#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৮ [এক্সট্রা]
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–

জেহের আসলো সন্ধ্যায়। তবে ঘরে না। বাগানের সামনের ছোট মাঠের বেতের সোফায় গিয়ে সোজা বসে পড়ল। ফর্মাল ড্রেসেই। বাগানে আওয়াজ পেয়ে ইনশিতা ড্রয়িংরুমের বারান্দায় গেল দেখার জন্য। দেখল জেহের চিন্তিত চেহারায় বাগানের সোফায় বসে আছে। হাঁটুর উপর ল্যাপটপ। ইনশিতা অবাক হলো জেহেরকে এভাবে দেখে। ঘরে না এসে হঠাৎ বাগানেই বা কেন গেল?

জেহের ইনশিতাকে লক্ষ্য করলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইনশিতাকে পর্যবেক্ষণ করে এক আঙ্গুল উঁচিয়ে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার। ভ্রু কুঁচকালো ইনশিতা। তখন দেখল দু’জন গার্ড এগিয়ে যাচ্ছে জেহেরের দিকে। গার্ডদের আসতে দেখে জেহের চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই ইনশিতা হনহন করে রুমে চলে গেল।

মনটা তার অভিমানে ভারী হয়ে গেল। আজ সকাল থেকে জেহের একটাও কথা বলেনি তার সাথে। এখন এসেছে তাও ধমকে ভেতরে যেতে বলছে! কোথায় একটু এসে আদর করে কথা বলবে তা না। হঠাৎ তার মাথায় আসলো, আজকে সে জেহেরের কনসার্ন পাওয়ার জন্য এত উদগ্রীব হচ্ছে কেন? আগে তো জেহের আসলে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করত। আর এখন তার মনটা চাইছে ছুটে গিয়ে জেহেরের বুকে পড়তে। অভিমানী হয়ে বলতে,‘আজ আপনি একবারও কেন কথা বলেননি জেহের? আপনার রোজ বুঝি কষ্ট পায় না?’এতদিন যার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে চেয়েছে আজ তার কাছে যাওয়ার জন্যই উৎসুক হয়ে আছে তার বেহায়া মন। যাকে অগোচরে পাগল বলত আজ তারই প্রেমে সে পাগল হয়েছে। ভালোবেসে ফেলেছে সে। ভাবতেই ইনশিতা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ঝলমল করে উঠল। এত লজ্জা লাগছে কেন তার!

উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নাতে নিজেকে দেখতেই পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেন তাকে ঘিরে ধরল। গালটা লালচে আভায় ছেয়ে গেছে। অন্যরকম এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য এসে ভর করেছে তার চেহারায়। ইনশিতা আলতো হেসে নিজের মাথায় চাপড় মারলো।

ক্যাবিনেট খুলে জেহেরের কালো শার্ট একটা নিলো। জেহেরের অর্ধেক শার্টই সাদা কালো। কারণ জেহেরের পছন্দের রঙ সাদা কালো। তাইতো রুমের বেশিরভাগ আসবাবপত্র সাদা কালো। শার্টটাকে গায়ে জড়িয়ে ধরে মনে হলো যেন জেহেরকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সে। কলারে ঘ্রাণ নিলো। জেহেরের শরীরে আলাদা একরকমের গন্ধ আছে। যেটা সে সবসময় ঘুমাতে গেলে জেহেরের শরীর থেকে পায়। সেই একই ঘ্রাণ এখন শার্টে মেখে আছে। প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিলো ইনশিতা। যেন এই ঘ্রাণ নিয়েই সে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগে নিজেকে। কালো স্কার্টের উপর কালো শার্ট। উহুম, খারাপ লাগছে না তো। জেহেরের ব্ল্যাক রোজের মতোই লাগছে এখন। ভাবতেই একা একাই হাসতে লাগল সে। হাসতে হাসতেই হঠাৎ পেছনে ফিরে থমকে গেল।

