নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব ৪

ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা এক হাজার টাকার চকচকে নোটখানা হাতে নিয়ে ভাবনার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। আবিরের কাছে নিজের প্রয়োজন মেটাতে তেমন কখনো হাত পাততে হয়নি তাকে। এতদিন নিজে ইনকাম করতো নিজেই খরচ করতো। এখনও খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কিছু চায়না আবিরের কাছে। আবির নিজে থেকে কখনোই ভাবনাকে হাত খরচ বাবদ টাকা পয়সা দেয়না। ভাবনা খুব আশা করে হয়তো আবির তার কথা ভাববে। কিন্তু আবির তেমন করে কখনোই ভাবেনা। সে ভাবে ভাবনা তো খাওয়া পরা সবই পাচ্ছে। আবার এক্সট্রা খরচ কিসের জন্য দিতে হবে? শুরুর দিকে ভাবনার খুব লজ্জা লাগতো আবিরের কাছে কিছু চাইতে। কিন্তু এখন আর লজ্জা লাগেনা। খুব কষ্ট হয়, অপমানজনক লাগে।
সবচাইতে বেশি অপমানিত হয় তখন যখন আবিরকে তার কাছ থেকে নেয়া টাকার হিসেব দিতে হয় বা কোথায় খরচ করবে সেই কৈফিয়ত দিতে হয়।
ভাবনা হাজার টাকার নোটটা আবিরের ড্রয়ারে রেখে দিলো। খুব অপমানকর লাগছে ব্যাপারটা। গতকাল এত করে বলার পরেও আবির এক হাজার টাকাই দিলো। তাও যে খুব ভালো মনে দেয়নি সেটা ভাবনা বুঝতে পারছে। না হলে এভাবে তাকে না বলে টেবিলের উপর রেখে যাবে কেনো? তাকে বুঝিয়ে বললেই হতো !

জারার বয়স এখন তিন বছর। একবছর তো ঘরে বসেই কাটালো ভাবনা। আবিরকে মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে তার। এতদিন ভাবতো হয়তো আবিরের আয় কম তাই ব্যয় করবে কোথা দিয়ে ? কিন্তু আবির এখন মোটামুটি ভালো বেতনেই চাকরি করছে। আসল সমস্যা আবিরের মানসিকতায়। সবচেয়ে বড় ভুল করেছে সে তার নিজের চাকরিটা ছেড়ে । অনেক হয়েছে । এবার প্রয়োজনে সে তার মায়ের কাছে যেয়েই থাকবে তাও চাকরি করবে। এমন করে সে সারাজীবন কোনোমতেই কাটাতে পারবেনা। সে সেকেলে মেয়েদের মত না! ছোটবেলা থেকেই ভাবনার আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি।

আবির এবং তার মা ভাই সবাই চায় ভাবনা যেনো তাদের বশ্যতা স্বীকার করে সারাজীবন পার করে। এজন্যই তারা চায়না ভাবনা কোনো কিছু করুক। ভাবনার স্বাধীনতা থাকুক! ভাবনা তখন সরল মনে তার জব ছেড়ে আসলেও এখন এই এক বছরে সে অনেক কিছু বুঝেছে, অনেক কিছু শিখেছে। টুকুটাকি বিষয় নিয়েও আবির মাঝেমাঝে এমন সিনক্রিয়েট করে যেন ভাবনা কিছুই বোঝেনা। সেই সবকিছু জানে বোঝে। ভাবনাকে প্রতিনিয়তই সবকিছুতেই অবমূল্যায়ন করছে আবির। ভাবনা মাঝেমাঝে যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে “ কে আমি” ? আমি কি সেই ভাবনা যাকে আবির একসময় পাগলের মত ভালোবাসত! আবির যাকে সম্মান করতো! ভাবনার চাওয়া পাওয়াকে মূল্যায়ন করতো! সেই ভাবনা কি হারিয়ে গেছে নাকি সেই আবিরই হারিয়ে গেছে? “

এই এক বছরে ধীরে ধীরে সে নিজের অবস্থানকে চিনতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে। নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এভাবে ছোট হওয়ার কোনো মানে নেই। তাকে তার স্বরূপে ফিরতেই হবে। কারো বশ্যতা স্বীকার মানে এইনা প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে নিজের অস্তিত্বকেই বিলীন করে দেওয়া।
মনে মনে দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হলো যে করেই হোক চাকরি করতেই হবে তাকে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে ভালো কোনো চাকরী সামনে হয়তো আর নাও পেতে পারে। তাছাড়া বয়সও একটা ফ্যাক্ট। তবে এ বিষয়ে সে আবিরকে কিছুই জানাবেনা এখনই সিদ্ধান্ত নিলো সে। আবিরকে জানালে সে যে পিছু টানবে এটা বুঝতে তার বিন্দুমাত্র আর ভুল হলোনা।

