প্রহর শেষে

পর্বঃ৫
গুনগুন আর ভাবতে চায় না। ভাবতে পারছেও না।ওয়াসিয়াত তার চাচাতো ভাই। তার সাথে খুব মেশে,আগলে রাখে ঠিকই তবে সে কখনোই তাকে অন্য নজরে দেখে নি।ওয়াসিয়াতের দায়িত্ববোধ কে সে যদি অন্য কিছু ভাবে তাহলে তা খুব অন্যায় হবে। তাছাড়া সে ওয়াসিয়াতের ধারে কাছেও নয়।তাই তার প্রতি ওয়াসিয়াতের কোনো অনুভূতি কখনোই থাকতে পারে না।

গুনগুন ছোট একটা নিশ্বাস ফেললো। সে তো ওয়াসিয়াতের যোগ্যই নয়।
ওয়াসিয়াত সুদর্শন, বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী।কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। যে কোন মেয়েই তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। হঠাৎ গুনগুনের চোখে ভেসে উঠলো অরিনের কথা বলতে গিয়ে ওয়াসিয়াত কেমন লজ্জা পাচ্ছিল। তখন তাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল।
সে নিশ্চয়ই অরিনকে পছন্দ করে?
পছন্দ করবে এই তো স্বাভাবিক। তার পাশে অরিনের মতো মেয়েকেই তো মানায়। খুব স্মার্ট, সুন্দরী আর বুদ্ধিমতি মেয়ে।

আর সে………….?
সে,তো কোন দিক থেকেই ওয়াসিয়াতের যোগ্য নয়। এই ছোট একতলা বাড়িটা তাদের শেষ আশ্রয়। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা সবকিছু একা হাতে সামলেছেন।
মায়ের টিউশনি আর বড়মামার দেওয়া আর্থিক সাহায্যে তাদের দিন ভালোভাবেই পার হয়ে যায়।

ওয়াসিয়াতদের বাগান ওয়ালা বিশাল দোতলা বাড়ির কাছে তাদের এই ছোট বাড়িটা কিছুই নয়।
গুনগুন চোখ বুজে বসে রইল। নিজেকে ধিক্কার জানালো।এসব কি ভাবছে সে!
ওয়াসিয়াত শুধুই তার চাচাতো ভাই। সে এসব চিন্তা মাথা থেকে তৎক্ষনাৎ ঝেড়ে ফেললো।তবে সেটা কতক্ষণ স্থায়ী হবে সে জানে না।

সেদিনের পর থেকে ওয়াসিয়াতের সাথে তার দেখা হলেই অরিনের কথা ওঠে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় গুনগুন নিজেই জানতে চায়। ওয়াসিয়াত শুধু বলে মাঝে- মধ্যে কথা হয়।তবে তাদের সম্পর্কটা এগিয়েছে কিনা আর এগোলেও ঠিক কতটা, হাজার চেষ্টা করেও গুনগুন সেটা জানতে পারে নি।

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে । গুনগুন এখন টেন’এ পড়ছে। পড়ালেখার অনেক চাপ।আজকাল আর গুনগুনের ও’বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না।প্রাইভেট-কোচিং শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়ে যায়। ফিরে এসেই সে খেয়ে ঘুম দেয়।সেই ঘুম ভাঙে রাত ১২ টার পর।তারপর আবার পড়তে বসা।ফলে তার আর ওই বাড়ি যাওয়া হয় না।

সন্ধ্যার পর মাঠে খেলে বাড়ি ফেরার পথে ওয়াসিয়াত মাঝে মাঝে আসে। কিন্তু গুনগুনের সাথে তার দেখা হয় না। কারণ তখন গুনগুন বাইরে থাকে নয়তো নিজের ঘরে ঘুমে বিভোর।বলা যায় কিছুটা ইচ্ছে করেই গুনগুন তাকে এড়িয়ে চলে।

নিজের সাথে নিজে নানা তর্ক-বিতর্কের পর গুনগুন একটা যুক্তি দ্বার করিয়েছে।ছোট বেলা থেকে একসাথে খেলাধুলা, ঝগড়া এসবের মাঝে হয়তো তার মনে ওয়াসিয়াতের প্রতি একটা দুর্বল অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। তবে ওয়াসিয়াতের দিক থেকে সে যে একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এটা বোঝার পরও মনে কোন অনুভূতি থাকা অন্যায়।তাই সে তাকে একটু এড়িয়ে চলে।

______________
শুল্ক পক্ষ চলছে। জোৎস্নার আলোয় চারিদিক ঝকঝকে পরিষ্কার ।গাছের পাতা পর্যন্ত চিকচিক করছে।খালি পায়ে গুনগুন ছাদে হাটছে।তার হাতে কফির মগ।