পেছন ফিরতেই দেখে জেহের দরজায় ঠেস দিয়ে পকেটে হাত রেখে মিটমিট করে হাসছে। জেহেরকে এই মুহুর্তে আশা করেনি সে। সে তো মাত্রই না উঠোনে ছিলো। এখন হঠাৎ এখানে! জেহেরের হাসি দেখে ইনশিতা চাইছে এক্ষুনি মাটি ফাঁক হয়ে যাক, আর সে মুখ লুকোয় সেখানে। লজ্জায় কান দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠতে লাগল। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রইল। এতটা লজ্জা আগে সে কখনোই পায়নি।

জেহের মাত্রই এসেছিল ড্রেস চেঞ্জ করতে। রুমে ঢুকতেই দেখল তার রোজ তারই শার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। এই প্রথম রোজকে এতটা লজ্জা পেতে দেখল সে। তার কাছে দৃশ্যটা বড্ড মিষ্টি লাগলো। তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তার মিষ্টি রোজকে।

জেহের পকেটে হাত রেখেই ধীর পায়ে কাছে আসলো ইনশিতার। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না ইনশিতা। জেহের নিজেই দুই আঙুল দিয়ে চিবুক উঁচু করল ইনশিতার। চোখ বন্ধ করে আছে ইনশিতা। জেহের মৃদু হাসলো। ইনশিতা চোখ বন্ধ রেখেই তড়িঘড়ি করে শার্ট খুলতে শুরু করল। বাঁধ সাধলো জেহের। কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

-“ভালোই তো লাগছে আমার বউটাকে। লাল লাল গাল, উমম, স্ট্রবেরি। ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি একদম। অনুমতি আছে কি?”

ইনশিতা লজ্জায় কী করবে বুঝতে পারছে না। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। জেহেরকে সরিয়ে চলে যেতে নিলে জেহের হাত ধরে টেনে কোমড় জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পলকবিহীন তাকিয়ে থাকে রোজের লালিমাপূর্ণ চেহারায়। রোজের গালে নিজের উষ্ণ স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে থাকে জেহের। আচমকাই রোজের কম্পিত কোমল ওষ্ঠাধর নিজের অধরের ভাঁজে নিয়ে নেয়। অদ্ভুত অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে ইনশিতা। ছাড়ানোর প্রয়াস চালায় না আর।

জেহের ইনশিতার হাত ধরতেই ব্যথায় ককিয়ে উঠে ইনশিতা। উষ্ণ স্পর্শ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাত চেপে ধরে। কপালের মধভাগ কুঞ্চিত হয় জেহেরের। রোজের হাতের দিকে খেয়াল করতেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে। হাতের ক্ষতটা এখনো তাজা। জেহেরের এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। সে কীভাবে কষ্ট দিতে পারল রোজকে? কালকে মাথাটাই পুরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। যার ফল ভোগ করতে হলো রোজকে।

ইনশিতাকে খাটে বসিয়ে জেহের দ্রুত এইড বক্স নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। ইনশিতা অবাক নয়নে দেখছে জেহেরকে। ক্ষত স্থানে মলম ছোঁয়ানোর সময় জেহের চোখ মুখ কুঁচকে রাখে, যেন ব্যাথাটা ইনশিতা না, জেহের পেয়েছে। আগোচরে হাসলো ইনশিতা। জেহের বারবার নিজে নিজে বিড়বিড় করছে যা কিছুটা হলেও ইনশিতা শুনতে পেয়েছে,

-“স্যরি, স্যরি, স্যরি। আ’ম রিয়েলি ভেরী স্যরি। স্যরি রোজ, ক্ষমা করো আমাকে, স্যরি…”

ব্যান্ডেজ করার পর জেহের এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল হাতের দিকে। হাত দুটো নিজের কাছে নিয়ে অধরের স্পর্শ দিতে থাকে দুহাতে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় ইনশিতার হাত। ইনশিতার ভালো লাগলেও পরক্ষণে সে বিরক্ত হয়ে যায়। কেননা হাত সহ ব্যান্ডেজটাও ভিজে যাচ্ছে। হাত সরিয়ে নিতে চাইলে জেহের জোর করে ধরে রাখে। ইনশিতা বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“ছাড়ুন না। জেহের!”

