প্রহর শেষে

পর্ব-১৫
প্রতিটি বাবা-মায়ের জীবনেই বোধহয় এমন একটা সময় আসে, যখন তারা নিজেদের সন্তানকেও ভয় পান।সেলিনা হকের বোধহয় সেই সময় এসেছে। আজকাল তিনি গুনগুনের সাথে কথা বলতে ভয় পান।সেই কোমলমতী মেয়েটির সাথে কথা বলতে গেলে এখন তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, তিনি সদা সতর্ক থাকেন, যেন কোনো ক্রমেই ভুল কিছু মুখ দিয়ে বেরিয়ে না পরে।মেয়ের সঙ্গে প্রতিটি কথাই তিনি বলেন মেপে মেপে । তবুও এতোসতো কথার বিপরীতে উত্তর আসে দু-একটির।

-‘সে কিরে গুনগুন, কথা বলতে ভালো লাগে না, এ কেমন কথা! বুড়ো মানুষ, সারাদিন একা একা বসে থাকে।তার সঙ্গে তুই একটু কথা বলবি না?’

গুনগুন মায়ের কথার উত্তর করলো না। একদৃষ্টিতে সামনের দেয়ালে তাকিয়ে রইল।সেলিনা প্রসংঙ্গ পাল্টালেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে ইতস্তত করে বললেন, ‘গুনি মা…আর কতদিন নিজেকে এই ঘরে বন্দী করে রাখবি?
একবার তো অন্তত নিজের কথা ভাব।তোর কিছু হলে এই বাড়ির মানুষ গুলোর কি হবে ভেবেছিস একবার? তোর বড়মা যে তোর দিকে তাকিয়েই এখনো সুস্থ আছে।তাছাড়া তোর বাচ্চাটার কথাও তো একটু ভাবতে হবে ।’

-‘আমি ঠিকই আছি।’

সেলিনার মনের কালো মেঘ যেন একটু কমলো। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘সে তো ভালো কথা।’
কিছুটা থেমে ভয়ে ভয়ে আবার তিনি বললেন, ‘আচ্ছা গুনি, এ ঘরে আসার সময় শুনলাম তুই কথা বলছিস।কার সাথে কথা বলছিলি ?’

-‘কারো সাথেই না।’

সেলিনা খানিক ভেবে বললেন, ‘তাহলে আমি যে শুনলাম…..। ‘

-‘ভুল শুনেছ।’

-‘কিন্তু…।’

গুনগুন কড়া গলায় বলল, ‘এখন যাও মা,কথা বলতে আমার এখন ভালো লাগছে না।’ কথা গুলো বলার সময় গুনগুনের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো।

সেলিনা হক ভীত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। এসব কি হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। জীবন কি জীবনে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? তার জীবনের অভিশপ্ত দিনগুলো কি তার মেয়ের জীবনের মধ্য দিয়েই আবার ফিরে আসছে?
এই খেলার শেষ কোথায়?
কিছু একটা ভেবে ভয়ে সেলিনা হক কেঁপে উঠলেন।মনে মনে বললেন, ‘এটা কখনো হতে পারে না,আমি হতে দেব না।’

আহসানউল্লাহ সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে।আজ তিনি অসহায়। তার সুখী পরিবারে কোথাও যে সুর কেটে গেছে, ধীরে ধীরে যে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তা তিনি বোঝেন। অথচ কিছুই তার করার নেই। জানা নেই কি করলে পরিবারে পুরনো ছোট ছোট সেই সুখের মুহূর্ত গুলো ফিরে আসবে। আর তা আদৌ সম্ভব কী না।চোখের সামনে সব শেষ হতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
-‘কেমন আছেন বড়বাবা? ‘

আহসানউল্লাহ সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে চমকে গেলেন।ব্যাস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। গুনগুন এসেছে এ যেন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না!বললেন,’আমি….আমি ভালো আছি মা।তুমি এসো।’

বড়বাবার দিকে তাকিয়ে গুনগুন স্মিত হাসলো।ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে আহসানউল্লাহ সাহেবের সামনে দাঁড়ালো।
-‘কি হলো বাবা, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন। ‘বলে সে নিজেও পাশের বেতের চেয়ারটায় বসল।
আহসানউল্লাহ সাহেব বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়লেন।
গুনগুন আহসানউল্লাহ সাহেবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার রুপালি বর্ণের এলোমেলো চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে শাসনের সুরে বলল,’ইশ.. কি অবস্থা হয়েছে চেহারার! কয়েকটা দিন আমি খেয়াল রাখিনি এতেই এই অবস্থা!
আমি না থাকলে তখন কি হবে?’

