প্রহর শেষে

পর্ব-১৩
রৌদ্রজ্বল সকাল। আহসানউল্লাহ সাহেব সোফায় বসে আছেন।হাতে পত্রিকা। তবে সেদিকে তার মনযোগ নেই। তিনি বারবার সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছেন।ওয়াসিয়াত কাল রাতে বাড়ি ফিরেছে।তবে এখনো তার সাথে দেখা হয় নি।
কাল রাতেই তিনি স্ত্রী কে বলে রেখেছেন সকালে তিনি ছেলেদের সাথে কথা বলবেন। তারা প্রত্যেকেই যেন উপস্থিত থাকে। অথচ এখনো কারোর দেখা নেই!

জোহরা খানম খানিক দূরে মুখভার করে বসে আছেন।চোখে মুখে বিষন্নতা।
আজ তার বাড়ি পরিপূর্ণ। স্বামী, ছেলে-বউ,নাতি সবাই তাকে ঘিরে। তবুও কোথাও যেন শূন্যতা।যে শূন্যতার উৎস ওয়াসিয়াত।ছেলের এই আকষ্মিক পরিবর্তনে তিনি ভীষণ অবাক। তার চেনা-জানা বেখেয়ালি ছেলেটা হুট করেই কেমন বদলে গেছে।আজকাল তিনি ওয়াসিয়াত কে একদমই বুঝতে পারেন না। সবসময় তার মধ্যে কেমন যেন অস্থির -অস্থির ভাব!
সকালে ওয়াসিয়াত কে ডাকতে তার ঘরে গিয়ে তিনি ঘাবড়ে গেলেন। সারাঘর জুড়ে সিগারেটের কড়া গন্ধ। অথচ ওয়াসিয়াত কোনকালে সিগারেট খেতো বলে তিনি জানতেন না।

ঘুমন্ত ছেলের শিয়রে বসে তিনি ছেলের মুখের দিকে চাইলেন।সে মুখে বিষাদের চিহ্ন। হঠাৎ বুকে ভীষণ যন্ত্রণা হলো। ছেলেটা কি শুকিয়ে গেছে!
চোখের নিচে কালি পড়েছে, চুলগুলো হয়েছে ভীষণ বড়।তিনি ছেলের মাথার এলোমেলো চুলে হাত বুলালেন, কপালে চুমু খেলেন। ভ্রু জোড়া কুচকে সে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো ঘুমোচ্ছে ।হঠাৎ জোহরা খানমের কান্না পেয়ে গেল।চোখ ভিজে উঠল।ছেলেটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? কেন তার এতো পরিবর্তন?
নিজের অজান্তেই তিনি কি বড় কোন ভুল করেছেন?

বাড়ির চিত্র এখন বদলেছে। পরিবারে নতুন সদস্য এসেছে। সে সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখে। সবাই বলে ‘জয়’ তার ছোট চাচার মতোই হয়েছে। সারাক্ষণ বাড়ি মাথায় তুলে রাখে।

কথায় আছে অতিরিক্ত চঞ্চল মেয়েরাই পরিণত বয়সে অধিক সংসারী হয়।গুনগুন কে দেখে এখন অন্তত তাই মনে হয়। তার সকল খেয়ালি পনা আর অস্থিরতা যেন এখানে এসে স্থির হয়েছে।এখন এই পরিবার আর পড়াশোনাই তার সকল ব্যস্ততার কারণ।নিজেকে সে সম্পুর্ন রূপে গুটিয়ে নিয়েছে। চলে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন বোধহয় এসেছে প্রিয়ার।গুনগুনের সহচার্যে এসে সে নিজেকে বদলেছে। শরিয়তের বিধান সম্পর্কে সে সচেতন ছিল না।ধর্মীয় আইন পালনে ছিল বেখেয়ালি। গুনগুনের সংস্পর্শে এসে সে ইসলামি জীবন ব্যবস্থায় আকৃষ্ট হয়েছে।এবং অবশেষে নিজেকে পর্দার আড়ালে টেনে নিয়েছে।তাদের দিনগুলো এখন খুব রঙিন। দুই জা’ তে মিলে সারাদিন গুটুর গুটুর কথা বলে।

ধীরে ধীরে পা ফেলে ওয়াসিয়াত এগিয়ে এলো। অসস্থি ঢাকার জন্য অকারণেই দাড়ি চুলকাতে লাগলো ।মাথা নিচু করে বসলো আহসানউল্লাহ সাহেবের ঠিক সামনের সোফা টায়। শাহাদাত আর ইরশাদ আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। এবার তৃতীয় পুত্র চলে আসায় আহসানউল্লাহ সাহেব কথা শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি ওয়াসিয়াত কে বললেন, ‘তোমার পড়াশোনার কি অবস্থা ওয়াসিয়াত? মাস্টার্স তো শেষ, এবার কি করবে কিছু ভেবেছ?’

