#প্রহেলিকা
#পর্ব_১৭
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)
———————–

ইনশিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। গলা, পিঠও খুব জ্বলছে। উঠে বসে আশেপাশে চোখ বুলাতে নিলেই দেখল জেহের দূরে থাকা সোফায় বসে এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুই হাঁটুতে হাতের কনুই রেখে হাত জোড় করে তার উপর থুতনি ভর দিয়ে রেখেছে। রক্তবর্ণ চোখ দুটো দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে ইনশিতাকে। ইনশিতা গতকালকের কথা মনে পড়লে নিজের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো। একটা টিশার্ট আর জিন্স পরে আছে সে। হতভম্ব হয়ে গেল সে। গতরাতে কী হয়েছিল? জেহের তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে অনেক্ষণ ভিজল, তারপর! সে কী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? তারপর জেহের তার ড্রেস চেঞ্জ করে দিল? জেহের নিজ হাতে জামা খুলেছে? ইনশিতা বড়বড় চোখ করে তাকাল জেহেরের দিকে। অথচ জেহের আগের ভঙ্গিতেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ইনশিতা পুরো শরীরে চাদর পেঁচিয়ে দাঁড়াল কারণ টিশার্ট আর জিন্স কখনোই পরেনি সে, কেমন আনকম্ফোর্টেবল লাগে। আর জেহেরের সামনে তো এভাবে থাকলে সে মরেই যাবে।

কোনোরকমে উঠে জেহেরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কন্ঠে তেজ ঢেলে বলল,

-“আপনার মধ্যে কী কমনসেন্স বলতে আসলেই কিছু নেই না কি? একটা মেয়ের অজ্ঞান হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজের চক্ষুক্ষুধা মেটালেন? আর না জানি কী কী করেছেন? আমার জামাকাপড় নিজ হাতে চেঞ্জ করার সাহস কোথায় পান; যেখানে আমার আর আপনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই?”

জেহের হাত জোড় খুলে সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসল, তবে মুখভঙ্গি অপরিবর্তনীয়। শান্ত কন্ঠে বলল,

-“সম্পর্ক বানাতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না।ওয়ানা সি?”

ইনশিতা ভয়ে দুকদম পিছু হটল। জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলো। জেহের একবার ঘাড় এদিক ফিরিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ইনশিতার সামনে এসে গালে হাত রাখল। ইনশিতা মুখ সরাতে গিয়েও সরাল না। জেহের শক্ত গলায় বলল,

-“আমি তোমার ড্রেস চেঞ্জ করিনি। গতরাতে তুমি অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথেই রুমে নিয়ে এসে মেইড দিয়ে চেঞ্জ করিয়েছি। সো, আমাকে ব্লেইম করা বন্ধ করো। আর আমি চাইলেও তোমার জামা কাপড় চেঞ্জ করতে পারি। বাট তুমি যেহেতু এসব পছন্দ করো না তাই বিয়ের আগে এসব করবো না। আর হ্যাঁ, বিয়ের পর তোমাকে একদিনের জন্যও নিজ হাতে চেঞ্জ করতে দেব না।”

বলেই দ্রুত পদে বেরিয়ে গেল জেহের। ইনশিতা জেহেরের কথা শুনে প্রথমে অনেক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাইল। কিন্তু শেষ কথাটা শুনে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কী বলে গেল জেহের! ছিঃ!

