#প্রমত্ততা_তুই
#আফসানা_মিমি
|| ১ম পর্ব ||
তু সাফার মেরা,
হে তুহি মেরি মানজিল।
তেরে বিনা গুজারা ,
এ দিল হে মুসকিল।
অন্ধকারে শিস বাজিয়ে হাই হিল পরে হেঁটে হেঁটে গান গাইছে মেয়েটা। তাঁর সামনে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় এক যুবক বসে আছে। যুবকটি চিল্লিয়ে বলল।
আমাকে এভাবে আটকিয়ে রাখার মানে কি আর কে আপনি। এভাবে অন্ধকারে লুকুচুরি না খেলে সামনে আসুন।
মেয়েটি এবার শিস বাজাতে বাজাতে সামনে আসল মেয়েটিকে দেখে যুবকটি আনমনে বলে উঠলো।
আয়না
মেয়েটি এবার হাতের গানটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে উত্তর দিলো।
হ্যাঁ আয়না তোমার আয়না তোমাকে এখানে আটকিয়ে রাখার মানে খুব সহজ জান। আজ তোমার আর আমার মনের আশা পূরন হবে দুই মনের মিল হবে আজ আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে যেখানে বর বেশে থাকবে তুমি আর বউ বেশে থাকব আমি।
মেয়েটির কথা শুনে ছেলেটি এবার তেঁতে উঠে চিৎকার করে বলল।
কখনোই না আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করব না। দরকার হলে সারাজীবন কুমার হয়ে থাকব কিন্তু তোমার মত পাগলকে বিয়ে করব না।
মেয়েটি এবার শান্ত হয়ে হাতের গান কপালে ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠলো।
সাইকো হা হা হা সাইকো হ্যাঁ হ্যাঁ আমি সাইকো , পাগল , হিংস্র , ঘৃণিত সব এই আমি। এসবকিছু আমি কার জন্য হয়েছি হুম কার জন্য বলো আচ্ছা তুমি বলবে না তো আমিই বলি এসব কিছু হয়েছি শুধুমাত্র তোমার জন্য।
মেয়েটি এবার একটু থেমে ছলছল চোখে আবার বলতে শুরু করল।
ভালবাসা হলো এক ধরনের নেশা যা পান করা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। ভালবাসা এমন এক অনুভতি যা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। তুমিও এই নেশায় বুদ হয়ে দেখো জীবনটা একেবারে বদলে যাবে। চারপাশে যা দেখবে তাই রঙিন লাগবে তখন এই ভালোবাসায় মরে যেতে ইচ্ছে করবে আর আর তুমি তো আমার প্রমত্ততা যা আফিমকেও হার মানাবে। তোমাকে ছাড়া এই আয়নার কোন অস্তিত্ব নেই।
ছেলেটি এবার বিরক্ত হয়ে যায় মেয়েটির কথা শুনে।
তোমার এসব ফালতু কথা শোনার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আর রইলো ভালোবাসার কথা ! যা তোমাকে কখনোই বাসা যাবে না। নিজেকে কি মনে করো তুমি মিস বাংলাদেশ ?
মেয়েটি এবার ছেলের দিকে কিছুটা ঝুঁকে হাতের গান ছেলেটির মুখে স্লাইড করতে করতে উওর দেয়।
আমি আয়না আমার জীবনটা ছিল আয়নার মত পরিষ্কার স্বচ্ছ আমার প্রতিবিম্বে শুধুই আমি ছিলাম কিন্তু আমার জীবন হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেল। সেই স্বচ্ছ প্রতিবিম্বে শুধু একজনকেই দেখতে পাই আর সেটা হলো তাযিন জারিফ আমার জারিফ হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে ভালোবাসি জারিফ। এতটাই ভালোবাসি যে তোমার ভালোবাসা পাবার জন্য হিংস্র হতেও প্রস্তুত। একটা কথা জানো কি তোমার পেছনে লেগে থাকা মেয়েদের এই আয়নাই তার প্রতিবিম্বে বন্দি করে রেখেছে তা কেউ কখনোই জানবে না হা হা হা।
আয়না এবার জারিফের চারপাশে চক্কর লাগিয়ে বলতে থাকে।
জান এই আমাকে এইরূপ দিয়েছো তো তুমিই আর দশটা মেয়ের মতো হাসিখুশিই তো ছিলাম কিন্তু তুমি আমার জীবনে এসে সব ওলটপালট করে দিলে। এখন অপেক্ষা করো আমার জন্য আমি আসছি বধূ সেজে তোমার হতে।
দুইঘণ্টা হয়ে যায় কিন্তু আয়না আসার নাম নিশানাও নেই তাই জারিফ আস্তে ধীরে হাতের বাঁধন খুলতে শুরু করে। একপর্যায়ে জারিফ হাতের বাঁধন খুলতে সফল হয় আর দরজা খুলে বাহিরে চলে আসে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আয়না বাহিরে কোন গার্ড রাখেনি তাই খুব সহজেই আয়না নামক প্রতিবিম্ব থেকে বের হয়ে যায় জারিফ।
এতক্ষণ সিসিটিভি ফুটেজে সবটাই দেখছিল আয়না। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলতে শুরু করে।
জান জান জান এই আয়না তাঁর প্রতিবিম্ব থেকে তোমাকে বের হতে দিয়েছে দেখেই তুমি বের হতে পেরেছো নয়তো এত সহজ না আমার থেকে ছাড়া পাওয়া। দেখা যাক কালকের পর থেকে আমাদের ভাগ্য কাকে কোনদিকে নিয়ে যায়।
চায়ের দোকানে টুংটাং গ্লাসের আওয়াজ হচ্ছে ফুটন্ত পানি টগবগ করছে আর সেই পানি দিয়েই দোকানি চা বানাচ্ছে। জারিফ উষ্কখুষ্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে চায়ের দোকানের সামনে প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর চা দোকানি প্রশ্ন করে।
বাবা কই যাইবেন?
