প্রহর শেষে
পর্ব-১২
সেই কালো রাতটা কেটে গেল ঠিক তবে আধাঁর ফুড়াঁলো না।কৃষ্ণপক্ষের ভীষণ অন্ধকার রাত্রি গুলি নামলো তার পরে।
বিশাল সাদা বাড়িটা আজ আলোয় আলোয় রাঙা।লাল,নীল আলোর জোয়ারে রাতটা যেন দিনের মতোই উজ্জ্বল হতে চলেছে।
জোহরা খানমের মেজাজ একটু খারাপ ।মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তিনি সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছেন । বিরক্তির কারণ হলো সন্ধ্যা থেকেই ওয়াসিয়াত লাপাত্তা! জোহরা খানম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন।তার এই সর্ব কণিষ্ঠ ছেলেটির বুঝি কোনো দিনও আর বুদ্ধি হবে না। বড় ভাইয়ের বিয়ে অথচ তার কোন খোঁজ নেই। জোহরা খানম ফের ওয়াসিয়াত কে কল করলেন। রিং হচ্ছে, তবে জোহরা খানম নিশ্চিত যে এবারো তার গুনধর পুত্র ফোন কানে তুলবে না।
কিন্তু, ওয়াসিয়াত কল রিসিভ করলো। অত্যধিক রেগে গিয়ে জোহরা খানম ছেলেকে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন। কোনো প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অবশেষে জানতে চাইলেন সে কোথায় আছে।ওয়াসিয়াত জানালো সে আশেপাশেই আছে তবে রাতটা সে এখানে থাকতে পারবে না। বন্ধুর বাড়ি থাকবে।
ঝুম বৃষ্টি, ওয়াসিয়াত দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সামনে। সে চলে যেতে চাইছে কিন্তু পা’দুটোর কি যেন হয়েছে, নড়ছে না। চোখেও বোধহয় কোন একটা সমস্যা হয়েছে। চোখ শুধুই ভিজে যাচ্ছে সেইসাথে ক্রমাগত পানি পড়ে যাচ্ছে। এমন কেন হচ্ছে? ছেলে হয়ে সে কেন কাঁদছে?
ওয়াসিয়াত মাথা নিচু করে চোখ মুছে ফেললো, এতটা সন্তর্পণে যে সে নিজেও বোধহয় টের পেল না।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে মেঘের পর মেঘ জমতে শুরু করেছে। ওয়াসিয়াত ফের একবার বাড়ির দিকে তাকালো। সেদিকে তাকিয়ে সে বলল,’আজ থেকে তোমার জন্য আমি নিখোঁজ হলাম, গুনগুন। তোমার পৃথিবীর কোথাও আর আমাকে খুঁজে পাবে না।’সে ফিসফিস করে বলল,
তোমার পৃথিবীতে বসন্ত আসুক,
ভ্রমর বসুক ফুলে ফুলে;
জোনাকিরা সাক্ষি থাক ভালোবাসার,
জড়িয়ে নিক মেঘের চাদরে।
আমার পৃথিবী আধার কালোয়,
গুম হয়ে যাওয়া রাত;
ডুবে যাওয়া অতলে নির্বাক হয়ে থাক।
ওয়াসিয়াত চোখ ফিরিয়ে নিল।সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। চোখে ভীষণ জ্বালা করছে।প্রেয়সী যখন লাল শাড়ী পড়ে, খোপায় গাজঁরা আর হাতে মেহেদী দিয়ে অন্য কারো অপেক্ষায় থাকে, সে দৃশ্য কি সহ্য হয়?
