#প্রহেলিকা
#পর্ব_৩১ [এক্সট্রা]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
-“জেহের আমার নিজের সন্তান নয়।”
জেসমিন চৌধুরীর কথাটা শুনে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে উঠল ইনশিতা। মুখ হা হয়ে গেল বিস্ময়ে। কথাটা বারবার তার মস্তিষ্কে বাজতে লাগল। পিনপতন নীরবতা পুরো চারপাশ জুড়ে। ততক্ষণে আফজাল এবং রাফিদও পাশে এসে বসেছে। রাফিদ নিজেও নির্বাক এই কথাটি শুনে। জেসমিন চৌধুরী বলেন,
-“শুধু জেহের না, জিহাদও আমার সন্তান নয়। আমি তাদের সৎ মা। তাদের মধ্যে জেহের মানসিক রোগে আক্রান্ত। ছোট থেকেই মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল ওর। তবে কারণটাও ছিল বেশ বড়সড়।”
কথাটি বলতে গিয়ে জেসমিন চৌধুরীর কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। আফজাল কথার মাঝে থামালেন জেসমিন চৌধুরীকে।
-“আমি বলছি। পুরো ঘটনাটাই প্রথম থেকে শুরু করছি।”
একটু থেমে আফজাল বলতে লাগেন,
-“জেহের আর জিহাদের মা, মানে মিতালি আমার প্রথম স্ত্রী ছিল। আমাদের দুজনেরই লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। তখন মিতালির বয়স নিতান্তই কম ছিল। বিয়ের দুই বছর পর জেহের আর জিহাদ দুজনেই একসাথে পৃথিবীতে আসে। আমার জীবনে বোধহয় এরচেয়ে বেশি খুশির দিন আর কোনোটাই ছিল না। দুজনেই ছিল আমার চোখের মণি। মিতালি একজন লেকচারার ছিল। জেহের ছিল বেশ মা ভক্ত। আমার থেকেও সে মিতালিকে বেশি ভালোবাসতো। এমনকি খেলাধুলার সাথীও ছিল মিতালি। মিতালি যখন কলেজ যেত তখন বেশিরভাগ জেহেরকেই নিয়ে যেত। জিহাদ যেতে চাইত না। সে বাহিরে সকলের সাথেই খেলত। জেহের আর জিহাদের যখন নয় বছর তখনই মিতালি পাল্টে যেতে শুরু করল। পরিবর্তন আসতে লাগল মিতালির মধ্যে। সে বাচ্চাদেরকে সময় দিলেও আমার সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। ঝগড়া হতো প্রতিনিয়ত। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে আমি মিতালির সাথে ঝগড়া খুব কমই করতাম। কিন্তু মিতালি যেন সবসময় সুযোগ খুঁজত আমার সাথে ঝগড়া করার। জেসমিন ছিল মিতালির বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তাকে ব্যাপারটা জানাই। জেসমিন আমাকে সাহায্য করবে বলে আশ্বস্ত করে। আর আমাদের বাড়ি প্রতিদিন আসতো বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য। কারণ এই বয়সে বাচ্চাদের দেখার জন্য কাউকে না কাউকে লাগতোই। আমি ব্যবসার জন্য সময় দিতে পারতাম না।
জেহের যখন মিতালির সাথে কলেজ যেতে চাইত তখন মিতালি সাথে নিতে চাইত না। কিন্তু জেহের এক প্রকার জোর করেই যেত। কারণ সে জেসমিনকে অকারণেই অপছন্দ করত। জেসমিনের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। আর জিহাদ মিতালিকে কাছে না পেয়ে জেসমিনের সাথেই থাকত। ছোট বাচ্চাদের মন তো! যার কাছে ভালো লাগবে তার কাছেই চলে যাবে। জিহাদও তাই। জেসমিনের আমাদের বাসায় নিয়মিত আসা যাওয়াটা মিতালি মেনে নিতে পারেনি। তার সন্তান অন্যের অধীনে বড় হবে এটা সে কোনোভাবেই মানতে পারত না। একদিন ঝগড়া করে সে এটা নিয়ে। জেসমিনের সামনেই। সে জেসমিনের নামে অনেক বাজে বাজে কথা উঠায় আর এটাও বলে দেয় যে, আমার আর জেসমিনের মাঝে সম্পর্ক আছে। সেজন্যই