ভুল মানুষ মাত্রই করে। তবে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়াটাই হল মূল শিক্ষা । অবশ্য এটা তার জন্য দরকার ছিলো। আবিরকে চিনতে হলে এর কোনো বিকল্পও ছিলনা। একবার ভুল করেছে আর সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সে সামনে এগুতে চায়।
মোবাইল হাতে নিয়ে হন্য হয়ে সে বিভিন্ন সাইটে জব খোঁজা শুরু করলো তখনই ।পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবাইকে নক করছে। বিকেলের দিকে কয়েক জায়গা সিভিও সেন্ড করলো সে।

রাতে আবির ঘরে ফিরে দেখে ভাবনার মুখ থমথমে । সকালের ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সে। ওয়ালেট রাখার জন্য ড্রয়ার খুলতেই সকালে রেখে যাওয়া এক হাজার টাকার নোটখানি চোখে পড়ল তার। বুঝতে পারলো ভাবনা টাকাটা নিবেনা। তিন হাজারের জায়গা এক হাজার টাকা দেয়াতে ভাবনা হয়তো রাগ করেছে। খাবার টেবিলেও তেমন কথা হলোনা তাদের। খাওয়া দাওয়া শেষে লাইট অফ করে ভাবনা মেয়েকে দুজনের মাঝখানে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আবির বলে উঠলো,

– এত রাগ দেখাচ্ছো কেনো?

– ভাবনা নিশ্চুপ!
– কি ব্যাপার কথা বলছোনা যে! আসার পর থেকেই একটা কথাও নেই। সারাদিন কাজ করে ঘরে এসে এসব কার ভালো লাগে? কি হয়েছে তোমার? ব্যাপার কি!

– কিছুনা , রাগ দেখাচ্ছিনা। এমনিতেই, ভালো লাগছেনা।

– এমনি তবে জারাকে মাঝখানে দিলে যে!

– বললাম তো ভালো লাগছেনা, তাই!

– টাকাটা নিলেনা কেনো?

ভাবনা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,

– আমি তোমার কাছে তিন হাজার চেয়েছিলাম। এক হাজারে কিছু হবেনা তাই নেইনি।

– বাজেটটা একটু কমিয়ে করলেই তো পারো। আমার ইনকাম কেমন সেটা তো তোমার অজানা নয়।

– কখনো কোনোকিছু কিনে দিয়ে দেখেছো জিনিসপ্ত্রের দাম এখন কেমন! জানা থাকলে এটা বলতেনা। আমি তোমার কাছে কখনো নিজের জন্য কিছু চাইনা আবির। গতমাসে এক হাজার টাকা নিয়েছি মেয়ের জন্য শীতের কাপড়চোপড় কিনতে। এ মাসে চেয়েছিলাম নিজের জন্য টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্য। বছর পেরিয়ে গেছে নিজের জন্য কিছু কেনা হয়নি। একটা অনুষ্ঠান সামনে তাই ভাবলাম জরুরী কিছু একদম না কিনলেই নয়। আর তুমি ভালো করেই জানো সেখানে আমার আত্মীয় স্বজন সবাই থাকবে। তাই চাইলেই যেমন তেমন বেশে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তাতে বরং তুমিই ছোট হবে। আর ফুটপাতের শপিং যে আমাকে দ্বারা সম্ভব না সেটাও জানা আছে নিশ্চয়ই।
– আবির খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে সকালে টাকা রেখে যাবো । এবার তো রাগটাকে ছাড়ো। এদিকে আসো। বাবুকে সাইডে দাও।

– আমার টাকার প্রয়োজন নেই এখন । যখন লাগবে তখন চেয়ে নিব।

– কেনো? মাত্রই তো বললে জরুরী কেনাকাটা আছে।

– আমি অনুষ্ঠানে যাচ্ছিনা।

– কেনো?

