প্রথম পর্বঃ১”শিশির কণা”
লেখাঃ শামসুল ইসলাম

১।।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো পাশে দেখি মুসলিমা নেই, খেয়াল করলাম সে সিজদায় অবনত । মৃদুস্বরে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি, মনেহচ্ছে সিজদার মাঝেই ডুকরে কাঁদছে।
মনের ভিতরে কৌতুহল জাগ্রত হলো, হঠাৎ এতো রাতে কাঁদে কোন দুঃখে?
আমার মতো কি প্রেমের প্যাড়াই আছে নাকি?
প্রায় দশ মিনিট অতিবাহিত হলো সিজদায়, মুসলিমা সালাম ফিরালো। আমি তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলাম-
-” এতো রাতে কিসের সালাত, আর কাঁদছিলি কেনো?”
-” তুমি সারাদিন ফেসবুকিং চ্যাটিং নিয়েই ব্যস্ত থাকো তাহলে বিভাবে এসব জানবে বলো?”
-” থাক কথায় কথায় জ্ঞান দিতে হবেনা, আসল কথায় যা!”
-” এটা হচ্ছে কিয়ামুল্লাইল যা আমাদের মাঝে তাহাজ্জত নামে পরিচিত।”
-” তা বুঝলাম, এটাতে কি কান্নাকাটি করতে হয় ?”
-” না এটা নফল ইবাদতের ভিতরে সব থেকে উৎকৃষ্ট ইবাদত, এটা রাতের এক তৃতীয়াংশ সময়ে পড়ার ব্যাপারে বিশেষ ফজিলত আছে এবং এ সালাতের মাধ্যমে সিজদায় মনের সমস্তরকম আবেগ অনুভুতি প্রকাশ করলে আল্লাহপাক সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের মনোবাসনা পূরণ করেন।”
-” তা বুঝলাম, কিন্তু তুই কি এমন চাইলি যারজন্য কান্নাকাটি করলি দেখলাম?”
-” আচ্ছা আপু তোমার কি বাবার চেহারা মনে আছে?”

হঠাৎ মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেলো, বাবা আমার সেই ছোটবেলায় মারা গেছেন চেহারাটা লুপ্তপ্রায়।
বাবার কথাই মোনের কোনে অজানা এক শূন্যতা বিরাজ করলাম।
মুসলিমা বললো-
-” আপু তুমি কি জানো মানুষ মৃত্যুর পর তার সমস্ত আমোল বন্ধ হয়ে যাই, কিন্তু তিনটি কর্মের সওয়াব অব্যাহত থাকে?”
-” না! তুই বল?”
-” রাসুল (সাঃ) বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর তার তিনটি কর্মের সওয়াব কবরে বসে তার আমোল নামাই যোগ হয়।
১- সদকায়ে জারিয়া বা চলমান দান সদকা।
২- এমন জ্ঞান যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যাই।
৩- আর এমন নেক সন্তানসন্ততি যারা তারজন্য দো’আ করে।
সুতরাং বাবা মারা গেছেন অনেক বছর হলো। অন্ততপক্ষে আমাদের দুই বোনের উচিৎ বাবার জন্য প্রত্যহ সালাতের মাধ্যমে দোয়া করা এবং সাধ্যমত দান সদকা করা। আর বাবা কতোটুক উপকারি জ্ঞানের পিছনে অর্থ শ্রম ব্যয় করেছেন সেটা আল্লাহপাক ভালো জানেন।”
-” হ্যাঁ বুঝলাম তারমানে তুই আব্বুর জন্য দো’আ করছিলি।”
-” জ্বি আপু, তোমাকে অনেক অনুরোধ করি তুমি সালাত পড়ো পর্দা করো আল্লাহর হুকুম আহকাম পরিপূর্ণ না মানতে পারলেও অন্ততপক্ষে চেষ্টা করো দেখবে অনাবিল শান্তির ঘুড়ি তোমার মনের আকাশে পতপত করে উড়বে।”
-” চেষ্টা করবো, তবে তুই সত্যি অনেক ভালো মেয়ে যা বাবার জন্য নেককার সন্তান আর আমি বদকার সন্তান হা হা হা।”
-” আপু তুমি কিন্তু প্রায়ই রহস্য করো ভালো কথা নিয়ে, তোমাকে ফ্রিতে আরেকটি জ্ঞান দিই তা হচ্ছে মেসেঞ্জার চ্যাটিংয়ের ব্যাপারে সংযত হও আর মোন দিয়ে পড়াশোনা করো সামনে এইসএসসি পরিক্ষা তোমার।”
মনেমনে ভয় পেয়ে গেলাম আমার প্রেমের খবরাখবর জেনে গেলো নাকি!!
তবুও নিজে সাহসী ভাব নিয়ে, আরে ধুর!! আমার রেজাল্ট ভালো হবে দেখিস?”
-” আলহামদুলিল্লাহ হলেই ভালো। একটু পরই ফজরের আযান হবে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, তুমিও তৈরি হয়ে নাও ফজরের সালাত আদায়ের জন্য।

