#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৯
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

ড্রয়িংরুমের সামনের বড় বারান্দায় ছোট একটি টেবিলে ক্যান্ডেল সাজিয়ে রাখা। তার মাঝখানে কালো গোলাপের বুকে’টা নিজস্ব সৌন্দর্য ছড়িয়ে টেবিলটার শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। বারান্দার চারদিকেই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। তার মাঝখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা ছোট টেবিল। নিকষ কালো আঁধারে ডুবে থাকা বারান্দায় মোমবাতির হলদে আভা দিগ্বিদিক ছুটে চারপাশটাকে আলোকিত করে তুলেছে।

সাজানোর মতো আর কোনো সামগ্রী পায়নি বিধায় এগুলো দিয়েই কাজ চালালো ইনশিতা। ওভেনে কেক বেক করতে আরও সময় লাগবে, সেই সুযোগে ইনশিতা নিজেকে তৈরি করলো। আজ জেহেরকে তার ভালোবাসার কথা বলবেই। তাই জেহেরের পছন্দ মতো সেজে নিলো। ফিনফিনে পাতলা কাপড়ের সোনালী পাড়ের কালো শাড়ির সাথে ছোট্ট একজোড়া কানের দুল আর ম্যাচিং চুড়ি। শাল আজ পরবে না। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক লাগিয়ে নিলো। খোলা চুলগুলো পিঠে ছড়ানো। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। ঠোঁট থেকে হাসি যেন সরছেই না তার।

কেক ডেকোরেট করা হয়ে গেলে শুধু জেহেরের আসার অপেক্ষা। রেড ভেলভেট কেকের উপর খুব চমৎকারভাবে ‘আই লাভ ইউ’ লিখে ছুরিটাকে পাশে রেখে ড্রয়িং রুমে চলে আসে ইনশিতা। আজ আসলেই সাথে সাথে জেহেরকে নিজের ভালোবাসা কনফেস করে ফেলবে। নয়তো পরে যদি আর সুযোগ না পায়! বারবার ঘড়ির দিকে নজর ঘুরাচ্ছে সে। রাত আটটা বেজে দশ। জেহের সবসময় সন্ধ্যা নামার সাথেই চলে আসে। আজ যেন একটু বেশিই দেরি করে ফেলছে জেহের। সময় যেন ফুরোচ্ছেই না। তবুও এই অপেক্ষাটাও মধুর ঠেকছে তার কাছে। কারো জন্য অপেক্ষা করাটা যে এত মধুর হয়, সেটা আজ টের পেল ইনশিতা। ইশ! হঠাৎ এমন সারপ্রাইজ পেয়ে জেহের কী চমকানটাই না চমকাবে! কেমন হবে তার রিয়েকশন?

ইনশিতার ভাবনা বেশিদূর এগোলো না। তার ফোনটা বিপবিপ আওয়াজে বেজে ওঠে ভাবনার ব্যাঘাত ঘটায়। চমকে উঠে ইনশিতা। আজ আবার সে ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছে। কোনোরকমে শাড়ি সামলে দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। বারবার ফোনটাকে সাইলেন্ট করতে ভুলে যায় সে। এখন যদি জেহের বাসায় থাকতো? কী হতো? এত সুন্দর সময়ে না জানি তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাতো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে তার মা ফোন করেছে। ভ্রু জোড়ার মধ্যভাগ কুঞ্চিত হলো তার। এই সময়ে মা তো কখনোই কল করে না। তাহলে হঠাৎ এখন?

দ্রুত কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই তার মায়ের কান্নারত আওয়াজ শোনা গেল। থমকে গেল ইনশিতা। হঠাৎ মায়ের কান্না তার কানের পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম ব্যথার জন্ম দিচ্ছে। কোনো বিপদ হলো না তো? উত্তেজিত ইনশিতা কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মা যা বলল তা শুনে ইনশিতার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। পায়ের তলাটা শিরশির করে উঠল। হাত আলগা হয়ে ফোন পড়তে গিয়েও পড়ল না। চারিদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসলো। এই মুহূর্তে এমন ভয়ানক খবর শুনবে হয়তো আশা করেনি সে। ধরা কন্ঠে বলল,

-“এখন কোথায় আছে বাবা?”

