#পদ্মফুল – শেষ পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
________________________
কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই লুটিয়ে পড়লাম আমি। চোখের জলে চেহারা মাখামাখি। উর্মি আমাকে কষ্ট পেতে দেখে তারও চোখ ছলছল করে উঠল। এসে আমার পাশে বসল। বলল,
‘ আপা, তুমি সত্যি মহসিন ভাইর সাথে প্রেম করো? ‘
আমি কি বলব? কি উত্তর দিব? ছোট বোনকে প্রেমের কথা বলতে লজ্জা লাগছে। আমি শুধু মৃদু মাথা দুলালাম। উর্মি বললো,
‘ আব্বা আজকে তোমাকে মেরে ফেলবে আপা। আমার খুব ভয় লাগছে। ‘
‘ মেরে ফেলুক। মেরে টুকরো টুকরো করে দিক। তবুও আমি তারে ছাড়ব না। হাত ধরেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে না। ‘
আমি ভীষন তেজদীপ্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে উর্মি ভয়ে সিটিয়ে গেল। আম্মা পাশের ঘর থেকে ঝাড়ু হাতে আমার দিকে তেড়ে আসলেন। আমার পিঠে শক্ত এক ঝাড়ুর আ’ঘাত পড়লে আমি আর্তনাদ করে উঠি। পিঠের চা’মড়া উঠে গেছে বোধ হচ্ছে। এবার স্বশব্দে কেঁদে ফেলি। প্রেম যদি এত কষ্টের হয়, তাহলে আমি কেন এই কষ্টে জড়ালাম। আফসোস হচ্ছে এখন। আম্মা আরো কটু কথা শোনালেন। যা মুখের বলার মত সভ্য না। যে আম্মা আমাকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিতেন, যে আম্মা আমার এক ফোঁটা চোখের জলে গলে যেতেন মোমের ন্যায়, সে আম্মা আজকে আমাকে মানসিক ও শারীরিক ভাবে আ’ঘাত করে ক্ষতবিক্ষত কর দিচ্ছেন। মহসিনের সাথে কথা বলা এইমুহুর্তে খুব প্রয়োজন। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। একটা বিহিত করতে হবে এবার।

আমি অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালাম। সম্পূর্ণ গা ব্যথায় বিষে যাচ্ছে। নড়তে পারছি না একদম। উর্মি এসে আমাকে ধরল। আমার গা গরম দেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল,
‘ আপা, তোমার জ্বর উঠছে। ‘
‘ উঠুক। গা পু’ড়ে যাক। আল্লাহর কাছে চলে গেলে শান্তি হবে আমার। ‘
উর্মি এই যেন কেঁদে ফেলবে। আমার উর্মির কান্না শোনার মত সাহস নেই। উর্মি আমাকে ধরে বিছানায় বসাল। আমি বালিশে হেলান দিয়ে বললাম,
‘ আব্বার ফোন কোথায় থাকে জানিস?
উর্মি আঁতকে উঠল। বলল,
‘ তুমি কি আবার মহসিন ভাইর সাথে কথা বলবে?
