#প্রহেলিকা
#পর্ব_৩১
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
হাসপাতালের করিডোরে ইনশিতা পায়চারি করছে। ইতিমধ্যে ভোর হয়ে গেছে। পুরো রাতটা সে নির্ঘুম কাটিয়েছে। জেহেরের চিন্তায় তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় বোধহয় শীতটা আরো ভালো করে জেঁকে বসেছে। তার মা কেবিনের ভেতরে বাবার পাশে বসে আছে। বাবার অবস্থা এখন মোটামোটি। বুকের মধ্যে জোরে চাপ পড়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে শুধু। একটু বাদেই ইনশিতার পেছনে এসে দাঁড়াল রাফিদ। গলা খাঁকারি দিলে ইনশিতা পেছনে তাকায়। তার চোখে টলমল করছে পানি। রাফিদ এই মুহুর্তে কী বলবে বুঝতে পারল না। তবুও কিছু তো একটা বলতে হবে।
-“তুমি বাসায় চলো ইতু। এসেই তো এখানে এসে পড়লে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আর চেঞ্জ করেও আসো।”
ইনশিতা বলতে চাইল সে কোথাও যাবে না। কিন্তু এই পোশাকেও থাকতে পারছে না। তাই মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ইনশিতা চলে যেতে চাইলে রাফিদ আটকায়। ইনশিতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে রাফিদ আমতা আমতা করে বলে,
-“আ-আব, তুমি কিছু মনে না করলে আমিও চলি তোমার সাথে?”
ইনশিতা তাও কিছু বলল না। নিরবে সম্মতি দিলো। সম্মতি পেয়ে রাফিদ খুশিমনে ইনশিতাকে নিয়ে বাড়ির পথে চলল।
ঘরে ঢুকে ইনশিতা ড্রয়িংরুমের আলো না জ্বালিয়েই তার রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। একটা অফ হোয়াইট কালারের থ্রি পিস নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল। চোখে মুখে পানি দিয়ে ছোট আয়নাটার দিকে তাকাল। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মুখটা দেখতেও কেমন বিদঘুটে লাগছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলো সে। জেহেরকে তারা ধরে নিয়ে কি করেছে? মারেনি তো? পুলিশের মাইর তো সেই লেভেলের। নাহ, সে এখন জেহেরের চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবে না। একজন খুনির চিন্তা করবে কেন সে?
ফ্রেশ হয়ে গিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল ইনশিতা। মায়ের জন্য খাবার বানিয়ে নিতে হবে। বাবার চিন্তায় মা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয়নি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রাফিদ হাতে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত মুখে তা মনোযোগ সহকারে দেখছে। টিফিন বাক্স হাতে নিয়েই সে রাফিদের পাশে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,
-“কী হয়েছে ভাইয়া? কী এমন দেখছো?”
রাফিদ চমকে উঠল ইনশিতার হঠাৎ বলা কথায়। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“এই দেখো না ইতু, সোফার কাছে এই ঘড়িটা পেলাম। বেশ দামী ঘড়িই মনে হচ্ছে। এমন ঘড়ি তো তোমার বাবা পরে না।”
রাফিদ হাত মেলে ঘড়িটা দেখাল। ইনশিতা নিজের হাতে নিয়ে নিলো ঘড়িটা। ঘড়িটা দেখেই তার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো। এমন ঘড়ি সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। তার মাঝেই রাফিদ বলে উঠল,
-“জেহেরের হবে হয়তো। জেহের যখন তোমার বাবাকে মেরেছিল তখন বোধহয় খুলে পড়ে গেছে।”
রাফিদের কথায় ইনশিতা না সূচক মাথা নাড়াল।
-“জেহেরের ঘড়ি এমন না। তার ঘড়ি সবসময় কালো কালারের হয়…”
ইনশিতার যেন মুহূর্তেই কিছু মনে পড়ল। সে চোখ বড় বড় করে তাকাল রাফিদের দিকে।
-“কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
ইনশিতা থেমে থেমে বলল,
-“এই ঘড়িটা তো…”
-“হ্যাঁ, ঘড়িটা তো কী?”
ইনশিতা হার্টবিট ক্রমশ বাড়তে লাগল। সে জানতোই বড় একটা ভুল হচ্ছে। আর সেই ভুলটা এখন তার চোখের সামনে। এই ঘড়িটা সেদিন জিহাদের হাতে দেখছিল। তার মানে জিহাদ তার বাবাকে মেরে জেহেরকে ফাঁসিয়ে গিয়েছে? রাফিদ ইনশিতার কাঁধে ধাক্কা দিলো।
-“এমন থম মেরে আছো কেন?”
-“ভাইয়া, এটা জিহাদের ঘড়ি।”
-“কীহ!”