ইনশিতা ওয়াশরুমে ঢুকতে নিলে চোখে সব অন্ধকার দেখতে লাগে। মাথায় হাত দিয়ে দেখে এক সেট জামা কেউ ছুঁড়ে মেরেছে তার দিকে যার ফলে চোখ ঢাকা পড়েছে। জামা হাতে পাশ ফিরতে দেখে জেহের দাঁড়িয়ে।

-“পনের মিনিট টাইম দিলাম। চেঞ্জ করে আসো। উই হ্যাভ টু গো ব্যাক।”

বলে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। গটগট করে হেটে চলে গেল। ইনশিতা দশ মিনিটে চেঞ্জ করে এসে দেখে একজন বাঙালি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে খাবারের ট্রে। এমনভাবে কাঁপছে মনে হচ্ছে একটু পরেই তার গর্দান হবে। হাতে থাকা খাবারের ট্রেটাও নড়বড় করছে। তবে হাত ব্যান্ডেজ করা। সদ্য লাগানো ব্যান্ডেজ। ইনশিতা আসতেই সে বলল,

-“ম্যাম। ব্রেকফাস্ট করে নিন। স্যার আপনার জন্য ওয়েট করছেন নীচে।”

খেতে গিয়ে ইনশিতার মনে হলো এনাকে বলা যাক জামা চেঞ্জের কথা। জেহের মিথ্যে বলেছে কি না কে জানে? ইনশিতা বলেই ফেলল,

-“আচ্ছা, গতরাতে কী আপনি আমার জামা চেঞ্জ করেছিলেন?”

-ই-ইয়েস ম্যাম।

ইনশিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবুও আরেকটু যাচাই করা যাক।
-“দরজা কী খোলাই ছিলো না কি…”

-“নো ম্যাম। বাহির থেকে বন্ধ ছিলো। চেঞ্জ করিয়ে দেয়ার পর স্যার নিজেই দরজা খুলেছেন।”

-“ওহ। আচ্ছা, আপনার হাতে কী হয়েছে? কীভাবে কাটল? দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ গভীর করেই কেটেছে।”

মেয়েটা এবার কেঁদে দেবে দেবে অবস্থা।

-“আসলে…গতরাতে স্যার ছুরি দিয়ে হাতে…

-“কীহ! জেহের?”

মেয়েটি মাথা নিচু করে বলে,
-“ইয়েস ম‌্যাম।”

-“কিন্তু কেন?”

-“আ-আপনার জামা চেঞ্জ করার সময় আমার হাতের ঘড়ির কোণার সাথে লেগে আপনার গলার অনেক নিচে আঘাত লাগে। বিশ্বাস করুন ম্যাম, আমি ইনটেনশনালি কিছুই করিনি। ঘড়ির কাছের ধারটা খুব সুঁচালো ছিলো, আমি খেয়াল করিনি সেটা, তার সাথে লেগে কিছুটা কেটে যায়। আর-আর সেটা দেখে স্যার আমার হাতে ছুরি দিয়ে…”

মেয়েটা কান্নার কারণে আর কিছুই বলতে পারল না। বেরিয়ে গেল মেয়েটা। ইনশিতার খারাপ লাগল। সামান্য একটু ব্যথা লাগায় মেয়েটার হাত কাটল আর নিজে যখন নখ দিয়ে আঁচড় কেটে দিলো সেটা কিছুই না? অন্যের দোষ ঠিকই দেখে অথচ নিজেরটা দেখেনা! এক মিনিট! টিশার্ট পরার কারণে তো ঐ ক্ষত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে জেহের কীভাবে জানল যে কাটা গেছে? জেহের তো চেঞ্জের সময় ছিল না, আর দরজাও বন্ধ ছিল। তাহলে? ইনশিতা একপাশে চোখ নিতেই দেখল সিসি ক্যামেরা ফিট করা। একদম দেয়ালের কোণায়। তারমানে জেহের সিসি ক্যামেরায়…! ও মাই গড! ও মাই গড! ইনশিতা বোধহয় দ্বিতীয়বারের মতো অজ্ঞান হলো।

.

.