প্রশান্তির ঘুমের পর শরীরে একধরনের আলস্য হয়। সেই আলস্য কাটাতেই এই মাঝ রাত্তিরে তার কফি নিয়ে ছাদে আসা।

সেলিনা হক পাশে এসে দাঁড়ালেন।গুনগুন মায়ের দিকে তাকালো।জোৎস্নার মায়াবি আলোয় মায়ের হাসি মুখ দেখে সে মনে একধরনের প্রশান্তি অনুভব করলো। মায়ের জীবনের হাসির মুহূর্ত যে খুব কম।সে তাকিয়ে রইল। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মা হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠলেন।কি সুন্দর সে হাসি।কিশোরী মেয়েদের মতো চাঞ্চল্য সেই হাসিতে।
তিনি রুপালি থালার মতো চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে বললেন -“গুনগুন, একটা সুখবর শুনবি?”

-“কি, মা?”

সেলিনা হক ফের মেয়ের দিকে তাকালেন।দু’হাত দিয়ে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন -“ইশ্ চুলে তেল-পানি কিছু দিস্ না? কেমন খসখসে হয়ে আছে। ”

গুনগুন কিছু বললো না। চোখ বুজে রইল।

-“তোর বড়মা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তুই তো ঘুমে বিভোর, তাই আমি একাই গিয়েছিলাম।
শাহাদাতের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ে ভাবির বাপের বাড়ির ওদিককার। ”

কথাটা শুনে গুনগুন প্রচন্ড খুশি হলো। তবে কিছু বললো না।মাথাও তুলল না।তার এখন কথা বলার মন নেই। সে কিছু বলবে না।কারণ মনের দাবি তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সেলিনা হক বললেন -“বিয়ের আর বেশি দেরি নেই বুঝলি,সামনের মাসেই বিয়ে ।”

_____________________
মীর্জা বাড়িতে গুনগুনের জরুরী তলব পরেছে।গুনগুন এবার আর ফাঁকি দিতে পারলো না। অগ্যতা তাকে যেতেই হলো। সেখানে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল । বাড়িতে হইহই-রইরই কান্ড।অসুস্থ শরীর নিয়েও জোহরা খানম আদা-জল খেয়ে নেমেছেন।এখান-ওখানে জিনিসপত্রের ছড়াছড়ি।ভৃত্যদের তিনি ক্রমাগত ঝাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন। বেচারাদের অবস্থা নাজেহাল।

প্রথমটায় তিনি অভিমান করে রইলেন। গুনগুনের সাথে কথা বললেন না।গুনগুনের এ’বাড়ি না আসাই সব রাগের কারণ। নানান কথা বলে সে বড়মার রাগ ভাঙালো।বোঝালো পড়াশোনাই না আসার কারণ। সেও তাদের খুব মিস করেছে। এ কথায় জোহরা খানমের মন ভিজলো ঠিকই তবে তিনি সাফ জানিয়ে দিলের শাহাদাতের বিয়ের আগ পর্যন্ত তাকে রোজ আসতে হবে। বিয়ে বাড়ির সব কাজ তো মেয়েদেরই। আর এ’বাড়িতে মেয়ে বলতে শুধু গুনগুনই আছে। তাই এখন আর কোন অজুহাত দেওয়া চলবে না।

বিয়ের বাকি আছে আরও সাত দিন। তবে এখনই বাড়িতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে।জোহরা খানম বরাবরই দূর্বল চিত্তের মানুষ। সকল বিষয়েই তিনি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক চিন্তা করেন।কিভাবে এতো কাজ শেষ হবে, শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ভাবে হবে কিনা, তার চিন্তার অন্ত নেই।আত্নীয়সজনরাও চলে এসেছে। ফলাফল বাড়িকে এখন মাছে বাজার বললেও খুব ভুল বলা হবে না।

বাড়ির প্রত্যেকেই কোন না কোন দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে।
আহসানউল্লাহ মীর্জা আছেন দাওয়াতের লিস্ট করার দায়িত্বে।ইতোমধ্যে তার একজন এসিস্ট্যান্টও জুটেছে । যে তাকে সর্বদা এই বিষয়ে বাণী দিয়ে যাচ্ছে, সেইসাথে সাহায্যও করছে।সেই এসিস্ট্যান্ট হচ্ছে গুনগুন। সে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়মিত এবাড়ি আসছে।
তবে দাওয়াতের লিস্ট বানানো, নাকি গল্প করা কোন কাজটা বেশি হচ্ছে সে বিষয়ে জোহরা খানম একটু দ্বিধায় আছেন।