জেহের নিজের কাজেই ব্যস্ত। এভাবে প্রায় অনেক সময় কেটে গেলেও জেহেরের থামার লক্ষণ নেই। ইনশিতা এক প্রকার জোর করেই হাত ছাড়িয়ে নেয়। জেহের অসহায় চাহনিতে তাকায় ইনশিতার দিকে। ইনশিতা কন্ঠে রাগ ঝরিয়ে বলে,

-“কী হলো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে? সেই তো ভিজেই গেল। এরচেয়ে ভালো ছিল খালি হাতেই থাকা।”

জেহেরের কানে ইনশিতার কথা ঢুকল না। তার চোখে অন্যরকম দৃষ্টি খেলা করছে। আবারও ইনশিতার হাত ধরতে নিলে ইনশিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। জেহেরের সামনে এই মুহুর্তে থাকা মানেই বিপদ। একবার ঘোর লেগে গেলে সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য তার জন্য। ইনশিতা নিজেই আরেক হাতের সাহায্যে ব্যান্ডেজ খুলে পরিষ্কার করে নিলো। পুরো হাত ভিজে গেছে। ছিঃ! ইনশিতা জেহেরের হাত ধরে নিয়ে বাথরুমে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো। একটা শার্ট আর ট্রাউজার হাতে ধরিয়ে বলল,

-“যেই কাজের জন্য এসেছেন সেটা করুন।”

বলে নিজেই বাথরুমের দরজা আটকে দিলো। জেহের চেঞ্জ করে বেরিয়ে ইনশিতার দিকে বারবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। ইনশিতা খেয়াল করেও কিছু বলল না। খাবার সাজাতে লাগল। খাবার খেতে এসেও জেহের আড়চোখে ইনশিতাকে দেখছে। ইনশিতা এবার ভাব নিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বলল,

-“আই নো হাউ বিউটিফুল আই অ্যাম। সব ছেলেই আমার জন্য পাগল। তবে আমি পাগল শুধু আপনার জন্য। এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখলেই পারেন। আমি তো সবটাই আপনার। জেহেরের রোজ।”

বিস্ময়ে জেহেরের মুখ থেকে খাবার পড়তে গিয়েও পড়ল না। সে তো এমনটাই হেলিকপ্টারে বলেছিল। তারই কথা তাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে! রাগে ফুঁসে উঠল জেহের। তবে রাগটাকে চেপে মিষ্টি হেসে বলল,

-“একটা কথা ভুল বললে মাই লাভ। ইউ আর নট অনলি বিউটিফুল বাট অলসো ব্লাডিফুল।”

ইনশিতা মুহুর্তেই চুপসে গেল। অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল তার। সে যতবারই জেহেরকে কথার জালে হেনস্থা করতে চায় ততবারই সে নিজে হেনস্থা হয়ে ফিরে। সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে থমথমে মুখে চুপচাপ খেয়ে নেয়।

ইনশিতা যখন বেডশিট ঝাড়ছিল তখন জেহের এসে হুট করে কোলে তুলে ব্যালকনির চেয়ারে নিয়ে বসায়। ইনশিতা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল শুধু। জেহেরের থেকে মুখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকাল। তার শীত করছে রীতিমত। শীতটা বেশ ভালোই জেঁকে ধরেছে আজকাল। জেহের নিজের সাথে ইনশিতাকে মিশিয়ে নিয়ে ইনশিতার মাথা নিজের বুকে ঠেকায়। ইনশিতার রাগ এখনো পড়েনি। সে জোর করে মাথা তুলে নেয়। জেহের কিছু বলে না, শুধু নিবিড়ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ইনশিতা একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাল জেহেরের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছে। প্রায় বেশ সময় বাদে জেহের নিরবতার জাল কেটে বলে,

-“রোজ, তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার।”

ইনশিতা কিছু বলল না। তার মনে হচ্ছে জেহের তার সাথে কথা জমানোর জন্য এমনটা করছে। তাই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো, জেহেরের সাথে কথা বলবেই না আজ সে, এত বড় অপমান করল কীভাবে তখন!

