প্রহর শেষে

পর্ব-১০
ওয়াসিয়াত বাড়ি পৌঁছালো মধ্যরাতে।ফ্রেশ হয়ে কোনরকম দুটো খেয়ে সে ঘুমাতে গেল।

ঘুম ভাঙলো বেলা ১২টার পর।বাড়ির আবহাওয়া উৎসবমুখর, সকলেই খুব খুশি মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে । ওয়াসিয়াতেরও মন খুব ভালো ছিল । সে ওপর থেকে নেমে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো। প্রিয়াকে দেখে বলল,’ভাবি, চা হবে এক কাপ? ‘

প্রিয়া হেসে বলল,’শুধু চা কেন? চা’য়ের সাথে টা’ও আনছি। তুমি বসো,কথা আছে।’

ওয়াসিয়াত মুচকি হেসে বলল,’কি ব্যাপার ভাবি,জরুরি নাকি?’

প্রিয়া গম্ভীর হয়ে বলল,’হুম,ভীষণ জরুরি।’

কিছুক্ষণ পরই চা-নাস্তা নিয়ে সে হাজির হলো। ওয়াসিয়াত মুখে সিরিয়াস ভাব এনে বলল,’ভাবি,কি কথা জলদি বলুন, আমার তো ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। ‘

প্রিয়া একটু নড়েচড়ে বসলো। মুখে গম্ভীর ভাব এনে বলল, ‘মজা করো না ওয়াসি, ভীষণ জটিল ব্যপার। ‘

ওয়াসিয়াত আবারো হেসে ফেললো। আজ তার শুধুই হাসি পাচ্ছে।বলল,’তাই নাকি?’

প্রিয়া প্রায় ফিসফিস করে বলল,’হুম,সামনেই তোমার ভয়াবহ বিপদ! ‘

তার সাথে তাল মিলিয়ে ওয়াসিয়াতও ভুরু জোড়া কুচকে প্রায় ফিসফিস করে জানতে চাইলো ,’কি বিপদ ভাবি? ‘

-‘তোমার প্রতিদ্বন্দির রণাঙ্গন তো পরিবর্তন হচ্ছে। ‘

-‘মানে? ‘

-‘আরে বুঝলে না, শত্রু পক্ষ তো এবার বাড়িতেই ঘাটি গাড়ছে। আর তাকে দাওয়াত করে আনছে সয়ং তোমার মা-বাবা! ‘

ওয়াসিয়াত ভুরু জোড়া আরও কুচকে গেল, সে হতাশ চোখে প্রিয়ার দিকে তাকালো ।সে কিছুই বোঝেনি। তার এই নির্বুদ্ধিতা দেখে প্রিয়া মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’বোঝ নি?

ওয়াসিয়াত মাথা নাড়লো।প্রিয়া কিছু বলতেই যাচ্ছিল।সে সময় সিঁড়ি দিয়ে শাশুড়িকে নিচে নামতে দেখে বলল,’ওই যে, আম্মা আসছেন এবার তিনিই বলবেন। ‘

____________
‘দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার,
এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে’
সত্যিই কি সবসময় দিনের ভাঁটার শেষে রাতের জোয়ারেরা কালো জল নিয়ে আসে? ঠিক সুখের পর দুখের মতো? তাদের কি আসতেই হয়?ওয়াসিয়াত ভেবে পায় না।

সেই নরম আলোয় ঘেরা সকালে মা যখন অতবড় কঠিন কথাটা বলল তখন ঠিক কি করা উচিত তা-ও সে ভেবে পেল না। অবশ্য কথাটা বুঝতেই তার অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল। সবকিছু বোঝার পর স্বাভাবিক ভাবে তার খুব চিৎকার চেচামেচি করা উচিৎ ছিল অথচ সে কিছুই করে নি।চুপচাপ উঠে ওপরে চলে এলো।

গুনগুনের বিয়ে! যার তার সাথে নয়।এ বাড়ির ই মেঝো ছেলের সাথে। এসব কথা জোহরা খানম বলছিলেন খুব হেসে হেসে। তার চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে। বললেন গুনগুনকে তিনি এই পরিবারের সদস্য করতে চান। সে এ-বাড়িরই মেয়ে, তবে এবার কাগজে-কলমেও প্রমাণ থাকবে।
এরমধ্যেই আলাপ-আলোচনা হয়ে গেছে, দু’বাড়ির সবাই রাজি।
কথা গুলো বলার সময় জোহরা খানমের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটা সত্যি হতে যাচ্ছে, এতো আনন্দ তিনি কোথায় রাখবেন!