ইনশিতার মায়ের ফোঁপানির আওয়াজ শোনা গেল,

-“হাসপাতালে। মা রে, তুই চলে আয়। ঐ জন্তুর সাথে সংসার করতে পারবি না তুই। তুই চলে আয় মা।”

ইনশিতা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করল,

-“মা, তুমি শিওর তো? তুমি কি ঠিক দেখেছিলে? দেখার কোনো ভুল নেই তো? হতে পারে ওটা জেহের না…”

কান্নারত অবস্থাতেই তিনি বললেন,

-“একদম সঠিক দেখেছি। কীভাবে তোর বাবাকে মারলো ঐ জানোয়ারটা! সেদিন তুই নাকি আমাদের কারণেই এসেছিস বলে কিসের বিপদে পড়েছিস। আর তার জন্য আমরা নাকি দায়ী। সেই জন্যই আজ বিকেলে জেহের এসে তোর বাবাকে মেরে গেল। আমার মাথায় ফুলদানী ছুঁড়ল। তোর বাবাকে লাথি ঘুষি কোনোটাই বাদ রাখেনি। মা’রে, আর একটু হলে বোধহয় তোর বাবার জানটাই উড়ে যেত। আমার চিৎকারে অনেক মানুষ এসে জমা হলে জেহের তোর বাবাকে ছেড়ে দেয়। আর শাসিয়ে চলে যায়। তোর বাবার অবস্থা খুব খারাপ। আমার কী হবে রে মা? কী হবে…”

ইনশিতা থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মাথা ফাকা হয়ে যেতে লাগল তার। চোখের অশ্রু গড়িয়ে চিবুক বেয়ে পড়ল। ইনশিতার মা থামলেন না। তিনি বলে চললেন,

-“তুই বলেছিস না ওটা জেহের না? আমিও ভাবছিলাম জেহের না, তবে ওর চোখ দেখেছিলাম, নীল চোখ। আর-আর, তুই বলেছিলি না, জেহের কালো স্যুট পরেছিল, ভেতরে সাদা শার্ট। তেমনটাই ছিল। মা, তোর বাবা ছাড়া আমি কী নিয়ে বাঁচবো রে মা? আমি মরে যাব ঐ মানুষটা ছাড়া। জেহেরের পা জড়িয়ে ধরেছিলাম পর্যন্ত, তাও জানোয়ারটা ছাড়েনি তোর বাবাকে। পশুর মতো মেরে গিয়েছে। তোর বাবার শরীরে কত রক্ত…”

ইনশিতার মা আর কিছু বলতে পারলেন না। ভেঙে পড়লেন কান্নায়। ইনশিতা কিছুই বলল না। তার মুখে কোনো শব্দ আসছিল না। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হলো তার। তার প্রিয় মানুষ তার বাবা। শত কষ্টেও যিনি তাকে আগলে রেখেছিলেন। সেই বাবা এখন হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। আর তার কারণ একমাত্র তার স্বামী জেহের! আজ জেহেরের জন্যই তার প্রিয় বাবা মৃত্যুর সাথে লড়ছে। নিজেকে দিশেহারা লাগল ইনশিতার। যেই মানুষটাকে আজ ভেবেছিল ভালোবাসার কথা বলবে সেই মানুষটাই কিনা তার জীবন থেকে আরেকজন ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল!

না না, এখন আর ভালোবাসার মানুষ না সে। সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি এখন ইনশিতার কাছে। ভেবেছিল জেহের ভালো হয়ে যাবে, তবে আজকের ঘটনার পর তা আর কোনোদিন হওয়ার নয়। মাথা চেপে ধরল ইনশিতা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। অদ্ভুতভাবে তার মুখ থেকে একটা টু শব্দও বের হচ্ছে না। জেহেরের প্রতি কিছুদিন আগের নুইয়ে পড়া রাগ আর ঘৃণা মাথায় দপদপ করে জ্বলে উঠল। ইচ্ছে করছে শেষ করে দিতে জেহেরকে। এমন একটা মানুষকে সে কী করে ভালোবাসতে পারল যে কিনা নিজের রাগ মেটাতে মানুষ মারতেও পিছপা হয় না?