-“আশা করি তুমি সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবে। কিছু লুকোবে না আমার কাছে।”

ইনশিতা এবার ফিরে তাকাল জেহেরের দিকে। তার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই সিরিয়াস। ইনশিতা নড়েচড়ে বসল। আপাতত জেহেরের কথা না শুনে তাকে রাগাতে চায় না সে। তাই ক্ষীণ কন্ঠে একটি শব্দে জবাব দিলো।

-“হুম।”

জেহের ভণিতা ছাড়াই সরাসরি কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো ইনশিতার দিকে,

-“কাল কী হয়েছিল তোমার সাথে? এখান থেকে যাওয়া অবধি আসা পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বলো আমাকে।”

ইনশিতা চমকে তাকাল জেহেরের দিকে। হঠাৎ এমন কিছু বলবে সেটা ভাবতে পারেনি সে। গতকালকের কথা মনে করতেই শিউরে উঠল সে। শরীরে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গিয়ে কেঁপে উঠল। জেহের স্পষ্ট টের পেল ইনশিতার কাঁপুনি। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রোজকে। তার মন বলছে রোজের সাথে গতকাল খুব খারাপ কিছু হয়েছে। এমনটা না যে সে জানতে পারবে না, সে জেনেছে কিছুটা, তবে পুরোটা আগে রোজের মুখ থেকে জানা দরকার। ইনশিতা জোর করে হাসার চেষ্টা করল। কিছু বলতে নিবে তার আগেই জেহের থামিয়ে দিয়ে বলল,

-“আমি কোনো মিথ্যে শুনতে চাই না রোজ। যা বলার সত্যিই বলবে, আলাদা কোনো এক্সপ্লেনেশনের দরকার নেই।”

জেহেরের চেহারাটা যথেষ্ট গম্ভীর এবং সিরিয়াস দেখে ইনশিতা কোনো মিথ্যা বলতে পারল না। কিন্তু সে সত্যিটাও বলতে পারবে না। সে জানে সত্যিটা জানার পর জেহের ওদের মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হবে না। আর সে জেহেরকে কখনোই খুনি হিসেবে চায় না। জেহের খুনি হলে তাকে মেনে নিতে পারবে না সে। চোখের দৃষ্টি নামিয়ে মিথ্যে বলার চেষ্টা করল,

-“ক-কী হবে আর? বাড়িতেই গ-গিয়েছিলাম খালি, আর কিছুই না, এ-এটাই।”

ইনশিতার কথা আটকে আসতে লাগলো। জেহেরের এমন চেহারার দিকে তাকিয়ে মিথ্যে বলতে পারছিল না সে। জেহের চুপ থেকে খুবই শীতল কন্ঠে বলল,

-“বারণ করেছিলাম মিথ্যে বলতে।”

ইনশিতা ভয়ে ভয়ে তাকাল জেহেরের দিকে। জেহেরের এই শীতল কন্ঠ যেন ঝড়ের পূর্বের আভাস। ঢোক গিললো ইনশিতা। জেহের নিজেই বলল,

-“গতকাল যদি তুমি শুধুই বাড়ি গিয়ে থাকো তাহলে তোমার জামা ছেঁড়া ছিল কেন? তোমার ঠোঁটও কাটা ছিলো। এই যে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তোমার অবস্থার কথা আর নাই বা বলি। এবারও কী তুমি বলবে শুধুমাত্র বাড়ি গিয়েই ফিরে এসেছিলে?”

ইনশিতা কিছু বললো না। কালকের ঘটনাটা আবার শরীরে কাঁটা দিয়ে দিচ্ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। জেহের দেখলো ইনশিতার শরীর ধীরে ধীরে কাঁপছে। প্যানিক হয়ে যাচ্ছে সে। জেহের ইনশিতার গালটাকে নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে নরম কন্ঠে বলল,

-“হেই গার্ল, ডোন্ট বি প্যানিক। লুক অ্যাট মি রোজ।”

ইনশিতা তাকাতে পারল না। ঘটনাটা তার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। জিহাদ যখন তার কাছে আসতে চেয়েছিল তখন সে কী পরিমাণ ভয়টা পেয়েছিল সেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। নয়নিকার হঠাৎ পরিবর্তন আর জিহাদের এমন নোংরা আচরণ ইনশিতার মাথায় সেট হয়ে আছে। সে কিছুক্ষণের জন্য ভুলতে পারলেও এখন আর ভুলতে পারছে না। জেহেরকে দেখলেই জিহাদের কথা মনে পড়ছে তার। এমন মনে হচ্ছে যেন সে এখন জিহাদের কোলেই বসে আছে। তড়িৎ গতিতে দাঁড়িয়ে পড়লো ইনশিতা। তার কপাল বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখে মুখে অজস্র ভয়, যেন কালকের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