ওয়াসিয়াতের মনে হচ্ছিল গলার কাছে শক্ত কি একটা জমাট বেঁধে আছে। সে শ্বাস নিতে পারছে না। পা দুটো টলছে। কোনমতে সে ঘরে এসে পৌঁছালো।দুচোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল ।যে পথচলায় শুরুর আগেই সমাপ্তির সুর বেজে ওঠে তাকে কি বলে?

মা বলছিলেন সবাই রাজি। তার মানে গুনগুনও……।
অথচ ফেরার পথে সেই মধ্যরাতে, ট্রেন এ বসে সে কত কিছুই না ভেবেছিল!ভেবেছিল তার আর গুনগুনের ছোট্ট একটা সংসার হবে। তাদের সেই সংসারের নাম হবে ‘খুনসুটি সংসার’।সারাদিন তারা দুজন ঝগড়া করবে। সে সারাক্ষণ গুনগুনের পেছনে লাগবে আর তাকে খেঁপাবে।গুনগুন তখন কোমড়ে আঁচল বেঁধে তার সাথে ঝগড়া করতে আসবে , রেগে গিয়ে এটা ওটা ছুড়ে মারবে।প্রচন্ড রেগে গুনগুনের চোখে যখন পানি চলে আসবে, নাকের ডগা লাল হয়ে যাবে, ঠিক তখন সে গুনগুনের রাগ ভাঙাবে। তাদের ভালোবাসা হবে কম,ঝগড়া হবে বেশি।
অথচ কি থেকে কি হয়ে গেল!ওয়াসিয়াত হাত বাড়িয়ে বেড সাইট টেবিলে রাখা এলার্ম ক্লক’টা ছুড়ে ফেলে দিল।বিশ্রী শব্দ করে সেটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে দরজার সামনে পড়লো। এমনটা কি কখনো হওয়ার কথা ছিল?

সে চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ফেললো। সেই নিশ্বাসে বিষন্নতা আর অসহ্য যন্ত্রণা মিশে একাকার ।কিছুটা স্বস্থিও বোধহয় আছে!
ভাগ্যিস গুনগুন এসবের কিছু জানে না। যা জানানো হয়নি আর কখনোই তা কাউকে সে জানতে দেবে না।গুনগুন এসব জেনে গেলে সে হতো হাসির পাত্র,ভাইয়ের স্ত্রী তো গুনগুন হতোই,ওপর থেকে সে তাকে ঘৃণার চোখে দেখতো।বিচ্ছেদ সহ্য হয়, কিন্তু প্রিয়জনের ঘৃণা…. সে কি সওয়া যায়?

গুনগুনের ওপর তার রাগ নেই, রাগ হবার কোন কারণও বোধহয় নেই।যদি সে রাজি হয়ে থাকে তবে অবশ্যই ঠিক কাজ করেছে। ইরশাদ হলো সেই ধরনের ছেলে যাকে মেয়েরা এক কথায় বিয়ে করতে চায়।ইরশাদের ব্যক্তিত্ব তাকেও ছোট থেকে মুগ্ধ করতো, সেই সাথে কিছুটা হিংসাও বোধহয় ছিল । কারণ সর্বদা নির্লিপ্ত থাকার পরও প্রাপ্তিটা খাতায় ইরশাদেরই সঞ্চয় বেশি ।ঠিক আজ যেমন হচ্ছে। ঘন মেঘে আচ্ছাদিত বিশাল আকাশটার দিকে তাকিয়ে ওয়াসিয়াত বলল-

আমার উঠোন জোড়া চাঁদের আলো,
তোমার প্রেম মন ভাঙালো,
আমার মেঘলা দিনে একলা বসে থাকা,
যত্ন করে তোমায় আড়াল রাখা,
স্বপ্ন গুলো মেঘে ঢেকে রাখা,
তবুও জিজ্ঞাসা..
উত্তরেরা নির্বাক হয়ে রয়,
আমি ভাবি
কেন এমন হলো, কেন এমন হয়?

__________
সকালে খেতে বসে ওয়াসিয়াত কে দেখে শাহাদাত হেসে বলে উঠল,’কিরে, এতো গম্ভীর কেন,খবরটা শুনেছিস তো নাকি?’
ওয়াসিয়াত নিচের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,’হুম শুনলাম, তোমার পর এবার মেঝোভাইও স্বেচ্ছায় কারাবরণ করছে। ‘

তার কথা শুনে শাহাদাত হো হো করে হেসে উঠল। বলল,’সে আর বলতে। এরপরই কিন্তু তোর সিরিয়াল, মনে আছে তো?’