– অনুষ্ঠানের ডেট চেঞ্জ করেছে। পরে যদি যাই তখন লাগলে নিবো। আপাতত লাগবেনা।

ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথা বলল সে আবিরের কাছে। এত কৈফিয়ত দেবার পরে আবির টাকা দিতে চেয়েছে। তাই নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সে টাকা নিতে মন চাইলো না আর তার। তার কাছে টাকা থাকার পরেও গতকাল এত করে বলার পরেও সকালে সে পুরো টাকাটা দিতে পারেনি । অথচ আজ ভাবনা যখন তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করলো তখন ঠিকই টাকা বের করতে রাজী হলো। ভাবনার কাছে নিজেকে অনেক বড় কেউ জাহির করাটাই যেন এখানে তার মুখ্য উদ্দেশ্য। চাইলেই যে আবির তাকে টাকা দিতে বাধ্য নয় সেটা সে বুঝিয়ে দিলো খুব ভালো করেই। ভাবনার আর ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইলোনা। স্ত্রীর কথাকে অবমূল্যায়ন করে নিজেকে অনেক বড় কেউ প্রকাশ করে আবির যে নিজেকে বরং ভাবনার কাছে ছোটই করলো এটা সে বুঝতেই পারলোনা।

রীতিমতো নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করে যাচ্ছে ভাবনা। আবিরের কাছে যাতে কোনোমতেই হাতে পাততে না হয় তাকে। খুব সামান্য প্রয়োজনেও না। হাসিখুশি মুখেই কষ্ট আর অভিমানকে চাপা দিয়ে আবিরের কাছে নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করলোনা সে।

এরপরে আরো কয়েক মাস কেটে গেলো। কখনো পাশের বাসার ভাবির কাছে, কখনো মায়ের বাসাতে রেখে রেখে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক জায়গা ইন্টারভিউ দিয়ে এল ভাবনা। যেখানেই তার উপযুক্ত কোনো জবের বিজ্ঞাপন দেখছে সেখানেই সে সিভি মেইল করছে। এ পর্যন্ত না হয় পনেরো বিশটার উপরে ইন্টারভিউ দিয়েছে সে। কিন্তু কোথাও থেকেই সে সাড়া পাচ্ছেনা। মনোবল হারতে শুরু করছে ধীরে ধীরে সে। কিছুই ভাল লাগছেনা তার। আবিরের সামনে অবশ্য সে বুঝতে দিতে চাচ্ছেনা তার এই মানসিক অস্থিরতা।
এভাবে প্রায় আরো তিন মাস কেটে গেল। জারাও বেশ বড় হয়েছে। ভাবনার আত্মবিশ্বাস যখন শূন্যের কোটায় যেয়ে পৌছাতে শুরু করেছে ঠিক তেমনি একটা সময় সে একটা মেইল পেল । বেশ কয়েক মাস আগে এসিস্ট্যান্ট একাউন্ট্যান্ট হিসেবে একটা নামকরা ব্রোকার হাউজ সিকিউরিটিজ এন্ড সার্ভিস কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। সেখানে সে সিলেক্ট হয়েছে । অফিস গুলশান দুই নাম্বারে। আগামী মাসেই তাকে জয়েন করার জন্য সকল ধরণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার অনুরোধ করেছে।
বেতনও বেশ ভালো। তার আগের জবের চেয়ে বেতন বেশিই। ভাবনার খুশিতে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে। সে ভেবেছিল আর বুঝি কোনোদিন চাকরি করা হবেনা তার। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে সে। জারা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তার মা এমন করে তার মত করে কাঁদছে কেনো। সে দুহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দিচ্ছে আর কপালে গালে চুমু খাচ্ছে।

ভাবনা ফোনটা হাতে নিয়েই আবিরকে কল করতে যেয়েও কেটে দিল। নাহ, প্রথমে তার মাকে জানাতে হবে। তার মাই তাকে সারাসময় সাহস দিয়েছে যে সে পারবেই। সত্যিই সে পেরেছে । ভাবনার মা মেয়ের চাকরি হয়েছে শুনে খুশিতে যেন আত্মহারা। সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে নানান কথা ভাবে সে। বড় দুই মেয়েকে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। বেশ ভাল জায়গায় বিয়ে দিয়েছে ওদের । তাই ওই দুজনকে নিয়ে তার তেমন চিন্তা নেই। যত চিন্তা ভাবনাকে নিয়ে। নিজেই নিজের পায়ে কুঠার মেরেছে মেয়েটা। তার বড় জামাই কত বড় ডাক্তারের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলো ভাবনার। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আর পারল কই। আসল কথা হচ্ছে যার ভাগ্যে যা আছে সেটা কি করে ঠেকানো যাবে।
যাক, অবশেষে মেয়েটার একটা গতি হলো। এখন ভালোয় ভালোয় চাকরিটা করতে পারলেই হয়। আবির কোনো ধরণের ত্যাড়ামি না করলেই আপাতত চিন্তামুক্ত সে।

রাতে আবির বাসায় ফিরে দেখল আজ ভাবনা বেশ হাসিখুশি। দেখে তার নিজেরও ভাল লাগলো।

– কি ব্যাপার! ম্যাডামের যে আজ মুড খুব ভাল।

– হুম, একটা খুশির সংবাদ আছে।

– তাই নাকি! কি আবার বাবা হচ্ছি নাকি!