-‘কিছুদিন পরই তো বিসিএস পরীক্ষা বাবা,দেখি কি হয়।’

-‘হুম, ভালো কথা। দেখো কি হয়।তবে আমারো তো বয়েস হয়েছে। আমি এইসব ব্যবসা -বাণিজ্য আর দেখতে পারছি না।ওদিকে শাহাদাত তো দায়রা আদালত আর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ছাড়া চোখে তেমন কিছুই দেখে না।’ বলে তিনি শাহাদাতের দিকে তাকালেন।বাবার মুখে এসব কথা শুনে শাহাদাত হঠাৎ কাশতে শুরু করলো।

আহসানউল্লাহ সাহেব আবার বললেন, ‘থাকার মধ্যে আছে শুধু ইরশাদ।ওর একার পক্ষে এতো বড় ব্যবসা সামলানো কঠিন ব্যাপার । ‘

উত্তরে ওয়াসিয়াত বলল,’আগে বিসিএস টা দিয়ে দেখি,বাবা।তারপর নাহয়….। ‘

-‘হুম তাই কর।চাকরি পেলে তো হয়েই গেল নাহয় ব্যবসা সামলাবে। ‘ বলে আহসানউল্লাহ সাহেব আবার শাহাদাতের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘বসে আছো যে,আজ কোর্টে যাবে না? ‘

-‘জ্বি….জ্বি বাবা।এখনি যাচ্ছি। ‘

শাহাদাত বেরিয়ে পড়লো। খানিক বাদে আহসানউল্লাহ সাহেবও উঠে পরলেন। বাবা চলে যাওয়াতে ইরশাদ পায়ের ওপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। একটু জোরেই চেঁচিয়ে বলল,’গুনগুন, দু’কাপ চা দিয়ে যাও।’

কথাটা কানে যেতেই ওয়াসিয়াতের হৃদকম্পন দ্রুত হলো। ভাইয়ের সামনে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে মাথা নিচু করে সে বসে রইলো। মনে মনে ভাবলো কোন মতে যদি এখান থেকে পালানো যেত তবে সে বাঁচতো।অথচ পালানোর উপায় নেই!

চা নিয়ে এলো মিনা।গুনগুন তার হাতে চা পাঠিয়েছে। আজ সে আসেনি, কখনোও আসে না, সে আড়ালে চলে গেছে। সেই প্রথম থেকেই। ওয়াসিয়াত ভাবে ‘কিন্তু কেন?’
তার মনে কি ছিল তো তা কেউ জানতো না।তাহলে সে আড়ালে কেন?তার মনেও কি অপরাধবোধ আছে ঠিক ওয়াসিয়াতের মতো?

ওয়াসিয়াত ওপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। আজকাল তার বিশ্রী একটা সমস্যা শুরু হয়েছে।মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া। সমস্যা টা আজকাল নিয়মিত হচ্ছে। প্রতিদিন মধ্যরাতে হুট করেই ঘুম ভেঙে যায়। তারপর আর ঘুম আসতে চায় না। তখন সে নিজের জন্য খুব যত্ন করে এক কাপ কড়া লিকারের চা বানায়। চা নিয়ে সোজা ছাদে চলে যায়।সেখানে ঘন্টা দেড়েক বসে থেকে ফজরের আযানের অপেক্ষা করে। আযান হয়ে গেলে নামায পড়ে এসে সে বিছানায় শোয়।তখন আর ঘুমাতে কোন অসুবিধা হয় না। শোয়া মাত্রই চোখে ঘুম জড়িয়ে যায়। আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। না মাঝরাতে না আজ একটু আগে ভেঙেছে।এখন রাত বাজে দেড়টা।ওয়াসিয়াত উঠে বসল।এভাবে শুয়ে থেকে কোন লাভ নেই। এক কাপ চা খাওয়া এখন অতীব জরুরি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ওয়াসিয়াত সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ছাদে এক পা রেখেই সে ওপরে তাকালো।আকাশে মস্ত বড় রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে।রাতের গভীরতার সাথে সেই চাঁদের আলোও বেড়েছে। ফলস্বরূপ সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আরো কয়েক পা এগিয়ে চিলেকোঠার ঘরের সামনে এসে ওয়াসিয়াত দাঁড়িয়ে পড়লো ।চোখ দুটো গিয়ে স্থির হলো ছাদের একেবারে শেষ মাথায়। একজোড়া কপোত-কপোতী সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা দু’হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে,মেয়েটা সে কথার সাথে তাল মিলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠছে। মানুষ দুটো কে চিনতে তার বেশি সময় লাগলো না।দূর থেকে দেখে কতটা সুখী মনে হচ্ছে তাদের !
ওয়াসিয়াতের চোখ সরিয়ে নিল । ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে হেটে সে নিচে নেমে এলো।

