#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
||১০ম পর্ব ||
বর্তমানে,
-স্যার ঘুমাচ্ছেন কি? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি। শহরে চলে এসেছি নামবেন না?
দোকানি আঙ্কেলের ঠিক করে দেয়া ট্রাক ড্রাইভারের ডাকে অতীত থেকে ফিরে আসে জারিফ।
-হ্যাঁ নামবো, ধন্যবাদ ভাই এতটুকু রাস্তা পর্যন্ত সাহায্য করার জন্য।
– ধন্যবাদের কি আছে ভাই। আমরা গরীব মানুষ আপনাদের মত বড়লোকদের জন্য এতটুকু করে উপকারে এসেছি সেটাই অনেক।
ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে জারিফ নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কলিং বেল চাপতেই সাজিয়া এসে সদর দরজা খুলে দিলো। সাজিয়া জারিফকে দেখে একপ্রকার চিৎকার করে বলল।
– ভাইয়া, একি অবস্থা তোমার? তুমি না পিকনিকে গিয়েছিলে, কিন্তু তোমার চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে গত দুইদিন যাবত কিছুই খাওনি।
জারিফ ছোট বোনের দুশ্চিন্তা দেখে মলিন হাসল।
– সাজিয়া বোন আমার ভিতরে চল আমার রেস্টের প্রয়োজন।
জারিফের কথার আওয়াজ শুনে জারিফের মা রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে আসেন জারিফকে উদ্দেশ্য করে ব্যথাতুর কন্ঠে বললেন।
– জারিফ জানিস, তুই পিকনিকে চলে যাবার পর থেকে আয়নাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আয়নার বাড়িতে গিয়েছিলাম আয়নার বড় বোন বলল যে আয়না হঠাৎ করে উধাও হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম তোদের সাথে পিকনিকে গিয়েছে কিনা! বলল না কোথায় গিয়েছে তা কেউ জানে না। তুই একটু খোঁজখবর নে না!কি অবস্থায় আছে মেয়েটা কি জানি!
– আহ মা, থামোতো! ঐ মেয়েটার কিছুই হয়নি গিয়ে দেখো সে ভালই আছে। আর এত আয়না আয়না না করে তোমার ছেলের হবু বউয়ের নাম জপতে থাকো দুদিন পর যাকে তোমার ছেলের ঘরে বউ হয়ে আসবে তার কথা চিন্তা করো।
জরিফের মা জারিফের এমন বেখেয়ালি কথা শুনে রেগে গেলেন
– জারিন আমার ভাইয়ের মেয়ে হলেও এই মেয়েকে আমি পছন্দ করি না। একদম উগ্র মেজাজের মেয়েটা। তোর কারনে শুধু চুপ হয়ে আছি। কী দেখেছিস এই মেয়ের মাঝে! যে তাঁকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিস?
– উফ মা থামবে তুমি? জারিন আমাকে ভালোবাসে তাই আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি আর কিছু!
জারিফের মা এবার রাগী কন্ঠে বলল।
– আর তুই কি ভালোবাসিস? আমিতো জানি তুই আয়নাকে ভালবাসিস তাহলে কেন এমন মিথ্যা অভিনয় করছিস?
