নীল ধ্রুব তারা
পর্ব চার
শাহানা জেসমিন
——————————
আজ আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ উঠেছে। চাঁদটা একদম চিকন, ধারালো। ঝরঝরে আকাশ,আর আকাশ ভড়া নক্ষত্র পুঞ্জ মনে হয় পাহারা দিচ্ছে আকাশ কে। মেঘ শূন্য আকাশ কি মায়াময়!
আমি আর ফুপ্পি ঝুল বারান্দায় বসে আছি। এ বারান্দা টা আমার খুব প্রিয়। এখান থেকে অনেক দূর দেখা যায়,এতো ভীর নিয়ে, কোলাহল ও নেই।
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছি,ম্যাম আর অরুন্ধতী র কথা। চোখের সামনে থেকে ম্যাম কে কোন ভাবেই সরাতে পাচ্ছি না। একটা ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছি ম্যাম কোন ভাবেই রাজি হচ্ছেন না। যেভাবেই হোক আমি এ ইন্টারভিউ টা করবো। একজন সফল মানুষ, লেখক, তাঁকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন করবো আমি।
অনুসুর্য র কথাও এ মুহুর্তে খুব মনে হচ্ছে। অনুসুর্য ও লেখালিখি করে, ওর অনু কবিতা গুলো খুব সুন্দর। চমৎকার করে কবিতা লিখে। তার একটা অনু কবিতা আমার খুব মনে হচ্ছে।
“যদি পারিস ছিড়ে ফেলিস, আমার যত স্মৃতি
তবু ও বলছি,
কস্ট গুলো ভুলতে চাইলে, আমায় লিখিস চিঠি
আমি আকাশ তোর, মেঘের আচলে লিখিস।”
যদি মন কাঁদে বৃষ্টি কে বুকে জড়িয়ে আমায় ভাবিস।”
অনুসুর্য র কথা ভিষন মনে হচ্ছে। আচ্ছা অনুসুর্য কি আমাকে খুব পছন্দ করে! কিন্তু আমি তো ওকে সেভাবে পছন্দ করি না। আমার ভেতরে একটা ভয় সব সময় ভর করে থাকে। আমি কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারি না।
আমার ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে।চোখের সামনে প্রায় চৌদ্দ পনের বছর আগের ভয়ংকর এক দৃশ্য আমাকে ভর করে থাকে।
তারপরও অনুসুর্য র জন্য আমার ভেতরে হাহাকার বোধ তৈরি হয়। তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। এ হাহাকার এর নাম কি ভালবাসা? তার প্রতি আমার এতো কিসের টান? কেন,বুকের ভিতর চিনচিন করে,কেন মোচড়ায়? এর নাম কি মায়া? মায়া,আর ভাললাগা কি এক?
আমি চোখ বন্ধ করে ই দেখতে পাই ছোট্ট সবুজ একটা গ্রাম,পাশে একটা চিকন নদী। এ নদীটা খুব শান্ত, কোন ঢেউ নেই।
আমি সেই শান্ত নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি।
একটা চিকন বাঁশির সুর আমার কানে বাজে। এ বাঁশি র সুর টা আমার ভিষন পরিচিত মনে হয়।
আমি চোখ বন্ধ করলেই এ চিকন নদী টা আমার কাছে চলে আসে। আমি সেই নদীর জলে ঘন্টার পর ঘন্টা পা ডুবিয়ে বসে থাকি। একটা গান আমার কানে বাজে
“জাত গেলো জাত গেলো……
আমি চোখ বন্ধ করলেই এ নদীর অস্তিত্ব পাই, সেই সঙ্গে একজনের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আমার মায়ের অস্তিত্ব অনুভব করি। আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠে। কিন্তু আমি তার চেহারা মনে করতে পারি না। মা আমাকে একটা নরম সুরে ডাকে,
——দেবযানী, দেবযানি। দেবযানী তুমি একা নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আছ কেন? চলো চলো বাড়ি চল,
কি আশ্চর্য আমার নাম দেবযানী সেটা মা কিভাবে জানলো, এটা তো আমার ফুপ্পি র দেয়া নাম।
একটা শীতল নরম হাত আমাকে আদর করে টেনে টেনে নিয়ে যায়, বাড়ির ভেতরে….