রাস্তায় স্ট্রিট লাইট নেই।আঁধার চারদিক থেকে ঘিরে আসছে। ওয়াসিয়াত বড় বড় পা ফেলে রাস্তায় নেমে পড়লো।এবং মূহুর্তেই আঁধারে হারিয়ে গেল।
শহর জুড়ে নিরবতা। ব্রম্মপুত্র নদীর ওপর দিয়ে হিম শীতল বাতাস বইছে। ওয়াসিয়াত দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজের ওপর।তার পেছনেই নদীর ধারে গড়ে ওঠা চমৎকার একটা শহর।তার নিজের শহর। অথচ আজ কত অচেনা লাগছে! রাত্রির গভীরতায় পরিচিত পৃথিবীকে এতো অচেনা লাগে, ওয়াসিয়াতের জানা ছিল না।ওয়াসিয়াত জোরে নিশ্বাস ফেললো। সেই নিশ্বাসের সঙ্গে বেরোলো নিকোটিনের ছাই রঙা ধোঁয়া।
দীপু হাটতে হাটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে সে চেনে।সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ওয়াসিয়াত ঘুরে দাঁড়ালো।
ওয়াসিয়াত আর দীপু পাশাপাশি হাটছে।তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। নিকোটিনের ধোঁয়ায় তার চারদিক ঘিরে আছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় দীপুর কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। ওয়াসিয়াত কে সে কখনোই সিগারেট খেতে দেখেনি।অথচ আজ তাকে মনে হচ্ছে চেইন স্মোকার।একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই চলেছে। তার মুখ ভর্তি ধোঁয়া।দীপু কিছু একটা বলতে চাইছে। কিন্তু ওয়াসিয়াতের অবস্থা দেখে ভয়ে মুখ ফুটে বলতে পারছে না।অনেকটা পথ তারা হেটে এসেছে। পথটা তার অচেনা। অবশেষে সে মুখ ফুটে বলল,’ভাই, কিছু কি হয়েছে? ‘
ওয়াসিয়াত উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে হাসলো। দু’দিকে মাথা নাড়লো। কিছু হয়নি।
দীপু আবার বলল,’ইয়ে ভাই, এইবার থামেন, চলেন বাড়ি যাই,রাত তো অনেক হলো। ‘
ওয়াসিয়াত ঘুরে দাঁড়ালো। তা দেখে দীপুও ঘুরে হাটতে শুরু করলো। কিছুটা হেটে হঠাৎ তার খেয়াল হলো। পেছন ফিরে দেখলো ওয়াসিয়াত এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। দীপু আবার উল্টো দিকে হেটে কাছে গিয়ে ওয়াসিয়াত কে বলল,’কি হল ভাই,দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি যাবেন না?’
-‘উহু, তুই চলে যা।’
-কিন্তু, ভাই আপনি……. ‘
-‘যা।’
দীপু দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হেটে যেতে লাগলো।
___________________________________
ট্রেনের গতি বাড়ছে। রাতের ট্রেন গুলো বোধহয় সবসময়ই দ্রুত গতিতে চলে।দেহটাকে তো তিস্তা এক্সপ্রেসের কামরায় চাপানো গেছে।কিন্তু মন? সে কোথায় পড়ে আছে তা ওয়াসিয়াতের অজানা।ওয়াসিয়াত জানালা ঘেঁষে বসে আছে ।আজও আকাশে চাঁদ নেই।আজ অবশ্য কৃষ্ণপক্ষ নয়।কিন্তু মেঘেদের দল চাঁদকে দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ একদমই দিচ্ছে না।সে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইল।
-‘চা খাবেন,স্যার ?’
ওয়াসিয়াত চোখ মেলে তাকাল।ছোট্ট একটা মেয়ে এই রাতের ট্রেনে চা বিক্রি করছে।তবে মেয়েটির দু’চোখে ভয় নেই।সেখানে শুধুই বিষ্ময়!
ওয়াসিয়াতের মায়া হলো।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে চা দিতে বলল।একসময়’ এই রাতের ট্রেন জার্নি আর চা ‘ভাবতেই তার শিহরণ হতো। আজ কোন অনুভূতিই হচ্ছে না। সে বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকালো। কি নিখুঁত ভাবে সে চা বানাচ্ছে। হঠাৎ ওয়াসিয়াত থমকে গেল।চোখ ভিজে এলো, মেয়েটির চিবুকের বা’পাশে একটা বড় কালো তিল দেখে। গুনগুনের ও ঠিক এইখানে একটা তিল আছে । যখন সে হাসে, হাসির ভাজে তিলটা পুরোপুড়ি অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন তার মুখটাও খুব অন্যরকম দেখায়।সেই হাসি দেখলে ওয়াসিয়াতের বুকে কেমন যেন ব্যাথা হয়, হারানোর ব্যাথা।
এই মেয়েটিও কি সেভাবেই হাসে?সে হাসলে তার চিবুকের তিলটাও কি এভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়?
-‘চা নেন।’
ওয়াসিয়াত হাত বাড়িয়ে চা নিল।চায়ের দাম পরিশোধ করা মাত্রই মেয়েটা ভীরের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওয়াসিয়াত মাথা নিচু করে বসে রইল। যে ছেলেটা নিজে সবসময় হাসে,পাশের মানুষটাকে দুঃখ ভুলে হাসতে শেখায় আজ সে কেন এতো দুঃখী!