হেলিকপ্টারে ওঠার সময় ইনশিতার মনে পড়ল রাফিদের কথা। বেচারা কোথায় এখন? তার জন্যই তো রাফিদ এত বড় বিপদে পড়েছে। জেহেরকে জিজ্ঞেস করতে নিলেই জেহেরকে দেখে চোখ আটকে যায় ইনশিতার। স্যুট পরা জেহেরকে এত হ্যান্ডসাম লাগছিল না! তার উপর আলাদা এক অ্যাটিটিউড। এরকম একটা ড্যাশিং ছেলে তার মতো ক্ষ্যাত মেয়েকে ভালোবাসলো কীভাবে? বাতাসে চুলগুলো এমনভাবে উড়ছিল যে ইনশিতার ইচ্ছে করল নিজ হাতে চুল সরিয়ে দিতে। জেহের মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বলল,

-“আই নো হাউ হ্যান্ডসাম আই অ্যাম। সব মেয়েই আমার জন্য পাগল। তবে আমি পাগল শুধু তোমার জন্য। এভাবে লুকিয়ে না দেখে সরাসরি দেখলেই পারো। আমি তো সবটাই তোমার। রোজের জেহের।”

ইনশিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করা এমন লোক দুনিয়াতে কমই দেখেছে সে। তার উপর জেহের কিভাবে বুঝল যে সে তার দিকে তাকিয়েছিল? পরক্ষণেই মনে পড়ল জেহের কত বড় লুচু। মহান মহান কথা বলে ঠিকই কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে কত লুচু টাইপ সেটা ইনশিতা ছাড়া আর কেউ জানে না। সিসি ক্যামেরার ঘটনাটা নিয়ে এখনো ইনশিতা রেগে আছে। কিন্তু রাগ ঝারতে পারবে না সে। তার অধিকার নেই। ইনশিতা মিনমিন করে বলল,

-“রাফিদ কোথায়?”

জেহের সেই মিনমিনে আওয়াজ শুনল না বোধহয়। ইনশিতা জেহেরের বাহুতে খোঁচা দিলো। জেহের ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“হোয়াট?”

-“ইয়ে মানে, রাফিদ কোথায়?”

-“কী বিড়বিড় করছ? গলায় শক্তি নেই?”

ইনশিতা এবার জোরেই বলল,
-“রাফিদকে কোথায় রেখেছেন? ও কে দেখছি না কেন?”

জেহের মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল। সেই দৃষ্টি দেখে ইনশিতা আর কিছুই বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে ফেলল। জেহের বলল,

-“ও তোমার ভাই। ওকে নাম ধরে না ডেকে ভাই ডাকবে।”

ইনশিতা ভেঙচি কেটে মনে মনে বলল,
-“আজ আপনি না থাকলে ও আমার হাজব্যান্ড হতো। হুহ…”

-“ওকে নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। ওকে নিয়ে পরে আসবে গার্ডরা। হি ইজ অ্যাবসলুটলি ফাইন।”

কথার ধরন শুনে ইনশিতা বার কয়েক ঢোক গিলল। বলার সময় জেহেরের মুখে অদ্ভুত হাসি লক্ষ্য করেছে সে। তার মানে রাফিদ ভালো নেই।

-“আ-আচ্ছা, একটা কথা বলি?”

-“হুম।”

-“আপনি কীভাবে জানলেন যে আমি এখানে আছি?”

প্রত্যুত্তরে জেহের বাঁকা হাসল। ইনশিতার চুল নিয়ে এক আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,

-“তোমাকে খুঁজে পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। রোজ যেখানে জেহের সেখানে।”

-“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজা করে বললে হয় না?”

-“ওয়েল। অ্যাকচুয়ালি, তোমাকে খুঁজে পেতে একজনের সাহায্য যদিও নিতে হয়েছে। আই ডোন্ট নো হার। বাট মেয়েটি আমায় বলেছিল যে রাফিদ তোমাকে নিয়ে এখানে এসেছে। আর গতরাতে আমি তোমাকে খুঁজতে বের হলে রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। ভালো করে দেখি তুমি। তারপর আর কি! আমিও তোমার পিছু নেই।”

ইনশিতা লুকিয়ে আকাশ সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেহেরের থেকে বোধহয় এ জীবনেও দূরে যেতে পারবে না সে।

.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here