে পেতে চাইতাম তা যেভাবেই হোক না কেন। নয়নিকা আমাকে বুদ্ধি দিয়েছিল যে তোমাকে তুলে এনে রেপ করি। এতে তুমি সম্মানের ভয়ে আমাকে বিয়ে করবে। জেবা না করে দিয়েছিল। আমারও ঐ প্রস্তাব ভালো লাগেনি। তোমার কোনো ক্ষতি ছাড়াই তোমাকে পেতে চাইতাম। কিন্তু নয়নিকা প্রতিদিন এই ব্যাপারটা নিয়েই ঘ্যানঘ্যান করতো। তা আমার মাথায় সেট হয়ে গেলে আমি ভাবতে থাকি যে ওটাই হয়তো ঠিক হবে। আসলে তোমাকে কীভাবে নিজের করে পাবো সেটাই আসল লক্ষ্য হয়েছিল আমার। যার কারণে এমন নীচু কাজ করতেও দ্বিধাবোধ হয়নি। জেবা চাইছিল না কিছুতেই। পরে নয়নিকাও ওর ব্রেইন ওয়াশ করিয়েছে। সে বলেছে তোমাকে রেপ করলে জেহের কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরবে। আর জেহেরের কষ্টই যেহেতু জেবা চায় সেহেতু এই পথটাই বেস্ট। জেবাও পরে সায় জানিয়েছে। তারপর নয়নিকাই প্ল্যান করল তোমাকে কোনোভাবে জেহেরের বাগানবাড়ি থেকে বের করে আনবে। সেটাও হলো। তারপর তোমাকে কোনো জোর করা ছাড়াই তুলে নিয়ে যাই। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম ঐদিনই বিয়ে করে নিই তোমায়। তাহলে কোনো কষ্ট পেতে হবে না তোমার। কিন্তু তুমি যখন বিয়ে করতে চাইছিলে না আর বারবার জেহেরের কাছে যেতে চাইছিলে তখন আমার রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই তোমায়…”

ইনশিতা শুধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নয়নিকা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমন একটা জঘন্য কাজ করতে চেয়েছিল!

-“ও’কে মেরেছিলেন কেন?”

-“যখন দেখলাম তোমাকে পাইনি তখন নয়নিকার উপরই রাগ চেপে গেল আমার। আর এমনিতেও তখন নয়নিকার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছিল। নয়নিকা বেঁচে থাকলে তোমার আরও কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করে বসতো। আর যে তোমার ক্ষতি করবে তাকে মেরে ফেলব না তা কি হয়? তাই নয়নিকাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরেছি। আর সেই খুনটা জেহেরের উপর চাপাতে চেয়েছি। ভেবেছি জেহের জেলে গেলে তোমাকে পাওয়া যাবে কোনো বাঁধা ছাড়াই। কিন্তু…”

-“পেলেন না তাই তো? আরে আপনি যদি আমাকে জোর করেও নিয়ে যেতেন না, তাও আপনাকে কোনোদিন মানতাম না আমি। ভালোবাসা তো দূর!”

-“তুমি শুধু সবসময় আমার কাছে থাকলেই হতো। তোমার ভালোবাসা লাগবে না, আমার ভালোবাসা দিয়েই সবটুকু পূরণ করতাম।”

কথাটি খুব ধীরস্বরে মাতাল চাহনিতে তাকিয়ে বলল জিহাদ। এই কথার পর ইনশিতার বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল খুব।

-“ইনশিতা!”

জিহাদের মাদকতা ভরা কন্ঠে ইনশিতার নাম শুনে তার বসে থাকতে আর ইচ্ছা হলো না। ইনশিতা ওঠার আগেই জিহাদ বলল,

-“খুব ভালোবাসি তোমায় ইনশিতা। আমাকে আপন করে নাও। আমাকে একটু ভালোবাসা প্লিজ। একটু ভালবাসা চাই আমার ইনশিতা।”

ইনশিতার কোনো ফিল হলো না এই কথা শুনে। জিহাদ তাকে ভালোবাসে ঠিক। এটা ইনশিতা নিজেও বুঝতে পারছে। তবে ভালোবাসার ধরণটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য জিহাদ খুব নোংরা উপায় বেছে নিয়েছে। সে তো পারতো রাফিদের মতোই ভালোবাসাকে মুক্ত করে দিতে। কিন্তু না, ভালোবাসাটা যেন তার জেদে পরিণত হয়েছে। আর সে জেদ মেটাতে যেকোনো কিছুই করতে চাইত। ইনশিতার এটাই ভালো লাগলো না। কেন সে রাফিদের মতো পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারেনি? কেন এত বিকৃত উপায় বেছে নেওয়া?

ইনশিতা উঠে পড়ল যাওয়ার জন্য। জিহাদ যেন এতে আরও অস্থির হয়ে পড়ল।

-“ই-ইনশিতা। আর একটু বোসো না প্লিজ, আমি কিছু বলবো না আর। শুধু একটু বসো…ইনশিতা…”

ইনশিতা এবার কন্ঠে তেজ ঢেলে বলল,

-“কেন? বসিয়ে রেখে কী করবেন? চোখের ক্ষুধা মেটাবেন? চোখ দিয়ে গিলে খাবেন তাই তো?”

