নীল ধ্রুব তারা

পর্ব তৃতীয় (ধারাবাহিক গল্প)

**

শাহানা জেসমিন
——————————–

আজকে ক্লাসে গেলাম না।একদম ভালো লাগছিল না ক্যাম্পাসে বসে আছি।বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগছে। বার বার মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আহা!মা কত বছর তোমাকে দেখি না!

কাল অনেক ক্ষন বৃষ্টি তে ভিঁজেছি,মনে হচ্ছে আকাশ পাতাল জ্বর আসছে। মার চেহারা মনে করতে পারি না। জানি না মায়ের চেহারা কেমন। মার শরীরের গন্ধ কেমন। মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকার স্বাদ কেমন আমার জানা নেই!

আজকে বার বার ফুপ্পির কথা মনে হচ্ছে। সামনে সপ্তাহে ফুপ্পির কাছে যাব।

আমার একটা ভয়ংকর দিক সব সময় চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। আয়নার মতো স্বচ্ছ। এ দৃশ্য টা আমি কখনো সরাতে পারি না। এর সঙ্গে আমার মা আর বাবার একটা ভয়ংকর স্মৃতি গন্ধ লেগে আছে।
আমার বাবাকে পছন্দ কেন করি না এ স্মৃতির সঙ্গে জড়িত।

আমি দেখলাম অনুসুর্য এদিকে আসছে।আমাকে বলল,

——কিরে দেবযানী আজ ক্লাসে যাস নি কেন, শরীর খারাপ না কি? আজকে ম্যাম চমৎকার করে পড়া বুঝিয়ে দিলো।একদম মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

——আচ্ছা আমাকে নোট দিও। আমি না বুঝলে তোমার কাছে বুঝে নিব।

——তোর এ স্বভাব টা আর গেলো না তুমি করে বলাটা।

—— সেটাই তো ভালো তাই না। আর তোমার হাতে সিগারেট কেন? তুমি তো প্রমিজ করেছো আর টাচ করবে না।

—–অবশ্যই খাব, আমার কথা না শুনলে অবশ্য ই টাচ করবো।

——-দেখো অনুসুর্য , আমার ভয়ংকর একটা অতীত আছে। আমার মস্ত বড় একটা ক্ষত আছে।

—–আমি কোন অতীত চিনি না, জানি না,আমার কাছে বর্তমান ই সব। চল দেবযানী টং চা খাই।

—–আমি এখন রুমে যাব,আমি একটু রেস্ট করব,বিকেলে গুলিস্তান যাব।একটা টিউশানি আছে সেটা কনফার্ম করতে হবে।

—–টিউশানি না করলেও চলে তোর।তুই কিছু ভুলে থাকার জন্য টিউশানি করিস আমি জানি।

আমি আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম হলের দিকে।

অনুসুর্য চিৎকার করে বলল,
—–আমি এতো কিছু বুঝি না, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। তুমি কেন আমাকে বুঝতে পারছ না দেবী। তোমাকে ছাড়া আমার একদম চলবে না। আমি তোমাকে জনম জনম ভাল বাসি। আমাকে তুমি এড়াতে পার না দেবী।

**
বিকেলে আমি হাঁটতে লাগলাম, নীল ক্ষেত যাব। একটা বই এর দোকানে যাব।কতগুলো গল্পের বই কিনবো,কবিতার বই ও সাথে।
একটা গল্প মনে হচ্ছে, এক ভদ্রলোক বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি চাকুরী টা ছেড়ে দেন।পুরাতন বই এর দোকান দেন।সারাক্ষণ বই পড়েন।

এই ভদ্রলোক এর কি নাম এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে না।আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি , আমার পেছনে পেছনে অনুসুর্য আসছে। অনুসুর্য গান ধরলো,

সেই ভালো সেই ভালো,না হয় না জানো……

অনুসুর্য র গান আমার মাথায় ঘোরপাক করতে লাগলো।

অনুসুর্য কে বললাম,

এক ভদ্রলোক বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক , চাকুরি বাদ দিয়ে পুরাতন বই এর দোকান দেয়, কিন্তু তার নামটা এ মুহুর্তে মনে হচ্ছে না,তুমি কি এ গল্প টা জান?