সকালে ওয়াসিয়াত তাড়াহুড়ো করে নাস্তা খেয়ে উঠে পড়লো।কাল সে চলে যাবে তাই আজ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা । কিন্তু সদর দরজা পর্যন্ত এসেই তাকে থামতে হলো। সেলিনা হক দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ওয়াসিয়াত কে দেখেই তিনি হাসলেন, স্নেহের দৃষ্টিতে ওয়াসিয়াতের দিকে তাকালেন। বহুদিন হলো ছেলেটাকে তিনি দেখেন নি।কুশল বিনিময় শেষে তিনি বললেন, ‘কোথাও যাচ্ছিলে ওয়াসিয়াত? চাইলে এখনো যেতে পারো।’হাতে থাকা বক্স টা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু এটা দিতে এসেছিলাম। ‘

ওয়াসিয়াত হেসে বলল, ‘যেখানে যাচ্ছিলাম সেখানে পরেও যাওয়া যাবে চাচি। আপনি আসুন।’
ওয়াসিয়াত বসার ঘরে সেলিনা কে নিয়ে বসলো।

সেলিনা হাতের বক্সটা ওয়াসিয়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও ওয়াসি, এটা তোমার জন্য বানিয়ে ছিলাম।ছোট বেলায় তো তুমি এই পুডিংয়ের জন্য পাগল ছিলে।’

ওয়াসিয়াত সেলিনার সামনেই বক্স খুলে পুডিং খাওয়া শুরু করলো । সেলিনা জোড়ে নিশ্বাস ফেললেন।ছেলেটা হয়তো জানে না তিনি তাকে ঠিক কতটা স্নেহ করেন। ছোট বেলায় সে যখন সেলিনার পেছন পেছন রান্নাঘরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো। তখন সেলিনার খুব হাসি পেত সেই সাথে ভালোও লাগতো। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেই সে বলতো, ‘আমার নাড়ু চাই।’
সেলিনা কাঁচের বোয়াম থেকে নাড়ু বের করে তার হাতে দিতেন।নাড়ু নিয়ে সে একদৌড়ে কিছুটা চলে গিয়ে আবার ফিরে আসতো। ফের চোখ বড় বড় করে তাকাতো।সেলিনা চোখ ঘুরিয়ে বলতেন, ‘আবার কি হলো, হুম?’

মুখ গম্ভীর করে খানিক ভেবে সে বলতো-‘চাচি, আমি বেশি সুন্দর নাকি তুমি? ‘

সেলিনা তাকে কোলে নিয়ে দু’গালে চুমু খেয়ে বলতেন, ‘অবশ্যই তুমি বেশি সুন্দর। তোমার মতো এমন বড় বড় চোখ, ফোলা ফোলা গাল আর এরকম আদুরে মুখ কি আমার আছে? ‘

-‘তাহলে যে চাচ্চু বলে তুমি বেশি সুন্দর?’

-‘তোমার চাচার মাথার ব্যমো।কি বলতে কি বলে কিচ্ছু ঠিক নেই।তাই ওর কথা একদম বাদ।মনে থাকবে তো? ‘

ওয়াসিয়াত গম্ভীর হয়ে ডানে বামে মাথা নাড়ঁতো।

পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে রয়েছে। ওয়াসিয়াত বারান্দায় বসে আছে। তাকিয়ে আছে বিশাল পিঙ্গল বর্ণের আকাশ টার দিকে।রৌদ্রজ্বল বিকেলের শেষভাগে আকাশ দেখার মতো আনন্দ বোধহয় আর কিছুতেই নেই। কোথায় যেন শুনেছিল আকাশ দেখলে নাকি মন বড় হয়।তবে আকাশের বিশালতা বোঝার জন্য মনেও আকাশ থাকা প্রয়োজন। যার মনের আকাশ যত বড় তার দৃষ্টির সীমানাও তত বিশাল।

তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ শুনে ওয়াসিয়াত ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো । উঁকি দিয়ে দেখলো জোহড়া খানম আসছেন তার কোলে জয়।জয় শাহাদাতের ছেলে। বয়স মাত্র আট মাস।

জোহরা খানম বারান্দায় এসে ওয়াসিয়াতের পাশের চেয়ারে বসলেন।ওয়াসিয়াত কে দেখা মাত্র জয় ফাঁকা দুই মারি বের করে হাসলো।জোহরা খানম কিছু না বলে হুট করে তাকে ওয়াসিয়াতের কোলে বসিয়ে দিলেন।ওয়াসিয়াত ঠিক করে কোলে নিতে পারলো না। তার কেবলই মনে হতে লাগলো বাচ্চাটা এক্ষুনি তার কোল থেকে পড়ে যাবে, নাহয় তার বেখেয়ালে সে ব্যাথা পাবে।এসব ভেবে তাকে খুব চিন্তিত দেখালো।ওদিকে জোহরা খানম পাশের চেয়ারে বসে কিছু একটা বলবেন ভেবে ইতস্তত করতে লাগলেন ।

চলবে…….
অদ্রিজা আহসান

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here