-“ভুল ভাবছ ইনশিতা। আমি এমনটা ভাবতেও পারি না…ইনশিতা প্লিজ…”

জিহাদের চোখের কোণে জল টলমল করছে। যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে পারে। ইনশিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জিহাদ চেষ্টা করছে চোখের পানিটুকু আড়াল করতে। সে চাইছে না কোনোভাবেই ইনশিতা তার দুর্বলতা দেখুক। ঘাড় এদিক ওদিক নাড়িয়েও চোখের পানি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বেহায়া জল উল্টো এতে আরো বাড়ছেই। জিহাদ তখন রাগ নিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দারোগার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,

-“হাত খুলে দিলে কী আমি পালিয়ে যেতাম? তোকে কাছে পাই, বাপের নাম ভুলিয়ে দেবো। শালা…”

বলতে বলতে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখের কোল ঘেঁষে। মুহুর্তেই মাথা নিচু করে ফেলল জিহাদ। এবার তার সত্যিই খুব দুর্বল লাগছে। ইনশিতা ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে জিহাদের কাছে এগিয়ে আসলো। ইনশিতার উপস্থিতি টের পেয়েও জিহাদ মাথা তুলল না। তার ভাবনা ছিল ইনশিতা রুমাল দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিবে। কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ইনশিতা রুমালটা টেবিলের উপর রেখে দেয়।

-“ছাড়া পেলে মুছে নিবেন।”

বলেই চলে যেতে নেয় ইনশিতা। জিহাদ এবার মাথা তুলে অসহায় চোখে তাকায়। কাতর গলায় বলে,

-“যেও না জান। প্লিজ…”

ইনশিতা পেছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“পরবর্তীতে কাউকে ভালোবাসলে ভালোবাসাকে মুক্ত করে দিতে শিখবেন। খারাপ পথ বেছে নেবেন না।”

-“তুমি ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবনাতেও আসে না ইনশিতা। আমি সত্যি তোমায় খুব ভালোবাসি।”

-“ভালোবাসার পদ্ধতিটা ভুল ছিল।”

জিহাদ কান্না আসা গলায় চেঁচিয়ে বলল,

-“আমার দু’বছরের ভালোবাসাটাকে কেন দেখছো না? আমার ভালোবাসা নোংরা ছিল না ইনশিতা। এমন ভাবে বলো না। প্লিজ ইনশিতা, একটু বসো। ছেড়ে যেও না, দোহাই তোমার…”

ইনশিতার ঠোঁটে একটু হাসি ফুটে উঠল। তাচ্ছিল্যের হাসি। এমনভাবেই সে একদিন জিহাদের পায়ে পড়ে দোহাই দিয়ে বলেছিল ছেড়ে দিতে। আজ সেই জিহাদ দোহাই দিচ্ছে ছেড়ে না যাওয়ার? অদ্ভুত!

ইনশিতা দ্রুত পায়ে চলে আসলো। তার কলেজে যেতে হবে এখন। জেহেরকে তখন ফোন করে জানাতেও ভুলে গিয়েছিল। ফোন বের করে জেহেরকে ফোন দিয়ে বলে সে একটু আগেই কলেজে পৌঁছেছে। চিন্তা না করতে। ওপাশ থেকে জেহেরের কোনো আওয়াজ না পেয়ে ইনশিতা কেটে দেয়। ট্যাক্সি নিয়ে চলে কলেজের পথে। বিষাদে ছেয়ে আছে তার মনটা। নয়নিকার কাজে সে একটুও সন্তুষ্ট নয়। তবুও দোয়া করে যাচ্ছে মৃত নয়নিকার জন্য। যতই হোক, সে তো নয়নিকাকে বেস্ট ফ্রেন্ড ভেবেছিল।

জিহাদ ইনশিতার গমন পথে অসহায় দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে ছিল। তার কিছুই করার নেই। ভালোবাসা সে হারিয়েছে। সারা জীবনের জন্য। এখন আর চোখের জল ঢাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তাদের কী দোষ? আপন মনে গড়িয়ে পড়ুক তারা। কোনো বাঁধা নেই।

.
ইনশিতা ট্যাক্সি থেকে নেমে কলেজের গেটের কাছে আসতেই থমকে গেল। গেটের সামনে জেহেরের গাড়ি দাঁড় করানো। আর তার সামনে জেহের ঠেস দিয়ে দু’হাত বুকের সাথে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ইনশিতার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে তো জেহেরকে মিথ্যা বলেছিল। এখন যদি জেহের জিজ্ঞেস করে তাহলে কী উত্তর দিবে?

ইনশিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জেহের এগিয়ে আসে। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সে কিছুই বলল না। উল্টো ইনশিতার কপালে লম্বা চুমু দিয়ে বলল,

-“মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করবে কেমন? আমি আসবো নিতে।”

ইনশিতা অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ইনশিতা খেয়াল করল জেহেরের শরীর মৃদু কাঁপছে। তার চোখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে যেন। এই আগুন ক্রোধের। যেন সে নিজেকে ঠান্ডা রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জেহের চলে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। আর ইনশিতা থম মেরে রইল।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here