#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৪)

” বাসার মেহমানকে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছেন? ”

মাহদীর অকস্মাৎ প্রশ্নে এরশাদ রহমান থমকালেন। ঘাড় বাঁকিয়ে একবারটি চাইলেনও কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। নীরব চালে বাসার গেইটের সম্মুখে এসে ভ্রু কুঁচকালেন। পাশে না তাকিয়ে বুঝতে পারলেন মাহদী তার পাশাপাশি হাঁটছে। গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুহূর্তকাল পর ভেতরে ঢোকার জন্য পা ফেললে মাহদী বলল,
” নায়রা সবসময় বলতো তার বাবা কারও উপর রাগ করলেও কথা বলা বন্ধ করেন না৷ অথচ আপনি আমার সাথে ছয় বছর ধরে কথা বলছেন না। তাহলে কি নায়রার ধারণা মিথ্যা? ”

এরশাদ রহমান আবারও থামলেন। এবার ফিরে তাকালেন মাহদীর দিকে। মাহদী একপা ভেতরে এগিয়ে বলল,
” আমি হয়তো আপনার মতো করে নায়রাকে ভালোবাসতে পারিনি। কিন্তু আমার মতো বেসেছি। হৃদয় উজার করে! তার বিশ্বাস ছিল, আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইলে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিবেন না। ”

মাহদী হাঁটতে হাঁটতে এরশাদ রহমানের নিকট এসে দাঁড়াল। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে বিনয়ী গলায় বলল,
” আমি চাই না নায়রার বিশ্বাস মিথ্যা হোক। আপনার সম্পর্কে তার ধারণা ভুল হোক। বাবা, আমি এখানে ক্ষমা চাইতে আসিনি। সম্পর্কটা দৃঢ় করতে এসেছি। ”

এরশাদ রহমানের তাকানো ভঙ্গি বদলাল না। মুখের ভাব পাল্টাল না। পূর্বের মতোই মাহদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাহদীকে পেছনে ফেলে উঠোন পেরোলেন। দরজার নিকট পৌঁছাতে একটা বাচ্চা তার কোমর জড়িয়ে ধরল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
” নানাজান! ”

নরম তুলতুলে স্পর্শে এরশাদ রহমানের গম্ভীর ভাব ছুটে গেল। মনের নিষ্পাপ, নির্মল, পবিত্র মুখখানা দেখেই চোখ দুটো আনন্দে প্রজ্জ্বলিত হলো। নিমিষেই দূর হয়ে গেল তনু-মনের সকল ক্লান্তি। মনকে কোলে তুলে নিয়ে সুধালেন,
” আমার নানাভাই কেমন আছে? ”

মন নানার গলা জড়িয়ে বলল,
” খুব ভালো। ”

কথাটা বলেই একগাল হাসল মন। চোখে-মুখে তার দারুন উচ্ছ্বাস। যেন দীর্ঘ দিন পর পাখি তার নীড়ে ফিরেছে! এরশাদ রহমানের ঠোঁটের হাসি স্পষ্ট হলো। মুগ্ধ চোখে দেখছেন নাতিকে। এই নবীন চোখ, নাক, ঠোঁটে গড়া বদনখানির আড়ালে কার ছায়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন? অস্থির চিত্তে কার মুখটা বার বার ভেসে উঠছে? কার জন্য চোখ দুটোতে জল চিকচিক করছে?

” নানাজান, আমাকে দেখে তুমি খুশি হওনি? ”

এরশাদ রহমানের গলা ধরে এসেছে প্রায়। বার কয়েক ঢোক গিলে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
” খুশি হব না কেন? খুব খুশি। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে চাঁদটা টুপ করে আমার হাতে পড়েছে। ”
” তাহলে তোমার চোখে পানি কেন? ”

এরশাদ রহমান চোখের পানি লুকাতে চাইলেন। হিতে বিপরীত হলো। চোখের কোল দুটো বর্ষার নদীর মতো থৈ থৈ করে উঠল। নদীর পানি কিনার ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই কণ্ঠ ছাড়লেন,
” নিহিতা? মা নিহিতা? ”

নিহিতা সকালের নাস্তা বানাচ্ছিল। বাবার গলা পেয়ে রুটি ফেলে ছুটে এলো। আশে-পাশে খেয়াল না করে দরজা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” বাবা, আপনি কখন এলেন? দাঁড়ান আমি পা ধোয়ার পানি নিয়ে আসছি। ”

নিহিতা ব্যস্ত চালেই ভেতরে ফিরে গেল। মিনিটের মধ্যে পানি নিয়ে হাজির হলো। বাবার পায়ে পানি ঢালতে গিয়ে চোখ পড়ল বাবার পেছনে। সাথে সাথে লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। অবশ শরীরে বিড়বিড় করল, ‘ আমি এতক্ষণ এই মানুষটার সামনে দৌড়াদৌড়ি করছি? এই খোলামেলা পোশাকে? ‘ নিহিতা পানি রেখে ভেতরে চলে গেল। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বলল,
” বাবা, উনার সাথে কি আপনার আলাপ হয়েছে? ”

এরশাদ রহমান মেয়ের দিকে তাকালেন। পর পরই মাহদীর দিকে। তারপর পা ধোয়ায় মনোযোগ দিলেন। পানির মগ হাতে নেওয়ার জন্য ঝুঁকতে মন কোল থেকে নেমে পড়ল। পানির মগের ভেতর হাত ডুবিয়ে দিল। এক হাতে পানি ফেলছে অন্য হাতে পা ডলে দিচ্ছে। তার এই কাণ্ডে বিস্ময়ে স্তব্ধ এরশাদ রহমান। মুহূর্তে মনের জায়গায় একটা বাচ্চা মেয়েকে কল্পনা করে ফেললেন। যে হাসতে হাসতে পা ধুয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
” আমার বাবার পা আয়নার মতো ঝকঝকে। দেখ আমার মুখ দেখা যাচ্ছে! ”