মুসলিমা বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
আর হ্যাঁ এতক্ষণ কথা বলছিলাম আমার ছোটবোন নাম মুসলিমা মণির সাথে এবং আমি সামিমা আক্তার কণা।
কিছুদিন পর আমার এইসএসসি পরিক্ষা, আর মুসলিমা সদ্য এসএসসি পাশ করে নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে।
আমরা দুইবোন মোটামুটি মেধাবী, সাইন্স নিয়ে পড়ছি। আমার স্বপ্ন আমার প্রেমিক শাহরিয়ার শিশিরকে বিয়ে করা।
আর মুসলিমার স্বপ্ন হলো কোনো দ্বীনদার ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করা ও তিনচারটা সন্তানের মা হওয়া।
মুসলিমার খুব ইচ্ছা তার সন্তান দেশের খ্যাতনামা শায়েখ হবেন মিশর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি,এইস,ডি ডিগ্রী করবে কোরআন, হাদিস বা ফিকাহ নিয়ে। এককথাই দ্বীনদার ও শিক্ষিত সন্তানের আদর্শ মা হওয়া।
কিন্তু আমার মামারা তা চাননা, তারা চান মুসলিমা বিসিএস ক্যাডার হবে।

★★★
অনেক ছোট থাকতে আমার বাবা মারা গেছেন, আমার বয়স ছয় বছর মুসলিমার বয়স চার বছর।
আমার মা খুব কম বয়সেই বিধবা হয়েছেন। মায়ের বয়স যখন উনিশ বা কুড়ি তখনি বাবা আমার সবাইকে পর করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।
আমাদের দুইবোনকে নিয়ে অনেক ইতিহাস আছে, যা বলতে গেলে চোখের অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে।
এককথাই মাঝি ছাড়া নৌকা যেমন উত্তল সাগরে দিগ্বিদিক ছুটে চলে অনেকটা তেমন আমরা।
তবে আল্লাহর রহমাতে আমার নানা-নানি এখনো জীবিত, এইজন্য আমরা দুইবোন অনেক আদরের মাঝে বেড়ে উঠছি।
মা আমার একটা ছোটখাটো চাকরি করেন যা দিয়ে আমাদের চাহিদা পুরণ করেন।
কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেননি।
আমার বাবা প্রবাসী ছিলেন, সৌদিআরব থাকতেন, বাবাকে নিয়ে অনেক কথা আছে যা প্রকাশ করতে খুব কষ্ট হয়। এ কষ্ট ব্যাথা সেই বুঝবে যে এর ভুক্তভোগী, আমি কষ্টগুলো চোখের জলে প্রকাশ করতে পারিনা কিন্তু বুকের ভিতরে চাপাকষ্টে নিজে পুড়েপুড়ে শেষ হয়ে যাই যা সহজে কেউ বুঝতে পারেনা আমার চেহারা দেখে।
আরেকটি কথা, আমার দাদা বাড়ির আদর সোহাগ কখনোই পাইনি এমনকি তারা খোঁজখবর পর্যন্ত নেননি আমাদের।
পিতৃকুলের একজন মাত্র আদরের মানুষ আছেন, তিনি হচ্ছেন আমার ছোট ফুফু ববিতা।
আমার বাবা যখন মারা যাই তখন আমরা অনেক ছোট ছিলাম। ফুফু আমাদের খুব আদর করতো সেই সুবাদে এখনো পর্যন্ত আমাদের আদর করে।
পিতৃকুল মাতৃকুলের ভিতরে আমার ফুফু একজন যাকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি।
এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যে আমাদের পোশাক বা প্রসাধনী সামগ্রী দেননি। খুব খুব ভালোবাসি ফুফুকে।
মুসলিমা এসে বললো-
-” কি ব্যাপার আপু! এখনো উঠনি কেনো। যাও ওযু করে এসে সালাত পড়তে হবে।”

