[১]
ফুলে সজ্জিত রঙিন ঘরে ফ্যানের সাথে লা’শ হয়ে ঝুলে আছে নীহা’র স্বামী। টকটকে লাল বেনারসি গায়ে জড়িয়ে যখন বাসরঘরের উদ্দেশ্যে ঘরে পা রাখলো, ফ্যানের সাথে ঝুলে থাকা মানুষটিকে দেখে থমকে গেলো চোখজোড়া। জীবনের সমস্ত রং শুষে নিলো কোনো এক রংচোষা যন্ত্র।
নীহার ননদ ভাইকে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করেছে। একটু আগেও ঘরটি ফাঁকা ছিলো। ভাবীকে নতুন সাজে বাসরঘরে দিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই পা রেখেছিলো সুফিয়া। ভাইকে অনেকক্ষণ যাবত না দেখে ভেবেছিলো কল করে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলবে। কিন্তু ভাই যে সারাজীবনের জন্য আসল ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে?

সুফিয়ার চিৎকারে লোক জড়ো হলো। চারদিকে বিষাদময় করুণ সুর আঁ’চড়ে পড়লো। নীহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষণিকেই চেহারার ঔজ্জ্বল্য বর্ণ খৈ হারিয়ে মুখশ্রীতে দেখা দিয়েছে মলিনতা, বিষাদের ছাপ। ভেতরে দাপুটে ঝড়ের হাতছানি। প্রথমদিকে বিয়েতে সে নারাজ ছিলো। যতই বিয়ের প্রস্তাব আসুক না কেনো, ছেলে তার পছন্দ হয়নি। শেষ যাত্রায় কিভাবে যেনো নাহিদ’কে পছন্দ হয়ে গেলো। বিয়ের কথাবার্তা আগালো। নিপুনভাবে বোনা স্বপ্নগুলো নিয়ে পা বাড়ালো নতুন যাত্রায়। কিন্তু স্বপ্নগুলো সব তাল হারালো, এলোমেলো হয়ে পড়লো। শরীরে কালিমা লেপন হলো ‘ সে এক বিধবা নারী, অল’ক্ষী নারী।’

নাহিদের ঝুলন্ত লা’শ মাটিতে নামানো হলো।
সবাই হায়হায় করছে। নীহার শরীরের লাল শাড়ি ছাড়িয়ে সাদা শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হলো। টেনে’হিঁচড়ে গয়নাগাটি খুলে রাখা হচ্ছে। অথচ দুপুরেই কত রংঢং করে গয়না পড়ানো হলো তাকে, মুখ ভারী করলো নানাবিধ প্রসাধনী ব্যবহারে। কেমন গুমোট ভাব ঝেঁকে ধরেছে নীহাকে। শুষ্ক চোখজোড়ায় খরা দেখা দিয়েছে। এক ফোঁটা পানি তার কপোল স্পর্শ করছেনা। চারপাশের মানুষজন এতে আরও যেনো লাই পেলো। ছিঃ ছিঃ করছে নীহাকে নিয়ে।

-“কেমন মেয়ে গো এটা? বিয়ে করে শশুর বাড়ী আসতে না আসতেই স্বামীকে খেয়ে বসলো। এখন দেখো তার দু-চোখে একফোঁটা পানির ঠাঁই নেই।”

নীহা’র কোনো পরিবর্তন হলোনা। কোলাহল, কান্নার শব্দে মাথা ভারী হয়ে উঠলো। ঝিম ধরে যাচ্ছে প্রতিটি নিউরন। খবর পেয়ে নীহা’র বাড়ি থেকে ছুটে আসলো তার পরিবারের লোকজন। বাবা, মা, বোনকে কাছে পেয়ে দলাপাকানো কান্নারা যেনো বাঁধ ভাঙলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো নীহা।

ভাইয়ের কথা শুনে হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসলো নাফিজ। সে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা ব্যাপারটা। ভী’ত ঢোক গিলে ছুঁয়ে দিলো নাহিদের ঘুমন্ত চোয়াল। চোখে ফেটে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা উষ্ণ জল। মা জ্ঞান হারিয়েছে, ছোটবোন বেতাল হয়ে পড়ে পড়ে কাঁদছে। নতুন যে মেয়েটা আজ এ বাড়িতে বউ হয়ে আসলো সে ও নিশ্চয়ই কাঁদছে? আচ্ছা কেমন কাঁদছে? খুব বেশিই নাকি কম কাঁদছে?
চারদিক তাকেই সামাল দিতে হবে।