-“হ্যাঁ ভাইয়া, জিহাদের হাতে সেদিন দেখেছিলাম এটা। আমার স্পষ্ট মনে আছে। তার মানে এসব জিহাদের প্ল্যান ছিল ভাইয়া। ও জেহেরকে ফাঁসানোর জন্য এ-এমন করেছে।”
ইনশিতার চোখে কান্নারা জমে এলো। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল তার। রাফিদ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।
-“তাহলে তোমার মা যে বলেছিল জেহের ছিল। আর চোখ তো নীল ছিল। এমনকি পোশাকটাও নাকি তোমার বলা কথা মতো ছিল।”
-“লেন্স বলেও একটা জিনিস আছে ভাইয়া। আর জিহাদ হয়তো জেহেরের ড্রেসকোড ফলো করে একই ড্রেস পরেছে যাতে সবাই মনে করে ওটা জেহের।”
একটু থেমে ইনশিতা বলল,
-“আমি এক্ষুনি জেহেরের কাছে যাবো ভাইয়া। আমাকে নিয়ে চলো জেহেরের কাছে।”
রাফিদের বিস্ময় যেন কাটছেই না। জিহাদ যে এতবড় খেলোয়ার হবে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল।
-“কী হলো ভাইয়া? চলো না।”
বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল সে,
-“জেহের কোথায় আছে সেটা এখন জানবে কীভাবে? পুলিশ স্টেশনটা চিনো?”
-“না, আমি তো কিছুই জানি না।”
-“তাহলে?”
ইনশিতা মাথায় হাত দিলো। এই মুহূর্তটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মুহূর্ত বলে মনে হলো তার কাছে। টেনশনে তার মাথা ধরে গেছে। পরক্ষণেই বলল,
-“জেহেরকে ফোন দেই?”
-“পুলিশ যদি ফোন নিয়ে নেয়?”
-“যদি না নিয়ে থাকে? একবার তো ফোন দিয়েই দেখি।”
-“আচ্ছা।”
-“তোমার ফোনটা দাও। আমারটা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।”
রাফিদ ফোন বের করতে দেরি ইনশিতার টান দিতে দেরি নেই। তিনবার ফোন করার পরেও নো রেসপন্স। রাগে মোবাইলটা আছড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করল। ডুকরে কেঁদে উঠল ইনশিতা। একটু বাদেই জেহেরের নাম্বার থেকে কল আসলো। চোখ মুছে ফোনটা রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে জেহেরের জড়ানো কন্ঠ শুনতে পেল,
-“ডোন্ট ক্রাই রোজ।”
ইনশিতা অবাক হলো। জেহের কীভাবে জানলো যে সে কাঁদছে? আর ফোনটা যে সে-ই তুলবে সেটাই বা কীভাবে জানলো? বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। ভেজা গলায় বলল,
-“আপনি…”
-“কী করে জানলাম তাই তো? ওহ রোজ, তোমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আমার জানা। চাইল্ডিশ কথা বলো না তো।”
-“আপনি কোথায় এখন?”
-“কোথায় আবার! বাসায়। কেন? জেলে থাকার কথা ছিল নাকি? যদি সেটা মনে করে থাকো তাহলে শুনে রাখো, এসব পুলিশ-জেল আমার কিছুই করতে পারবে না। টাকার কাছে সবই তুচ্ছ। তুমি তাড়াতাড়ি এসো তো।”
-“আপনি সত্যি এখন বাসায়?”
জেহের সেই কথার জবাব না দিয়ে কেমন অন্যরকম গলায় বলল,
-“আই ওয়ানা সি ইউ রাইট নাও। চলে এসো প্লিজ। আ-আমার ভালো লাগছে না তোমাকে ছাড়া।”
জেহেরের কন্ঠটা কেমন জড়িয়ে আসছে। যেন যুদ্ধ করে সে এখন ক্লান্ত। ইনশিতা আর কিছু বলবে সেই মুহূর্তে ওপাশ থেকে কিছু একটার বিকট আওয়াজ শোনা গেল।
-“হ্যালো, জেহের। হ্যালো!”
বেশ কিছুক্ষণ হ্যালো বলার পরে হুট করেই ফোন কেটে গেল। ইনশিতা ফোন সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে নিলো। রাফিদ পেছন থেকে আসতে আসতে বলল,
-“কোথায় যাচ্ছ এখন?”