ওয়াসিয়াত কিছু না বলল না, নিঃশব্দে উঠে চলে গেল।

_____________
গুনগুন ছাদে বসে আছে। শ্রাবণ মাসের দুপুর। আকাশ মেঘলা। মেঘলা দুপুরে সবকিছুই অন্যরকম লাগে।ক্লান্ত আর বিষন্ন দুপুর গুলোতে সে ছাদে বসে থাকে।কিন্তু আজকের দুপুর শুধু ক্লান্তির না তারও উর্ধ্বে, অথচ এ-ছাড়া আর কোন একলা বসে থাকার জায়গা তার নেই।
গুনগুন কাঁদছে। সে কাঁদছে তার নামের মতোই গুন-গুন করে। মাঝে মাঝে শুধু ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।কি হচ্ছে, আর এরপরই বা কি হবে তা তার অজানা।

-‘গুনগুন…’
মায়ের ডাক শুনে গুনগুন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাড়াঁলো।চেয়ে রইল লোহার সিঁড়ির দিকে। সেদিক থেকে কারও আসার চিহ্ন না দেখে সে নিজেই নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।

রাতের আঁধার গাঢ় হয়েছে। সেলিনার ঘরের বাত্বি নেভানো।গুনগুন ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। তিনি বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিলেন।হুট করে কেউ একজন জড়িয়ে ধরেছে। সেলিনা সচকিত হলেন। গুনগুন নড়লো না।মায়ের বুকে মুখ গুজে পরে রইলো।সেলিনা মেয়ের এহেন আচরণে অবাক হলেন।

বললেন, ‘গুনি মা, কি হলো তোমার, মন খারাপ? ‘
মাঝে মাঝে আহ্লাদিত হয়ে তিনি মেয়েকে তুমি সম্মোধনে ডাকেন।

গুনগুনের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। সে কিছু বলল না।শুধু আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।তার শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠতে লাগলো। দুজনের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সেই গাঢ় আঁধারে ঢাকা রাতে, থেমে থাকা সময়ে মা-মেয়ের মাঝের সমস্ত অভিমানের দেয়াল ভেঙে পরলো।

দিনটি ছিল শুক্রবার। ‘আষাঢ়ের তৃতীয় দিন’ তবুও আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। গুনগুন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে।একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে দেখলো তাদের ছোট্ট ঘর ভর্তি লোকজন। একসঙ্গে এতো মানুষ দেখে সে কিছুটা ভয় পেল।মা কে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির শেষ মাথার ঘরটায় এসে দাড়িঁয়ে পড়লো। মা বিছানায় শুয়ে আছেন, তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। ভীড়ের কারণে সে কাছে যেতে পাড়লো না। কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনের বড় আম গাছ টার নিচে এসে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে যেন ওয়াসিয়াত দৌড়ে এলো। তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। গুনগুন সেদিকে খেয়াল না করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মার কি হয়েছে ওয়াসি ভাই? আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি বাবার কাছে যাব।বাবাকে ডাক।’
বলেই সে আবার কান্না শুরু করলো। ওয়াসিয়াত নিজের চোখ মুছে তার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,’ গুনগুন তুমি আর কেঁদো না, কাঁদলে মা আর ঠিক হবে না।তুমি কি তাই চাও?

গুনগুন মাথা নেড়ে না জানালো।
-‘তাহলে আর কাঁদবে না।’গুনগুনের কান্না তবুও পুরোপুরি থামলো না।সে আস্তে আস্তে বলল,’বাবা কোথায়?’

ওয়াসিয়াত তার মাথায় হাত রেখে বলল,’বাবার একটু অসুখ করেছে তো তাই হাসপাতালে গেছে, অসুখ সাড়লেই তোমার বাবা ফিরে আসবে। ‘

কিন্তু বাবা আর ফিরলেন না।মাও ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করলেন। খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। গুনগুনের খেয়াল খুব একটা রাখতেন না।গুনগুন দিনের বেশির ভাগ সময় থাকতো বড় চাচার বাড়ি।সে বেড়ে উঠতে লাগলো চাচা-চাচির কাছে।জোহরা খানমও তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন।তখন থেকেই ওয়াসিয়াত তার নিত্ত সঙ্গী হলো। ছায়ার মতোই পেছনে লেগে থাকতো। গুনগুনকে কেউ ছুলেই যেন তার গায়ে আগুন জ্বলে উঠত।সবাই কে বলে বেড়াতো গুনগুন তার খেলনা।সত্যিই গুনগুন তার শৈশবের সবচেয়ে প্রিয় খেলনা ছিল!

চলবে………।
অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here