– আরে নাহ! জারা এখনো ছোট! আরেকটু বড় হোক তারপর না হয় ওসব নিয়ে ভাববো।

– তবে?

– আমার একটা জব হয়েছে।

– কি বলছো?

– খুশি হওনি?

– খুশি অখুশির কথা পরে বলছি। আগে বল তুমি জবের চেষ্টা করছ আমাকে বলনি তো!

– বলিনি কারণ যদি না হয় সে লজ্জায়! আজকেই মেইল পেলাম।

– কোথায় হল?

– গুলশান দুই নাম্বারে অফিস।

– সেটা তো বুঝলাম । আমি বলছি কিসের জব?

– সিকিউরিটি এন্ড সার্ভিস কোম্পানীতে এসিস্ট্যান্ট একাউন্ট্যান্টের।

– এসব জায়গা মেয়েদের জন্য সেফ না। এ চাকরি করা যাবেনা।

– এসব কি বলছো। ওখানে আরো মেয়েরা আছে। আমি সব জেনেবুঝেই ইন্টারভিউ দিয়েছি। তাছাড়া বেতনও বেশ ভালো।

– কার মাধ্যমে চাকরিটা পেয়েছো?

– কারো মাধ্যমে না, নিজের চেষ্টাতেই ।

– বেশ তো ইন্টারভিউ দিয়েছো অথচ আমি কিছুই জানতে পারলাম না। বেশ এডভান্স হয়েছো দেখছি। আমাকে কিছুই জানানোটা তোমার কাছে প্রয়োজনীয় না দেখছি আজকাল।

– আবির ভুল বুঝছো কেনো? আমি জানাইনি কারণ ভেবেছি জবটা না হলে খুব লজ্জা পাবো এজন্য।

– আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বেশ তো ! এখনই বা জানানোর কী দরকার ছিলো। অফিসে পৌছেই আমাকে ফোন দিতে!

– আবির রাগ করছো কেনো? আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তুমি কষ্ট পেলে রিয়ালি ভেরি সরি!

– অন্যায় করে সরি বললেই যদি সব অন্যায়ের মাফ হয়ে যেত তবে তো বেশ হতো। তা আমি এখন সংসার চালাতে পারছি তাহলে তোমার কেনো জব করতে হবে? আগে করেছো তখনের কথা আলাদা। তাছাড়া আগের জবটা ছেড়েছো জারার জন্য । এখন জারাকে কোথায় রেখে যাবে? নাকি জারা বড় হয়ে গেছে একাই থাকতে পারবে?

ভাবনা বুঝতে পারলো আবিরের এখন মেজাজ গরম ।এই মুহূর্তে আর কথা না আগানোই ভাল। সে সেখান থেকে আর কোনো কথা না বলেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।

আবির ভাবনার এমন ঔদ্ধত্য দেখে খুব অবাক হলো। ভাবনা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। আগের মত আর তার কাছে সবকিছু জিজ্ঞেস করেনা। আগে সামান্য কিছু ব্যাপার হলেও আবিরকে না বলা পর্যন্ত তার গলার কাছে আটকে থাকতো। আর এখন? এই চাকরির প্রসেসিং দু একদিনের ব্যাপার না। এটার প্রস্তুতি যে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে সে ভালভাবেই বুঝতে পারছে। ভাবনা তাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য যে ব্যাপারটা তার কাছে লুকায়নি এটা সে জানে। তাকে লুকানোর জন্যই ভাবনা এতদিন সবকিছু গোপন করেছে। ভাবনা এতকিছু তার কাছে গোপন করছে ভেবে সে অবাক হচ্ছে খুব। সে কল্পনাতেই আনেনি যে ভাবনা আবার চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আবিরও আর কোনো কথা বাড়ালোনা তখন। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খুব রাগ হলো ভাবনার উপর তার। খাবার টেবিলেও চুপচাপ দুজনেই। জারাকে একটু একটু করে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে ভাবনা। আবির ভাবনার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভেবেছো ?