নাকি মিতালি আর আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়। অথচ এমন কিছুই হয়নি, জেসমিনের সাথে ছেলেদের কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথাই বলতাম না আমি। জেহের আর জিহাদকেও বুঝ দিত জেসমিন খারাপ, জেসমিন আন্টি নাকি তাদেরকে তার মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। জিহাদ প্রথমেই জেসমিনের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই সে প্রথমে মানলেও পরবর্তীতে ভুলে যায় মায়ের কথা। আর জেহের তো মায়ের সব কথাকেই চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিত। আর তারপর থেকে জেহের জেসমিনকে দুচোখে দেখতেই পারত না। খুব ঘৃণা করত।
একদিন খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারি মিতালির সাথে ঐ কলেজের আরেকজন টিচারের সাথেই সম্পর্ক চলছে। আর গভীরেও গিয়েছে সেটা। আমি মিতালির সাথে এই ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবেই বোঝাপড়া করে নিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি চাইছিলাম না, সন্তানদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক। আমি একদিন সেটা ও’কে বলেওছিলাম। সে নিজেই সেদিন উঁচু গলায় কথা বলে। যার ফলস্বরূপ বাচ্চারাও এসে পড়ে। বাচ্চাদের সামনে সে নিজে বলে আমার নাকি সম্পর্ক চলছে জেসমিনের সাথে। তখন জেহের আর জিহাদও কিন্তু কিছুটা বুঝদার। এসব সম্পর্ক কিছুটা হলেও তারা বুঝে। আমি থামাতে চেয়েছিলাম মিতালিকে, থামেনি। আমার এত রাগ হয়েছিল যে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে চড় মেরে দিই। সেদিন রাতেই মিতালি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জিহাদ আর জেহেরকে নিতে চাইলে জিহাদ কান্নাকাটি করে সে কখনোই যাবে না, আর এমনিতেও জিহাদ মিতালির আদর খুব কম পেয়েছে। তাই জেহেরকে সাথে নিয়েই সেদিন চলে যায় মিতালি। আমি পরে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চেয়ে আটকাতে চেয়েছিলাম, পারিনি।”
আফজাল চৌধুরী হাঁপাতে থাকেন। রাফিদ পানির বোতল এগিয়ে দেয়। ঢকঢক করে পানি পান করেন তিনি। চোখের চশমা খুলে চোখ মুছে আবারও পরে নেন। ইনশিতার চোখে পানি। জেসমিন চৌধুরী বিমূঢ় চেয়ে থাকেন রাস্তার দিকে। যেন প্যারালাইজড রোগী তিনি। আফজাল চৌধুরী লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলেন,
-“সেদিন সন্ধ্যায়ই আমার মোবাইলে আননোন নাম্বারে কল আসলে শুনি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে একটা ট্রাকের সাথে। আর গাড়িতে একটা বাচ্চা আর মহিলাকে পাওয়া যায়। আমি তখনই হাসপাতালে ছুটে যাই। জেসমিন সেদিন শহরে ছিল না। মিতালি স্পট ডেড। জেহের আহত হয়েছিল। তবে ব্রেইনে মারাত্মক ইফেক্ট ফেলে এই অ্যাক্সিডেন্ট। সে মেনে নিতে পারেনি মায়ের মৃত্যু। বাসায় আনার পর সে অনেক চিৎকার করেছিল মায়ের কাছে যাবে বলে। পাগলের মতো ব্যবহার করত। জিহাদকে ব্যাট দিয়ে মেরেছিল একদিন। তারপর জিহাদকে আলাদা রুমে শিফট করলাম।