হুট করে তার রুমের লাইট আলো ছড়ানো বন্ধ করে দিলো। ভয় পেয়ে গেল ইনশিতা। এভাবে লোডশেডিং হলো কেন হঠাৎ! সচরাচর এই বাড়িতে লোডশেডিং একদমই হয় না। তাহলে এই মুহুর্তে…আকস্মাৎ কিছু একটার শব্দ হলো। ইনশিতা ভাবল জেহের এসেছে। মোবাইলটা আর লুকালো না। চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে ফ্ল্যাশ অন করে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। আজ জেহেরের প্রতি সমুদ্র সমান ঘৃণা বইছে তার মনে। যতই হোক না কেন, জেহেরকে সে আর কোনোদিন মেনে নেবে না। কোনদিন না মানে কোনোদিনই না।

মেইন দরজা তো বন্ধই। জেহের তো আসলো না। তাহলে আওয়াজ হলো কোথায়? আবারও কিছু একটার আওয়াজ হলো, চকিতে তাকাল ড্রয়িংরুমের বারান্দার দিকে। হ্যাঁ, ওখান থেকেই আওয়াজ আসছে। ইনশিতার ভীতু মনে অজানা ভয়ের শিহরণ ঢেউ খেলে গেল। দুরুদুরু বুক নিয়ে ভীতু পায়ে এগিয়ে গেল ব্যালকনির দিকে। ফ্ল্যাশ অফ করল। মোমবাতির আলোতে ড্রয়িংরুম উজ্জ্বল। কাঁচের দরজা ঠেলে সাজানো টেবিলটার সামনে দাঁড়াতে পিলে চমকে উঠল সে। কালো গোলাপের সবগুলো পাপড়ি ছিঁড়ে টেবিলের ওপর ছিটানো। যেন কালো গোলাপ দিয়েই টেবিলটা কেউ সাজিয়েছে। তার মাঝেই পাপড়ি দিয়ে একটা শব্দ লেখা ‘লাভ’। ঢোক গিললো ইনশিতা। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েকটা মোমবাতি নেভানো। যার ফলে আলোটাও হ্রাস পাচ্ছে। হৃৎপিন্ডের স্পন্দন বেড়েই চলছে ইনশিতার। এই শীতেও বাহির দমকা বাতাস বইছে। তাতেও ইনশিতার শরীরে কাঁপন ধরল না। বাতাসের তোড়ে মোমবাতি সবগুলো নিভু নিভু প্রায়।

আচমকাই তার নজর চেয়ারের পাশে চলে গেল যা দেখে ইনশিতার হাত পা মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে লাগল। আরেকধাপ চমকানোর পালা বোধহয় এসে গিয়েছে তার। কেক কাটার জন্য যে ধারালো ছুরিটা সে নিয়েছিল তা নিচে পড়া। ছুরিতে টকটকে লাল রঙের তরল লেগে আছে। আর চারপাশেও রক্তের ছিটা ছড়িয়ে। ইনশিতার মাথা ঘুরতে লাগল। রক্তের দাগ অনুসরণ করে একটু এগিয়ে সামনে যেতেই তার পায়ের সামনে গড়িয়ে কিছু একটা আসলো। বিস্মিত আর ভয়াতুর দৃষ্টিতে দেখল মারবেলের মতো দুটো চোখ তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইনশিতার হার্টবিট দ্রুতগতিতে চলছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। হাত পা কাঁপছে তার ভয়ে।

সেই মারবেলের মতো কদর্য দৃশ্যটি অনুসরণ করে বারান্দার কোণার চিমনির পাশে তাকাল। চিমনির পাশের জিনিসটা দেখতে পেয়ে তার পা চলা বন্ধ হয়ে গেল। চিমনির পাশের অর্ধেক ফ্লোর রক্তে ভেসে গেছে। সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে এলো তার। গা গুলিয়ে বমি পেল। এমন ভয়ানক, বিশ্রী, বিভৎস দৃশ্য জীবনেও তার চোখের সামনে আসেনি। গলায় বমি এসে আটকে গেল। মাথা ঘুরানো শুরু করল তার। এমনটা কে করবে তার বুঝতে বাকি রইল না। মুহুর্তেই দুনিয়াসুদ্ধ ঘৃণা উপচে পড়ল তার প্রতি।

মুখ দিয়ে অস্ফুটে শব্দ বের হলেও শোনা গেল না। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় নোনাজল নির্বিঘ্নে বইতে লাগে। তখনই পেছন থেকে কেউ একজন শক্ত কন্ঠে ধমকে উঠে,

-“নিজের কর্মের ফল ভোগ করেছে সে। এতে কান্নার কী আছে? স্টপ ক্রায়িং রোজ।”

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here