– কি ব্যাপারে?

– জব কি করবেই ?

– করার জন্যই তো ইন্টারভিউ দিয়েছি।

– বাবুর কথা ভেবেছো?

– হুম।

– কার কাছে রেখে যাবে বাবুকে?

– মার বাসায় থাকবে।

– এক কথা বারবার ভালো লাগেনা। আমি আগেই বলেছি আমার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব না। আমি বুঝতে পারছিনা তুমি জব করার জিদ ধরেছো কেনো? আমি এখন কি সংসার খরচ মেইনটেইন করতে পারছিনা ? না খেয়ে থাকছো?

– তুমি পারছোনা সেটা তো বলছিনা। আমি এভাবে ঘরে বসে বসে আমার মেধাকে নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।

– জারা এখনো ছোট!

– জারা এখন বাড়তি খাবার খাচ্ছে। কোনো সমস্যা হবেনা।

– আমি কিন্তু যাচ্ছিনা তোমার বাবার বাসাতে।

– আমি তোমাকে যেতে তো বলছিনা।

– তবে কি তুমি ওখানে থাকবে?

– দেখি কি করি।

– বাবার বাসায়ই যদি পার্মানেন্ট থাকবে তাহলে বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেনো রাগের সাথে বলল আবির। এজন্যই মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা দিতে নেই। মা ঠিকই বলে। চাকরি ,চাকরি! তোমার চেয়ে বহু যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়ে ঘরে পড়ে আছে। যোগ্যতা থাকলেই ঘর ,সংসার, সন্তান সব ফেলে চাকরি করতে হবে? এটা কোথাকার নিয়ম?

– তুমি বদলে গেছো আবির! খুব বেশিই বদলেছো।

– আমি বদলেছি কিনা জানিনা তবে তুমি খুব বদলেছো এটা খুব টের পাচ্ছি। আমাকে না বলে বলে জব ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছো । মাই গড! এত সাহস আজকাল তোমার। তোমার মধ্যে টাকার নেশা খুব চেপেছে। জানতো এই নেশা খুব বেশি ভালোনা। বিপদে পড়ে যাবে । বিয়ের সময় তো দেখেশুনেই এই স্বল্প আয়ের মানুষটিকে বিয়ে করেছিলে। তখন নিশ্চয়ই বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। নাকি আজকাল সেই সিদ্ধান্তকে ভুল মনে হচ্ছে নিজের কাছে। তবে একটা কথা বলে রাখি তুমি যেখানেই থাকো আর যেখানেই যাও আমার মেয়েকে সাথে নেবার কথা একদমই ভাববেনা। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারবনা এটা সাফ কথা।

খাবার শেষ না করেই রাগে গজগজ করতে করতে হাত ধুয়ে সেখান থেকে চলে গেলো আবির। ভাবনা আবিরের চলে যাবার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। পুরো কথা আবির ভালো করে না শুনেই এভাবে ওকে যা মুখে আসলো তাই বলে গেলো। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার। কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছেনা সে। কিন্তু কিছুতেই সে কাঁদবে না। চোখের পানি মানুষকে দুর্বল করে ফেলে। এখন তাকে যে করেই হোক সাহস রাখতে হবে। মনের জোর হারিয়ে ফেললে আর সামনে এগুনো সম্ভব হবেনা তার। এভাবেই আবিরের পা ধরে বাকি জীবন পার করতে হবে তার। সামনের দিনগুলি হয়তো আরো ভয়াবহ হবে তার জীবনের। যে জীবনের কথা সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি এমন জীবনে সে গুমরে গুমরে কাটাতে চায়না। আবিরের আরো বদলে যাওয়া রূপ সে সহ্য করতে পারবেনা কিছুতেই। আবির তো এমন ছিলনা! কতটা বদলে যাচ্ছে দিনদিন সে! একসময় সবার কাছে সে গর্ব করে বলতো “ আবির আমার সব কথা বোঝে। আমি না বলতেই আমার মনের কথা বুঝে ফেলে সে! কখনো আমার পছন্দ ,অপছন্দ, স্বাধীনতায় বাঁধা দেয়না ।“
কথাগুলি মনে পড়ে নিজের প্রতি হাসি পেলো তার। মানুষের রূপ কখন বদলায় কে জানে? আবিরকে চিনতে তার তবে ভুলই হয়েছে। তবে কি পুরোটাই অভিনয় ছিলো!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here