আমি সে বাড়ির উঠোন,পুকুর পাড়,নীম তলা, কাঠাঁল তলা,সুপুরি বাগান দেখতে পাই স্পষ্ট ই। কিন্তু মায়ের চেহারা কোন ভাবেই মনে করতে পারি না।
সে বাড়ির উঠোনে পুঁথি পড়ার শব্দ আমার কানে আসে। হারান ফকিরের, কন্ঠে লালনের গান আমার কাছে ভেসে আসে।
ফুপ্পি আমার গা ঘেষেঁ বসে আছেন। আমার মাথায় চিরুনি করে দিচ্ছেন। আর বললেন,
কি সুন্দর রেশমি চুল তোমার,একদম মায়ের মতোই।
কিন্তু মার সম্পর্কে ফুপ্পি কখনো কিছু বলতে চান না।আমি প্রশ্ন করলে তিনি মন খারাপ করেন।এজন্য আমি কখনো তার সঙ্গে মাকে নিয়ে কোন কথা বলি না।
আমি চোখ বন্ধ করে ফুপ্পির আদর নিচ্ছি।
রিনা একবাটি স্যুপ দিয়ে গেলো আমার জন্য। বলল,
——-দিদি মনি স্যুপ শেষ কর, কফি দিয়ে যাই।কফির সঙ্গে কি নোনতা বিস্কুট খাবে?
আমি বললাম,
হুম রিনা, দিতে পার।
——আচ্ছা দিদি মনি।
রিনা চলে গেলো।রিনা ফুপ্পির সংসারের একটা পার্ট। অনেক বছর হলো সে এ সংসারে থাকে। আমাকে দিদি মনি ডাকে।রিনা ছাড়া এ সংসার অচল।
রিনা কফি দিয়ে গেলো।আমি কফির মগে চুমুক দিলাম। অনুসুর্যের কথা বার বার মনে হচ্ছে।
অনুসুর্য একটা মধ্য বিত্ত ঘরের ছেলে।কিন্তু অসম্ভব মেধাবী। আর সে লেখালেখি ও করে।কবিতা লিখে চমৎকার। আমি খুব পছন্দ করি। অনুসুর্যের প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করি। তাহলে এ টান কি ভালবাসা? আমি অনুসুর্যের প্রতি ক্রমশঃ দূর্বল হয়ে যাচ্ছি মনে হয়।
ফুপ্পি আমাকে বলল,
——কাল চলে যাবে, একদম ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়িটা।
——-অনেক গুলো ক্লাস মিস হলো ফুপ্পি। মনটা ভিষন খারাপ ছিল,তোমার কাছে থেকে মন ভালো করে গেলাম।
——–তুই ছিলি ভালো ছিলাম,এখন শূন্য শূন্য লাগবে।
ফুপ্পি আমাকে কখনো কোন কিছুর অভাব দেন নি।আমিই তাঁর পৃথিবী। আমি টিউশানি করি অন্য কারণে।আমার অর্থের জন্য না।
ফুপ্পি র এতো আদর তবু ও মার জন্য খা খা করে ভিতরে।
***
আমি একটা ক্যাফেতে বসে আছি। আমি মাঝে মাঝে ই এ ক্যাফেতে বসে সময় কাটাই একা। খুব সুন্দর নীল রঙের শাড়ি পড়ে বসে আছেন এক ভদ্র মহিলা। বিষন্ন মনে হচ্ছে তাকে দেখে। তার সামনে একটা বড় কেক । তিনি একাই, মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। কি আশ্চর্য কেউ আসলো না। তিনি অবাক হয়ে আমাকে দেখছেন, আমি লক্ষ্য করলাম। হঠাৎ তিনি আমার কাছে এলেন। আমাকে বললেন,
——তুমি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছো?