চা দোকানির কথায় জারিফ আশ্বস্ত হয়ে বলে
চাচা এটা কোন জায়গায়? আর এখানে কি গাড়ি পাওয়া সম্ভব?
দোকানি এবার চা বানাতে বানাতে উওর দিলো।
বাবা এখন তো বাস পাইবা না সেই ভোরে বাস ছেড়েছে আবার আসবো বিকালে আমগোর গেরামে এই দুইবারই বাস আহে।
চা দোকানির কথা শুনে জারিফ হতাশ হয়ে যায়। জারিফের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এসময়ে কতটা অসহায় আর কিছু মুহূর্ত এখানে থাকলে আয়নার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না। চা দোকানি এবার চিন্তিত সুরে বলল।
বাপজানরে দেইখা মনে হচ্ছে বিপদে পড়ছেন। আমার এক ভাইস্তা একটু পর ট্রাক নিয়া শহরে যাইবো আমনে চাইলে শহর পর্যন্ত পৌছে দিতে পারে।
জারিফ এবার খুবই খুশি হলো চা দোকানি থেকে বিদায় নিয়ে মালবাহী ট্রাকে চড়ে রওনা হলো।
মাথার উপর আকাশ আর তার মধ্যে সাদা মেঘের ভেলা নিজ গতিতে ছুটে চলছে। চোখ বন্ধ করে জারিফ ডুব দেয় আয়না নামক প্রতিবিম্বে আটকে যাওয়া সেই কালো অতীতে।
—–
ভার্সিটির প্রাঙ্গণে বসে আড্ডা দিচ্ছে জারিফ ও তার বন্ধুরা আড্ডার টপিক হলো কার উপর কতজন ক্রাস খেয়েছে। সবার মাঝে বসে শিহাব বলা শুরু করল ।
ঘোষণা ঘোষণা ঘোষণা আজ আপনাদের সামনে পেশ করা হবে ভার্সিটির পপুলার চকলেট চার্মিং বয়কে যার রুপে মুগ্ধ ভার্সিটির হাজারো হাজারো মেয়ে কিন্তু সে কাউকে পাত্তা দেয় না। এই মহান ব্যক্তিটি আর কেউ না আমাদের সবার প্রিয় তাযিন জারিফ তালিয়া।
হ্যাঁ রে কতই লাইন মারলাম আমাদের জারিফের পেছনে কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দিলো না এজন্যই তো এই রসিকের গলায় ঝুলে আছি।
কি বললি তুই আমাকে মোনালিসা কি বাচ্চি আমি রসিক। তুই জানিস ভার্সিটির অর্ধ মেয়ে এই শিহাবের জন্য পাগল কিন্তু এই শিহাব শুধু তার মোনালিসাকে ভালোবেসেছে।
কি বললি শিহাইব্বা দাঁড়া আজ তোর একদিন তো আমার যতদিন লাগে।
এতক্ষণ ঝগড়া চলছিলো ভার্সিটির সেরা ঝগড়াটে কাপল সারাদিন একথা সেকথা বলে ঝগড়া করতেই থাকে। দুইজনের ঝগড়ার মাঝে আমাদের নিষ্পাপ বেচারা জারিফ বসে আছে। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে দুজনকেই ধমক দিলো ,
এই তোরা চুপ করার জন্য কি নিবি বলবি? যখনই দেখি তখনই টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়া লেগেই থাকে তোদের। এখন যদি তোরা চুপ না করিস তো আমি এখান থেকে উঠে চলে যাবো।
জারিফের ধমকে শিহাব মোনালিসা চুপ হয়ে যায় কিন্তু দুজনের চোখে চোখে ঠিকই ঝগড়া হচ্ছে ওঁদের এমন কাজ দেখে কপাল চাপড়ে বসা থেকে উঠে ভার্সিটির গেইটের দিকে অগ্রসর হয়। আজ ফার্স্ট ইয়ারদের প্রথম ক্লাস শুরু তাই প্যারা নাই।
ভার্সিটির গেইট পেরিয়ে একজায়গায় জট পাকিয়ে রয়েছে দেখতে পায়। একটু সামনে এগিয়ে দেখে একটা মেয়ে কোমড়ে হাত রেখে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে রিকশাওয়ালা মামার সাথে আর তার আশেপাশে লোকেরা ঘেরাও করে রং তামাশা দেখছে। ভার্সিটির সামনে জ্যাম হয়ে আছে অনেকটুকু জায়গা তাই জারিফ এগিয়ে যায় ভীরের মধ্যে আর বলতে শুরু করে।
কি হচ্ছে কি এখানে আপনারা এমনভাবে ঘেরাও করে রেখেছেন কেন? আর এই মামা আপনার সমস্যা কি?