এরশাদ রহমান এতক্ষণে উপলব্ধি করল, নায়রার মতো মনও তাকে তুমি তুমি করে বলে। তার পরিবারের একমাত্র নায়রায় তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করত।

” নানাজান, হয়েছে? ”

মনের কণ্ঠে এরশাদ রহমানের সম্বিৎ পড়ল। নাতির কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” হয়েছে তো। একদম আয়নার মতো চকচকে করছে। ”

মন হাসল। সেই হাসিতে গড়িয়ে পড়ল আকাশ মাপের খুশি সমুদ্র মাপের আনন্দ। এরশাদ রহমান মনের গাল ছুঁয়ে দিলেন। চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। আগের মতো কোলে তুলে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” দক্ষিণ ঘরের চাবিটা নিয়ে আয়৷ ”

নিহিতা চাবি এনে দিল। এরশাদ রহমান নাতিকে কোলে নিয়ে মাহদীর সন্নিকটে এলো। চাবিখানা তার হাতে দিয়ে বলল,
” জামা-কাপড় পাল্টে গোসল করে নেও। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

কথাটা বলেই এরশাদ রহমান বড় ঘরের মূল দরজার ভেতর হারিয়ে গেলেন।

_________________

নাস্তা শেষে একটু বাইরে বের হলো মাহদী। মন তার নানার সাথে কোথাও একটা গিয়েছে বিধায় সে একাই বেরিয়েছে। মাটি রাস্তা পার হয়ে ইটে রাস্তায় পা রাখতে একটা রিক্সা দাঁড় করাল। কী ভেবে রিক্সায় উঠে বসল। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল,
” কোনটে যাবেন, ভাই? ”
” ফুলবাড়ি সরকারি কলেজ। ”

রিক্সার ছুটে চলা রাস্তার ধারে গাছপালায় ভরা। সজনে গাছের নরম হাওয়াই মাহদীর চুল উড়ছে। হৃদয়ে মৃদু দোলা দিচ্ছে। উদাসীন চোখ জোড়া কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে,

“এক্সকিউজ মি ম্যাম। ”

মাহদীর ডাকে বোর্ডে হিসাব কষায় ব্যস্ত মাঝ বয়সী শিক্ষিকা বিরক্ত চোখে তাকালেন। মাহদী মনোযোগ পেয়ে বলল,
” নায়রাকে কিছু সময়ের জন্য ছাড়া যাবে? ”

ফিন্যান্সের শিক্ষিকা বোর্ড থেকে মার্কার সরিয়ে নিলেন। মাহদীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
” কেন? ”
” জরুরি কথা আছে। ”
” কী কথা? ”

এ পর্যায়ে মাহদীর মেজাজ নষ্ট হলো। ভদ্র চাহনি হারিয়ে গেল। বিনয়ী ভাব ছুটে গেল। অনুমতির পরোয়া না করে ক্লাসের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল পুরো ক্লাসে। নায়রাকে পেল একদম সামনে থেকে দ্বিতীয় বেঞ্চে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেয়ে ঠোঁটের কোণে খুশির টান পড়ল। নায়রার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,
” বাইরে এসো কথা আছে৷ ”

নায়রা ভয়ে পাশে সরে বসল। ভীত চাহনি আঁকল ম্যামের দিকে। মাহদী সে চাহনি উপেক্ষা করে আচমকা নায়রার হাত ধরে ফেলল। ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে আসল জোর করে। পেছনে গম্ভীর মুখের শিক্ষিকার চেঁচামেচি কানেই তুলল না।

নায়রাকে টেনে নিয়ে এসে দাঁড়াল মাঠের ঠিক মাঝে। ক্লাস চলছিল বিধায় তখন পুরো মাঠ ফাঁকা। নায়রার হাত ছেড়ে সবুজ ঘাসে বসে পড়ল মাহদী। নায়রাকে টেনে বসিয়ে বলল,
” কাল রাতে তোমার বাবাকে কল দিয়েছিলাম। ”

নায়রা ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া অবস্থা! রক্ত শূন্য চোখে তাকালে মাহদী বলল,
” তোমার বাবার ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। প্রথমে সুন্দর করে কথা বললেও পরবর্তীতে যখন তোমাকে চাইলাম সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিলেন। কাজটা কি ঠিক করেছে, নায়রা? তার দুর্ব্যবহারের কারণে আমাকে ঢাকা থেকে এখানে ছুটে আসতে হলো। ঘাম ঝরিয়ে, টাকা দিয়ে তোমার কলেজের নাম জানতে হয়েছে। ভাগ্যিস গ্রামের লোক তোমাকে চিনত! ”

মাহদী একটু থামল। নায়রার চোখ দুটোতে চেয়ে আচমকা বলল,
” তুমি কিন্তু আমার হাতে চড় খাওয়া প্রথম মেয়ে নও। তুমি কত নাম্বারে আছ নিশ্চিত বলতে পারছি না। তবে দশের পরে একটা হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই প্রথম কোনো মেয়েকে চড় দেওয়ার পর আমার দুঃখ হচ্ছে, খারাপ লাগছে। মনের ভেতর অশান্তি লাগছে। কেন বলো তো? ”

চলবে

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here