——–তোমার শরীর খুব খারাপ দেবী, হলে চল।

আমি বললাম আমি গুলিস্তান যাব , সেখানে টিউশানি টা কনফার্ম করতে হবে। তারপর যাব কাঁটাবন কনকর্ড ভবনের উজানে। আমার বিশেষ দরকার , একজন আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

দিলু রোডে আমার এক কাজিন থাকে। সেখানেও যাব। তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে অনু?

অনুসূর্য আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। আসলে দিলু রোডে আমার কোন কাজিন থাকে না। আমি মাঝে মাঝে কল্পনা য় কিছু চরিত্র নিয়ে আসি। দিলু রোডে আমি কোন দিন যাই নি। কিন্তু আমি কল্পনায় প্রায়ই এ কাজিন কে দেখি।

আমার এ কাজিনের নাম লুছমি। সে খুব ছোট কালে হারিয়ে যায়। সে হারিয়ে যায় পদ্মার সারা ঘাট থেকে। তারপর সে কিভাবে যেনো একটা অনাথ আশ্রমে আসে। সেখানে সে অল্প কিছুদিন থাকে। এক লন্ডনীয় নিঃসন্তান দম্পতি লুছমিকে দত্তক নেয়। লুছমি সেখানে বড় হয়, সে একসময় ডাক্তার হয়। সে এক সময় জানতে পারে তার দত্তক নেয়া বাবা মার কাছে,তার সম্পর্কে।

লুছমি অস্থির হয়ে তার শেকড়ের খুঁজে এ দেশে আসে। সে অনাথ আশ্রমে খোঁজ করতে থাকে কিন্তু কোন কিছু ই সে পায় না। তার কোন ডকুমেন্টস ও নেই সে অনাথ আশ্রমে। সে খুব ই আশ্চর্য হয়। সে পর্যায় ক্রমে সব হোমস গুলোতে খোঁজ করতে থাকে।
লুছমির লন্ডনে বাবা মার কাছেও কোন ডকুমেন্টস নেই। তাকে কোন আইন অনুযায়ী দত্তক ও দেয়া হয় নি।
লুছমি চিন্তা করে সে এ দেশের অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করবে। আজকে বার বার লুছমি কে কাছে দেখতে পাচ্ছি যেনো।

অনুসুর্য আমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। কোন কথা বলছে না। আমার মনে হচ্ছে আমি আর অনুসূর্য চলন্ত ট্রেনের মতোই। আমাদের পাশ কাটিয়ে আর একটা ট্রেন চলে গেলো সাঁ করে। এ ট্রেন কোথায় যাচ্ছে তার কোন গন্তব্য নেই যেনো।ট্রেনের দু পাশে ঘন ঝোপঝাড়। একটা বিশাল বড় কামিনী ফুলের ঝাঁড় দেখতে পেলাম। কামিনী ফুলের ঝাঁড়ে অগনিত জোনাকি পোকা। সন্ধ্যা তারার মতো লাগছে।

আকাশ ঝলমলে পরিস্কার। কোন চাঁদ নেই অথচ মনে হচ্ছে চাঁদের আলোর মতোন আলো। আমি আর অনুসূর্য চোখ বন্ধ করে হাঁটছি।কতগুলো জোনাকি শরীরে এসে বসলো। জোনাকি গুলো সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না আমার।জোনাকি পোকা জ্বলছে আর নিভছে,টিপটিপ করে। ওদের কে ঠিক গহনার মতোই লাগছে, এদের জ্বলা নেভার মধ্যে এক ধরনের ছন্দ আছে।

অনুসুর্য আমাকে ডাকলো।বলল,
____দেবযানি আজকে দিলু রোডে না গেলে হয় না!

আমি বললাম, অনুসুর্য আমি আর তুমি একদিন গ্রামের অন্ধকার পথে হাঁটবো। অসংখ্য জোনাকি পোকা আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমার শরীরে বসবে মনে হবে আমি জোনাকির গয়না জড়িয়েছি।

অনুসুর্য বলল,
—-কি আশ্চর্য তোকে তো একদম পরীর মতোই লাগবে,জোনাকি পরী তাইনা।
আমি বললাম,লুছমিকে একদিন সঙ্গে করে নিব সে গ্রামের পথে,মেঠো পথ,অথচ কোন ধুলো নেই।
অনুসূর্য আশ্চর্য হয়ে বলল,
—লুছমি কে? তাকে কেন আমাদের সঙ্গে নিতে হবে?

আমি বললাম, লুছমি আমার কাজিন,সে এখন অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করবে।

ক্রমশ ০০০

৫/১১/২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here