জেহের উঠে দাঁড়িয়ে ইনশিতার কাছে এগোলো ধীরে ধীরে। রোজ প্রচুর ভয় পেয়েছে। শান্তনা সুরে বলল,

-“লুক রোজ, ভয় পাবে না। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। অ্যান্ড আই প্রমিস তোমার থেকে জোর করে কিছু জানতেও চাইব না। তুমি কাছে এসো। বললাম তো কিছু হবে না, দূরে যাচ্ছ কেন? কাম হেয়ার।”

ইনশিতা পেছাচ্ছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। জেহের এগিয়ে ইনশিতার বাহু ধরল আলতো করে। নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিতে চাইলে ইনশিতা ছাড়াতে চায়। জেহের আজ আর ধমক দেয় না। শুধু নরম কন্ঠে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে।

সে গতকালকের ঘটনার কিছুটা জানতে পেরেছে রাফিদের কাছ থেকে। আজ অফিস গেলে শুনে রাফিদ এসেছে তার সাথে দেখা করার জন্য। জেহের পাত্তা না দিয়েই নিজের কাজে মন দেয়। রাফিদ তার দুচোখের বিষ। তবুও এখন আর তার সাথে কোনো ঝামেলা করতে চায় না। রিসেপশনিস্ট কল করলে সে বলে দেয় রাফিদকে যাতে ধাক্কা মেরে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়। তার কিছুক্ষণ বাদে আননোন নাম্বার থেকে কল আসলে রিসিভ করে দেখে রাফিদ। সে কেটে দিতে নিলে রাফিদ খালি বলে,

-‘কেটে যখন দিবেন তার আগে একটা কথা শুনে রাখুন মিঃ জেহের। নিজের ঘরেই কিন্তু আপনি দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন। সময় গড়ানোর আগেই তাড়িয়ে দিন তাদের। নাহলে গতকাল যেভাবে আপনার স্ত্রীকে সেই কালসাপ গুলো ছোবল মারতে যাচ্ছিল সেভাবে যে পরবর্তীতে মারবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আর আমিও সবসময় থাকবো না আপনার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য। খেয়াল রাখবেন।’

এইটুকুই বলে রাফিদ কল কেটে দিয়েছিল। রাফিদের ইঙ্গিত জেহের বুঝতে পারলেও কালসাপদের চিনতে পারেনি সে। রাফিদের সাথে দেখা করতে গিয়েও যায়নি। কারণ সে চাইছিল রোজের মুখ থেকেই সবটা শুনবে। এখন রোজের থেকেও কিচ্ছু জানতে পারেনি। তবে খুব খারাপ কিছু যে ঘটেছিল তা আন্দাজ করতে পারছে সে। আর সেই কালসাপদের চিনে তাদের তিলে তিলে মারবে বলে প্রতিজ্ঞা নেয়।

ইনশিতাকে কোলে করে জেহের বিছানায় শুইয়ে দেয়। ইনশিতা জেহেরের বুকে মাথা দিয়ে কাঁদছে। জেহের এক হাতে আলতো জড়িয়ে ইনশিতার চুলে পরম আদরে বিলি কেটে দেয়। একসময় ইনশিতা ঘুমিয়ে পড়লে জেহের ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়ে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। যারা তার রোজকে কাঁদিয়েছে তাদের অবস্থা এমন করবে যে সারাজীবন আক্ষেপ করতে করতেই একসময় মরেই যাবে। জ্যাকেট জড়িয়ে মোবাইল আর ল্যাপটপ নিয়ে বাগানের মাঠে চলে যায়। রাত বাড়লেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।

.

.