এভাবে এক বছর কেটে যায়। জেহেরের আচরণ ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল। কোনো পরিবর্তন হচ্ছিল না, ডাক্তার দেখাতে যেয়েও পারিনি জেহেরের কারণে। পরিচারিকার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল একবার। ঘর থেকে বেরিয়ে যেত ফাঁক পেলেই। এমন আচরণের জন্য রুমে বন্দী করে রাখলাম। আমি কী করতাম? বাচ্চাদের কীভাবে সামলাতে হয় জানি না। মনে হয়েছিল রুমে বন্দী থাকলেই ও এসব বন্ধ করবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। রুমের মধ্যেই একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ রুমে ভাঙচুর অবস্থা। রক্ত এদিক সেদিক। জেহেরকে দেখলাম সোফার সামনে অজ্ঞান অবস্থায়। ড্রেসিং করিয়ে রুম পরিষ্কার করিয়ে দিলাম। ডাক্তার ডাকলাম না ইচ্ছা করেই। রুমের দরজা বন্ধ করলাম না আর। তার পরদিন সকালেই জেহেরকে রুমে পাওয়া যায় না। পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। বাহিরে বেরিয়ে আসলে দেখি আমার পালিত কুকুরকে সে ইট হাতে মেরে ফেলেছে। আমার রাগ হলো খুব। এমনিতেও মিতালিকে হারানোর শোক আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। খুব ভালোবাসতাম ও’কে। তার উপর জেহেরের পাগলামো। তাই রাগ কন্ট্রোল করতে পারলাম না। জেহেরকে সেদিন খুব মারলাম। রুমে নিয়ে জানালার সাথে শিকল পরিয়ে দরজা আটকে রাখলাম। পুরো দিনে আমি ওর কথাই ভুলে গিয়েছিলাম এক প্রকার।
রাতের বেলা জেসমিন আসলো। ও এসে সবার আগে জেহেরের খোঁজ নিল। আমার তখনই মনে পড়ল জেহেরের কথা। জেসমিনকে বললে সে খুব রেগে যায়। দুজনে যখন দরজা খুলে দেখি তখন জেহের কেমন ঝিমাচ্ছিল। সকাল থেকে খায়নি, আমার মনেই ছিল না। জেসমিন গিয়ে ও’কে মুক্ত করে নিজ হাতে শরীর মুছিয়ে খাইয়ে দেয়। শরীরে ওর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। জ্বরের ঘোরে জেহের ‘মা মা’ বলে খুব কেঁদেছিল। আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করা শুরু করল। সেদিন পুরো রাত জেসমিন ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।
জেহেরের জ্বর থাকাকালীন পুরোটা সময় জেসমিন জেহেরের খেয়াল রেখেছে। তবে জেসমিনের এখানে বারবার আসা যাওয়াটাকে প্রতিবেশীরা খুব খারাপ ভাবে নিয়েছিল। জেসমিন লজ্জায় আসা বাদ দিলো। কিন্তু না এসেও থাকতে পারত না। তখন বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য বাধ্য হয়েই জেসমিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। জেসমিন রাজি হয়েছিল একমাত্র জেহের আর জিহাদের জন্যই। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়। তখন জেহের সুস্থ। আমি বলেছিলাম জেসমিনকে মা বলে ডাকতে, জিহাদ ডাকলেও জেহের ডাকেনি। সে তারপর থেকে প্রচুর ঘৃনা করতো আমাদের। তার ধারণা সেদিন আমি মিতালিকে চড় মেরেছিলাম নাকি জেসমিনের কারণে। আমি নাকি জেসমিনকেই বিয়ে করার জন্য মিতালিকে মেরে ফেলি। আর মিতালি আগেও জেসমিনের ব্যাপারে বানোয়াট কথা বলেছিল বিধায় জেহের আরও বেশি ঘৃণা করত জেসমিনকে। মিতালির মৃত্যুর জন্য আমাদের দায়ী করে জেহের। জেসমিন তাকে খাওয়াতে চাইলে সে খাবার ফেলে দিত। আমার রাগ হলেও আমি কিছু করতে পারতাম না, কারণ জেসমিন রাগ করতে বারণ করেছিল আমায়। আমি যদি জেহেরকে মিতালির মৃত্যুর দিন থেকেই বাবার দায়িত্ব পালন করতাম তাহলে আর এসব দিন দেখতে হতো না, ও’র গায়ে হাত তোলা আমার ঠিক হয়নি।