বেশি দেরি করা ঠিক হবেনা। সকল দায়িত্ব এখন নাফিজের ঘাড়ে। লা’শ দ্রুত ঘর থেকে বের করা হলো। লা’শ ঢাকার জন্য আলমারি থেকে নতুন বিছানার চাদর বের করতে গিয়ে এক টুকরো কাগজ এসে পড়লো পায়ের কাছে। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হলো নাফিজের। একটি খোলা কাগজ। ভাঁজ করা হলে হয়তো এতটাও কৌতুহল জেগে উঠতোনা। নাহিদের মৃ’ত্যুটা কিভাবে হয়েছে ভাবতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেনা। ঝটপট পড়ে ফেললো কাগজটি। ভাইয়ের কিছু তিক্ত অনুভূতি পড়তেই ভেতরটা মুচড়ে উঠলো নাফিজের। পড়া শেষে ভাঁজ করে খুব সন্তর্পণে নিজের পকেটে গুঁজে নিলো কাগজটি। বিছানার চাদর হাতে নিয়েই ঘর ছাড়লো।

বাইরের ঘরে মালেক চাচার মেয়ে শাহনাজকে চোখের পানি আড়াল করতে দেখা গেলো। নাফিজ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে পকেটে গুঁজে রাখা সাদা কাগজে চোখ রাখলো। “পাপ কখনো বাপকে ও ছাড়েনা”। কিন্তু আত্ম’হ’ত্যা কোনো সমাধান নয়, এই কথাটি মানুষ জানলেও বুঝে উঠতে পারেনা।

লা’শের সকল কার্যাদি সম্পন্ন হলো। হায় আফসোস নিজ দোষেই আজ ছেলেটা কবরস্থানে ঠাঁই পেলোনা। তার স্থান হলো পুকুর পাড়ের নিচু অংশে। যত মানুষ তাকে দেখতে এসেছিলো তার কানাকড়ি মানুষকেও জানাজায় পাওয়া যায় নি। গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজন
কে দেখা গেলো জানাযায়।

বিয়েটা যেহেতু হয়েছে তখন নীহাও ইসলামী নিয়মের উর্ধ্বে নয়। অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে হলেও অন্তত চারমাস দশদিন অপেক্ষা করতে হবে। স্বামীর বাড়িতেই স্থান নিতে হবে তাকে। এমন হৃদয় ভাঙা পরিবেশে কারোরই গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। প্রেমা হাজার চেষ্টা করেও বোনের মুখে একদানা খাবার তুলতে পারলোনা। নাফিজ একবার পর্দার আড়াল থেকে মহিলাদের খাবারের তদারকি করে গেলো।
প্রত্যাশিত কন্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই আড়াল থেকে বের হলো প্রেমা। বিরস মুখে জবাব দিলো,

-” আপুকে কিছুতেই খাওয়াতে পারছিনা। একটু পানিও মুখে তুলছেনা।”

চতুর্দিকের চিন্তায় মাথাটা টনটন করে উঠলো নাফিজের। ডান হাতে কপাল চেপে ব্যথা নিবারনের চেষ্টা করলো।

প্রেমা যেনো মুহুর্তেই বুঝে গেলো মানুষটার ভেতরকার কথা। ঝট করে বলে উঠলো,

-“আপনার কি মাথাব্যথা হচ্ছে?”

-“নাহ। তোমরা সবাই খেয়ে নাও। আর উনাকে ও খাওয়ানোর চেষ্টা করো।” বলেই সরে দাঁড়ালো।

প্রেমা চেয়ে থাকলো নাফিজের যাওয়ার পথে। আপুর যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন বরের পাশে বসে থাকা বরের ছোট ভাইকে তার মনে ধরে, ভীষণ মনে ধরে। প্রেমা নাফিজের বয়সের তুলনায় অনেকটা ছোট বলে নাফিজ ওকে তুমি করেই বলে। অবশ্য নীহা, প্রেমা দু’বোনই বয়সের তুলনায় নাফিজের ছোট। অষ্টাদশী প্রেমার একটাই আক্ষেপ,

-“ইশ! এই সুন্দর মানুষটা যেনো আমার হয়।”

অনেক বিড়ম্বনার পর মাত্র দু’লোকমা খাবার নীহাকে খাওয়ানো গেলো। রাত্রি কাটলো নিদ্রাহীন। নাফিজের মায়ের জ্ঞান ফেরার পর থেকেই থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। তার বড় ছেলে। সোনার টুকরো ছেলে এভাবে কেনো সবকিছুর মায়া ত্যাগ করলো? মায়ের মন ভুলবে কি করে? নাড়িছেঁড়া ধন কে কিভাবে ভোলা যায়? সবাই ভুলে গেলেও কোনো এক সুখের মুহূর্তে এসেও মা মুখ চেপে কাঁদবেন সন্তানের কথা ভেবে। যদি সন্তানটা থাকতো তবে আরেকটু, আরেকটু খানি সুখ ধরা দিতো।
আমাদের জীবন একটা বইয়ের মতো। বইয়ে যেমন নানা অধ্যায় থাকে। তেমনি জীবনে আর কিছু থাক বা না থাক সুখ, দুঃখ এ দুটি অধ্যায় অবশ্যই থাকে।
সুখের অধ্যায়টা যতটা সহজ দুঃখের অধ্যায় ঠিক ততটাই কঠিন। এর সময়সীমা ও যেনো অত্যধিক। অথচ সুখের মুহুর্ত গুলো স্রোতের গতিতে গড়িয়ে যায়।