কনের নাম প্রিয়া। দেখতে আহামরি সুন্দরী নয়।কিন্তু মুখটা মায়াবী, স্বভাবেও মার্জিত।
শাহাদাত এতদিন বিয়ের নাম শুনলেই পালিয়ে বেড়াতো। তবে এই মেয়েকে কোন এক কারনে তার পছন্দ হয়েছে। তাই কোন হাঙ্গামা ছাড়াই সে বিয়েতে রাজি হয়েছে।
নিজের বিয়ে বলে তাকেও কেউ ছাড় দিচ্ছে না। তার ঘাড়েও কাজ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভাইয়ের বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খাটুনি হচ্ছে ইরশাদের।স্বভাব মতো হাসি মুখে সে সব কাজ করে যাচ্ছে।

প্রায় সবাই যখন কোন না কোন কাজে ব্যস্ত সেখানে একজন শুধু নির্লিপ্ত। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে কে কি করছে তা দেখা আর কাজের ভুল খুঁজে বের করা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই। ।ওয়াসিয়াতের ভাষায় অবশ্য এটাই সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব।

বিয়ের যেহেতু আর বেশিদিন বাকি নেই। জোহরা খানমের সব চিন্তা এখন বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে । সবাই যেতে আগ্রহী। কিন্তু একাজে যাকে তাকে পাঠানো যায় না। আবার তিনিও শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেতে পারবেন না। তাই তিনি ডেকে পাঠালেন লায়লা কে।লায়লা আহসানউল্লাহ সাহেবের ফুপাতো বোনের পুত্রবধূ। তাদের দু’বাড়ি পরেই লায়লাদের বাড়ি।লায়লা খুব স্পষ্টভাষী আর মিশুক স্বভাবের মেয়ে। বিয়ের কেনাকাটার বিষয়ে তার জ্ঞানও অন্যদের তুলনায় একটু বেশি।
লায়লা এলো সন্ধের পর।সকল আলাপ-আলোচনার পর চলে যাওয়ার আগে লায়লা বললো –
” ফুফু’ তাহলে আমি আর শাহানা খালা কাল যাচ্ছি, এটাই ফাইনাল। ” বলে সে কিছুটা এগিয়ে যেতেই জোহরা খানম তড়িঘড়ি করে বললেন –
“লায়লা, ইয়ে তোমাদের সাথে গুনগুনকেও নিয়ো।”।

লায়লা মুচকি হেসে বললো -“কি ব্যাপার ফুফু,বাড়িতে তো এখন আপনার ছোট বোনেরা,তাদের ছেলে-মেয়েরাও রয়েছে। সবাই কে রেখে আপনি শুধু গুনগুনকেই নিতে বললেন। আপনার তো আরও দুটো ছেলে আছে। গুনগুনকে ছেলের বউ বানাবেন নাকি?”

জোহরা খানম হেসে ফেললেন। কিছু বললেন না। তবে একটা ব্যাপার মনে করে তিনি কিছুটা অসস্থি বোধ করলেন। কারণ এই একই কথা তিনি অন্য একজনের মুখেও শুনেছেন।তখন অবশ্য দিলরুবার কথাটা তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আহসানউল্লাহ সাহেবের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় দিলরুবা। কাছাকাছি বাসা হওয়ায় এখনো যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ আছে। মাঝে মধ্যেই তিনি এ’বাড়িতে আসেন। কিছুদিন আগে এক বিকেলে তিনি এলেন। গুনগুনও তখন এখানেই ছিল। গুনগুনের প্রতি জোহরা খানমের অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখে সেদিন তিনি অনেক কিছু বলেছিলেন। আকারে ইঙ্গিতে আজকে লায়লার বলা কথাটাই বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন।

পুরো বাড়ি জুড়ে বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। কারোর দম ফেলবার সময় নেই যেন। বিয়ের মোটে বাকি আছে আর একদিন।বাড়ির মেয়েরা শাহাদাত কে ধরেছিল গায়ে হলুদ দেওয়ার জন্য। তবে বিশেষ লাভ হয় নি।এসব তার বরাবরই অপছন্দ।তাই সে সাফ না জানিয়ে দেওয়ায়
তাদের একটু মন খারাপ হলো।
সেই সকালে গুনগুন এখানে এসেছিল তারপর আর ফিরতে পারে নি। বড়মার ভীষণ জোড়াজুড়ির পর সে শাড়ি পরতে বাধ্য হয়েছে।

চলবে………….
অদ্রিজা আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here