#ধারাবাহিকগল্প
#ভৌতিক থ্রিলার
#পাপের ক্ষরণ
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

মেয়েটার অবয়বটা রশ্নি দেখতে পায়নি। রায়হান মেয়েটাকে আস্তে আস্তে সুইমিংপুলের পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। বাঁচার জন্য মেয়েটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রায়হানের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। মেয়েটা রায়হানের দিকে তীব্র আক্রোশের দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পানিতে ডুবে গেলো। তারপর রায়হান আস্তে আস্তে পানি থেকে উপরে উঠলো। সে সময় হঠাৎ বাদুরের মত দেখতে ধারালো নখর যুক্ত এক প্রাণী আকাশ কালো করে উড়ে এসে রায়হানের সামনে দাঁড়ালো। আক্রোশে বাদুরের চোখদুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছিলো। নখ দিয়ে রায়হানের গলার কাছে আঁচড় দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করলো। রক্তে রায়হানের শরীর ভেসে গেলো। রায়হানও মেয়েটার মতো বাঁচার জন্য চেষ্টা করলো। কিন্তু ঐ প্রাণীর শক্তির সাথে পারলো না। মুখ দিয়ে অদ্ভূত এক গোঙ্গানীর মতো শব্দ হয়ে রায়হান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। রশ্নি চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। রশ্নি ছটফট করতে লাগলো। ওর মা এসে ধাক্কা দিয়ে রশ্নির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—–তোর তো সর্বনাশ হয়ে গেছে। রায়হান আর বেঁচে নেই। ওর লাশ সুইমিংপুলে ডুবে আছে।
প্রথমে রশ্নি মনে করলো ও স্বপ্ন দেখছে। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে ওর মাকে বললো,
—-আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। রশ্নি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে পুলের কাছে চলে গেলো। ও যেই পানিতে নামতে যাবে ওমনি ওর বাবা এসে ওকে টেনে ধরলো। হাসান জোয়ার্দার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবলো এ জন্য হয়ত সবাই বলে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। কিছুক্ষনের মধ্যে আর জে গ্রুপ অব কোম্পানীর কর্ণধারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লো। সাংবাদিকরাও রশ্নি মহলে এসে মিডিয়াতে নিউজ করলো। খবর পেয়ে ব্যবসায়ীরা সবাই রশ্নি মহলে ভীড় করতে লাগলো। রশ্নির মা রশ্নিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগলো। গতকাল রাত বারোটা পর্যন্ত সবাই রায়হানের সাথে রশ্নিমহলে ছিলো।

সাংবাদিকদের রায়হানের বাবাই ম্যানেজ করতে লাগলো। ইতিমধ্যে থানার ইনচার্জ মোহাম্মদ বক্সি চলে এসেছে। পুলের চারপাশটা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। বক্সি মৃতের দিকে তাকিয়ে দেখলো। হাত পা শক্ত হয়ে আছে মনে হয় অনেকক্ষণ আগেই মৃত্যু হয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল আটটা বাজে। বক্সি আবারো মৃতের দিকে তাকালো। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ চোখ দুটি আতঙ্কিত বিষ্ফোরিত। সারা শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। শুধু পুলের চারপাশে মাটির উপরে হিংস্রপ্রাণীর নখের আঁচড়ের দাগ আর বড় বড় পায়ের ছাপ রয়েছে।