আমি নিভু কণ্ঠে বললাম,
‘ হু। ‘
‘ আল্লাহ, আপা তুমি পাগল হয়ে গেছ। এত মা’ইর খেয়েও শিক্ষা হয়নি? ‘
আমি এবার কঠিন হলাম। বিষ চোখে উর্মির দিকে চেয়ে বললাম,
‘ তুই এনে দিবি কি না বল। ‘
উর্মি হতাশ চোখে আমাকে দেখল খানিক। আপা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে ভাবছে। এখন উর্মি কিংবা মায়ের মাইর কোনোভাবেই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না, বুঝে যায় উর্মি। ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে উর্মি আব্বার ঘরের দিকে যায়। ড্রয়ারের কর্নার থেকে ফোন এনে আমাকে দেয়। আমি মহসিনের নাম্বার ডায়াল করতে করতে উর্মিকে বললাম,
‘ দরজা লাগা। ‘
‘ আম্মা জানলে তোমার সাথে সাথে আমারেও মা’রবে। ‘
‘ তুই চলে যা। দরজা আমি লাগাচ্ছি। ‘
উর্মি চলে গেল না। দরজার সিটকিনি আটকে দিয়ে আমার পাশে বসলো। আমার সারা গায়ে মারের দাগ। উর্মি সেসব হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। হঠাৎ হাতের উপর পানির উপস্থিতি বুঝতে পারলাম। উর্মি কাদঁছে। আমার উর্মিকে খুব জোড়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। তবে ধরলাম না। গায়ে গতরে যে আমার সেই শক্তিও নেই।
মহসিন কল ধরল।
‘ হ্যালো, মৌরি? কেমন আছ? আমি ভাবিনি এই বিকেল বেলা তুমি কল করবে। কিছু কি হয়েছে? আর তুমি তোস্পোর্টস কোথায় পেলে? ‘
আমি আর চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। তার আহ্লাদী কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। সে হন্তদন্ত হয়ে গেল। দ্রুত বলল,
‘ এই তুমি কি কাদছ? কি হয়েছে, মৌরি? বাড়িতে সমস্যা হয়েছে? ‘
‘ ও-ওরা আমায় খুব মে’রেছে। আমার সারা গায়ে ব্যথা। আমি আর এসব নিতে পারছি না। ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। ‘
সে চুপ হয়ে গেল। আমি জানি, সে এখন রাগে ফুসছে। হয়ত পরিকল্পনা করছে আমার বাড়িতে হামলা করার। তার রাগ সম্বন্ধে এলাকার সবাই জানে। অযথা রাগ করে কাউকে পে’টা’নোর রেকর্ড আছে তার। আমি শুধরে দিলাম,
‘ আপনি আমার বাড়ির লোকদের কিছু বলবেন না। ‘
সে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘ ওরা তোমার নিজেদের লোক? এইটুকু মেয়েকে কেউ এমন ভাবে মারে? তুমি কোথায়? আমি আসছি। এক্ষুনি পালাব আমরা। ‘
‘ এই না। এমন কিছুই করবেন না আপনি। আমি আমার বাড়ির সম্মান নষ্ট করব না। এটাই হয়ত আপনার সাথে আমার শেষ কথা। আজ একটা কথা বলব। আমার এই মার খাবার পেছনে আপনার বন্ধু কামালের হাত আছে। ও ভাইকে আমার আপনার কথা সব বলেছে। মা ঘরের বাইরে ভাইর সাথে এই নিয়ে কথা বলেছে,শুনেছি। আপনাকে একটা উপদেশ দেব, ভালো বন্ধুদের সাথে মিশবেন। এমন না হয় আপনার বন্ধুদের জন্যেই আপনি ডুবে গেলেন। ভালো থাকবেন। বাড়ির সকলের কথা শুনবেন। আর মারামারি করবেন না। আমি নিজে থেকে কথা না বলা অব্দি এসে কথা বাড়াবেন না। দোহাই আপনার। রাখছি। ‘
মহসিন হতবম্ব হয়ে গেল। বলল
‘ এই পাগল হয়ে গেছ? এসব কি বলছ? সব ঠিক হয়ে যাবে। এখনই হার মেনে সব শেষ করে দেওয়ার কি মানে? এই মৌরি, মৌরি। কথা বলো। ‘
আমি আর শুনতে পারলাম না তার কথা। কল কেটে ফেললাম। উর্মির হাতে ফোন দিয়ে বললাম,
‘ যে জায়গায় ছিল ঠিক সেই জায়গায় ফোন রেখে আয়। কেউ যেন বুঝতে না পারে। ‘
উর্মি এখনো বিস্ময় চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি ঠোঁট কা’মড়ে ধরে দাত দিয়ে নখ খুটছি। কান্না চেপে রাখার ফলে গাল দুটো ফুলে উঠছে। চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। উর্মি ফোন রেখে এসে আমার পাশে বসলো। বলল,
‘ আপা, তুমি কি মহসিন ভাইকে ছেড়ে দিলে? ‘