ইনশিতা পেছন না ফিরেই উত্তর দিলো,
-“হাসপাতালে, আগে এগুলো হাসপাতালে দিয়ে আসি। মা এখনো কিচ্ছু খায়নি। তারপর জেহেরের কাছে যেতে হবে।”
রাফিদ ইনশিতার হাত থেকে টিফিন বাক্স নিলো। চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে।
-“তুমি এত প্যানিক হচ্ছো কেন? শান্ত হও। তুমি যাও জেহেরের কাছে, আমি খাবার দিয়েই আসছি। মা আছে ওখানে।”
ইনশিতা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাল রাফিদের দিকে। রাফিদ মুচকি হাসল শুধু। দেরি না করে ইনশিতা চলল বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে।
আকাশ মেঘলা। পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘ ছড়িয়ে আছে আকাশের মধ্যিখানে। তবুও চারপাশটায় কেমন গুমোট ভাব। ইনশিতার বুকের ভেতরটায় দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। অপরাধবোধে ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার। এসব কিছুই জেহের করেনি। তাহলে সে কেন জেহেরকে দোষী করেছিল? সব ছিল জিহাদের প্ল্যান। ছিঃ! গতকাল জেহেরকে সে কতই না খারাপ খারাপ কথা বলেছে। অথচ জেহের তার বিপরীতে কিছু না বলে শুধু তাকে বোঝাতে চেয়েছিল। সে যদি একবার জেহেরের কথা মন দিয়ে শুনতো!
দশটা বাজে সে বাগানবাড়িতে পৌঁছাল। মনে তার প্রচন্ড ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমনিতে জঙ্গলের মধ্যে তার উপর কুয়াশার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত পুরো পরিবেশ। ঘরটা দেখতে যেন আগের দিনকার চেয়েও ভয়ানক লাগছে। যেন পুরো ঘরটার দেয়ালে আতঙ্কের ছাপ। মেইন দরজা খোলা। ভেতরটা প্রচুর অন্ধকার। ঢোক গিলে ক্ষীণ কন্ঠে সে জেহেরকে ডাকল। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আবার ডাকল। নাহ! কোনো সাড়া নেই। রুমের কোথাও নেই, ড্রয়িংরুম, ব্যালকনিতেও নেই। তার মানে কী জেহের এখনো জেলেই? খট করে কিছু একটার শব্দ এলো। থমকে দাঁড়ায় ইনশিতা। আওয়াজটা চিলেকোঠা থেকে আসছে। ঐ তো আবারও আসছে আওয়াজটা।
ইনশিতা পা টিপে টিপে সেদিকে গেল। রুমের দরজা ভেজানো। একটু ফাঁক করে যা দেখল তাতে তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল ভয়ে। অবাক বিস্ময়ে তার মস্তিষ্ক চলাচল বন্ধ করে দিলো। ধাম করে সে দরজাটা খুলে দৌড়ে ভেতরে গেল। জেহের পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। মুখ থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। জেহেরের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ডাকতে লাগল।
-“জেহের! এই জেহের? কী হলো আপনার? জেহের?”
জেহের চেতনাহীন। চোখ দুটোও খুলছে না। মৃদু শ্বাস উঠানামা করছে। ইনশিতার আত্মা শুকিয়ে আসলো। কীভাবে কী করবে সে এখন? পানি খুঁজতে আশেপাশে তাকাতেই তার চোখ কপালে। ডেস্কের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে সিগারেট ফুঁকছে জিহাদ। চোখদুটো টকটকে লাল। পরিহিত টিশার্ট বুকের দিক দিয়ে ছেঁড়া। একহাতে চেয়ারের ভাঙা শক্ত হাতল। অস্ফুটে ইনশিতার মুখ থেকে জিহাদের নাম বেরিয়ে আসলো। জিহাদ তাকাল ইনশিতার দিকে। সেই তাকানো দেখে ইনশিতার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তোতলিয়ে কিছু একটা বলল। স্পষ্ট শোনা গেল না। জিহাদ হাতলটা ফেলে ইনশিতার দিকে এগিয়ে আসলো। ইনশিতার বাহু শক্ত করে ধরে উঠিয়ে দিলো। ব্যথায় ইনশিতা চেঁচিয়ে উঠল। জিহাদ কর্ণপাত করল না। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে সব ধোঁয়া ইনশিতার মুখে ছুঁড়ে দিলো। কেশে উঠল ইনশিতা। হাত ছাড়াতে চাইল। পারল না।
আচমকা ইনশিতাকে চেপে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল সে। ইনশিতা তখন জেহেরকে ডাকতে ব্যস্ত। জিহাদ নিজের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে ইনশিতার গলার দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে জ্বলন্ত সিগারেট এগিয়ে নিতে লাগল ইনশিতার গলার তিল বরাবর। সিগারেটটা ইনশিতার গলা ছুঁই ছুঁই সেই ক্ষণেই জিহাদ আর্তনাদ করে মাথায় হাত চেপে বসে পড়ল। ইনশিতা বড় বড় চোখ নিয়ে দেখল রাফিদ সেই শক্ত হাতল ধরে আছে পেছনে।
জিহাদের মাথায় আরেকটা বারি দিবে তার আগেই জিহাদ রাফিদের পা উল্টে ধরলে সে পড়ে যায়। সেই সুযোগেই জিহাদ মাথায় হাত চেপে টলতে টলতে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ইনশিতা দৌড়ে যায় জেহেরের কাছে। বারবার ডাকতে থাকে। রাফিদ উঠে দাঁড়াল। ইনশিতাকে বলল,
-“এভাবে ডাকলে হবে না। জেহেরকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।”
ইনশিতা কাঁদছে।
.