_______________
কথায় আছে ‘যতবার হৃদয় ভাঙে,মানুষ ততবার আরও বেশি প্রেমিক হয়ে ওঠে। ‘
হৃদয়ের এই ভাঙা-গড়ার খেলায় কি ওয়াসিয়াতও আরও বেশি প্রেমিক হয়েছে? কে জানে!
নিজেকে হারিয়ে ফেলে, সমস্ত শাসন অমান্য করে চোখের জল গড়িয়ে পড়লে কি প্রেমিক হওয়া যায়? যদি যায় তবে ওয়াসিয়াত নিশ্চয়ই প্রেমিক হয়েছে।কিন্তু সেই সাথে হয়েছে ভীষণ রুক্ষ।আচরণে এসেছে কঠোরতা আর গাম্ভীর্য।সেই ছেলেমানুষী ওয়াসিয়াত আর আজকের ওয়াসিয়াতের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।সে বদলেছে খুব ধীরে ধীরে। ফলাফল তার এই পরিবর্তন সবার দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে।
ঢাকায় ফিরে এসেই ওয়াসিয়াত ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল।বলা যায় নিজেকে সে ব্যাস্ততার মাঝে আড়াল করে নিয়েছিল।এখন পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। জীবনে সফল হওয়ার চেষ্টায় সে এখন মরিয়া।পেছনের দিনগুলো ভুলে সে এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
জোহরা খানম কিছুদিন যাবৎ বাড়ি যাওয়ার জন্য ওয়াসিয়াত কে খুব তাড়া দিচ্ছেন। ফোন এলে ওপাশের মানুষটার কথাই সে শুনে যায়।এপাশে শুধুই নিরবতা। কারণ মিথ্যে কথায় সে বরাবরই কাঁচা।
প্রতিবারই নানান কথা বলে সে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপার টা এড়িয়ে যায়। কিন্তু এইবার জোহরা খানম ফোন দিয়ে খুব কান্নাকাটি করলেন।অনুরোধ করে বললেন বাড়ি আসতে।ওয়াসিয়াত নিরব থাকলো।যেতে পারবে না বলতেই জোহরা খানম রেগে গেলেন।নানান জেরা শুরু করলেন। বললেন তিনি আর কোন অজুহাত শুনতে রাজি নন।ওয়াসিয়াত বুঝলো তার অসুস্থ মা খুব কষ্টে আছে।আর মা কষ্টটা পাচ্ছে শুধু তারই জন্য।নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে মায়ের সাথে তার বিশাল একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে।যে দুরত্ব খুব তাড়াতাড়ি মেটানো দরকার।
দীর্ঘদিন পর ওয়াসিয়াত আবার সেই তিস্তা মেইল এ উঠলো। ইরশাদ আর গুনগুনের বিয়ের পর ও-বাড়ি আর সে যায় নি।ওয়াসিয়াত যখন ট্রেনে উঠল তখন বিকেল।পৌষ মাস,সন্ধ্যা নামার আগেই চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে। সূর্যের ফিকে আলো ক্রমেই লাল বর্ণ ধারন করছে।অপুর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা সময় । এমন আবহাওয়ায় চাইলেও কখনো মন খারাপ করে থাকা যায় না।কিন্তু ওয়াসিয়াতের মন ভীষণ খারাপ। বুকে রীতিমতো ঝড় হচ্ছে।ওয়াসিয়াত গুম মেরে বসে রইল। আজকাল এই কাজটা সে খুব ভালো শিখেছে।
জোহরা খানম বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন।ছোট-খাট কোন শব্দ হলেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছেন।যদিও তিনি জানেন ওয়াসিয়াতের ফিরতে এখনো ঢের দেরি।তবু মন মানছে না।ওয়াসিয়াত কেন বাড়ি আসে না,সে কারণ তার অজানা।তবে সে যে আর আগের ওয়াসি নেই তা তিনি ভালো করেই বোঝেন।তিনি ভেবে পান না কি এমন ঘটলো যার জন্য ছেলেটা এভাবে বদলে গেল।ছেলেমানুষী ছেড়ে গম্ভীর স্বভাবের হয়ে গেল।আগের ওয়াসি’র তার মায়ের জন্য কতো ভালোবাসা ছিল।আর এখন তাকে মিথ্যে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে বাড়ি আনাতে হয়।
চলবে…….
অদ্রিজা আহসান