রিকশা ওয়ালা মামা অসহায় কন্ঠে বললেন।
দেখেন ভাইজান এই আপায় কি শুরু করছে সলিং মোড় থেইকা কলেজেগেইট পর্যন্ত ভাড়া পঞ্চাশ টাকা আর উনি আমারে একশত টাকা দিতাছে যেইখানে আমি বার বার কইতাছি পঞ্চাশ টাকা ভাড়া সেখানে এই আপা মানতেছে না।
রিকশা ওয়ালা মামার কথায় মেয়েটি এবার চিল্লিয়ে উঠল।
মামা একশত টাকাই আপনার নিতে হবে সলিং মোড় থেকে এখানে আসতে একশত টাকাই ভাড়া সত্যি করে বলুন আপনাকে কে অর্ধেক টাকা দিয়ে দিয়েছে যে আপনি আমার থেকে টাকা নিচ্ছেন না?
মেয়েটির কথা শুনে এবার রিকশা ওয়ালা মামা বলল।
সত্যি বলছি আপা ভাড়া মোট পঞ্চাশ টাকা।
জারিফ এবার তীক্ষ্মচোখে মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণ করল। পরনে থ্রি পিস চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে ছেড়ে দিয়েছে কানে ছোট ঝুমকা। একটু পর পর নিজের পরিহিত ওরনা ঠিক করছে আর কথা বলছে।মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে এর আগে কখনোই থ্রি পিস পরিধান করেনি তাই ওরনা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অবস্থার বেগতিক দেকে জারিফ দুজনের উদ্দেশ্যে বলে।
হয়েছে থামুন আপনি আর এই যে মেয়ে ভাড়া পঞ্চাশ টাকাই। অযথা ঝগড়া না করে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দাও দেখো তোমার জন্য রাস্তায় কত বড় জ্যাম পড়েছে আর আপনারা ( জনগণের উদ্দেশ্যে ) আপনাদের কি কাজ কর্ম নেই? যেখানেই দেখেন ঝামেলা হচ্ছে সেখানেই জটবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকুন যান যার যার কাজে যান।
মেয়েটি এবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে সত্যিই অনেক লোক জমা হয়ে আছে আর জ্যাম পড়েছে। অগত্যা ব্যাগ খুঁজছে পঞ্চাশ টাকার আশায় কিন্তু আফসোস সবগুলোই একশত টাকার নোট।
মামা আপনি একশত টাকাই রাখুন আমার কাছে ভাংতি নেই।
কি কন আপা আমি কলিমুদ্দিন হালাল টেহা কামাই করি আমারে আমার প্রাপ্য পঞ্চাশ টাকাই দেন। আমার কাছে ভাংতি নাই আইজ আপনিই আমার প্রথম যাত্রী।
জারিফ দেখলো এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভার্সিটির ঝামেলা হবে তাই সে বলল।
আমার কাছে ভাংতি আছে।
জারিফের কথা শুনে এবার মেয়েটি কোনা চোখে উওর দিলো।
কিন্তু আমি আপনার থেকে নেবো না।
মেয়েটির কথা শুনে এবার জারিফের মেজাজ গরম হয়ে যায় তাই মেয়েটির হাত থেকে একশত টাকার নোট নিয়ে নিজের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে চলে যায়। এদিকে পেছন থেকে মেয়েটি চিল্লিয়ে বলছে।
আরে ভাই আমার পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলেন না তো।
মেয়েটির কথা শুনে জারিফ বলে।
ঐ টাকা আর ফেরত পাবেনা মিস ত্যাড়া। যেমন কর্ম তেমন ফল কথাটা তো জানো?
মেয়েটি এবার রাগে গজগজ করতে করতে বলে।
শা** খচ্চর আমারও দিন আসবে এই আয়না এমনি এমনিই কাউকে ছাড় দেয় না।
চলবে…..