খট করে কিছু শব্দের আওয়াজে ইনশিতা জেগে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে। তবে ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়েই উঠে পড়ে। আওয়াজকে অনুসরণ করে দেখে বাগানে জেহের আর তিন চারজন গার্ড কথা বলছে। জেহেরকে দেখে মনে হচ্ছে সে প্রচন্ড রেগে আছে। ফর্সা মুখমন্ডল রক্তিম হয়ে আছে। চোখ দিয়ে অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে যেন। কপালের আর ঘাড়ের রগ দপদপ করে জ্বলছে। ইনশিতা বারান্দায় গেল না, জেহের দেখলে রেগে যাবে আবার। তাই সোফায় বসেই কাঁচের মধ্য দিয়েই জেহেরকে দেখতে লাগে। বাহিরে কুয়াশায় ঘেরা সব। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাড়ে তিনটা।

এইমাত্ররই সবটা জানতে পেরেছে জেহের। গার্ডদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে, আর রাফিদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে রাগে তার ইচ্ছে করছে পুরো দুনিয়াটা শেষ করে দেয়। সিসি ক্যামেরায় রোজকে জিহাদ যেভাবে টাচ করে টানা হেঁচড়া করেছিল সেটা দেখে জেহেরের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কতটা অসহায় ছিল তখন তার রোজ! সারা শরীর কাঁপছে রাগে। এমন একটা কাজ যে তার ভাই আর বোন মিলে করবে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। এখন তার সবচেয়ে বেশি রাগ উঠছে রোজের উপর। রোজকে সে বারবার সাবধান করেছিল ঐ বিশ্বাসঘাতক মেয়েটার থেকে দূরে থাকার। এই মেয়েকে তার এমনিতেই বিরক্ত লাগে। আর রোজকে সে দেখতেই পারতো না এই মেয়েটার সাথে। রোজ যদি কালকে তাকে বেঁধে না রাখতো তাহলে এমন ঘটনা সে চাইলেই আটকাতে পারতো।

রাফিদকে এখন তার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। যতই হোক, তার ভালোবাসাকে সে ঐ নরকীটদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এখন জেবা জিহাদ আর নয়নিকাকে সে কখনোই ছাড়বে না। তার রোজের ভয়ের আর কান্নার কারণকে সে দুনিয়া থেকেই নিঃশেষ করে দেবে। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে জেহের। তখনই তার চোখ যায় ব্যালকনির কাঁচ ভেদ করে সোফায় শুয়ে থাকা রোজের দিকে। গার্ডদের বিদায় দিয়ে বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুমে যায় সে। গিয়ে দেখে সোফার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে রোজ। হাটু গেড়ে তার মাথার কাছে বসে জেহের। ঘুমন্ত চেহারার রোজকে দেখে রোজের উপর থাকা সব রাগ নিমিষেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কপালের চুল গুলো সরিয়ে গভীর মনোযোগের সহিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোজকে পর্যবেক্ষণ করে সে। ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের নিচে চিকন নাক। কিশলয়তুল্য পাতলা আবরণবিশিষ্ট ঠোঁট। গোলগাল চেহারার আদুরে মুখটা জেহেরের ভেতরটায় তোলপাড় সৃষ্টি করে।

ইনশিতার মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে। পিটপিট করে চোখ মেলে জেহেরকে দেখতে পায়। এক হাত বহু কষ্টে উঠিয়ে জেহেরের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলায়। জেহের তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। ইনশিতার হাত ঢলে পড়ে আবারও সে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।

.
সকালে জেহেরকে পাশে দেখতে পায় না সে। শুধু টেবিলে একটা ছোট্ট চিরকুট দেখতে পায়। যেখানে লেখা আছে, ‘গুড মর্নিং লাভ। আজ তাড়া থাকায় তোমাকে না বলেই যেতে হচ্ছে। স্যরি ইনফিনিট। তোমার ব্রেকফাস্ট রেডি করে রেখেছি। খেয়ে নিও।’ লেখার শেষে লাভ আর স্মাইলিং ইমোজি।

চিরকুটটা পড়ে ইনশিতার মন মুহুর্তেই ফুরফুরে হয়ে গেল। আরো কয়েকবার পড়ে নিলো। সতেজ মনে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখলো টেবিলের উপর সব সাজানো। ব্রেডে সস দিয়ে লাভ আঁকা। আর টেবিলের উপর বড় একটা কালো গোলাপের বুকে। ইনশিতার মাথায় তখন একটা আইডিয়া আসলো। আজকে জেহেরকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here