আর গল্পবলা হলোনা, সালাত পড়ে নিই তারপর আবার গল্প বলবো।
আমি ওযু করে মুসলিমার সাথে দুইবোন সালাত আদায় করে নিলাম। সালাত সমাপ্ত করে সে কোরআন তেলায়ত শুরু করলো।
আর আমার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস ঘুম থেকে উঠেই মেসেঞ্জার চেক করা শিশির মেসেজ করলো কি না!
মেসেঞ্জারে প্রবেশ করেই মোনটা খুশিতে ভোরে উঠলো, দেখি সে মেসেজ করেছে-
-” লাভ ইউ সোনা বাবু কি করো?”
বাবু ডাক শুনতে বেশ ভালোলাগে আমার। আমি রিপ্লাই দিলাম-
-” সালাত পড়ে মাত্র বেডে সুলাম, তুমি?”
-” আমিতো এখনো উঠি নাই”
-” কেনো?”
-” পরে উঠবো, আচ্ছা! তুমি নামাজকে সালাত বলো কেনো?”
-” আমার একটি অনেক ধার্মিক বোন আছে, সে বলেছে কোরআনের প্রতিটি আরবি এক একটি অক্ষরে দশ নেকি, তাই নামাজ আরবি শব্দ নই এবং নামাজের আরবি শব্দ সালাত এইজন্য সালাত বলি।”
-” সব হুজুর মনেহচ্ছে”
-” হ্যাঁ, এসব বাদে আগে বলো বিয়ের প্রস্তাব কবে পাঠাচ্ছ ও দেখা দিচ্ছ?”
-” কিহ!! বিয়ে! এতো সকালে?”
-” সকাল মানে? আমি এখন এইসএসসি পরিক্ষার্থী আমার যথেষ্ট বিয়ের বয়স হয়েছে।”
-” তা হয়েছে কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে তুমি মেধাবী ছাত্রী আগে বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পাও পড়াশোনা করো তখন বিয়েশাদীর চিন্তাভাবনা করা যাবে।”
-” তারমানে আগে পড়াশোনা?”
-” হ্যাঁ, আমি এখন মাত্র অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি। এখন বিয়ের কথা বাড়িতে বললে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে।”
-” বাই ভালোথাকো, আর কোনো কথা নেই।”

মোন খারাপ করে মুখ ফুলিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকলাম।
কিছুক্ষণ পর মা এসে ডাকলেন-
-” এই কণা, ওঠ উঠে পড়তে বস বেলা গড়িয়েছে। আজ বাদে কাল পরিক্ষা আর তোর ঘুমই কাটেনি।”
আসলেই মা ঠিক বলেছেন, আমার প্রচুর ঘুম যারকারনে অনেক কটুকাব্য শুনতে হয়।
মা আমার খুব সহজ সরল পড়াশোনা ব্যতীত কখনো বকা দেইনা। তবে দুইবোনের ভিতরে মুসলিমা মা সহ সকলের কাছে অনেক শ্রদ্ধাশীল মেয়ে।
কিন্তু বদের হাড্ডি হলাম আমি যারকারনে মাঝেমধ্যে একটুআধটু বকাঝকা খাই।

প্রথম পর্বঃ
“শিশির কণা”
লেখাঃ শামসুল ইসলাম

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here