আহসানউল্লাহ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তাকিয়ে রইলেন গুনগুনের মুখের দিকে ।গুনগুন তার চোখের ওপর থেকে সোনালি ফ্রেমের মোটা, ভারি কাঁচের চশমাটা খুলে নিল।নিজের ওড়না দিয়ে চশমাটা মুছতে মুছতে আপন মনে কিসব বলতে লাগলো। তার ঘন কালো ভ্রু জোড়া কুচকে গেল।

আহসানউল্লাহ’র চোখ ভিজে উঠল।ঝাপসা চোখে অসহায় বালকের মতো তিনি এই ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। চশমা পরিষ্কার করে গুনগুন আহসানউল্লাহ সাহেবের চোখে পড়িয়ে দিয়ে বলল,’চা খাবেন বাবা? চা করে আনব?’

-‘চা…..আচ্ছা দাও মা।’

গুনগুন নিঃশব্দে হেটে চলে গেল।আহসানউল্লাহ সাহেব সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি জানেন গুনগুন অসুস্থ তাছাড়া চা খাওয়ার ইচ্ছেও তার ছিল না তবুও তিনি হ্যাঁ বলেছেন। এর পেছনে একটা সুক্ষ কারণ আছে।তিনি গুনগুনের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চান।দুজন দুজনের সাথে হাসি মুখে কথা বলছে ঠিক তবে দুজনেই জানে এই হাসি মিথ্যে ।এই হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে অজস্র চেপে রাখা বেদনার অনুভূতি ।

গুনগুন শব্দহীন পায়ে এসে দাঁড়ালো। টি-পট নামিয়ে রেখে পরম যত্নে চা বানিয়ে আহসানউল্লাহ সাহেব কে এগিয়ে দিল।আহসানউল্লাহ সাহেব অন্যমনস্ক ছিলেন।হুশ হতেই চা’য়ে চুমুক দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে বললেন, ‘চা খুব ভালো হয়েছে। তুমি দাঁড়িয়ে কেন বসো মামণি। ‘

গুনগুন তন্দ্রাতুর স্বরে বলল,’এটা কফি বড়বাবা। ঘরে চা পাতা ছিল না,তাই….।’

আহসানউল্লাহ সাহেব মাথা ঝাকালেন, যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন।বললেন, ‘ওহ,তাই তো! বুড়ো হয়েছি তো সবকিছুর ঠিক খেয়াল থাকে না। ‘

গুনগুন উত্তর করলো না। গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমি যাই বাবা।’বলে সে আর অপেক্ষা করলো না, মুহুর্তেই বেরিয়ে গেল।

আহসানউল্লাহ সাহেব তার চলে যাওয়া দেখলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। কারণ এই গুনগুন আগের গুনগুন নয়।আগের গুনগুন সবসময় নরম গলায় কথা বলতো ।এখনকার গুনগুনের এই দৃঢ়তা তার কথায় ছিল না।

রাতে আহসানউল্লাহ সাহেব এশার নামাজ পড়ছিলেন। বার্ধক্য জনিত নানান সমস্যার কারণে তিনি এখন ঘরেই নামাজ আদায় করেন ,মসজিদে যেতে পারেন না। সালাম ফিরিয়ে তিনি টের পেলেন ক্ষীণ একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।কেউ যেন খুব গোপনে কাঁদছে, চাইছে সে কান্নার আওয়াজ কেউ শুনতে না পাক!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধীরে ধীরে সেই করুন সুরের কান্না বাড়তে লাগলো। জোহরা খানম বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তিনি অস্থির হয়ে বললেন, ‘কে কাঁদে, কে কাঁদে?’