আমি বললাম, না তো, আমি মাঝে মাঝে ই এখানে আসি। এদের ব্লাক কফিটা চমৎকার।
তিনি বললেন, আমার মেয়েটা অবিকল তোমার মত।
—— সে আসেনি? আপনি একা।
——- না, সে বেঁচে নেই। নীল ছিল তার নাম। আজ নীলের বার্থ ডে। আস তুমি কেক কাটবে।
আমি তার কথা উপেক্ষা করতে পারলাম না। কেক কাটলাম। আমি লক্ষ্য করলাম, তার একটা আঙুল বেন্ডেজ করা। অবিকল ম্যামএর মতো।
তিনি তার ভিজিটিং কার্ড দিলেন। বললেন,
তুমি এসো, অনেক গল্প আছে, তোমার সঙ্গে।
তিনি চলে গেলেন, আমি তার চলে যাওয়া দেখলাম। একটা সাদা গাড়ি এসে থামলো ক্যাফের সামনে। তিনি দ্রুত চলে গেলেন।
আমি অনেক ক্ষন বসে থাকলাম। বিকেল গড়িয়ে গেলো। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম , আমার বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক বড় ভাই আসলো, সে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। আমাকে দেখে বলল,
—— আমি জানতাম তুমি এখানে। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে দেবযানী। আমি তোমাকে পছন্দ করি।
———— কি আশ্চর্য হিমু ভাইয়া, আমি তো আপনাকে পছন্দ করি না।
কেন পছন্দ করবে না, আমার যোগ্যতা কি কম, আমার রেজাল্ট ভালো সব ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আমি দেখতে সুদর্শন। আমার বাবা প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। তাকে সবাই এক নামে চেনে। আমি সেরা সাবজেক্ট এ পড়ছি।
———— কিন্তু আমি তো একজন কে পছন্দ করি। জোর করে কি সব হয় হিমু ভাইয়া।
———- আমি এতো কিছু বুঝি না। তোমাকে আমার চাই।
আমি বললাম,
——- কিন্তু আমি তো জানি আপনার পছন্দের মানুষ আছে। মুমু আপু, তার কি হবে।
——– আমি মুমুকে পছন্দ করি না। সে আমাকে লাইক করতো আর কিছু না।
আমি বললাম, হিমু ভাইয়া আমি অনুসুর্য কে পছন্দ করি সেও আমাকে পছন্দ করে।
সে বলল, আমি বাবাকে তোমার বাড়ি পাঠাবো। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না দেবযানী। বিশ্বাস করো দেবযানী।
আমি বিরবির করে বললাম,
হিমু ভাইয়া আপনি কি জানেন আমার জীবনের একটা বড় ক্ষত আছে। আমি একজন কে খুঁজছি।
হিমু চলে যাচ্ছে, বলল,
চলো দেবযানী হলে চলো, রাত হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে পৌঁছে দিব।
আমি বললাম, আমি আরও কিছুক্ষন থাকবো হিমু। এখানে থাকতে ভাল লাগছে আমার, আমি আর এক মগ ব্লাক কফি খাব। আপনি কি ব্লাক কফি পছন্দ করেন? হিমু আমার পাশে বসে থাকলো বিষন্ন হয়ে।
আমি সেই ভদ্র মহিলা র কথা ভাবছি যার একমাত্র মেয়ে নীল। আমার সঙ্গে হুবহু মিল সে বলেছে। আর তার আঙুল প্যাচানো বেন্ডেজে। তার সঙ্গে আমার দেখা করতে হবে। আমি তার ভিজিটিং কার্ড দেখলাম। তিনি নামকরা একজন ডাক্তার।
হিমু আমার পাশে বসে থাকলো উদাস হয়ে। আমি ভাবছি অনুসুর্য কে নিয়ে। আচ্ছা আমি কি বলব হিমুকে অনুসূর্যের গল্প!
.ক্রমশ……….
৬/১১/২২