– হ্যাঁ মা আয়নাকে ভালোবাসি। কিন্তু আয়নার মত গুন্ডি মেয়েকে ভালোবাসা সম্ভব না। আয়নার মন বলতে কিছু নেই মা। আয়না খুব কঠোর সে চায় আমাকে তার প্রতিবিম্বের সারা জীবনের জন্য আটকে রাখতে কিন্তু আমি তা চাইনা। আমি চাই আমার জীবনসঙ্গী আমার মনের মত হবে।
জারিফের মা এবার করুন স্বরে বলল।
– কিন্তু আমিতো আয়নাকে পছন্দ করেছিলাম আমার ছেলে বউ হিসেবে।
জারিফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। ছোটবেলা থেকেই জারিফের পছন্দ অপছন্দ সব তাঁর মা বুঝে যায়। জারিফ আয়নার চোখে নিজের সর্বনাশ দেখেছে। জারিফ সেই সর্বনাশে চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত। যতদিন না সেই মানুষটাকে খুঁজে পাচ্ছে ততদিন আয়নার থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে। নচেৎ জারিফ আয়না কখনোই এক হতে পারবে না মনে মনে জারিফ এসব চিন্তা করে বসা থেকে নিজের কক্ষে যাবার জন্য অগ্রসর হল।
– জানি না তুই কি চাস আর কি করছিস। আয়না মেয়েটার মধ্যে আমি অন্যরুপ দেখেছি যেখানে রয়েছে পবিত্রতা। আয়নাকে ভালোবাসা দিলে মেয়েটার ভেতরের সেই রুপ ফিরে আসবে। তুই নিজেকে সময় দে বাবা। আমার কথা চিন্তা করে দেখ।
জারিফের মা কথাগুলো বলে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। এদিকে জারিফ মলিন চোখে মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। আজ সে ইচ্ছে করেই নিজের কিডন্যাপের কথা মাকে জানায়নি।
জারিফ নিজের কক্ষে এসে ফ্রেস হয়ে শুয়ে আবারো অতীতে ফিরে গেল।
———–
– তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে? মা বললো আর তুমি আমার বাসায় থেকে গেলে?
শুনশান মেইন রোড দিয়ে গাড়ি চলছে। চারপাশে পিনপিন নীরবতা। আকস্মিক জারিফের এমন কথায় আয়না ভরকাল। আয়না এই সময়ে মোটেও এমন কথা আশা করেনি। সময়টা এখন সকাল, ভোর সকাল। অনেক কষ্টে জারিফের মাকে বুঝিয়ে ভোর সকালে বেরিয়ে পড়েছে আয়না। বাসা থেকে হঠাৎ ইমারজেন্সি কল এসেছে দর্পণ নাকি খুবই অসুস্থ। আয়না কোনরকম চোখে মুখে পানি দিয়ে একাই বের হতে উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু জারিফের মা বাঁধা দেয়। জারিফের মা জারিফকে শক্তভাবে আদেশ দেন যেন আয়নাকে ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
– মিস্টার জারিফের দেখি স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। একটা কথা ভুলবেন না আন্টি আমার জন্য চিন্তা করেনি বরং আন্টি তার ছেলের জন্য চিন্তা করেছে। সুতরাং আপনি এই কথা বলতে পারবেন না যে আমি ইচ্ছে করে আপনার বাসায় থেকেছি নিজের স্বার্থে।
আয়নার শান্ত কন্ঠে জারিফ দমে গেল। বিড়বিড় করে কি যেন বলে পুনরায় বলল
-তুমি কাল মিথ্যা বলেছিলে কেন?
জারিফের কথায় আয়না আবার বিরক্তি প্রকাশ করল মুখ দিয়ে চ শব্দ বের করে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলল।
– আমাকে কি একটু শান্তি দেবেন না? ভোরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার জন্য পারছিনা। তো বলুন মহাশয় কি মিথ্যা বলেছিলাম কাল?
– ওই যে তুমি মাছ ধরতে পারো এসব বলেইতো আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলে কিন্তু পরবর্তীতে মাছ ধরতে পারলে না।
– আমি কি একবার বলেছিলাম যে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে পারি?