কান্নার আওয়াজের সাথে এবার ফোঁপানোও যুক্ত হলো। আওয়াজ যত বাড়তে লাগলো জোহরা খানম তত বেশি অস্থির হয়ে উঠতে লাগলেন।আহসানউল্লাহ বিরক্ত হয়ে বললেন,’আহ! জোহরা চুপ করো।’
এর বেশি কিছু তিনি বলতে পারলেন না। তার কথা আটকে আসছে। তিনি জানেন এমনকি জোহরাও জানে কে কাঁদছে।
গুনগুন চাপা স্বরে কাঁদছে।দেয়াল ছাপিয়ে সেই কান্না আহসানউল্লাহ সাহেবের ঘরেও এসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আহসানউল্লাহ নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। এই চাপা কান্নার শব্দ তার কাছে সন্তানের মৃত্যুর আর্তনাদের থেকেও বেশি করুন মনে হল।

গুনগুন রোজ রাতেই এভাবে কাঁদে। কখনো তিনি শুনতে পান, কখনো বা পান না,আবার কখনো না শোনার ভান করে থাকেন। তবুও স্বস্তি নেই ।তার শ্বাস রোধ হয়ে আসে যন্ত্রণায়।শুধু প্রহর গুনেন এই কালরাত শেষ হওয়ার।

শেষ রাত থেকেই জোহরা খানম ছটফট করছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন ভোরের আলো ফোটার।ফজরের আযান কানে আসা মাত্রই তিনি উঠে পড়লেন, নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন ।
নামাজ শেষ করে চুপিসারে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন।গিয়ে দাঁড়ালেন গুনগুনের ঘরের সামনে।ভেতরে যেতে তার সাহস হলো না। যদিও তিনি জানেন গুনগুন এখন জেগে আছে।ফজরের পর সে কখনোই ঘুমায় না,এই সময় সে কুরআন তিলাওয়াত করে।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে জোহরা খানম দেয়ালে ভর দিলেন।শরীর টা হঠাৎ করেই খুব খারাপ লাগছে, সারারাত জেগে থাকার ফল।বুকে হাত রেখে তিনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন।তখনই দরজাটা খুলে গেল।ধীর পায়ে গুনগুন বেরিয়ে এলো। জোহরা খানম কে দেখে সালাম জানিয়ে সে ম্লান মুখে হাসলো। সালামের জবাব দিয়ে জোহরা খানম বেদনাতুর চোখে গুনগুনের দিকে তাকালেন ।
তার পরনে ধবধবে সাদা বর্ণের আবায়ার মতো পোশাক, গায়ে অলংকারের চিহ্ন মাত্র নেই,সুদীর্ঘ রুক্ষ কেশরাশি বিপর্যস্ত ভাবে মাথায় জোরানো, চোখের দৃষ্টি শ্রান্ত, মুখ ফ্যাকাসে। জোহরা খানমের বুকে হাহাকার করে উঠল । সেই প্রানবন্ত চঞ্চল মেয়েটার আজ এ কি করুন দশা!
দেখে মন হচ্ছে কি ভীষণ জটিল রোগে সে আক্রান্ত।যে রোগ তার সমস্ত সৌন্দর্য, লাবণ্য আর সুখ কেরে নিয়েছে।

নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনি হাসলেন।ইতস্তত করে অবশেষে গুনগুনের হাত ধরে বললেন,
‘ কিরে গুনি মা,ভালো আছিস তো।’কথা গুলো বলতে গিয়ে তার চোখ ছলছল করে উঠল,কণ্ঠ রোধ হয়ে এলো।

গুনগুন মাথা নিচু করে নখ খুটতে লাগলো,কিছু বলল না।

জোহরা খানম সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে গুনগুনকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে উঠে বলতে লাগলেন,’গুনি তুই এমন করিস না।তুই আগের মতো হয়ে যা।তোর কিছু হলে এবার আমি মরে যাব।’

গুনগুন নড়লো না, স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।যেন সে এক পাথরের মূর্তি। যে জীবনের সমস্ত কোমলতা, নমনীয়তা, আর অনুভূতিকে অতিক্রম করেছে।

বিষন্ন অপরাহ্নে ফিকে হয়ে যাওয়া সূর্যের আলোর নিচে আহসানউল্লাহ সাহেব বসে আছেন।তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। যেন দেখতে চাইছেন দৃষ্টি সীমানার বাইরের কোন বিষয়। বাবাকে একা পেয়ে ওয়াসিয়াত পাশে এসে বসলো।

চলবে……..
অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here