[২]

জীবন থেকে হারিয়ে গেলো কিছু বিষাদময় দিন। এই দিনগুলো নাফিজের দায়িত্ব,কর্তব্যের ভেতর দিয়েই কে’টে গেলো। মা,বোন, বড় ভাইয়ের স্ত্রী সবার দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব একহাতেই সামলে নিলো নাফিজ। মাঝে একদিন মায়ের হাতে নাহিদের লিখা সাদা কাগজখানা তুলে দিলো। আজ আবার ও মায়ের চোখে পানি টলমল করছে, সাথে চোখদুটো চরম আশ্চর্য হলো।

প্রেমা বাবার সাথে আজ আবার নাফিজের বাড়িতে আসলো। চারমাস সময় অতিক্রম করেছে। এখন তো আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। আপুকে এখান থেকে নিয়ে যাবে তারা। হয়তো বাবা আবার ও আপুর বিয়ের তোড়জোড় শুরু করবেন। যখন শুনলো নাফিজ আজ কর্মস্থলে যায়নি তখন থেকেই প্রেমার ব্যস্ত চোখজোড়া নাফিজকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠলো। তার দেখা না পেয়ে নীহা’র কাছে গিয়েই বসলো। এ কয়েকমাসে নীহা’র রূপ-লাবণ্য কমে গিয়েছে। উজ্জ্বল চামড়া ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। নাওয়াখাওয়ায় শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে আছে। প্রিয় বোনের এমন দুর্দশা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো প্রেমা। নীহা মৃদু হেসে বলল,

-“এভাবে কাঁদছিস কেনো পা’গ’লি?”

প্রেমা কান্না চেপে বলল,

-” তোমার এই অবস্থা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা আপু। কি অবস্থা হয়েছে তোমার? তোমাকে চিনতে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।”

উত্তরে ম্লান হাসলো নীহা।
দুপুরে একসাথে খাওয়া শেষ করলো সকলে। তখনই নাফিজের দেখা পেলো প্রেমা। নাফিজ প্রেমাকে দেখে মুচকি হেসে খোঁজখবর জেনে নিলো। সবাই পাশে থাকায় আর লজ্জায় প্রেমা বেশি কথা বলতে পারলোনা। মাঝের সময়গুলোতেও কয়েকবার এসে বোনের সাথে সময় কাটিয়ে গিয়েছে প্রেমা। খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করতে ধীরস্থির হলেন প্রেমার বাবা। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলতেই বেয়ানের কথা শুনে চকিতে তাকালেন জয়নুল আবেদীন।

-“আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ। নীহা এই বাড়ির বড় বউ হয়ে আসলেও সে এই কয়দিনে আমার মেয়ের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। তাকে ছাড়া দিন কাটাতে আমার খুব কষ্ট হবে। আমি ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি চাই আপনারা বউমাকে আমার কাছেই আমানত রাখুন। নাহিদ নেই তো কি হয়েছে? নাফিজ বিয়ে করবে নীহাকে।”

নীহাকে নিয়ে তৈরি হয়ে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বসার ঘরে আসলো প্রেমা। নীহার শাশুড়ীর কথা শুনে পা যেনো চলছেইনা। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। ভেতরটা জীবন্ত অনুভূতি গুলো মাটি চা’পা দেওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নাফিজ লোকটা তার বোনকে বিয়ে করবে?
নীহা ও বেশ চমকালো। মনে হচ্ছে চোখের তারা ছুটে যাচ্ছে। আম্মা এসব কি ধরনের কথাবার্তা বলছে?

জয়নুল আবেদীন নিজেকে ধাতস্থ করে বেশ গম্ভীর সুরেই শুধালেন,

-“কিন্তু নাফিজ কি বিয়ে করবে নীহাকে?”

নীহার শাশুড়ী জয়নুল আবেদীনকে আশ্বস্ত করে বললেন,

-“নাফিজ এর মতামত নিয়েই বিয়ে হবে। আপনি চিন্তা করবেননা।”

খাবার খেয়ে ঘরেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো নাফিজ। ছোটবোন সুফিয়া এসে জানালো মা নিচে ডেকে পাঠিয়েছে। নিচে নেমে মায়ের প্রস্তাবে আশ্চর্য হলো নাফিজ। মায়ের চোখে ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস দেখলো নাফিজ।

প্রেমা নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে তার উত্তরের আশায়। নাফিজের ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই তার উত্তর কি হতে পারে। কি বলবে লোকটা? সে কি আপুকে বিয়ে করতে রাজি হবে?

কিছুটা সময় নিয়ে নাফিজ উত্তর দিলো। তার উত্তর শুনে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো প্রেমা।

#চলবে………

#পাওয়া_না_পাওয়া_সুখ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here