যত বড় হতে লাগল ততই জেহের এগ্রেসিভ হতে লাগল। এর মধ্যে জেবা আসলো। তাও জেহের জেবাকেও দেখতে এলো না। নিজের সব কাজ নিজেই করে নিত। জেসমিন কিংবা আমার সাহায্যও নিত না। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। আমাদের এড়িয়ে চলত। পড়াশোনা নিজ দায়িত্বেই করে, ঘরে টিচার রাখলে জিহাদের আর জেহেরের জন্য আলাদা রাখতে হতো। জেহেরের রাগ হলে তার মাথা ঠিক থাকত না, পছন্দ মতো কিছু না হলে খুব রেগে যেত। আর একবার যেটা তার প্রিয় হয়ে ওঠে সেটা কখনোই হাতছাড়া করতে চাইত না, কাউকে দেখাতেও পর্যন্ত চাইত না, ভাবত কাউকে দেখালেই তারা ছিনিয়ে নিবে। জেহেরের এতটাই রাগ যে আমার নিজেরই ভয় করত জেহেরের সামনে যেতে।”
এবার জেসমিন চৌধুরী মুখ খুলেন,
-“আমি জেহেরকে নিজের ছেলে হিসেবে চাইতাম খুব, আমি কখনোই সৎ মায়ের মতো আচরণ করিনি, তাদেরকে আপন মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছি। তাও জেহের আমাকে এড়িয়ে চলত। জেবা আর জিহাদের সাথে আমার সম্পর্ক আর বাকি পাঁচটা মা-সন্তানের মতোই। কিন্তু জেহের আমাকে কখনোই মা হিসেবে দেখেনি। ওর মুখ থেকে মা ডাক শোনার জন্য আমি মরিয়া হয়ে থাকতাম। জিহাদ আর জেবার কাছে আমি আদর্শ মা হয়েও যেন আমার কমতি ছিল। জেহেরকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে চাইতাম। জেহেরের এড়িয়ে যাওয়াটা আমার মনে খুব কষ্ট দিতো, তাও আমি ওর মুখ থেকে মা ডাক শোনার জন্য কত কিছুই না করলাম! পছন্দের খাবার রান্না করতাম, ওর পছন্দের জিনিস কিনে দিতাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ও নিজের রুমেই আলাদা খেতো, এমন মনে হয় যেন সে একা একাই থাকে, তার আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে খেয়াল রাখে না। আমাকে দেখলে ও রেগে যেত খুব। ওর অস্বাভাবিক আচরণ কমেনি। এসবের জন্য একবার সাইকোলোজিস্ট দেখাতে চেয়েছিলাম। একবার সফল হয়েছি দেখাতে, মেডিসিন সাজেস্ট করেছিলেন। সেগুলো নিয়মিত দেওয়া হয় জেহেরকে তার অজান্তে, তাও যে কেন ছেলেটা আমার সুস্থ হয়নি! সবসময় ভাবে আমরা সবাই তার ক্ষতি করে ফেলব। কাউকেই সে বিশ্বাস করেনি, তার মনে হয় দুনিয়ার সকল মানুষ মিথ্যে মুখোশ পরে ঘুরছে। সকলকেই বিশ্বাসঘাতক মনে হয় তার। এত বছর হয়ে গেল, হাল ছাড়িনি তাও। আমার বিশ্বাস একদিন জেহেরের ভুল ভাঙবে, সে একদিন আমাকে মা বলে জড়িয়ে ধরবে। তখন আমি শান্তি পাবো, আর নয়তো মরে গিয়েও শান্তি পাবো না।”
জেসমিন চৌধুরী শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। ইনশিতা বুঝল না সে কীভাবে এখন শান্তনা দিবে। তার কাছে শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই। তার নিজের কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জেহেরের কষ্ট সে বুঝতে পারছে না ঠিকই কিন্তু কিছুটা অনুভব করতে পারছে। জেসমিন চৌধুরী যে কীভাবে নিজেকে সামলিয়েছেন! ধৈর্য্য আছে বলতে হবে!
আর রাফিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকে হাত মুড়ে বসে আছে। তার নিজেরও খারাপ লাগছে জেহেরের কথা শুনে। ছেলেটা এত কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে! নিজেকে সবসময় সকলের থেকে আলাদা করে গুটিয়ে রেখেছে! এত কষ্ট বুকে চেপে বেঁচে আছে কী করে?