– না।
– তো শুনুন আসলে আমি জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারি কিন্তু বড়শি দিয়ে পারিনা।
জারিফ এবার আহত হলো। আয়নার সাথে যে কথায় কখনও পারবে না বুঝে গিয়েছে।
– হয়েছে আর মিথ্যা বলতে হবেনা। আমি দেখেছি তোমার মাছ ধরা তুমি পারো।
জারিফ এবার কিছুটা দুষ্টুমি সুরে আয়নার উদ্দেশ্যে বলল।
– আসলে আমি মানুষটাই এমন হ্যান্ডসাম যে কেউ আমার কাছে আসতে চায়। কাল এত বাহানা না করে বললেই হত যে তুমি আমার কাছে আসতে চাচ্ছো এত বাহানা করার দরকার ছিল না।
জারিফের এখন কোথায় আয়না তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল।
– নিজেকে এতটাও ইম্পর্টেন্ট মনে করবেন না। আপনি আমার কাছে কিছুই না।
আয়নার এমন কথায় জিরিফ গাড়ি ব্রেক কষে ফেলে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে স্টিয়ারিংয়ে আঘাত করে বলে।
– নামো।
আয়না তাকিয়ে দেখে তার বলা জায়গায় গাড়ি থেমে গেছে তাই মুচকি হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায়।
– ধন্যবাদ মিস্টার জারিফ।
জারিফ সামনের দিকে তাকিয়ে আয়নার উদ্দেশ্যে বলল।
– আশা করি গতকালকের ঘটনা সব ভুলে যাবে। আজকের পর থেকে তুমি তোমার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়। ভুলেও যেনো আমার কোন কাজে তোমাকে নাক গলাতে না দেখি। তাহলে এর ফল বালো হবে না।
আয়না নিজের মাথার কাপড় ঠিক করতে করতে বলল।
– তা সময় বলে দিবে মিস্টার তাযিন জারিফ।
——-
ভরা ক্যাম্পাসের সামনে আয়না জারিনকে থাপ্পড় মারল। এই কথা সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ক্যাম্পাস ছড়িয়ে গিয়েছে। জারিন জারিফের মামাতো বোন হওয়ায় দ্রুতই জারিফের কানে পৌঁছাল।
– এখানে কি হচ্ছে এত মানুষ এখানে কি করে?
জারিফের উপস্থিতিতে সকলে সরে যায়। আয়না ক্রোধভরা চাহনিতে জারিনের পানে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ঐ চক্ষুদ্বয় দিয়েই জারিনকে ভস্ম করে দিবে। জারিফের কণ্ঠস্বর শুনে জারিন যেন প্রাণ ফিরে পেল। জারিফকে দেখতে পেয়ে জারিন দৌঁড়ে জারিফের পেছনে লুকালো।
– জারিফ দেখো না এই মেয়েটা পাগল হয়ে গিয়েছে। কথা নাই বার্তা নাই আকস্মিক আমাকে আক্রমণ করছে।
জারিনের এমন কথা যথেষ্ট ছিল আয়নার রাগ বাড়ানোর। আয়না বুঝতে পেরেছে জারিন জারিফের সামনে ভালো সাজতে চাইছে তাইতো আগুনে ঘি ঢেলে আয়নার রাগটা আরো বাড়িয়ে দিল।
আয়না নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে জারিফের পেছন থেকে জারিনকে সামনে এনে আরো কয়েকটা থাপ্পড় দিলো। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে।
– মাথা ঠিক আছে ইউ স্টুপিট মেয়ে? মারছো কেন এভাবে?
– আপনার এই ন্যাকা বোনকে জিজ্ঞেস করুন কি করেছে সে।
আয়নার এখনও জারিনের পানে অগ্নি চক্ষু করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে জারিন আরেকটু ন্যাকামি করে বলল।
– জারিফ, দেখলে মেয়েটা আবার আমাকে মারছে। একে কিছু করো নয়তো আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে বিচার দিবো।
– রক্তের বদলে রক্ত, মারের বদলে মার। আমার বোনকে মারার বদলে তোমাকেও যে শাস্তি ভোগ করতে হবে!
পর পর দুটো থাপ্পড়ের আওয়াজে চারপাশের পরিবেশ স্তব্ধ বনে গেল। আজ যে থাপ্পড় খাবার দিবস তা নিঃসেন্দহে বলা যাবে। এখন দেখার বিষয়, শেষের থাপ্পড় কে কাকে মেরেছে।
বাকিটা আগামী পর্বে,
চলবে……