ওসি বক্সি রশ্নি মহলের গার্ড বাগানের মালী ড্রাইভার বাবুর্চি কাজের হেলপার দুইজন সবাইকে জিজ্ঞাসা করে তেমন কিছু জানতে পারেনি। বক্সি ওদের বললো,
—–লাশ তোমাদের মধ্যে কে সবার আগে দেখেছে?
গার্ড আক্কাস মিয়া বললো,
—–আমি ফজরের নামাজ পড়ে পুরো বাড়ি টহল দেই। তখন পুলের কাছে এসে দেখি সাহেব পানিতে ডুইবা রইছে। তারপর সবাইরে ডেকে দেই। তখন একসাথে সবাই ঘুম থেকে উঠে লাশের কাছে চলে আসে।
বক্সি আবার বললো,
—-তুমি কি দেখছো সাহেব রাতে কখন পুলের কাছে আসছে?
—–না স্যার আমি দেখি নাই। আমি রাত দুইটা পর্যন্ত জাইগা ছিলাম।
ওসি আবার লাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো। মৃতের চোখ দুটি কিসের আতঙ্কে ঐ ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে আছে বোঝা গেলো না। হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ তার মানে মৃত বাঁচার চেষ্টা করেছিলো। বক্সি ভাবছে উনি যেহেতু সাঁতার জানেন তাই পানিতে ডুবে মরার প্রশ্নই আসে না। ইটালী থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথরের মেঝেতে লাশটা পড়ে আছে। যাই হোক সবকিছু ধোঁয়াসা রয়ে গেলো।
ওসি বক্সি রশ্নির সাথে দেখা করতে চাইলো। হাসান জোয়ার্দার বক্সিকে দোতালায় নিয়ে গেলো। রশ্নি গোসল করে ফ্রেস হয়ে নিজের রুম থেকে বের হয়ে এসে বক্সির সামনে বসলো।
—ম্যাডাম আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
—ওতো সবার খুব মাই ডিয়ার মানুষ ছিলো। ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা আলাদা ব্যাপার। এটা থাকলে সবাই ব্যবসায় উন্নতি করে। এ ছাড়া তো ওর তেমন কোনো শত্রু ছিলো না। সবার সাথে সুন্দর সম্পর্ক রক্ষা করে চলতো।
রশ্নির মোবাইলটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে জয়া ফোন দিয়েছে। রশ্নি ওসিকে বলে ওখান থেকে বের হয়ে জয়ার সাথে ফোন কথাটা সেরে নিলো। তারপর ওসিকে বললো,
—-আপনারা কি লাশ এখনি ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাবেন?
—তাইতো ভাবছি। লাশ নিয়ে যাওয়া উচিত।কারণ অনেক আগেই মারা গিয়েছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে অসুবিধা হবে।
—আমার আর রায়হানের এক বন্ধু আধঘন্টার মধ্যেই চলে আসবে। ওর নাম জয়া। ও এসে লাশটা দেখার পর আপনারা নিয়ে যান। আমি মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত। আমাকে যদি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার না থাকে তাহলে আমি রুমে যাই।
—-ঠিক আছে আপনি বিশ্রাম করুন। রশ্নির মা রশ্নির সাথে সাথে ঘরে চলে আসলো।
রশ্নি ঘরে এসে ওর মাকে বললো,
—-মা আমি একটু একা থাকতে চাই।
রশ্নির মা এই কথা শুনে চলে গেলো। ওনারও মনটা খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা কিভাবে এই শোক সামলাবে?একটা সন্তান থাকলেও ওকে বুকে জড়িয়ে রায়হানকে ভুলতে পারতো। সে ভাগ্য মেয়েটার হলো না।
রশ্নি নিজের রুমে বসে গতরাতের কথা মনে করলো। রায়হান ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলো। ওর গলায় চিবুকে রায়হানের সোহাগের দাগ তখনও রয়ে গেছে। কেন ওর সাথে এমন হলো। বারোটা বছর ধরে ওকে রায়হান মন উজাড় করে ভালবেসেছে। ওর এতোদিন সন্তান হয়নি সেটা নিয়ে কখনও কোনো কটু কথা রায়হান ওকে বলেনি। ওর রাতের স্বপ্নের কথাও মনে পড়লো। সাথে সাথে ওর শরীরের পশম কাঁটা দিয়ে উঠলো। রশ্নি ভাবছে ওর স্বপ্নটা কি কোনো ইঙ্গিত বহন করে। নাকি ওটা নিছক একটা স্বপ্ন। হঠাৎ রশ্নির মনে পড়লো ওর শ্বশুর কেন রায়হানকে রাতে একা বাগানে যেতে নিষেধ করেছে। কারণটা ওর জানতে হবে। দরজায় কে যেন নক করলো। রশ্নি দরজা খুলে দেখে জয়া দাঁড়িয়ে আছে। ও জয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—জয়া আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো। রায়হান শুধু মরে যায়নি আমাকেও মেরে রেখে গেছে। আমি জীবন্ত লাশ হয়ে কি করে বেঁচে থাকবো?
—–সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোকে অনেক শক্ত থাকতে হবে। রায়হানের বিশাল ব্যবসা
সব তোকেই দেখাশোনা করতে হবে। ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
জয়া রশ্নির কাছে আসার আগে বাগানে সুইমিংপুলে রায়হানের লাশটা দেখে এসেছে। হাসান জোয়ার্দার এসে রশ্নিকে বললো,
—-বউমা পুলিশ লাশ নিয়ে যেতে চাইছে।
রশ্নি রুম থেকে বের হয়ে রায়হানের লাশটা দেখতে নিচে গেলো। জয়াও রশ্নির পিছনে পিছনে হেঁটে গেলো। রশ্নি লাশের নিকটে গিয়ে তাকিয়ে থাকলো। রায়হানের মুখটা কি নিঃষ্পাপ লাগছে। হঠাৎ জয়া দেখতে পেলো বাগানে এক সুদর্শন যুবক হেঁটে বেড়াচ্ছে। জয়া ওসির পানে তাকিয়ে বললো,
—এখানেতো বাইরের মানুষ এখন আসা নিষেধ।
—-এখানে আসাও নিষেধ। আর তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কেউ বের হতে পারবে না।
জয়া বাগানের দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেবকে বললো,
—-তাহলে উনি কে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here