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল পুরো পরিবেশ জুড়ে। মনে হয় যেন পৃথিবীর সব জায়গাতেই এমন গম্ভীর নিরবতা ছেপে আছে। নিরবতার জাল ছেদ করলেন আফজাল চৌধুরী।
আফজাল বলেন,
-“ আমাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করে কারণ তার মনে হয় আমি যদি মিতলিকে কলেজ যেতে না দিতাম তাহলে মিতালি সম্পর্কে জড়াত না। আর না সে মারা যেত।”
ইনশিতা ভারী গলায় বলল,
-“এই জন্যই কী জেহের আমাকে কলেজ পড়তে দিত না? ওর মনে হতো আমিও এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যাব? আর কারো সাথে মিশতে দিতো না, ভাবতো আমাকে কেউ নিয়ে যাবে?”
আফজাল চৌধুরী উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। ইনশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেহের এতটা ইনসিকিউরড তাকে নিয়ে! ইনশিতা কখনোই তো এমনটা করবে না। তাও জেহের কেন এতটা ভয় পায়? পরক্ষণেই মনে হল, তার মায়ের ঘটনাটা, তার মায়ের সাথে যা ঘটেছে সেটা যে তার সাথে ঘটবে না তার তো আর নিশ্চয়তা নেই! আর ইনশিতাকে জেহেরের কারো মিশতে না দেওয়ার কী এইটাই কারণ? যাতে তাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে? যাতে তার ভালোবাসার রোজ সবসময় তার সাথে থাকে? জেহেরের এই ভাবনাটাও স্বাভাবিক।
তখনই কারো পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং শব্দটা খুবই দৃঢ় হতে লাগল।
-“আফজাল!”
কারো ডাকে আফজাল চৌধুরী মাথা তুলে তাকালেন। ব্যক্তিটিকে দেখে কষ্টের মাঝেও হাসি ফুটে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
-“মানিক! কেমন আছিস বন্ধু?”
-“আমি ভালো। তোর খবর কী?”
-“এত তাড়াতাড়ি? তোর না কাল আসার কথা ছিল?”
-“আজকের ডিউটি ক্যান্সেল করেছি।”
কুশল সেরে মানিক জানতে চাইলেন জেহেরের কথা। ইনশিতা তাকাল জেহেরের কেবিনের দিকে। স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে নিস্তেজ দেহের অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জেহেরের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।
.
.
জেহেরের জ্ঞান ফিরল পুরো একদিন পর, সকালে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে নিজেকে অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করল। উঠতে চাইল। পারল না, পুরো শরীরে যেন পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে। তবুও উঠল। তার ভালো লাগছে না এখানে, রোজকে দেখতে হবে। রোজ কোথায়? তার মনে আছে, রোজের সাথে ফোনে কথা বলার সময়ই তার মাথায় ভারী আঘাত পায়। পিছন ফিরে জিহাদকে দেখলেও পর মুহুর্তে চোখে অন্ধকার দেখে।
বহু কষ্টে উঠে বসে সে। মুখের অক্সিজেন মাস্ক টেনে খুলে ফেলে। মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কেমন খাপছাড়া লাগল নিজেকে। তাকে রোজের কাছে যেতেই হবে। এসব যন্ত্রণা তাকে রোজের কাছে যেতে আটকাতে পারবে না। ফ্লোরে পা রাখতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। পড়ে যেতে নিলেই ইনশিতা দৌড়ে এসে ধরে ফেলল। সে দূরের সোফাতেই বসে ঝিমুচ্ছিল। আওয়াজ শুনে দেখে জেহের উঠে পড়েছে। উতলা হয়ে জেহেরকে ধরে বসাতে বসাতে বলল,
-“আপনি উঠেছেন কেন? বসুন।”
জেহের ইনশিতার হাত শক্ত করে ধরল। ইনশিতা হাত ছাড়াতে চাইল, কিন্তু জেহেরের শক্ত হাত থেকে কিছুতেই ছুটতে পারল না।
-“ছাড়ুন এখন, আমি মানিক আঙ্কেলকে ডেকে আনছি।”
ছাড়ল না জেহের। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল ইনশিতার দিকে। এমন ভাবে তাকাল যেন সে কত বছর পর দেখছে রোজকে। জেহেরের শুষ্ক ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। চোখে কাতরতা। তারপর আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইনশিতাকে। ইনশিতা হতভম্ব। তাও কিছু বলল না, আর না ছাড়াতে চাইল। জেহেরের পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণ। কোমল কন্ঠে বলল,
-“জেহের, কিছু লাগবে আপনার?”
-“তোমাকে।”
.
.
চলবে…