‘ না, সময় আসুক। আমি উনাকেই বিয়ে করব। কিন্তু এখন আমাদের দূরে থাকতে হবে। এতে আমারও মঙ্গল তারও মঙ্গল। ‘
___________________________
আব্বার পায়ে ধরে আমি সেদিন কথা দিয়েছিলাম আমি মহসিনের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখব না। তাকে ভুলে যাব। আব্বা সেদিন কি যে খুশি হয়েছিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন অনেকক্ষণ। বাড়ির সবাই সম্মানের কথা ভাবল। আমার কথা ভাবার কারো সময় নেই। আমার বুকে বয়ে চলা তুফানের কথা কেউ বুঝেও বুঝল না। এই দুঃখ বয়ে বেড়ালাম ১০ বছর। তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। সে প্রথম প্রথম এসে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করত। আমি করতাম না। শুধু একবার বলেছি, আপনি বড় হলে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন। বউ হয়ে যেদিন যাব আপনার বাড়িতে সেদিন আপনার সাথে কথা হবে। তার আগে নয়। ‘
সে রেগেমেগে অস্থির। আমার এমন অবুঝ আচরণ সে নিতে পারল না। তারপর রাগে আর আমার সাথে কথাই বলল না।
অনার্স শেষ করে আপাতত ঘরে বসে আছি। ইতিমধ্যে অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ভালো ভালো ঘর আমাকে তাদের ঘরের ঘরণী করতে চায়। মা বেশ গর্ব করে এই প্রস্তাবগুলো আমার সামনে তুলেন। অথচ আমি এক বাক্যে মানা করে দেই। বড় হয়েছি। ছোটখাটো জব করি। আব্বা মারা যাওয়ায় ভাই আর আমি মিলে সংসার চালাই। হয়ত রোজগার করি বলে মা আমায় আর কিছু বলেন না। কেটে যায় কয়েক দিন। আগের চেয়ে আমি আরো বেশি চুপচাপ হয়ে যাই। তার জন্যে অপেক্ষা করেছি এতবছর যাবত। অথচ এখন তার কোনো খোঁজ নেই। শুনেছি ঢাকা আছে। বড় লোক হয়েছে। উর্মির ফেসবুকে তার ছবি দেখলাম। আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছে। জিম শেখায় ঢাকায়। বডি যেন ফুলে ফেঁপে ঢোল। এই ফেঁটে যাবে ভাব। এমন প্রতিদিন জিম করলে নিশ্চয়ই জয়েন টয়েন ছিঁড়ে যাবে। অথচ তাকে এসব কে বোঝায়? বাড়ির লোকদের কথা নাকি ঠিকঠাক শুনে না। আস্ত বেপরোয়া হয়েছে। সবাই ভাবছে, এবার বিয়ে করাবে। আমি তীর্থের কাকের ন্যায় তার পথ চেয়ে বসে আছি। সে কবে আসবে?

একদিন ঘুমুতে যাওয়ার আগে ভাইর ঘরে আমাকে নিয়ে কথা শুনতে পেলাম। এতদিন পর মহসিন নামটা শুনে আমার বুক কেপে উঠল। তার নাম এতবছর পর আবার উঠছে কেন? আমি বুকে হাত চেপে ভাই এর ঘরের দরজার আড়ালে লুকালাম।
আম্মাকে কথা বলতে শুনলাম,
‘ চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। মহসিনের জন্যে ওরা মৌরিকে চাইছে। ‘
‘ চাক। চাইলেই আমাদের মেয়ে আমরা দিয়ে দেব? ‘
‘ তোর আর তোর বাপের এই রাগের জন্যে মৌরি মহসিনের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। এখনো ওরা দুজন আলাদা। কিন্তু মৌরি আলাদা থাকলেও কাউকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। মহসিনকে বিয়ে করলে ক্ষতি কি? গ্রামে তাদের মান সম্মান বেশ ভালো। সবাই চেনে তাদের। ‘
‘ ওদের বাড়ির ছেলে আমাদের বাড়ির মান সম্মান ডুবিয়েছে, আম্মা। মৌরিকে ফাঁসিয়েছে ওই পোলা। ‘
‘ চুপ থাক। মৌরি আমাদের দিকে চেয়ে ওই ছেলেরে ভুলে গেছে। এখন ওই বাড়ীর লোকেরা নিজে মৌরিকে চাইছে। তোর এসব মান সম্মান দিয়ে মৌরির জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এতদিনে বুঝে গেছি, মৌরি ওই ছেলে ছাড়া কাউরে বিয়ে করবে না। পাগল হয়ে গেসে এই মেয়ে। শোন, ভালোই ভালোই ওদের বিয়ে দিয়ে দে। নাহলে পরে পস্তাতে হবে। যখন বাড়িতে অবিবাহিতা বোন তোর ঘাড়ে লটকে থাকবে, তখন বুঝবি। সময় থাকতে আমার কথার দাম দে। বুঝছস?