.
মিসেস জেসমিন চৌধুরী উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে আসলো। এসে দেখল ইনশিতা চেয়ারে বসে কাঁদছে আর পাশে রাফিদ দাঁড়ানো। তিনি এসেই ইনশিতাকে বলল,
-“জেহের আমার জ-জেহের কোথায়?”
কান্নার দমকে ইনশিতার কথা দলা পাকিয়ে আসলো। সে কিছুই বলতে পারল না। তার হয়ে রাফিদ বলল,
-“ওটিতে নেওয়া হয়েছে।”
জেসমিন চৌধুরী ধপ করে বসে পড়ল ইনশিতার পাশের চেয়ারে। আফজাল চৌধুরী পাশে দাঁড়িয়ে তাকে শান্তনা দিতে লাগলেন।
-“মানিক আসছে। ওকে খবর দিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করো না তুমি। কালই মানিক আসবে।”
মানিক রহমান আফজাল চৌধুরীর বেস্ট ফ্রেন্ড। পেশায় ডক্টর। আর তাকে আফজালের পারিবারিক ডক্টরও বলা যেতে পারে। আপাতত তিনি দেশের বাহিরে আছেন। জেহের হসপিটালে আসছে শুনে তিনি আগেই মানিককে বলে দিয়েছেন। আর মানিক কালকেই আসছে বলে জানালো।
জেসমিন চৌধুরী বিমুঢ় চোখে তাকিয়ে থাকল ওটির দরজায়। কয়েক ঘন্টা পর ডক্টর বেরিয়ে আসলে ইনশিতা তড়িঘড়ি করে জানতে চায় জেহের কেমন আছে। ডক্টর জানায় জেহের বিপদমুক্ত। তবে মাথার এক সাইড জখম হয়েছে খুব মারাত্মকভাবে। তাকে দেখতে চাইলে ডক্টর মানা করে। কারণ তার জ্ঞান এখনো ফিরেনি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাগরিবের আজান পড়েছে। হসপিটালের ভ্যাপসা গন্ধে ইনশিতার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। মাথা ঘুরছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। একটু খোলা বাতাস দরকার তার। চেয়ার ধরে কোনরকমে উঠে ধীরে ধীরে হসপিটালের বড় ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়াল। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইল। অথচ পারল না। বুকটা ভার লাগল। যেন শতমণ পাথর চাপা দিয়ে আছে। হুট করে ইনশিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুখে হাত গুজে কাঁদতে লাগল। হাত কামড়ালো কিছুক্ষণ। তাও যেন কান্না থামছে না।
কাঁধে কারো হাত পড়তেই সে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে জেসমিন চৌধুরী বিষন্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জেসমিন চৌধুরী এখনো জানেন না তার ছোট ছেলে আর মেয়ের কর্মকাণ্ড। না জানানোই ভালো। একটা ধাক্কাই সামলে উঠতে পারছে না, বাকি গুলোতে না জানি কী অবস্থাই হয়! ইনশিতা চোখের পানি মুছে হাসি হাসি মুখে তাকাল। কিন্তু বেশিক্ষণ আর হাসিমুখ ধরে রাখতে পারল না। চোখ ভর্তি হয়ে আসলো নোনাজলে।
জেসমিন চৌধুরী ইনশিতার হাত ধরে চেয়ারে বসালো। তিনি তাকিয়ে আছেন ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তার পানে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে উঠল,
-“তোমাকে একবার বলেছিলাম না তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে?”
ইনশিতা কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়াল।
-“আজ বলছি সেটা। জানি না ঘটনাটা শোনার পর জেহেরের প্রতি তোমার মনোভাব কিরূপ হবে! তবে তোমাকে এটা বলা অনেক প্রয়োজন।”
ইনশিতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল জেসমিন চৌধুরীর দিকে। পরক্ষণেই চোখে মুখে অজস্র কৌতুহল জেগে উঠল। ঘটনাটা জানতে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো জেসমিন চৌধুরীর অভিমুখে।
.
.
চলবে…