আম্মা বিছানা থেকে উঠে গেলেন। আমি দরজার আড়াল থেকে সরে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমার আর উনার বিয়ের কথা চলছে? খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এল। এই বুঝি কেঁদে ফেললাম। রাতে খাবারের পর উর্মি এল। এসে আমার দিকে শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আম্মা দিয়েছে। কাল তোমারে দেখতে আসবে। জানো কে আসবে?’
আমি খুশিতে উর্মিকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
‘ আমি তাকে পেয়ে যাচ্ছি রে উর্মি। এত খুশি কোথায় রাখব? উর্মি আমার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। ‘
উর্মি হেসে ফেলল। আমাকে উত্তেজনা আর বাঁধ মানছে না। প্রায় দশ বছর পর আমি এভাবে প্রাণখুলে হাসলাম। আম্মা আমাকে নিয়ে এত ভাবেন, ভাবলে শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।
____________________________________
অতঃপর আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। ভাইকে দেখলাম। বেশ হাসিখুশি। মহসিনের বাড়ির লোকদের বেশ খাতির দারি করছে। মহসিন আমাকে নিয়ে ফটোগ্রাফারের সামনে এটা সেটা করে ছবি তুলছেন। আমি তাকে চোখ ভরে দেখলাম। আগের চেয়ে গায়ে গতরে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গেছেন। প্রতিদিন ওয়ার্কআউট করা দেহ বেশ চোখে লাগছে। আমি তার দিকে সম্মোহনের ন্যায় চেয়ে আছি। কামালকে দেখলাম না কোথাও। হয়ত সেদিনের পর তার সাথে সকল যোগাযোগ ছিন্ন করেছে মহসিন।

মামীর মুখে তার ভালোবাসার পুরো গল্প শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মামীর চোখে জল। অথচ আমি দেখলাম, এ জল সুখের জল। ভালোবাসার মানুষকে শত চেষ্টা করে নিজের করে পাওয়ার জয়। মামী যুদ্ধ করেছেন। ভালোবাসার মানুষের জন্যে তিনি সকল বাঁধা পেরুতে রাজি ছিলেন। তাই তো আজ মামা এবং মামীর ভালোবাসাটা আমাদের সবার চোখে পড়ে। মামা মামীর ছোট থেকে ছোট বিষয় ভীষন খেয়াল করেন। মামীর হাত পুড়ানোর অভ্যাস। মামাকে দেখেছি, মামীর হাতে খুব যত্ন করে মলম লাগিয়ে দিতে। দুজনের অ্যানিভার্সারি ছিল আজ। সেই উপলক্ষে মামী আজ তার ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছেন আমায়। আমি বড্ড ভালো লাগা থেকে বললাম,
‘ মামী, মামার দেয়া প্রথম উপহার কি ছিল?
মামী হেসে বললেন,
‘ বিয়ের দিন মোহরানা পেয়েছি। তবে বিয়ের পরের দিন নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম দুজন। তোমার মামা নদী থেকে একটা পদ্মফুল আমায় এনে দিয়েছেন। পদ্মফুলই তার দেওয়া প্রথম উপহার ছিল। ‘

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here